ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভাঙে রাতুলের। রাতুল ওজু করে নামাজ পড়ে নেয়, ভোর রাতে দুটো পানি-পান্তাখেয়ে কাজে ছুটতে হবে। ফিরবে সেই বিকেল গড়িয়ে গেলে। সাথে ফজর আলী চাচাও থাকে। আজ আর ফজর আলী ঘুম থেকে উঠলো না। ফজর আলীর বিছানার পাশে এগিয়ে গেল রাতুল। ছোট্ট একটা ঝাঁকুনী দিয়ে রাতুল বলল, ‘ও চাচা, আজ আর কামে যাবা না। এখনো ঘুম থেকে উঠলে না যে?’
ফজর আলী ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘নারে বাজান, আজ আর বোধহয় কামে যাতি পারলাম না। শরীলডা বড্ড খারাপ লাগতেছে।’
ফজর আলী কষ্ট করে ওঠার চেষ্টা করে। রাতুল বাধা দেয়। ফজর আলীর স্ত্রী শহর বানু এসে বললো, ‘তোর চাচার শরীলডা কদিন ধরে বড্ড খারাপ য্যাতেছে রে বাবা। ভালো একটা ডাক্তার দেখাবার দরকার।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শহর বানু।
রাতুল শহর বানুকে সান্ত¦না দিয়ে বলল, ‘তুমি কোন চিন্তা করো না চাচীমা, এই রাতুল থাকতে তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। ফজর আলী চাচার চিকিৎসা হবে, সোনাভানের ভালো জায়গায় বিয়ে হবে।’
সোনাভান ফজর আলীর একমাত্র মেয়ে। তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো বিয়ে সাদীর ব্যবস্থা করতে পারেনি ফজর আলী। সোনাভান এসএসসি পাশ করতে পারেনি, পরীক্ষা দিয়েছিল দুইবার।
শহর বানু বলল, ‘যাও বাবা, দুটো পানি পান্তা খেয়ে কামে যাও। তোমার চাচার জন্যি আবার ঔষধ-পাতির ব্যবস্থা করতে হবেনে।’
রাতুল ভাত নিয়ে বসে। রাতুলের মাথায় এক রাজ্যের চিন্তা। কোন কিছু ভালো লাগে না তার। সোনাভানের বিয়ে, ফজর আলী চাচার চিকিৎসা, চাচীর জন্য আরো চিন্তা হয় রাতুলের। তার শরীরও ভালো নেই। রক্ত শূন্যতা রোগ কংকালসার দেহ তার। তার মধ্যে আবার নিজের লেখাপড়া। রাতুল নাইট স্কুলে পড়ে। দিনের বেলায় কাজ আর রাতে স্কুল।
রাতুল কাজে যাওয়ার সময় চাচীমাকে বলল, ‘তোমার জন্যি কিছু আনতে হবে নাকি?’
শহর বানু বলল, ‘আমার জন্যি কিছু আনতি হবে না, তোমার চাচার জন্য দুডো ব্যথার বড়ি অ্যানো।’
রাতুল কাজে যায়। দুবেলা কাজ, ওভার টাইম। পয়সাও পাওয়া যায় ভালো। ফজর আলী গেলে ডবল টাকা ঘরে আসে। রাতে ঘরে ফেরে রাতুল। হাতে ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ইটের ঝুড়ি ভুলবশত রাতুলের হাতে মেরে দিয়েছিল কামাল। ভাঙেনি তবে চোট পেয়েছে প্রচুর।
রাতুল ব্যান্ডেজ শুদ্ধ বাড়ী এলে সারা বাড়ী জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। শহর বানু রাতুলের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘এ তুই কি করলি বাজান?’
ফজর আলী বলল, ‘আমি আজ কামে যাতি পারিনি বলে এই অঘটন ঘটেছে।’
সোনাভানও বাদ গেলো না, সেও রাতুলের ব্যান্ডেজ আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল, ‘ইস, খুব লেগেছে ভাইয়া, অনেকখানি কেটে গেছে বোধায়।’
রাতুল কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, ‘আমার তেমন কিছু হয়নি আপা, তোমরা আমার জন্য মন খারাপ করো না। এতো সামান্য ব্যাপার।’
রাতুল রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছে অনেক কথা। তার হাতের যন্ত্রণার চেয়ে মনের যন্ত্রণাটা বেড়ে গেল হঠাৎ করে। সত্যি তো তার ফেলে আসা কষ্টের কাছে হাতের যন্ত্রণা অতি তুচ্ছ।
রাতুলের চোখে ঘুম নেই। মাঝে মাঝে ফজর আলী, শহর বানু ও সোনাভান এসে খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছে রাতুলের। রাতুল উল্টো ওদের সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘এ আমার তেমন কিছু হয়নি, সকালেই আমি আবার কাজে যেতে পারবো।’
শহর বানু হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, ‘নারে বাজান, আমি আর তোরে এ অবস্থায় কাজে যাতি দোব না।’
রাতুল ক্ষীণ হেসে বলল, ‘তোমরা আমারে এত ভালোবাসো চাচীমা!’
রাতুলের চোখে জল টলমল করছে। তখন অনেক রাত। তুলশীডাঙ্গার প্রায় সবাই ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমায়নি রাতুল।

