‘একটি পাখি উড়তেছিল
ডানা মেলে
হেসে খেলে
আপন মনে ক্ষণে ক্ষণে
ছুটতেছিল
হাসতেছিল
হাজার রঙে সেই পাখিটি
এঁকে যেত মন চাতালে
তাল বেতালে কত্তরকম ছবি,
তারই জন্য গাঁথতো মালা
রাত জাগা এক কবি।’
তোমরা নিশ্চয় কবিতার এই অংশটুকু পড়েই বলে উঠেছো ‘ওয়াও! কী অসাধারণ!’ হ্যাঁ, তোমাদের জন্য অসাধারণ সব কবিতা লেখা আর সেই পাখিটির জন্য রাত জেগে মালা গাঁথা কবিই তিনি, মোশাররফ হোসেন খান; আশির দশকের অন্যতম কবি। বাংলা সাহিত্যে তার ‘হৃদয় দিয়ে আগুন’, ‘নেচে ওঠা সমুদ্র’, ‘বিরল বাতাসের টানে’, ‘পাথরে পারদ জ্বলে’, ‘সবুজ পৃথিবীর কম্পন’, ‘দাহন বেলায়’, ‘স্বপেড়বর সানুদেশ’, ‘পিতার পাঠশালা’, ‘বৃষ্টি ছুঁয়েছে মনের মৃত্তিকা’, ‘ক্রীতদাসের চোখ’ উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ১৯৫৭ সালের ২৪ আগস্ট যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার অন্তর্গত কপোতাক্ষ বিধৌত বাঁকড়া গ্রামে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই তার লেখালেখিতে হাতেখড়ি। গ্রামের নৈসর্গিক পরিবেশে চোখ রেখে বেড়ে উঠতে থাকেন আর দেখতে থাকেন তার পূর্বসুরী কবি মাইকেল মধূসূদন দত্ত আর ফররুখ আহমদের স্মৃতিধন্য নদী, নদীপাড়ের মানুষ আর ঘাসের ডগায় দুলতে থাকা শিশির বিন্দুকে। অবলোকন করেন কোনো এক অপার্থিব সৌন্দর্যকে। যেখানে ভোরের বাতাসে ফুলের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়; যেখানে জোয়ার-ভাটায় নদীর কল্লোল আর ভাটিয়ালী গানের সুর-মূর্ছনা বাতাসকে মথিত করে মিশে যেতে থাকে প্রকৃতির কোলাহলে। আর তখনই হয়তো তিনি লিখে ফেলেন,
‘কপোতাক্ষর বাঁকে-
আমার মনটা পড়ে থাকে।’
কিংবা
‘আকাশ ভরা তারার মেলা বাওড়ি বাউল সুর
বাতাস ফুঁড়ে যাচ্ছে ছুটে সামনে বহুদূর।’
আচ্ছা, তোমরা যারা খুব ভোরে ফুটবল নিয়ে মাঠে খেলতে যাও অথবা যাদের খুব সকালে মক্তবে যেতে হয়- বলো তো শিশির ভেজা ঘাসের উপর পা ফেলতে তোমাদের কেমন লাগে? বড়োরা, যারা আজকাল পড়াশোনা কিংবা চাকুরীর সুবাদেও শহরে থাকছে তারাও নিশ্চয় ফেলে আসা সেই শৈশবকে খুব মিস করছে! মিস করতেই হয়, প্রকৃতির সান্নিধ্য বলে কথা!
