চাচাতো ভাই উজ্জ্বল জাতীয় দলের ফুটবলার। বাবা জেলা ফুটবলে খেলেন। এমন পরিবার থেকে একজন ফুটবলার বের হওয়ারই কথা। কিন্তু না, ফুটবলার না। সে বাড়ি থেকে বের হতো ব্যাট-বল হাতে নিয়ে ছোট্টবেলা থেকেই। স্কুলের ক্যারাম চ্যাম্পিয়নশিপে যে ছেলেটা চ্যাম্পিয়ন, লুডোতে যাকে কেউ হারাতে পারতো না সেই ময়না আজ সারাবিশ্বে সাকিব আল হাসান।
সাকিব আল হাসানের আশ্চর্য শান্ত নিবিষ্ট চিন্তা নিয়ে তার কোচ সালাহউদ্দিন বলেছেন, আমাদের একটা ম্যাচে অল্প রানে ৬ উইকেট পড়ে গেছে, ৭ নম্বরে যে ছেলেটি নামবে সে সাইডলাইনে বসে অনুচ্চস্বরে গান গাচ্ছে, গান গাইতে গাইতেই ক্রিজে নামলো সে। আর ঝড়ো ৪৩ রান করে দলকে জিতিয়ে দিলো। অবিশ্বাস্য না? হ্যাঁ! মারাত্মক আত্মবিশ্বাসী সাকিব কখনোই হার মানতেন না।
বাংলাদেশ ‘এ’ দলে যেসব ক্রিকেটার চান্স পায় তাদের মধ্য থেকেই জাতীয় দলে ডাক পায় সেরা পারফরমাররা। সাকিব নামের ছেলেটা ‘এ’ দলে চান্স পেলো না। প্রচণ্ড মন খারাপ। এ সময় খবর এলো, ‘এ’ দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানের জ্বর হয়েছে। ব্যস সাকিবকে আর ঠেকায় কে? জিম্বাবুয়ের সাথে চার দিনের (‘এ’ দলের টেস্ট ম্যাচগুলো ৪ দিনের হয়, জাতীয় দলের ৫ দিনের) টেস্টের প্রম দুই ম্যাচ দারুণ পারফর্ম করে জাতীয় দলে ‘যাই যাই’ করা সাকিব হঠাৎ দেশে ফিরে এলেন কেন? তার পাবলিক পরীক্ষা, সাকিবের হার না-মানা মনোভাব অবিচল রেখেছে তাকে এমন মুহূর্তেও।
পাশের গ্রাম আলোকদিয়া, যে গ্রামে এক টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলতেত গিয়ে প্রথম বলেই বোল্ড করলেন প্রতিপক্ষের ওপেনারকে, ব্যস। ম্যাচ হাতের মুঠোয় পুরে শিরোপা জিতে এলেন সাকিব। সেটিই ছিল সাকিবের প্রথম শিরোপা। কে জানতো যে এই সাকিব একদিন শিরোপা রাখার জায়গা পাবে না। সাকিব আর তার বন্ধুরা নিজেরা নিজেরা টুর্নামেন্ট ছাড়তো। একদিনেই কোয়ার্টার, সেমি ও ফাইনাল- সব। জয়ী দল পেতো নোনতা বিস্কুটের প্যাকেট। নোনতা বিস্কুট দিয়ে চা খাওয়ার সেসব স্বাদ সাকিব এখনো ভুলতে পারেননি। তোমরাও একবার খেয়ে দেখো।
আলোকদিয়া থেকে বিশ্বমঞ্চে । শরিফ ইসলামতোমরা যারা সাকিব হতে চাও তারা কিন্তু মনে রাখবে, সাকিব খেলার পাশাপাশি পড়ালেখায়ও ফার্স্ট ছিল। এমনকি সিরিজ বাদ দিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছিলো। বুঝতেই পারছো। সাকিবকে যখন বিকেএসপি ক্রিকেটার অন্বেষণ কর্মসূচির আওতায় খুঁজে বের করে, সাকিব তখন ক্লাস সেভেনে। কিন্তু বিকেএসপিতে গিয়ে এইটে অটো প্রমোশন পায় সে। এতে হিতে বিপরীত হয়ে গেল। সাকিব বন্ধু-বান্ধবশূন্য হয়ে গেল। মাগুরায় গেলেই দেখা যেত সবাই ক্লাস সেভেনে আর সাকিব এইটে। বন্ধুরা একটু একটু করে দূরে সরতে লাগলো।
তোমাদের কারো জীবনে এমন হয়েছে কি? ধরো এক ক্লাস টপকে উপরে উঠে গেলে। আর বন্ধু-বান্ধব ‘নাই’ হয়ে গেল। কিংবা ফেল করে ফেললে! ফেল করা আদৌ খারাপ কিছু না। যদি সাকিব হতে পারো। সাকিবের কাছে সবচেয়ে অসহ্য লাগতো বিকেলে খেলার টাইমে ইংরেজি প্রাইভেট পড়া। মন পড়ে থাকতো খেলার মাঠে আর দেহ পড়ে থাকতো পড়ার টেবিলে। উহু! সাকিব মোটেই পিছপা হয়নি। ঠিকই খেলার সময় বের করে নিতো সে, কিভাবে? দ্রুত পড়া শেষ করে। আগের রাতেই ইংরেজি পুরোপুরি ‘পান্তা’ বানিয়ে রাখতো সাকিব। তারপর স্যার এলেই গড়গড় করে পড়া শেষ করে দে ছুট।