রাতুলের স্বপ্ন দেখা । আবদুল ওহাব আজাদ

দুই.
রাতুলদের গ্রামের বাড়ি আরশাদনগর। এখান থেকে প্রায় একশত কিলোমিটার হবে। রাতুলের সংসারে বাবা-মা আর একমাত্র বোন তুহিনা। বেশ চলছিল রাতুলের সংসার। রাতুল গ্রামের স্কুলে পড়তো। বরাবরই ওর খেলাধুলা আর পাখি শিকারের অভ্যাস ছিল। পড়াশুনোয় মন বসতো না ওর। সেবার বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হলো না। রাতুলের চার বিষয়ে ফেল হয়ে গেল। এতে রাতুলকে প্রমোশন দেয়া হবে না স্রেফ জানিয়ে দিলেন আরশাদনগর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আশরাফ সিদ্দিকী।
রাতুলের বাবাও রাশ ভারী লোক। সে যাত্রা থেকে রাতুলকে বাঁচানো গেল না কোনভাবেই। কপাল মন্দ হলে যা হয়, তাই হলো। তার কদিন আগে সমবয়সী বন্ধুরা মিলে বনভোজন করতে যেয়ে শিকদারের মুরগীর কোঠা থেকে মুরগী চুরি করার সময় হাতে নাতে ধরার সময় উত্তম মধ্যম, তো হোলই, সেই সাথে রাতুলের আব্বা তোরাব সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, রাতুলের জায়গা আর কোনভাবেই এ বাড়িতে হবে না।
মা আমেনা বেগম, বোন তুহিনাকে কেবল নির্বাক দর্শক হয়েই থাকতে হলো। তার উপর পরীক্ষার ফলাফলের এই দশা রাতুলকে বাড়ী ছাড়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে সহায়তা করলো এক সময় তোরাব আলী রাতুলকে বেদম পেটালেন। আর ক্ষীপ্র কন্ঠে বললেন, ‘এ বাড়িতে তোর কোন স্থান নেই, যদি কোনদিন মানুষ হয়ে ফিরতি পারিস তাহলে সেদিনই বিবেচনা করে দেখবো, তোকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়া যাবে কিনা?

