বাঁকা চাঁদের হাসি নিয়ে বছরে দুই বার ঈদ আসে। ঈদ শব্দের অর্থ খুশী, এ কথা কারো অজানা নয়। কিন্তু সবার মনে কি প্রতিটি ঈদে খুশীর বান ডাকে? আমাদের দেশে আছে ধনী-দরিদ্রের চরম ব্যবধান। এই ব্যবধানের বাইরে নয় শিশু-কিশোররাও। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র আছে সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোররা। শহরগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এখানে আছে অসংখ্য শিশু-কিশোর যাদের কোন অভিভাবক নেই, থাকার ঘর নেই। পথের পাশে, রেল, বাস স্টেশন, পার্কে এদের জীবন কাটে। তাদের জীবনেও ঈদ আসে, কিন্তু সুখ আনন্দ হাসি খুশীর বান কি আসে? ঈদের খুশীর মহিমা বুঝে বিত্তবানরা বঞ্চিতদের সাথে নিয়ে উৎসব আয়োজন করলে মুসলিম জাহানের কারো মনে কষ্ট থাকার কথা নয়। ঈদের আনন্দ ভোগে নয় ত্যাগে এই দর্শন ভুলে গিয়ে মুসলমানরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কারণেই এতিম, বাস্তুহারা ছিন্নমূল পথ-শিশুদের মুখে ঈদের দিনেও হাসি দেখা যায় না।
একজন শিশুর নাম রাসেল। বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ওকে দেখার কেউ নেই। বাবা ব্যস্ত নতুন বউ আর সেই ঘরের সন্তান নিয়ে। মায়ের ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। তার দ্বিতীয় বিয়ে না করে উপায় ছিলো না, কিন্তু তাতেও সুখের দেখা মিলেনি। রাসেলের মায়ের নতুন স্বামীর অভাবের সংসারে তাকে মনে করা হতো বোঝা।
নির্যাতন-অবজ্ঞা-অবহেলা সইতে না পেরে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে করে সেই কবে ঢাকা এসেছে দিন তারিখ মনে নেই। এখানে আসার পর অনেক সাথী পেয়েছে সে। সবু, কালু, লাল মিয়া, কলিম ওরা এক সাথে চলে। সারাদিন কাগজ কুড়ায়, ময়লা ঘেঁটে যা পায় তাই বিক্রি করে বেঁচে আছে। ঈদের দিন সে কী কাজ করেÑ-জানতে চাইলে সবু বলে, ‘আমার আবার ঈদ! ঈদের দিন আমার মতো ছোট ছোট পোলাপানরা নতুন পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি মাথায় নামাজে যায়। আমার তখন মনে হয়, বাবা তুই থেকেও কেন নাই? আমার কপাল এমন কেনে।’
লাল মিয়ার বাবা নেই। সে মায়ের সাথে কমলাপুর বস্তিতে থাকে। ঈদে নতুন কাপড় না পেলেও পোলাও, গোস্ত, সেমাই খেতে পায়। ওর মা যে বাড়িতে কাজ করে তারা ওর মাকে এসব মজার মজার খাবার দেয়, তিনি ওর জন্য নিয়ে আসেন। গত ঈদে সাহেবের ছোট ছেলের একটা পুরাতন পাঞ্জাবিও ওর জন্য তারা দিয়েছিলো। সে নতুন পাঞ্জাবির মতোই মজা করে পরেছে।
কলিমের মনে নেই সে কবে কার সাথে ঢাকা এসেছে। সে জানে না ওর বাবা-মা কারা। ওর বুদ্ধি হওয়ার পর সে নিজেকে একটি চায়ের দোকানের হেলপার হিসেবে আবিষ্কার করেছে। মালিকের মার সহ্য করতে না পেরে এই রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। সারা দিন দল বেধে কাগজ কুড়িয়ে বিক্রি করে যা পায় তাই দিয়ে তার এক পেট চলে যায়। সে ঈদের দিন ভিক্ষা করে, বাসা বাড়ির দ্বারে দ্বারে যায় কেউ দয়া করে কিছু দিলে খায়। না দিলে উপোস থাকে। এমন বঞ্চিত ছিনড়বমূল শিশুর সংখ্যার সঠিক হিসাব কি কারো কাছে আছে? ২০১১ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা সূত্রে জানা যায়, দেশে দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী জনসংখ্যা শতকরা ৪০, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে শতকরা ৫৯ জন। ২০১১ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা সূত্রে চরম দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে ২৫.১% জন।
সাধ্য যাদের নেই তাদের মনেও সাধ আছে। তারাও চায় সবার সাথে মিলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে। কিন্তু তাদের এই সাধ পূরণ করার সামর্থ্য যাদের আছে, তারা কি সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন?
