অনেক দিন আগের কথা। উজবেকিস্তানে এক ব্যক্তি বাস করতেন। তার নাম ছিল বেগ। তাদের সংসারে ছিলেন দু’জন মানুষ- তিনি আর তার স্ত্রী। বেগের ছিল একটি বুদ্ধিমান ও বিশ্বস্ত কুকুর। বিরাট আকারের কুকুরটা দেখতে একেবারে নেকড়ে বাঘের মত। বেগ তাকে খুব যতেড়বর সাথে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ভারি কাজের ছিল প্রাণিটা। বাড়ি পাহারার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন তো করতই, প্রায় দিনই সকালে মনিবের জন্য বন থেকে বুনো খরগোশ আর তিতির ধরে আনত সে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কুকুরটিকে খুব ভালোবাসতেন। তারা তার নাম দিয়েছিলেন বাঘা। কোনো সময় সে বাড়িতে না থাকলেও গলা উঁচু করে নাম ধরে ডাকলেই দৌড়ে চলে আসত।
একদিন বাঘা রাস্তায় ঘুরছিল। এ সময় একটি বাড়ির ছায়ায় একটি সংকর জাতের কুকুরকে শুয়ে থাকতে দেখল সে।
বোঝাই যাচ্ছিল যে কুকুরটি অনাহারের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাঘা তার কাছে গিয়ে বলল- ‘কি হে আলসের রাজা! আর কত শুয়ে থাকবে? আমার সাথে একবার চল। দেখবে আমার মনিব আমার জন্য কি করেছেন। তিনি আমার থাকার জন্য সুন্দর একটি ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। শীতের রাতে চমৎকার উষ্ণ হয়ে থাকে ঘরটা! আমার খাবার জন্য আলাদা পাত্রও দিয়েছেন তিনি। তিনি এত ভালো মানুষ যে কখনো আমাকে তাড়িয়ে দেন না। তুমি আমার সাথে যেতে পার। গেলে সুখে থাকবে।’
সংকর কুকুরটি বাঘার কথায় রাজি হয়ে যায়। তারা বাড়িতে পৌঁছলে বেগ নতুন মেহমানকে দেখে খুশিই হন। বাড়ির কাজের লোকদের বলে নতুন কুকুরটির জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেন। এরপর থেকে সংকর কুকুরটিও বাঘার সাথে শিকারে যেতে শুরু করল। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিল বাঘা। দু’কুকুর মিলে প্রতিদিন মনিবের জন্য বুনো খরগোশ ও তিতির শিকার করে আনে।
কুকুর দু’টি শিকার করতে একদিন এক জঙ্গলে গেল। একটি শিয়ালকে শুয়ে থাকতে দেখল তারা। এক সাথে দু’টি ডাকাবুকো কুকুরকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল শিয়ালটা। ব্যাপরটা লক্ষ্য করে বাঘা বলল- ‘ভয় পেয়ো না। আমরা হিংস্র নই। তা, তুমি এখানে কি করছ?’
শিয়াল বলল- ‘গত ক’দিন থেকে অনাহারে আছি ভাই। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিও এখন নেই।’
সংকর কুকুরটি তাকে বলল- ‘ভালো মানুষ তিনি। তাঁর স্ত্রীও অত্যন্ত দয়াবতী। আমরা তাদের শিকার ধরে এনে দেই আর বাড়ি পাহারার কাজ করি। তারা আমাদের ভালো খাবার দেন, যত্ন করেন। আমাদের সাথে গেলে তুমিও ভালো থাকবে।’
শিয়াল তাদের কথায় রাজি হয়ে যায়। তারপর তিনজন বেগের বাড়িতে পৌঁছে। বেগ শিয়ালকে দেখে খুশি হন। তার জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেন। তিনটি প্রাণি মিলে প্রায়ই কয়েকটি করে খরগোশ, বনমোরগ ও তিতির শিকার করে আনে। বেগের স্ত্রী সবার জন্য ভালো খাবার তৈরি করে দেন।
কিছুদিন পর শিকার করার জন্য তিনজন এক বনে উপস্থিত হল। সেখানে এক সিংহ ও বাঘের সাথে তাদের দেখা হয়ে যায়। সিংহ ও বাঘ তখনো কোনো শিকার ধরতে পারেনি। দু’জনেরই মন খারাপ।
অনেকক্ষণ কোনো খাবার না জোটায় ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাঘা দু’জনকে বলে- ‘শোনো, আলাদা আলাদাভাবে শিকার না করে আমরা সবাই মিলে যদি একসাথে শিকার করি, সেটাই ভালো হবে। তাহলে দলও শক্তিশালি হবে, আবার শিকারও বেশি মিলবে। তোমরা কি বলো?’
