মিরাজকে নিয়ে অসম্ভব টেনশনে পড়েছেন আম্মু। রাতদিন ছেলেকে নিয়ে ভাবনার মধ্যে পড়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিষয়টা শেয়ার করেন। আত্মীয়-স্বজনরাও তাকে কোন যুক্তিযুক্ত উপদেশ দিয়ে একটা রাস্তা বাতলে দিতে পারেন না।
অংক শাস্ত্রে পাটিগণিতের ভয় ছিল না এমন লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে নেহায়েত কম। অংকের স্যার পাটিগণিত উল্টালেক্লাসে সবার বুকটায় দশ মাত্রার ভূমিকম্প শুরু হয়। শরীরের কাঁপুনি শুরু হলেও শেষ হতে চায় না। সেই পাটিগণিত কিনা মিরাজের কাছে পানির মতো লাগে? পাটিগণিত বিষয়টা পানির মতো লাগে, ব্যাপারটা এখানে থেমে থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু বীজগণিত তার কাছে কঠিন ও জটিল লাগবে কেন? সূত্রটা অংকের মধ্যে ফেলে দিলেই তো অংকটা লবণের মতো গলে যায়। তাহলে?
আম্মু মিরাজের পড়ার রুমে এলেন। মিরাজ বাংলা বইটা খুলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। রুমের সবুজ দেয়ালে একটা টিকটিকি শিকার ধরে আছে। টিকটিকির আশপাশে একটি মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। মাছিটা উড়ছে তো উড়ছেই। টিকটিকিটাও মাথাটা এদিক ওদিক নাড়াচাড়া করছে।
আম্মু খোশ গলায় বললেন, ‘তোমার নানু আসছে।’
‘কখন আসছে আম্মু?’
‘আজ বিকেলে। এক সপ্তাহের জন্য আসছে। শুনে কেমন লাগছে?’
‘ভালো লাগছে না আম্মু।’
‘ভালো লাগছে না? ভালো লাগছে না কেন?’
‘বাংলা নিয়ে ঝামেলায় আছি। কিছুই মাথায় ঢুকছে না।’
‘বাংলা তো অনেক সহজ পড়া বাবা। গল্প কবিতার মতো। মুড়ির মতো ।
‘মুড়ির মতো মানে?’
‘বাঙালিদের কাছে মুড়িটাই হলো সহজ খানা। দাঁতের চাপ পড়ার আগেই ভেঙ্গে যায়। তুই তো মুড়িই খাস না, বুঝবি কী করে?’
‘নানু কি মুড়ি নিয়ে আসছে?’
‘মুড়ি নিয়ে কি কেউ বেড়াতে আসে? আমের মওসুম, আম তো আসবেই।’
‘ঠিক আছে, অপেক্ষায় আছি।’
ইশকুলেও মিরাজকে নিয়ে বেশ কথা চালাচালি হয়। ইংরেজি, ভূগোল, বিজ্ঞানে তার নব্বইয়ের কাছাকাছি নম্বর থাকলেও বাংলা ধর্মে কোনমতেই পঞ্চাশের ঘর পার করতে পারে না। এদিকে পাটিগণিত, জ্যামিতিতে সত্তর নম্বর হলেও বীজগণিতটা স্টার মার্কের পথ আটকে দেয়। ইশকুলের প্রধান শিক্ষক একজন বিজ্ঞান গবেষক, তাঁর গবেষণা পত্র পত্রপত্রিকায় প্রশংসার ঝড় তুললেও মিরাজের ব্যাপারে তাঁর মাথাটা আক্কেল গুডুম হয়ে যায়। ইশকুলের বাংলা স্যার খেজুর রসের মতোই একজন রসালো মানুষ। তাঁর মুখ থেকে রস সব সময় টস টস করে ঝরে। মিরাজকে পাঠ দানের ব্যাপারে তিনি নতুন ফর্মুলায় ব্রতী হয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত ফর্মুলায় মিরাজকে একদিন নিশ্চয় পথ দেখাবে। মৌলভী ফরিদ উদ্দিন স্যার ধর্ম পড়ান। পান গালে দিয়ে ঠোঁট জোড়া সব সময় লাল করে রাখেন। ধর্ম সহজ বিষয় বলে কারোর মাথায় চাপ থাকে না। শুধু চাপ থাকে একজনের, ওর নাম মিরাজ।
ধর্ম স্যার নরম গলায় ডাকলেন, ‘মিরাজ।’
‘জি হুজুর।’
‘কোন কোন মানুষ সাপকে ভয় পায় না, কিন্তু কেঁচোকে ভয় পায়।’
‘এ রকম মানুষও আছে হুজুর?’