তাছাড়া এটিই কিন্তু আমাদের চিরায়ত বাংলার দৃশ্য, যেখানে খুব ভোরে মক্তব কিংবা শুধু খেলতে যাওয়া কিশোর নয়, বরং এদেশের কৃষকরাও গরু নিয়ে লাঙল কাঁধে ফেলে মাঠে চলে যান খুব ভোরেই। আর এই চিত্রটি খুবই প্রাণবন্ত হয়ে ধরা পড়ে কবির চোখে,
‘ভোরগুলো শিরশির কেঁপে ওঠে বুক
এক ফোঁটা রোদ যেন শিশুদের মুখ।
চারদিকে মেলে আছে কুয়াশার ছাতা
টুপটাপ ঝরে পড়ে সরিষার পাতা।
ভোরগুলো শিরশির জিউলের মেয়ে
ঘাই মেরে উড়ে যায় প্যারাসুট বেয়ে।
কুয়াশা কহর ফুঁড়ে জেলেদের নাও
ছুটে যায় ঢেউ-জল-ঝিনুকের গাঁও।
ভোরগুলো হিমহিম ইলিশের চোখ
হিম বড়ো ভয় যেন শহরের লোক।’
আচ্ছা, শেষ পঙক্তিতে কবি ‘শহরের লোক’ বললেন কেন? শহরের লোক কি ভয়ের? না, তা হবেন কেন? আসলে কবি বলেছেন শহরের কথিত আধুনিক লোকদের কথা; যারা সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতির মহোৎসবে নিজেদের একীভূত করে ফেলেছেন। যারা সুন্দর এই দেশটিতে হতাশার বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেটা শহর কিংবা গ্রামের যেখানেই হোক, লোকগুলো তো ভয়েরই! তবে এই ভেবে তোমাদের হতাশ হয়ে কাজ নেই। পৃথিবীর সব দেশেই এরকম কিছু লোক আছে, যারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যায় করে যাচ্ছে প্রতিদিন। তবে শুধু এজন্যই আমাদের হতাশ হলে চলবে কেন? কারণ, এর ঠিক বিপরীতেও তো রয়েছে অনেক-অগণন মানুষ; যারা সত্য ও সুন্দরের মশাল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আর তাদের সাথে আছো তোমরাও! তোমাদের হাসি হাসি মুখগুলো কল্পনা করে কবি লিখেছেন
‘আয়নাতে রঙধনু জ্বলজ্বলে চোখ
পৃথিবী জেনেছে ওরা নবীন আলোক।
পাথরে পারদ জ্বলে জলে ভাঙে ঢেউ
ভাঙতে ভাঙতে জানি গড়ে যাবে কেউ।’
কী চমৎকার চিত্রকল্প! দ্যাখো, ব্যাপার অনেকটা নদীর মতো; নদীর এক পাড় ভাঙে আর পাড় গড়ে, তাই না? বিখ্যাত গানই তো আছে- ‘নদীর এপাড় ভাঙে ওপাড়
গড়ে, এই তো নদীর খেলা…।’ সমাজের যেসব তরুণেরা খারাপ লোকদের সাথে মিশে অন্ধকারের হাবুডুবু খাচ্ছে তাদের দেখে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। ঠিক এখানেই তীর্যক আলোকপাত করেছেন কবি। একান্ত নিজস্ব, ব্যতিক্রম ও প্রত্যয়দীপ্ত ভাষায় কবি উচ্চারণ করেছেন, ‘ভাঙতে ভাঙতে জানি গড়ে যাবে কেউ।’
তোমরা অনেকেই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ বিবরের কথা জানো। সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো আপন আপন কক্ষপথে সর্বদা আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু এই আবর্তনের পথে কোনো কোনো দুর্ভাগা নক্ষত্রকে পড়তে হয় এই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ বিবরের মুখে। আর ব্ল্যাকহোলের মুখে পড়া দুর্ভাগা নক্ষত্রটি চিরতরে হারিয়ে যায় সৌরজগত থেকে! কী ভয়ঙ্কর, তাই না! আমাদের সমাজের খারাপ চরিত্রের মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে যদি এই ব্ল্যাকহোলের সাথে তুলনা করি তাহলে কি খুব অত্যুক্তি হবে? মোটেও না। তবে আশাবাদী হতে হবে আমাদের এবং এদের থেকে খুব সাবধানে বেঁচে থাকতে হবে। কবিকেও খুব আশাবাদী কণ্ঠেই বলে উঠতে দেখি,
‘ওই জেগেছে স্বপড়ববুকে নতুন আশার চর
কে কে যাবি আয় ছুটে আয় গড়তে সবুজ ঘর।’
