মোড়ের টং দোকানে বসে আমরা পাঁচ বন্ধু যেই তিনটারে পাঁচটা (তিন কাপ চা, পাঁচ কাপে ভাগ করে) চা এর অর্ডার দিয়েছি ওমনি হরমুজ মামা এসে হাজির। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার একটা ফুল কাপ চা।’ হরমুজ মামা আসলে কার রক্তের সম্পর্কের মামা কিংবা কী করে আমাদের মামা হলেন সেটা গুগুল সার্চ করেও বের করতে পারিনি। একে ওকে মামা ডাকতে দেখে আমরাও মামা ডাকি। চাঁদ মামার সাথে আমাদের হরমুজ মামার অনেক মিল। চাঁদ যেমন কবে থেকে মামা হলো তা কেউ বলতে পারে না, আমাদের হরমুজ মামাও তাই। কারো আপন না হয়েও সবার খুব আপন। মামা হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন উদয় হয়। আবার যেভাবে উদয় হয়, সেভাবেই অস্তে চলে যায়। মাঝখানে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ জি বাংলা চ্যানেল! খালি বিনোদন আর বিনোদন। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর বয়ান শুনি।
‘আয় না সবাই মিলে একটা সেলফি তুলি!’ আমরা কেউ নড়ছি না দেখে হরমুজ মামা আবার বললেন, ‘এমন অবহেলা করছিস, সুন্দরবন হলে ডাকের সাথে সাথে বনের সবাই আমার সাথে সেলফি তোলার জন্য ছুটে আসতো।’ হা হয়ে গেলাম কথা শুনে। সুন্দরবনে মানে?
চায়ের কাপের ডাঁটে আঙুল ঢুকিয়ে নাক দিয়ে চায়ের গরম ধোঁয়া টানতে টানতে মামা বললেন, ‘সুন্দরবন মানে সুন্দরবন। কয়েক বছর আগের ঘটনা। তখন ভালোই গরম। সুন্দরবনে গিয়েছি সেলফি মিশন নিয়ে, সিংহের খোঁজে।’
বিল্টু বসে পড়া থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ‘মামা, চাপাবাজির আর জায়গা পাও না? এক কাপ চা মাগনা খাবে খাও, তাই বলে সুন্দরবনে সিংহ আনবে?’

সিংহ ফি । সত্যজিৎ বিশ্বাসহরমুজ মামাও রেগে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ‘তোদের এই এক দোষ। পুরোটা না শুনেই পটর পটর শুরু করে দিস। দিলি তো গল্প বলার মুডটাই নষ্ট করে। নাহ্, আর বলবোই না।’ আমরা চারপাশ থেকে মামার হাত চেপে ধরলাম। আরে মামা, বিল্টুর কথা বাদ দাও, ও বড়দের সাথে কথা বলার জানে নাকি? আরেক কাপ চা খেতে খেতে প্লিজ তুমি বলোতো ঘটনাটা।
চায়ের লোভে নাকি আমাদের অনুরোধে হরমুজ মামা আবার বসে পড়লেন, কে জানে। নতুন কাপের চায়ে একটা চুমুক বসিয়ে ঝাড়া ত্রিশ সেকেন্ড চোখ বুঁজে চুপ করে বসে রইলেন। তারপর চোখ খুলে বেমাক্কা এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আমাদের দিকে। ‘আচ্ছা, ব তো দেখি, সিংহের খোঁজে কেন সুন্দরবন গেলাম?’
আমাদের মধ্যে সেন্টুর বুদ্ধিই বেশি। এসব কুইজ টাইপ প্রশ্নের উত্তর সেই দিয়ে থাকে। আমরা উত্তরের আশায় সেন্টুর দিকে তাকালাম। সেন্টু চশমাটা নাকের দিকে ঠেলে দিয়ে খুব ভাব নিয়ে মুখ খুলল।
‘কারণ, দেশের আর কোথাও সিংহ পাওয়ার সম্ভবনা নেই। একমাত্র ওখানেই সিংহ পাওয়া গেলে যেতেও পারে।’
‘আরে, সিংহ দিয়ে দরকারটা কী, সেটা বলতে পারবি?’
‘অবশ্যই দরকার আছে।’
‘সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। কী দরকার আছে?’
‘দেখ মামা, একটার জায়গায় দুইটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। এবার তুমিই এর উত্তর দাও।’
কাপে বড় একটা চুমুক দিয়ে মামা গর্বের হাসি হেসে বললেন, ‘কথাবার্তা বলার জন্য।’
‘কী! কথাবার্তা বলার জন্য? সিংহের সাথে কথা?’
‘হুম, সিংহের সাথে কথা।’
‘কী কথা?’
‘বনে সেলফি ভালো আসে না।’
‘মানে?’
‘বনের লাইটিং সিস্টেম ভালো না। আর লাইট ভালো না থাকলে ছবি ভালো আসে? তাছাড়া ইয়ে মানে সিংহ এমনিই খুব হিংস্র প্রাণী। তার উপর ইয়া বড় বড় নখ, দাঁত। সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারও পায় না। ক্ষুধার্ত পেটে আক্রমণ করে বসতে পারে কিনা বল?
সেলফি তুলতে মাথা ঝোঁকাতে গিয়ে যদি আমার মাথাটা মুখের ভেতর নিয়ে নেয়? ’
‘তুমি এত ভীতু?’ চান্স পেয়ে ঝেড়ে দিলাম!
‘মোটেই না। তাহলে কি আর সিংহের সাথে কথা বলতে যেতাম? আমি চাই সিংহ থাকবে সিংহের জায়গায়।’
‘সেটা কোথায়?’
‘কেন চিড়িয়াখানায়! খাবারের সুব্যবস্থাসহ লোহার খাঁচায়। খাঁচার সিংহের সাথে ছবি তোলাও খুব সহজ। মোটেও কাঁপে না। ছবিও ঝাপসা হয় না।’
‘কে কাঁপে না? সিংহ নাকি সেলফিম্যান?’
‘দুজনেই।’
‘তোমার প্রস্তাব শুনে সিংহ কী বলল?’
‘কী বলবে আবার? এমনেই বনে থাকতে থাকতে নিয়মিত খাওয়া দাওয়া না করতে পেরে শরীরের অবস্থা কাঁকলাস। সিংহ বলে কী তাঁর মন নেই? তারও কী সেলফি তুলতে ইচ্ছা করে না? আমার প্রস্তাব শুনে এক লাফে রাজি!’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? সেই থেকে সুন্দরবনে আর কোন সিংহ থাকে না।’
‘তাহলে কই থাকে?’
‘কই আবার? আমার সাথে সেই যে চলে এলো চিড়িয়াখানায়, এখনো সেখানেই আছে। বিশ্বাস না হলে ঘুরে আয় চিড়িয়াখানা থেকে। সেলফি তুলতে ক্যামেরা উঠিয়ে দেখ, কেমন হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে পোঁজ দিতে।’

Share.

মন্তব্য করুন