ইতস্তত করতে থাকে বাঘ ও সিংহ। বন ছেড়ে মানুষের বাড়ি গিয়ে তার অধীন হয়ে থাকা! কেমন হবে সেটা? বাঘা তাদের মনের কথা বুঝতে পারে। তাই মনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বাঘ ও সিংহকে তাদের সাথে বেগের বাড়ি গিয়ে সবাই একসাথে থাকার কথা বলে। রাজি হয়ে যায় বনের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই পশু। দল বেঁধে বেগের বাড়ি পৌঁছে তারা। বেগ বাঘ এবং সিংহকে পেয়ে ভীষণ খুশি হন। তাদের জন্যও ভালো খাবারের ব্যবস্থা হয়। পাঁচজনের দলটি প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ শিকার ধরে আনে। এদিকে বেগের স্ত্রী তাদের ভালো ও সুস্বাদু খাবার তৈরি করে দেয়। বেশ সুখেই সবার দিন কাটতে থাকে।

বন্ধু । দিলফুজা তাশপুলাতোভা । অনুবাদ: হোসেন মাহমুদ২.
হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বেগের স্ত্রী। কিন্তু ভালো মত চিকিৎসা করার আগেই মারা যান তিনি। স্ত্রীর শোকে ভীষণ কাতর হয়ে পড়েন বেগ। নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেন তিনি। তার অবস্থা দেখে দু’টি কুকুর, শিয়াল, বাঘ ও সিংহ তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে।
কারণ সত্যিকার ভালো মানুষ বলে বেগকে তারাও অন্তর থেকেই ভালোবাসে। কিছু একটা করতে হয়। বৈঠকে বসে তারা। অনেক আলোচনার পর স্থির হয় যে তাদের মনিব বেগকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিতে হবে। সে জন্য শিক্ষিতা, সুন্দরী, নানা গুণে গুণান্বিতা একজন স্ত্রী চাই তার। ভালো জীবন সঙ্গিনী পেলেই তিনি আবার আগের মত হয়ে যাবেন। করণীয় ঠিক করে ফেলে বুদ্ধিমান বাঘা। শিয়ালকে বলে সে- ‘তুমি কাল সকালে শহরে যাবে। সেখানে সবচেয়ে বড় সোনার দোকানে গিয়ে সেরা অলংকারগুলো কিনবে। তোমাকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সাথে যাবে বাঘ ভায়া। অলংকার কেনার পর সেগুলো তাকে দেবে। তাহলে ভয়ে তার কাছে কেউ আসবে না। নিরাপদে অলংকারগুলো এখানে নিয়ে আসবে সে।’
সবাই বাঘার কথায় সমর্থন জানায়।
শিয়াল ও বাঘ পরদিন সকালে শহরে রওনা হয়ে যায়। দামি সব অলংকার কিনে ভালোভাবেই ফিরে আসে তারা। এবার পাত্রী নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শিয়াল বলে- ‘আমি জানি, পাশের রাজ্যের বাদশাহ্র মেয়ে যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী। তার সাথে বেগের বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ঘটক পাঠানো যেতে পারে।
বাঘা বলে- ‘তাহলে ওই বাদশাহ্র মেয়ের সাথেই আমাদের মনিবের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কাজটি মোটেই সহজ হবে না। আমাদের মনিব সম্ভ্রান্ত লোক, কিন্তু বিশিষ্ট কোন ব্যক্তি নন। সুতরাং বাদশাহ্ তার সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। তাই আমাদের অন্য বুদ্ধি করতে হবে।’
আবার পরামর্শে বসে সবাই। বহু চিন্তা-ভাবনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে শিয়াল আর বাঘ যাবে বাদশাহর মেয়ের কাছে। সুযোগ বুঝে নিয়ে আসবে তাকে। কখন কিভাবে কি করতে হবে, বিশদভাবে তাদের বুঝিয়ে দেয় বাঘা ও অন্যরা। সব কিছু ভালোভাবে বুঝে নেয় দু’জন। বাদশাহর প্রাসাদের একদিকে তার মেয়ে থাকে। রাতের আঁধারে সেখানে গিয়ে পৌঁছে শিয়াল আর বাঘ। চারদিক নীরব হয়ে এলে শিয়াল গিয়ে বাদশাহর মেয়ের কক্ষের দরজায় টোকা দিয়ে লুকিয়ে পড়ে।