ওদের ঈদের আনন্দ । হারুন ইবনে শাহাদাতদারিদ্র্যতার কারণে অনেক মৌলিক চাওয়াই এইসব শিশু-কিশোরের অপূর্ণ থেকে যায়। গত বছর ঈদের আগে ঢাকার রাস্তায় রানা নামের একটি ছেলে ফেরি করে লজেন্স বিক্রি করছিলো। তার কাছে জানতে চাইলাম, ঈদের জন্য সে কি নতুন জামা কিনেছে। তার ঝটপট উত্তর, ‘লেখাপড়ার টেহা নাই, তিনবেলা খাওন জুটে না, আর ঈদে নতুন জামা?’ সত্যি তাই, সারা বছর যেখানে দু’বেলা খাবার পেতে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়, সেখানে তো নতুন জামা তো স্বপ্নের ব্যাপার। আকাশ-পাতাল ব্যবধানের এই সমাজের দরিদ্র পথশিশুদের ঈদের আনন্দ শুধুমাত্র নতুন চাঁদ দেখার মাঝে আর কতকাল সীমাবদ্ধ থাকবে? আর কতকাল তাদের ঈদের দিন অন্য সাতটা দিনের মতই ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে চলে যাবে!
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়, ঈদের আগে অনেক ছোট ছোট শিশুরা রাস্তায় বেরিয়ে বিভিন্ জিনিস ফেরি করে বিক্রি করে। তাদের আশা একটা নতুন জামা যেন তারা অন্তত কিনতে পারে। শিশু ফেরিওয়ালা রানা (১০) জানায়, তার বাবা নতুন জামা কিনে দিতে পারবে না। তাই সে ভাইদের সাথে বই, চকলেট এসব বিক্রি করছে। রানার বয়সী অনেক শিশু রাস্তায় টার্মিনালে যানবাহনের ভিড়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফেরি করে। অনেক শিশু বসে ঈদ-কার্ড, টুপি-আতর বিক্রি করতে। তারা তাদের সোনালি শৈশবের বিনিময়ে একটি আনন্দ-রঙিন ঈদের স্বপ্ন দেখে।
ঈদের আনন্দে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে শরীক করতে হবে। পবিত্র ঈদুল আযহা! সে তো ত্যাগের উৎসব; তারপরও কেন দরিদ্র শিশুরা ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বার বার? জনসংখ্যার দিকে থেকে চতুর্  বৃহত্তম মুসলিম দেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। প্রথম ইন্দোনেশিয়া, দ্বিতীয় পাকিস্তান আর তৃতীয় নাইজেরিয়া। উল্লেখিত দেশগুলোসহ সারা বিশ্বের মুসলমানরা কোন সেই যাদুর টানে হারিয়ে ফেলছে ইসলামের ত্যাগের শিক্ষা! এই প্রশ্নের উত্তর জানতে এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে আজকের এই দিনে পবিত্র কোরআন-হাদীসের শিক্ষায় নতুন করে দীক্ষা নিতে হবে।

Share.

মন্তব্য করুন