গুয়াতেমালার গ্রীষ্মপ্রধান নিচু অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত মায়ান সাম্রাজ্য বা মায়া সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি সময়ে শক্তি, শৌর্য এবং প্রভাবে সফলতার শীর্ষে ওঠে এই মায়ান সভ্যতা। মায়ানরা কৃষি, মৃৎশিল্প, হায়ারোগ্লিফিক লিখন, ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা তৈরি, গণিতশাস্ত্র ইত্যাদিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত করে এবং আধুনিক পৃথিবীর জন্য নানা রকম চিত্তাকর্ষক এবং দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক শিল্পকর্ম রেখে গেছেন। মায়ায় খনন কাজে আবিষ্কৃত হয় বিভিন্ন প্লাজা, মন্দির, প্রাসাদ, পিরামিড, এমনকি একটি কোর্ট যেখানে বল দিয়ে খেলতে হয়- এমন খেলাগুলো হতো। আর এই কোর্টটি মায়া সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তবে মায়া সভ্যতার সবচেয়ে বড় বড় পাথুরে নগরীগুলো ৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে মায়া সাম্রাজ্যের নাটকীয় পতনের কারণ সম্পর্কে আজও পন্ডিতরা দ্বিধান্বিত এবং বিতর্কিত।মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস । তমাল হোসেন
মায়া সভ্যতা মেসো আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী আদিবাসী সমাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। মেসো আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর থেকে ভিন্ন এই মায়ানদের সভ্যতা ছিলো ইউক্যাটান উপদ্বীপ এবং পুরো গুয়াতমালা নিয়ে গঠিত ভৌগোলিক ব্লকের কেন্দ্রবিন্দু। এই ব্লকের আরো কিছু অংশ হলো বেলিজ এবং মেক্সিকোর তাবাস্কো ও চিয়াপাস রাজ্য, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের পশ্চিম অংশ। এই মানচিত্র দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেছেন যে, মায়া সভ্যতা অন্যান্য মেসো আমেরিকান সম্প্রদায়ের দ্বারা আক্রমণ থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদেই ছিল। আর এই বিস্তৃতির মধ্যেই মায়ানরা স্বতন্ত্র পরিবেশ  সাংস্কৃতিক পার্থক্যসহ ৩টি ভিন্ন ভিন্ন উপ-এলাকায় বসবাস করত। যার মধ্যে উত্তরের ইউক্যাটান উপদ্বীপ এবং মেক্সিকো, বেলিজ ও হন্ডুরাসের সংলগ্ন অংশ অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি এবং দক্ষিণাংশ উঁচু ভূমি যা গুয়াতেমালালার পাহাড়ি অঞ্চল। নিচু অঞ্চলের এই মায়ানরা খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ থেকে ৯০০ সালের মধ্যে সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করে এবং এই সময়ের মধ্যেই বিখ্যাত পাথুরে স্থাপত্যগুলো নির্মাণ করে যা এই অঞ্চলের অভিযাত্রী এবং বিদ্বানদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস । তমাল হোসেন
মায়ান সাম্রাজ্যে মনুষ্য জনবসতির সূত্র ঈসা (আ)-এর জন্মের ১৮০০ বছর পূর্বে। একে মায়া সভ্যতার প্রি-ক্লাসিক বাত প্রাতিষ্ঠানিক সময়কাল বলা হয়। প্রথম দিকে মায়ারা ছিলো কৃষিনির্ভর। তারা বিভিন্ন শস্য যেমন: ভুট্টা, মটরশুঁটি, স্কোয়াশ এবং কাসাভা উৎপাদন করত। মধ্যপ্রাচ্যকালীন সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে, মায়ান কৃষকরা উঁচু এবং নিচু উভয় অঞ্চলেই তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। আর এই মধ্যপ্রাচ্যকালীন সময়েই দেখা যায় মেসো আমেরিকার প্রথম বড় কোন 
সভ্যতা যার নাম ওলমেক সভ্যতা। জাপোটেক, টটোন্যাক, টিওটিহুকান এবং অ্যাজটেকদের মত মায়া সভ্যতার মানুষরাও ওলমেক সভ্যতা থেকে অনেক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসেছে।মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস । তমাল হোসেন