তিন.
অবশেষে রাতুলকে বাড়ী ছাড়তে হলো। রাতুল এখন নিরুদ্দেশের পথিক।
এক ঝড় ঝঞ্ঝার রাতে রাতুলকে তুলশীডাঙ্গার নদীর পাড় থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে বাড়ী নিয়ে যায় ফজর আলী। তারপর সেবা শুশ্রুষায় সুস্থ করে তোলে রাতুলকে। সেই থেকে রাতুল ফজর আলীর বাড়ী। অনেকেই জানে রাতুল ফজর আলী আর শহর বানুর একমাত্র সন্তান। আর সোনাভানের সহোদর ভাই।
রাতুলের আব্বা তোরাব আলী চোখে এখন ঠিকমত দেখতে পায় না। কি যেন খুঁজে বেড়ায়। আমিনা বেগম ছেলে শোকে পাগল প্রায়। বোন তুহিনাও স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমেনা বেগমকে কি যেন বলতে চেয়েও বলতে পারে না তোরাব আলী। কেবলমাত্র বিড় বিড় করে। আমেনা বেগম স্বামীর কাছে যেয়ে বলল, ‘তুমি কি কিছু বলবে, রাতুলের আব্বা?’
চোখের কোনায় পানি জমে। তবু কথা বলে না। আমেনা বেগম আবারও স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘তোমার বোধ হয় রাতুলের কথা মনে পড়ছে।’ ঘাড় নাড়ে তোরাব আলী। তোরাব আলী অস্পষ্ট কন্ঠে বলল, ‘আমার রাতুল কবে বাড়ী আসবে, কবে?’ তোরাব আলীর চোখের জল বাধা মানে না। পাশ থেকে তুহিনা ছুটে এসে বলল, ‘তুমি তো ভাইয়াকে আসতে নিষেধ করেছ।’ তোরাব আলী মেয়ের কথার উত্তর দিতে যেয়ে ভাঙা গলায় বলল, ‘রাগের মাথায় বাবা-মারা কত কথাই বলে, তাই কি সারা জীবন কেউ মনে রাখে? আজ কত দিন হলো, রাতুলের চোখে দেখিনি, জানি না আর কোন দিন ওকে কাছে পাবো কি না?’
আমেনা বেগম স্বামীকে অভয় দিয়ে বলল, ‘তুমি রাতুলের জন্য দোয়া করো, দেখবে রাতুল এক দিন মানুষের মতো মানুষ হয়ে ঘরে ফিরবে।’ তোরাব আলী চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না।

চার.
রাতুল এখন অনেকটাই সুস্থ। হাতের ব্যাথাটাও কমেছে। পরদিন কাজে যেতে চায় রাতুল। পথ রোধ করে দাঁড়ায় চাচী শহর বানু। বোন সোনাভান। রাতুল চাচীমাকে এক রকম আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, ‘চাচীমা, চাচা অসুস্থ, তোমার শরীরও ভালো না, এরপরও আমি যদি কাজে না যাই, তাহলে আমাদের সংসার চলবে কি করে?’
শহর বানু হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘আল্লাহ চালাবে বাবা, আল্লাহ চালাবে’।
রাতুল বলল, সে কথা তো ঠিক চাচীমা, তাই বলে বসে থাকলি তো চলবে না। কিছু তো একটা করতে হবে। রাতুল খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে বলল, ‘চাচী ভালো করে শুনে রাখো, সামনে ঈদ, আমার অনেক টাকার দরকার। আমার অনেক কেনা কাটা করতে হবে। আমার তো আর কোন টাকা পয়সা সঞ্চয় নেই তাই সারাদিন রাত কাম কাজ করে আমার অনেক টাকা রোজগার করতে হবে চাচীমা। আর তাছাড়া…’ শহর বানু মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আর তাছাড়া কি বাপ? তুই আমার ফাঁকি দে চলে যাবি না তো সোনা?’
শহর বানু কাঁদতে শুরু করলো। রাতুল চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘মেয়েদের এই একটা দোষ, কিছু হলেই অমনি চোখে পানি। যাও চাচীমা ভাত দাও, খুব ক্ষিধে পেয়েছে। শহর বানু রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো।’

পাঁচ.
রাতুল সামনে ঈদের খরচ জোগাতে রাত ৮টার আগে আর বাসায় ফেরে না। তারপর নাইট স্কুল, লেখাপড়া, সামনে পরীক্ষা তাই রাতজেগে পড়াশুনা করে রাতুল। এসএসসি পরীক্ষার আর খুব বেশি বাকী নেই। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। রেজাল্টের জন্য সে ঘর বাড়ী ছেড়েছে। আর রেজাল্ট ভালো করতে হলে বেশি বেশি লেখাপড়া করতে হবে।