তোমরা বলো আম্মু খেলতে দেন না, আব্বুও। সাকিবের আব্বু কী করেছিলেন জানো? ব্যাট কেটে ফেলে দিলেন। আহা, সাকিব সে কি কান্না, যদি দেখতে! সাকিব কিন্তু দমে যায়নি, সিস্টেমে খেলেছে। আলোকদিয়ার যে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেই ম্যাচের কথাই শোনো না। সাকিবের বাবা তো খেলতে দিবেন না! তো? বুদ্ধি বের করলো সাকিব। আলোকদিয়া যাওয়ার পথেই সাকিবের মামার বাড়ি।
ব্যস! ‘মামার বাড়ি ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে সুখ।’ সাকিবের মায়ের মাধ্যমে বাবার কাছে খবর গেল, ‘যেহেতু স্কুল দুই দিনের ছুটি, সাকিব মামাবাড়ি যাবে।’ ছুটি মঞ্জুর হলো কিন্তু ঘটনা ঘটলো দুদিন পর। সাকিব যে খেলতে গেছে কাকপক্ষিটিও টের না পাওয়ার কথা। টের পেয়ে গেলেন সাকিবের বাবা। এই যাত্রা বেঁচে গেল সাকিব। কারণ বাবার কানে ‘চ্যাম্পিয়ন সাকিবের’ নাম এসেছে।
আলোকদিয়া থেকে বিশ্বমঞ্চে । শরিফ ইসলামসাকিবের সবচেয়ে বড় হেল্পিং হ্যান্ড ছিল সাদ্দাম হোসেন গোর্কি নামের এক যুবক। গোর্কি ভাই সাকিবকে আর দশজনের মতো হারিয়ে যেতে দেননি। সাকিব কিন্তু সব খেলাতেই সেরা ছিল। কি ক্যারাম বলো, কি ভিডিও গেইম বলো। সাকিবদের ছোটবেলার এক ধরনের ভিডিও গেইম ছিল দোকানে দোকানে। কয়েন দিয়ে খেলা যেত। ইয়া ঢিশুম-ঢিশুম, ঐ গেমেও সাকিব চ্যাম্পিয়ন। তো সেই সাকিবকে ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে তুলে দেয়ার মূল কাজটি কিন্তু গোর্কি ভাই-ই করেছিলেন। সাকিবের বাবা ভীষণ রাগী ও মেজাজি। ‘কিসব ক্রিকেট-ফিকেট খেলিস, এগুলো কোনো খেলা? খেলা হচ্ছে ফুটবল। পেলে-ম্যারাডোনা।’
বলে রাখি, সাকিবের ছোটবেলায়, মানে সেই ২০০১-০২তে ক্রিকেট অতো জনপ্রিয় ছিলো না। বলা চলে প্রায় অচেনা খেলা। প্রত্যন্ত মাগুরায় তো অচেনা বটেই, সে সময় কোন বাবাই বা চাইবেন যে খেলার ভবিষ্যৎ নেই, সে খেলা খেলে সময় নষ্ট করুক ছেলে! তো সাকিবের বাবাও চাইতেন না। কিন্তু গোর্কি ভাই সাকিবকে ক্রিকেট খেলাবেনই। সাকিবের মা তার বাবার অলক্ষ্যে সাকিবকে প্রতি বিকেলে গোর্কি ভাইয়ের সাথে দিয়ে দিতেন। আমাদের সবার জীবনেই কিন্তু একজন গোর্কি ভাই আসে। তাদের মেন্টর বলে। গোর্কি ভাইদের চিনতে ভুল করো না।
আলোকদিয়া থেকে বিশ্বমঞ্চে । শরিফ ইসলামআরেকটা ব্যাপার, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবের বাঁ-হাতি অর্থোডক্সে প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরাত- তাই না? কিন্তু সাকিব প্রথমে স্পিনার ছিলেন না। ছিলেন পেসার। গোর্কি ভাই বললেন, তোর পেসে জোর কম, তুই স্পিনটা কর। সাকিব স্পিনার হিসেবে জীবনের প্রম ম্যাচেই ৩ উইকেট পেলেন। তাকে আর ঠেকায় কে? এখন বিশ্বসেরা বোলারদের নামের পাশে সাকিবকে মোটেও অনুজ্জ্বল দেখায় না। বরং পেসার হলে আমরা এই সাকিবকেই হারাতাম। মনে রেখো, তুমি যেদিকে জোর দিতে পারছো না, সে জিনিসটি ছেড়ে দিয়ে ভিন্নভাবে ট্রাই করো। ঐ যে শিব খেরা নামের এক পণ্ডিতের নাম শুনছো তো তোমরা? তিনি কিন্তু বলে দিয়েছেন, ‘বিজয়ীরা ভিন্ন কোনো কাজ করে না, একই কাজ ভিন্নভাবে করে।’

Share.

মন্তব্য করুন