টোকার শব্দে পরিচারিকা এসে দরজা খোলে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ফিরে যায় সে। একটু পর শিয়াল আবার টোকা দেয়। পরিচারিকা এসে আবারো দরজা খোলে। কিন্তু এবারো কাউকে দেখতে না পেয়ে রাগে গজগজ করতে থাকে। একটু পর আবারো দরজায় টোকা দেয় শিয়াল। এবার পরিচারিকাকে অন্য কাজে যেতে বলে বাদশাহ্জাদি নিজেই উঠে এসে দরজা খুললেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না তিনিও। সে মুহূর্তে শিয়াল ও বাঘ মিলে চট করে কাবু করে ফেলে তাকে। সযত্নে ভরে ফেলে সাথে আনা রেশমী বস্তায়। বাঘ বস্তাটা পিঠে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। বাদশাহ্জাদিকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন বেগ। প্রথম দেখায়ই ভালোবেসে ফেললেন তাকে। তবে এভাবে তাকে নিয়ে আসার জন্য বারবার দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি। অনেকবার ক্ষমা চাইলেন তার কাছে। বেগের বিনয়ী ব্যবহারে খুশি হন বাদশাহ্জাদি। সে সাথে বেগের প্রতি তার পশু বাহিনীর দুই কুকুর, শিয়াল, বাঘ ও সিংহের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তাকে মুগ্ধ করে।
অন্যদিকে তাকে খুশি করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকলেন তিনি। বাদশাহ্জাদিও বেগের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন বোঝা গেল। আরো কয়েকদিন পর বেগ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। সানন্দে সম্মতি জানালেন বাদশাহ্জাদি।
এদিকে প্রাসাদ থেকে মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বাদশাহ্ ভীষণ রেগে গেলেন। ভৃত্যদেরকে ডেকে পাঠালেন তিনি। তাদের বললেন- ‘আমার মেয়ের সন্ধান যে এনে দিতে পারবে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা দিয়ে ঢেকে দেব। আর সন্ধান দিতে না পারলে সবার গর্দান যাবে।’
সবাই তটস্থ হয়ে ওঠে। লোকজন চারটি দলে ভাগ হয়ে বাদশাহজাদির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু অনেক খুঁজেও তার সন্ধান পেল না তারা।
শহরে বাস করত জাদু-টোনা জানা এক বুড়ি। আগেও কয়েকবার নানা কাজে বাদশাহর প্রাসাদে এসেছে সে। বাদশাহ তাকে চিনতেন। সে হাজির হল তার কাছে। বলল- ‘হুজুর! আপনার মেয়েকে চুরি করা হয়েছে। তিনি এখন আছেন পাশের রাজ্যের এক শহরে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।
বাদশাহ্জাদি স্বামীকে পেয়ে খুশি। এখন জাদু শক্তিবলে আমি তাকে এনে দিতে পারি। তবে আমার একটি শর্ত আছে। আপনার জাদুকরদের দিয়ে আমার জন্য একটি উড়ন্ত যান তৈরি করে দিতে হবে। এটাকে দু’ভাবে চাবি দিয়ে চালানোর ব্যবস্থা থাকবে। একটা চাবি দিয়ে চালালে এটা পুব দিকে যাবে, আরেকটা চাবি দিয়ে চালালে পশ্চিম দিকে যাবে।
বাদশাহর নির্দেশে উড়ন্ত জাদু যান তৈরি হয়ে যায়। বৃদ্ধা জাদুকর তাতে উঠে বসে। চালু করতেই যানটি শূন্যে উঠে দ্রুত চলতে শুরু করে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে বুড়ি জাদুকর বেগের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নামে। একটি ঝোপের মধ্যে জাদু যানটি সে লুকিয়ে রাখে। তারপর বেগের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। বেগ শিকারে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন বাড়ির বাইরে এক বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বেগ জিজ্ঞেস করেন- ‘কি ব্যাপার ! কি চাও তুমি?’