চলো, কবির এই আহবানে সাড়া দিয়ে আমরাও নেমে পড়ি নতুন আশার চরে। শুধু আহবানে নয়, নিজেদের মানবিক তাড়নায়ও মুমূর্ষু মানবতার বস্তিতে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যেতে হবে এ সময়ের তরুণ-কিশোরদের। চতুর্দিকে যখন ক্ষুধা-দারিদ্র, নারী-শিশুদের আহাজারি কিংবা গৃহহীন মানুষের অশ্রুপাত চোখে পড়ে; ঠিক তখনই শহুরে সভ্যতায় ম্রিয়মাণ মানুষেরা রাজধানী ঢাকায় গাড়ি হাঁকিয়ে চল যাচ্ছে। নিরন্ন লোকদের দিকে তাকাবারও যেন সময় নেই তাদের! তারপর নাগরিক জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যা মূল্য তাও তো মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে! সারাবছর ধরে রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি আর যানজট তো থাকছেই। দুঃখের যেন শেষ নেই! দুঃখীদের অশ্রুর ধারা আর তাদের দুঃখের রজনী কেবলই দীর্ঘতর হতে থাকে। তাইতো কবিকেও লিখতে হয়-
‘এই যে শহর ঢাকা শহর
উদোম দেহখানি
বিনা মেঘে পিচের পথে
হাঁটু ভেজা পানি।
পানি তো নয় এ যে দেখি
ঢল নেমেছে ঢল
এই শহরে সবই চড়া
সস্তা চোখের জল।’
এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। সেজন্য সৎ, দক্ষ ও মেধাবী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে নিজেদেরকে। কিশোর-তরুণদের অভিধানে না বলতে কিছুই থাকবে না। তোমরা কাল প্রসন্ন ঘোষের কবিতায় পড়েছো-
‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার।’
হ্যাঁ, কেন পারবো না সেটা ভেবে বের করাই গুরুত্বপূর্ণ। যে কাজটা অন্যেরা খুব সহজেই পারছে, তুমি হয়তো সেটা তেমন সহজে পারছো না; কিন্তু তোমাকে দিয়ে যে হবেই না ব্যাপারটি এমন তো নয়, তাই না? জীবনে অনেক দুর্লঙ্ঘ্য বাধাই কেবল আত্মবিশ্বাসের জোরে পার হওয়া যায়। তাছাড়া তোমার ভেতর এমন চেতনাও তো কাজ করতে হবে যে, সবাই পারছে আমি কেন পারবো না।
কবি মোশাররফ হোসেন খান লিখেছেন-
‘মনু তো মনের জোরে
হারালো অভীরে
দেহে নয় শক্তি থাকে মনের গভীরে।
হারু হেরেছে বলে তুমি
কেন হারবে?
পারু পেরেছে জানি-
তুমিও পারবে।’
হ্যাঁ, তুমিও পারবে। তুমি পারবে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফলটি অর্জন করার পাশাপাশি নিজেকে আগামীর সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের একজন স্বপ্নবাজ কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে। তবেই দূর হবে আমাদের জাতীয় জীবনের তাবৎ সমস্যা।
হেসে উঠবে ঝলমলে সূর্যের দিন। তোমাদের জন্য এই স্বপ্নের কথা, সম্ভাবনার কথা নীরবে লিখে যাওয়া মানুষটির নামই কবি মোশাররফ হোসেন খান।
তোমাদের হাসি-হাসি মুখ, জ্বলজ্বলে চোখ আর স্বপ্নময় আগামীর কথা ভেবে মনের অজান্তেই কলম তুলে নেন হাতে। কারণ তোমাদের চোখেই তিনি দেখতে পান আগামীর বাংলাদেশকে। দেখতে পান, তোমরাই একেকজন শহীদ তিতু আর টিপুর সুযোগ্য উত্তরসূরী; সাহসী মানুষ। তোমরাই হয়ে উঠছো একেকজন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী।
আসছে ২৪ আগস্ট কবি মোশাররফ হোসেন খানের ৬২তম জন্মদিন। এসো আমরা তার জন্য প্রাণভরে দোয়া করি, আর তার মতো করে বলে উঠি-
‘এ দেশ আমার ব্যাকুল হৃদয় আকুল করা গান
দেশের জন্য ভালোবাসা বান ডেকেছে বান।’

Share.

মন্তব্য করুন