‘আছে, অনেক আছে।’
‘কেন এমন হয় হুজুর?’
‘যেমন তুমি পাটিগণিত বিজ্ঞানকে ভয় পাও না, ভয় পাও বাংলা আর ধর্মকে। বাংলা এবং ধর্ম দুটোই নিরীহ সাবজেক্ট। কেঁচোর মতো নিরীহ। তোমার জীবনটাও সাপ ও কেঁচোর কাহিনির মতো হয়ে যাচ্ছে না? যে মানুষ সাপকে ভয় পাবে না, সে কেঁচোকেও ভয় পাবে না। এটাই মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।’
‘আমি এখন কী করবো হুজুর?’
‘বাংলা ও ধর্মকে রূপকথার বইয়ের মতো পড়তে হবে। রূপকথা ভাবতে হবে। তুমি কি রূপকথার বই পড়ো?’
‘জি হুজুর পড়ি।’
‘আমি কি বোঝাতে পেরেছি?’
‘জি হুজুর, বোঝাতে পেরেছেন।’
‘আজ এতোটুকুই বললাম। সবাই ভালো থেকো’ এই বলে ধর্ম স্যার বের হয়ে গেলেন।
নানু এলেন বেশ জাঁকজমক করে। তালপাতার পাখা থেকে শুরু করে তাল সুপোরি পর্যন্ত কিছুই বাদ রাখেননি। নানুর পাহাড়সম জিনিসপত্তর নিয়ে আম্মু মহাবিপদে আছে। কোনটা কোথায় রাখা যায় তার কোন দিশকুল করতে পারছেন না।
প্রচন্ড দাবদাহ চলছে বাংলাদেশের আবহাওয়ায়। এই আষাঢ়েও কোথাও এক ফোঁটা বৃষ্টিপাত নেই। নানু আধঘন্টা সোফায় বসে জিরিয়ে নিলেন। শরীরে ঘামের স্রোতটা এখন আর নেই। নানু একটা বড়সড় স্বস্থির নি:শ্বাস ফেললেন।
নানুর জন্য খানার আইটেম অনেক। পুদিনা পাতা আর ইছা সুটকির ভর্তা নানুর লাগেই। আম্মু টমেটো পুড়ে দারুণ চাটনি বানাতে পারে। এই চাটনি বানাতেও আম্মু ভুল করেনি।
নানু মুখে ভাত পুরে দিয়ে বলল, ‘পড়ালেখা কোমন
চলছে ক্রিকেটার মিস্টার মিরাজ?’
আমি ক্রিকেটার না, ফুটবলার মেসি।
‘মেসি? মেসি বাংলাদেশে এল কখন?’
‘বারো বছর নয় মাস আগে, অন্ধকার রাত তিনটায়।’
নানু ভ্রু কুঁচকে হো হো করে হেসে ফেলল।
‘তা তোমার মেসি তো এবার পাশ করে নাই। ফেল মারা ছাত্রের কোন দাম নেই।’
‘মেসি পাশ করেছে, আর্জেন্টিনা পাশ করেনি।’
নানা আরো উঁচা করে ভ্রু কোঁচকালেন।
‘তা মেসি সা’ব, বাংলা এবং ধর্মে নাকি বারবার গোল খাচ্ছেন। এভাবে আর কতোদিন চলবে?’