বুড়ির চোখ থেকে পানি ঝরে। বলে- ‘কি বলব বাছা! আমার তিনটি ছেলে। বিয়ে-শাদি করে তারা এখন সবাই ভালো আছে। কিন্তু তাদের কারো কাছেই আমার জায়গা হয়নি। এখন রাস্তাই আমার ঠিকানা।’
তার কথা শুনে বেগের মনে দয়া হয়। বলেন- ‘ঠিক আছে, এখন থেকে তুমি আমার বাড়িতে থাকবে।’
এদিকে বেগের সাথে বুড়িকে দেখেই বাদশাহজাদি চিনতে পারেন তাকে। স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন- ‘একে কোথায় পেয়েছ? আর বাড়িতেই বা নিয়ে এসেছ কেন?’
ভালো মানুষ বেগ বলেন- ‘আহা! এভাবে বলছ কেন? অসহায় মানুষ। দু’টি রুটি খেতে পেলে আমাদের জন্য দোয়া করবে।’
বাদশাহজাদি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। কয়েকদিন কেটে যায়। একদিন বেগ তার দলবল অর্থাৎ দু’টি কুকুর, শিয়াল, বাঘ ও সিংহকে নিয়ে শিকারে বের হলেন। বুড়ি এ রকম সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল। বাদশাহ্জাদির কাছে গিয়ে গলায় মধু ঢেলে বলে- ‘আহারে বাছা! কতদিন মন খুলে কথা বলতে পারি না তোমার সাথে। চল, আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলতে বলতে একটু হেঁটে আসি।’
বুড়ির মিষ্টি কথায় বেগের স্ত্রী রাজি হয়ে যান। হাঁটতে হাঁটতে তাকে জাদু যানের কাছে নিয়ে যায় বুড়ি। অদ্ভুত রকমের জাদু যানটি দেখে বাদশাহ্জাদি বলেন- ‘বুড়ি মা! কেমন জিনিস এটা, দেখেছ?’
বুড়ি বলে- ‘এটা মনে হয় উড়তে পারে। চল তো চড়ে দেখি।’
বাদশাহ্জাদি তার সাথে জাদু যানে চড়লেন। বুড়ি যানটির উপরের ঢাকনা নামিয়ে দিয়ে পুবদিকে যাবার চাবি ঘুরিয়ে তা চালু করে। তাই দিক না ঘুরেই শূন্যে ওঠার পর জাদু যানটি পাশের রাজ্যের দিকে চলতে থাকে। এবার বাদশাহজাদি টের পান, বুড়ি তার সাথে শয়তানি করেছে। ভীষণ রেগে উঠে তিনি বুড়িকে বললেন- ‘দুষ্ট বুড়ি! তুমি আমার স্বামীর ভালোমানুষীর সুযোগ নিয়ে বেইমানি করতে চাইছ? এক্ষুনি ফিরে চল। নইলে কঠিন শাস্তি পাবে তুমি।’
কোনো কথা বলে না জাদুকর বুড়ি। একটু পরই বাদশাহর বাড়ির ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে নেমে পড়ে সে জাদু যান নিয়ে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন বাদশাহ। মেয়েকে ফিরে পেয়ে উল্লসিত বাদশাহ্ ওয়াদামত বুড়িকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা উপহার দিলেন।

৩.