ছয়.
তোরাব আলীকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে গেল আমেনা বেগম। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন, ‘দ্রুত অপারেশন প্রয়োজন। একটি চোখে যত সম্ভব তাড়াতাড়ি লেন্স সংযোজন করতে হবে।’
মাঝে একবার মিনি স্ট্রোক করলো তোরাব আলী। সেই থেকে অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটেন তিনি। অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীকে খুব কেয়ারে রাখার কথা বললেন। সেই সাথে তিনি আরও বললেন, রোগীকে যেন টেনশানে না রাখা হয়। তাহলে কিন্তু আবার স্ট্রোক হতে পারে। আর স্ট্রোক করলে রোগীকে আর কিন্তু ফেরানো সম্ভব হবে না। আমেনা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে তোরাব আলীকে বাড়ী নিয়ে এলো। তুহিনা বলল, ‘এই সময় যদি রাতুল ভাইয়া বাড়ী আসতো, তাহলে বোধ হয় বাপজী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতো।’
আমেনা বেগম আবারো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কোথায় পাবো রাতুল কে, জানিনা সে আজও বেঁচে আছে কিনা?’ আমেনা বেগমের দুচোখ আবারো ছল ছল করে উঠলো।

সাত.
রাতুল এখন পরিশ্রমের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রাত দিন  কাজ আর কাজ, রাতের বাকী সময়টা লেখাপড়া করে কাটায় রাতুল, ঘুমোবার সময় নেই তার। এখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি রাতুলের। এখনো যে অনেক কাজ বাকী, তাকে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে না পারলে সে বাপজীর সামনে দাঁড়াতে পারবে না। রাত অনেক হয়েছে, চাচীমার ঘর থেকে কাশির শব্দ ভেসে এলো। অনেকক্ষণ ধরে শহর বানু কাশছে। ধীর পায়ে শহর বানুর ঘরের দিকে গেল রাতুল।
এক প্রকার রাগ করেই বলল, ‘তোমার কাশি হয়েছে তো আগে বলোনি কেন? আসার সময় ঔষধ আনতাম।’ শহর বানু খুক খুক করে কাশতে কাশতে বলল, ‘তোরে আর কত কবো, তুই আমাগের জন্য যা করলি…।’
শহর বানু কাঁদছে, কথা শেষ নামাতে পারলো না। এবার মেজাজটা আরো বিগড়ে যায় রাতুলের। এক ধরনের চড়া কন্ঠেই রাতুল আবার বলল, ‘আমার জন্য অত ভাবা চিন্তার দরকার নেই কারো, যে কদিন আছি, যার যা হবে সব কিছু খোলাখুলি বলতে হবে আমার।
শহর বানু অতি কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে বলল, ‘কি কলি বাজান, যে কদিন আছিস মানে, তুই সারা জীবনের জন্যি থাকপি, কোনদিন তোরে আমরা যাতি দোব না, কোন দিন না। রাতুলের গলা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদলো শহর বানু।

আট.
মাঝরাতে তোরাব আলী চিৎকার করে বলল ‘রাতুল বাড়ী এসেছে, রাতুল বাড়ী এসেছে।’ তোরাব আলীর চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে গেল আমেনা বেগম বলল, ‘অমন করে চিৎকার করছিলে কেন?’
তোরাব আলী বলল, ‘স্বপ্নে দেখলাম, রাতুল ভালোভাবে পাশ করে বাড়িতে ফিরে এসেছে, সেই আনন্দে চিৎকার করছিলাম’।
আমেনা বেগম বলল, ওটা তোমার দুঃস্বপড়ব রাতুলের আব্বা…।’
অনেক আশা বুকে বেঁধে তোরাব আলী বলল, ‘আমেনা বেগম, অনেক মানুষতো বদলে যায়, দেখো আমার রাতুল একদিন প্রকৃত মানুষ হয়ে ঘরে ফিরবে।’
আমেনা বেগম আবারও হাতাশার সুরে বলল, ‘আমার রাতুল কি আর বেঁচে আছে?’
তোরাব আলী আমেনা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল।