‘গোল খেতে খেতে পেট যতদিন ভরে না যাবে, সেই দিনতক অপেক্ষা করতে হবে।’
‘তো মেসি সাহেবের কী হতে ইচ্ছে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল……’
‘ডাক্তার।’
নানু এবার মজার বৃত্ত থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি বড় বড় চোখ করে মিরাজের দিকে চেয়ে থাকলেন। নানু বিস্ময়কন্ঠে বললেন, ‘ডাক্তার!’
‘আম্মু চায় আমি ডাক্তার হই। বড় ডাক্তার।’
‘ডাক্তার আমার একেবারেই অপছন্দ। ডাক্তাররা সংসারে সময় দিতে পারে না। তোমার মায়ের বিয়ের জন্য একজন ডাক্তার চেপে বসেছিল, আমি রাজি হইনি।’
‘আম্মুর কাছে শুনেছি।’
‘তোমার আম্মু এসব নিয়েও গল্প করে?’
‘অনেক করে।’
মুহূর্তে নানুর কপালে ভাঁজ পড়ল। সুলতানা মল্লিক বিব্রত বোধ করছেন। তিনি ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে দিয়ে উঠে পড়লেন।
দাদু অপরাধী কন্ঠে বরলেন, ‘তোমার আম্মুকে ডাক্তারের কাছে বিয়ে না দিয়ে কি আমি ভুল করেছি?’
‘একদম না। তুমি ঠিক কাজটিই করেছিলে।’
এলিয়েন ডাক্তার । আলী আসকরদাদুর মুখের উৎকন্ঠাটা দ্রুতই কেটে গেল। তাঁর চেহারার উৎফুল্লতা আবার ভর করতে শুরু করল। ডাক্তার ইরফান উদ্দিন। নিউরোলজিস্ট। নেমপ্লেটে কী কী আরো বিদেশী ডিগ্রী লেখা। গাদাগাদি করে মেয়ে পুরুষ টানা চেয়ারে বসে আছে। আজ আধা রাতেও ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাবে কিনা সন্দেহে ডুবে যাচ্ছেন সুলতানা মল্লিক।
তাদের সিরিয়াল হলো সাতচল্লিশ। এখন চলছে মাত্র এগারো। ফিরে যাবেন কিনা ভাবছেন এই মুহূর্তে। তিনি মিরাজের হাতটা মুঠোয় নিলেন। দুই কদম দিতেই ডাক পড়ল, ‘মিরাজ’।
থমকে দাঁড়ালেন সুলতানা মল্লিক। শ্রবণীয় শব্দটাকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। ডাক্তারের সহকারী আবার ডাক দিলেন, ‘মিরাজ’।
মিরাজ নামের আর কেউ যখন ভেতরে ঢুকছে না তখন হুলুস্থুল করে ঢুকে পড়লেন সুলতানা মল্লিক। ডাক্তারের বয়স নিয়ে মনে মনে তিনি যে-রকম একটা চিত্র এঁকেছিলেন, আসলে বয়সটা তার কাছাকাছিও নয়। সুলতানা মল্লিক একটু নরম স্বরে বললেন, ‘আমি কি শুরু করতে পারি?’
‘আপনি মিরাজের ব্যাপারে আলাপ করতে চান?’
‘জি।’
‘মিরাজের ব্যাপারটা আমি জানি।’
‘জানেন মানে? কী জানেন?’
‘কঠিন কঠিন বিষয়গুলো তার কাছে সহজ লাগে, সহজ বিষয়গুলো কঠিন লাগে।’
‘একদম ঠিকই বলেছেন।’
‘এটা একটা নিউরনজনিত রোগ। এই রোগ আপনাদের বংশ পরম্পরা। আপনার বাবা মল্লিক চৌধুরীর কাছেও আছে।’
‘আমার বাবার নাম আপনি কীভাবে জানেন?’