বাড়ি ফিরে বেগ দেখলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীও নেই, বুড়িও নেই। আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। এ কি ঘটনা? কিন্তু বাঘা বুঝতে পারে- ঐ বুড়ি ছিল জাদুকর। সেই বেগের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছে। স্ত্রীর চিন্তায় আবার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করলেন বেগ। সবাই মিলে আবার বৈঠকে বসে। বাদশাহর মেয়েকে যেভাবেই হোক, আবার ফিরিয়ে আনতে হবে, এ ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? দীর্ঘ পরামর্শের পর উদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করে বাঘা। ঠিক হয় যে বাঘ ও সিংহকে এ দায়িত্ব দেয়া হবে। কি করে কি করতে হবে তা ভালো করে দু’জনকে বুঝিয়ে দেয় সে।
বাঘ ও সিংহ সন্ধ্যারাতে বাদশাহর প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে পড়ে। লুকিয়ে থাকে তারা। গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে বাদশাহ্জাদির ঘরের দরজায় টোকা দেয় বাঘ। এদিকে বাদশাহ্জাদি এখানে আসার পর থেকেই স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার উপায় খুঁজছিলেন।
নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেছিলেন তিনিও। চোখে ঘুমও ছিল না তার। অত রাতে দরজায় টোকার শব্দ শুনেই লাফিয়ে উঠে দরজা খুললেন তিনি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লেন বাঘ ও সিংহকে দেখে। তারপর…
সকাল হতেই বাদশাহ্র কাছে দুঃসংবাদ পৌঁছে। সাথে সাথে বুড়িকে তলব করলেন তিনি। বলেন- ‘আমার মেয়েকে আবার চুরি করা হয়েছে। এবার যদি তুমি তাকে এনে দিতে পার তাহলে অর্ধেক রাজ্য দিয়ে দেব।’
বুড়ি জাদুকর বলে- ‘জাঁহাপনা, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আবার সেখানে গেলে তারা আমার মাথা মুড়িয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়াবে। এখন তাকে ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায় সৈন্য পাঠানো।’
বুড়ির সাথে বাদশাহ্ একমত হন। শুরু হয়ে যায় রণসজ্জা। বিরাট এক সৈন্যদল সংগ্রহ করলেন তিনি। বেগের শহরের কাছে পৌঁছে যায় তারা।
বেগ শংকিত হয়ে ভাবলেন, এরা আমাকে হত্যা করে সব কিছু ধ্বংস করবে, আমার স্ত্রীকেও কেড়ে নিয়ে যাবে। কি করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। কিন্তু বাদশাহ্জাদির মনে অনেক সাহস। স্বামীকে বললেন তিনি- ‘আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়।’
বাঘা ও তার বাহিনীকে ডাক দিলেন তিনি। এদিকে ব্যাপার-স্যাপার দেখে কি করতে হবে সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই বাঘা তার বাহিনীর সাথে পরামর্শ সেরে ফেলেছিল। সে বেগকে বলে-
‘হুজুর! আপনি একটুও ভয় পাবেন না। আমরাও সৈন্য বাহিনী জোগাড় করছি। একটু ধৈর্য ধরুন।’
পরামর্শ অনুযায়ী তার সাথীরা কাজ শুরু করে। সংকর কুকুর বাড়ির বাইরে গিয়ে ডাকতে শুরু করে- ‘ঘেউ ঘেউ… ঘেউ ঘেউ।’ তার ডাকে একের পর এক অসংখ্য সংকর কুকুর এসে সেখানে জড়ো হতে থাকে। শিয়াল একটু দূরে মাঠের মধ্যে গিয়ে ডাকতে থাকে- ‘হুক্কা হুয়া… হুক্কা হুয়া।’ তার সে ডাকে পিল পিল করে অগুণতি শিয়াল চলে আসে।
বাঘ রাস্তায় গিয়ে গর্জন শুরু করে- ‘হালুম… হালুম।’ কিছুক্ষণের মধ্যে বহু বাঘ চলে আসে সেখানে। সিংহ তার গুরুগম্ভীর হুঙ্কারে আশপাশের এলাকা কাঁপিয়ে তোলে। অল্প সময়ের মধ্যেই সিংহ আর সিংহে ভরে যায় জায়গাটি।
বেগের স্ত্রী অত্যন্ত বুদ্ধিমান বাঘাকে পশুবাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। নির্দেশ দিলেন- ‘বাঘ ও সিংহরা বাদশাহ্র সৈন্যদলকে দু’ভাগে বিভক্ত করে দেবে, আর কুকুর ও শিয়ালরা তাদের গায়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলবে।’
যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পশু বাহিনী ও সৈন্য বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ। এ রকম যুদ্ধ কেউ কোনোদিন দেখেনি। বাঘ ও সিংহের থাবার প্রচ- আঘাতে বহু সৈন্য হতাহত হয়। কুকুর ও শিয়াল বাহিনীও নাস্তানাবুদ করে ফেলে সৈন্যদের। এভাবে বাদশাহর গোটা সেনাবাহিনীই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। প্রাণ নিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে দেশে পৌছেন বাদশাহ্ ও বুড়ি। পশু বন্ধুদের জন্য বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন বেগ ও বাদশাহ্জাদি। তাই পশুবাহিনীর সবাইকে উপযুক্ত আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা।

*দিলফুজা তাশপুলোতভার এ গল্পটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া।

Share.

মন্তব্য করুন