নয়.
আজ রাতুল অনেক টাকার বাজার করেছে। ঈদের বাজার। ফজর আলীর জন্য লুঙ্গি-পাঞ্জাবী, শহর বানুর জন্য শাড়ী-শায়া, ব্লাউজ, সোনাভানের জন্য দামী একটা থ্রি পিচ আর কিছু সাজ গোজের জিনিস, সঙ্গে একটা দামী হারও এনেছে রাতুল।
শহর বানু সব কিছু উল্টে-পাল্টে দেখে বলল, তোর জন্যি তো কিছুই আনিস নি বাজান? সব তো আমাগের জন্যি আনলি? রাতুল মুরুব্বীর ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি এখন বাড়ির গার্জিয়ান, আগে তো তোমাদের নতুন পোষাকের ব্যবস্থা হোক, তারপর আমার কথা ভাবা যাবে।’
শহর বানু এক রকম রুক্ষ মেজাজেই বলল, ‘ঈদের দিন আমরা কেউ নতুন জামা কাপড় পরবো না। যদি তুই কিছু নতুন জিনিস না নিস।’
রাতুল কষ্ট করে এক গাল হেসে বলল, ‘ঠিক আছে চাচী মা ঠিক আছে, আমি তোমাদের কথা রাখবো, আমিও নতুন জামা গেঞ্জি নেবো।’ শহর বানুর মুখখানি আনন্দে ঝলমল করে উঠলো।

দশ.
গতকাল এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। মহান আলাহ রাব্বুল আলামীন তার মুখ রক্ষা করেছেন। তুলশীডাঙ্গা নাইট স্কুল থেকে সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছে রাতুল। খুব অল্প নম্বরের জন্য এ+ হয়নি। রাতুল শুকরিয়া আদায় করে ২ রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিল। মুহূর্তের মধ্যে রাতুলের বাপজী ও মায়ের মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠলো, কতদিন তাদের সঙ্গে দেখা হয় না, তাঁরা হয়তো রাতুলকে ভুলেই গেছে। সন্ধ্যায় পরীক্ষা পাশের মিষ্টি এনে খাওয়ালো। ফজর আলী, শহর বানু, সোনাভান সহ বাড়ীর পাশের অনেকেই। খুশির জুয়ারে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, যখন শুনলো রাতুল এই ঈদে তার গ্রামের বাড়িতে যাবে। সবাই এসে বাঁধ সাধলো কিছুতেই তারা রাতুলকে গ্রামে যেতে দেবে না।
রাতুল বলল, এই একটা অনুরোধ আমার রাখতেই হবে তোমাদের। আমার বাবা মা আর বোন টাকে আজ আমি কয়েক বছর ধরে দেখিনি। আজ আমার পাশের সংবাদটা তাদেরকে অন্ততঃ দিতে যেতে হবে। তবে আমি আবার আসবো। তোমাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না।
সবার মন ভারাক্রান্ত। কেউ চোখের জল আটকাতে পারলো না।

এগারো.
একদিন পরে ঈদ। তোরাব আলীর শরীর ভেঙে গেছে আগের তুলনায়। চোখের দৃষ্টি কমে গেছে। আমেনা বেগমও রোগে শোকে ভারাক্রান্ত।
তুহিনা ভাইয়ের শোকে দিশেহারা, রাতুল বিনে এভাবেই অনেক ঈদ কেটেছে তাদের। হঠাৎ বাড়ীতে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল।
ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা দৌঁড়ে এসে বলল, ‘রাতুল ভাইয়া এসেছে, রাতুল ভাইয়া এসেছে।’
সবার দৃষ্টি এখন সেদিকে। রাতুল দৌঁড়ে এসে তোরাব আলীক কদম বুছি করলো, তারপর মাকে। তুহিনা ছুটে এসে রাতুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই এতদিন কোথায় ছিলি ভাইয়া?’
রাতুল বলল, ‘সে অনেক কথা, পরে সব বলবো, আপাতত, নতুন কাপড়- চোপড় গুলো রাখ, সবার জন্য ঈদের নতুন পোষাক রয়েছে এই ব্যাগটাতে।’ রাতুল কাঁদছে, তোরাব আলী ও মা সান্ত্বনা দিচ্ছে সবাইকে।
রাতুল ব্যাগ থেকে প্রশংসা পত্র খানি বের করে তোরাব আলীর সামনে মেলে ধরে বলল, ‘বাপজী, আমি এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছি। অল্পের জন্য এ+ হয়নি। এই দেখো তুলশীডাঙ্গা নাইট স্কুলের প্রশংসাপত্র। এখনো মার্কশীট, সার্টিফিকেট আসেনি।
প্রশংসা পত্রের উপর তোরাব আলীর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। সারাবাড়ী জুড়ে এখন কান্নার রোল চলছে, এ বুঝি আনন্দের কান্না।

Share.

মন্তব্য করুন