‘আপনার বিয়ের সময়ের কথাই ধরুন, দু’জন পাত্র আপনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। একজন বিএ পাশ, অন্যজন মেডিকেলে সেরা ছাত্র এমবিবিএস পাশ। আপনার বাবা বিএ পাশ ছেলেটাকে আপনাকে বিয়ে দিলেন। এটাও আপনার বাবার নিউরনজনিত রোগের কারণেই হয়েছিল।’
‘আপনি আমার অবাকের বৃত্তটাই বড় করে চলেছেন।
আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘আপনার মাথায়ও এই রোগ আছে।’
‘আমার মাথায়? কী সব উল্টা পাল্টা বলছেন আপনি?’
‘আপনি মাঝে মাঝে তরকারির ভেতর লবণ মনে করে চিনি ঢেলে দেন। এটাও নিউরনজনিত রোগের কারণেই হয়।’
মিরাজ নড়েচড়ে উঠল। ডাক্তারের কথাকে সমর্থন করে বলল, ‘এ জন্যই মাছ মাংস মাঝে মাঝে মিষ্টি হয়ে যায়।’
সুলতানা মল্লিক ডাক্তারের এ কথার কোনো প্রতিবাদ করলেন না। তিনি নিজেকে কঠিন অসহায় বোধ করতে থাকলেন।
ডাক্তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ঢেলে বললেন, মিরাজের চিকিৎসা কাল ধর্ম স্যার করে দিয়েছেন। বাংলা এবং ধর্মটা রূপকথার বইয়ের মতো পড়ুক। তাহলেই এর একটা বিহিত হয়ে যাবে।
ধর্ম স্যারের কথাগুলো আপাতত মেনে চলুক মিরাজ। এক সপ্তাহ পর আবার আসবেন।’
একটা বিরাট ঘোর কাজ করছে সুলতানা মল্লিকের। এই ঘোর থেকে বের হতে তিনি বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন।
‘আম্মু।’
‘বলো।’
‘ডাক্তার স্যারকে আমার মানুষ মানুষ বলে মনে হচ্ছে
না।’
‘মানুষ মানুষ মনে হচ্ছে না মানে?’
‘তোমার বিয়ের কথা, নানুর নামটা বলে ফেলা, ধর্ম স্যারের উপদেশ একজন মানুষের পক্ষে এসব বলে দেওয়া অসম্ভব আম্মু। মনে হয় ডাক্তার মানুষরুপী এলিয়েন। এলিয়েনেরাই জীব জগতের অজানা তথ্য বলে দিতে পারে।’
‘তুমি এলিয়েনের কাহিনি কীভাবে জানো?’
‘একমাত্র এলিয়েনেরাই মহাবিশ্বে বাধাহীন চলাচল করতে পারে। কোনো মহাকর্ষ শক্তিই এদের চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এরা গ্রহ থেকে গ্রহে ছুটে বেড়াতে পারে। প্রত্যেকটি এলিয়েনের তাপ প্রতিরোধক ক্ষমতাও অন্য প্রাণীর চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি। এলিয়েনের জ্ঞান বুদ্ধিও মানুষের চেয়ে বেশি।’
মিরাজের কথা শুনে সুলতানা মল্লিকের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি মিরাজের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘হতে পারে ডাক্তার এলিয়েনের মতোই বুদ্ধিমান, তবে তিনি আমাদের রক্ত মাংসের মানুষ। আমার বিয়ের ডাক্তার পাত্রটি হয়তো উনিই ছিলেন, তোমার নানু যাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘তুমিও এলিয়েনের মতো কথা বলছো, আজব।’ সুলতানা মল্লিক হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। মিরাজও আম্মুর পাশাপাশি দ্রুত হাঁটতে থাকল।

Share.

মন্তব্য করুন