এমনকি তাদের সংখ্যা ব্যবস্থা এবং বিখ্যাত মায়া ক্যালেন্ডারেরও উৎপত্তি ওলমেক সভ্যতা থেকেই। কৃষি কাজ ছাড়াও এই প্রি-ক্লাসিক মায়া যুগেই সংস্কৃতির অনেক উন্নতি সাধিত হয়। এ সময়ই তারা পিরামিড তৈরি, শহর নির্মাণসহ পাথুরে বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। এ পর্যায়ের শেষে নির্মিত হয় মিরাডোরের শহর যা উত্তরীয় পিটেনে অবস্থিত এবং এটি প্রি-কলম্বিয়ান আমেরিকান ইতিহাসের অন্যতম বড় শহর। আকারে এই শহর মায়া সাম্রাজ্যের রাজধানী তিকালকেও ছাপিয়ে গেছে। আর এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে ক্লাসিক মায়া সভ্যতার শত বছর আগে থেকেই মায়া সভ্যতা ছিলো অলঙ্কৃত।
ক্লাসিক মায়া সভ্যতায় বেশির ভাগ মন্দির ও রাজপ্রাসাদ নির্মিত হয় যা দেখতে অনেকটা পিরামিডের মত এবং কারুশিল্প ও শিলালিপি দ্বারা সুসজ্জিত। আর এই দৃষ্টিনন্দন স্ট্রাকচারের কারণেই মায়ারা মেসো আমেরিকার অন্যতম গ্রেট আর্টিস্ট হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত মায়ারা গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলো। বিশেষ করে শূন্যের ব্যবহার এবং ৩৬৫ দিনের ওপর ভিত্তি করে একটি জটিল ক্যালেন্ডার পদ্ধতির উন্নয়ন।মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস । তমাল হোসেন
প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষকরা মায়াদের একটি লেখক এবং পুরোহিতদের শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা মনে করলেও পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন কাজকর্ম, শিলালিপি ইত্যাদি পরীক্ষা করে জানা যায় প্রতিদ্বন্দ্বী মায়াদের যুদ্ধ, নিপীড়ন এবং ধর্মের জন্য মানুষ আত্মত্যাগ সম্পর্কে। মায়া  সভ্যতার মানুষদের অন্যতম বিখ্যাত ও বিস্ময়কর ক্ষমতা হলো বনাঞ্চলের মধ্যেও মায়া সভ্যতার মত এতো বড় একটি সভ্যতা গড়ে তোলা। ঐতিহ্যগতভাবে, প্রাচীন এই জনগোষ্ঠী শুষ্ক জলবায়ুতেই উন্নতি লাভ করেছে, যেখানে পানি সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কিছু নৌচলাচলযোগ্য নদী। ফলে সেখানে সেচব্যবস্থারওত তেমন প্রয়োজন ছিলো না।
২০ শতকের শেষের দিকে এসে, গবেষকরা একমত হয়েছেন যে, তখন নিচু ভূমির জলবায়ু ছিলো আসলে পরিবেশগতভাবে খুবই বৈচিত্র্যময়। যদিও বিদেশী আগ্রাসকরা এ অঞ্চলে সোনা ও রূপার স্বল্পতায় হতাশ হয়েছিলো, তবে মায়ানরা গ্রহণ করেছিলো প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার সুবিধা। যার মধ্যে ছিলো চুনাপাথর আগ্নেও শিলা এবং লবণ। পরিবেশগত ছাড়াও এখানে আরো অনেক মূল্যবান সম্পদ ছিলো যেমন: কুয়েৎজাল পালক, জেড, সামুদ্রিক খোলক ইত্যাদি।মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস । তমাল হোসেন
খ্রিস্টপূর্ব আট শতকের শেষ দিক থেকে নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ে মায়া সভ্যতায় এমন এক অজানা কিছু ঘটেছে যা এই সভ্যতার ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। ৯০০ খ্রিস্টাব্দের আগেই এক এক করে দক্ষিণের নিম্নভূমিতে অবস্থিত ক্লাসিক শহরগুলো পরিত্যক্ত হয়, ফলে ঐ অঞ্চলে মায়া সভ্যতার মৃত্যু হয়। আর এই রহস্যজনক পতনের কারণ এখনো অজানা যদিও অনেক পন্ডিতই নিজেদের মত করে বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন। তবে এর মধ্যে তিনটি তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেয়া যায়। কেউ বিশ্বাস করতো যে, মায়ার জনসংখ্যা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিলো। আর যা মায়ার পরিবেশ সহ্য করতে পারেনি। আবার অনেকে মনে করেন, প্রতিনিয়ত পরস্পরের সাথে যুদ্ধের ফলেই মায়া ধ্বংস হয়েছে। আর আরেকটি তত্ত হলো পরিবেশের বিপর্যয়।
হয়তো মায়া সভ্যতায় এমন কোন খরা, বন্যা বা অতিকায় শক্তিশালী প্রাকৃতিক কিছু আঘাত হেনেছিলো যার ফলে প্রাচীন এই মায়া সভ্যতা ধ্বংস হয়। তবে হয়তোবা মায়া ধ্বংসের কারণ এসবগুলোই। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, নিজেদের সাথেই যুদ্ধ আর কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আর স্প্যানিশ আক্রমণকারীরা মায়া সভ্যতায় আসার আগেই মায়া সভ্যতা চাপা পড়ে যায় সবুজ বনাঞ্চলের নিচে।

Share.

মন্তব্য করুন