নাসা তাদের গবেষণা পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রাণী ব্যবহার করেছে। এসব প্রাণীদের বিভিন্ন বৈশিষ্টকে কাজে লাগিয়ে পরিচালিত হয়েছে নানা রকম গবেষণা। তেমনই গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছ ফলের মাছি বা ফ্রুট ফল।
মানুষ নামক বুদ্ধিমান প্রাণীটির সাথে এই ক্ষুদ্রাকার মাছির আশ্চর্যজনক ভাবে অনেক মিল রয়েছে। এর কারণ হিসেবে নাসার এক জীববিজ্ঞানী শারমিলা ভট্টাচার্য বলেন, ৭৭% বহুল পরিচিত মানুষের রোগবাহী জীন এর সাথে ফলের মাছির জেনেটিক কোড এর যথেষ্ট মিল রয়েছে এবং স্তন্যপায়ীদের সাথে এই মাছির প্রোটিন ক্রমের ৫০% মিল রয়েছে।
এটি বিস্ময়কর কিন্তু খুবই সাধারণ ফলের মাছি। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল Drosophila melanoster । ছোট-খাট, চিকন-চাকন এই মাছি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। যদিও তারা পচা কলা খেতে পছন্দ করে। পিন আকারের ক্ষুদ্র মস্তকবিশিষ্ট এই মাছি দিনে প্রায় শতটি ডিম পারতে সক্ষম।
স্তন্যপায়ী আর মানুষের সাথে এত মিল বলেই এরা জেনেটিক রিসার্চল্যাব এ বহুল পরিচিত। শুধু তাই নয় মানুষের বিকল্প এক প্রাণী হিসেবে তাদের বেশ সুখ্যাতি আছে। তাছাড়া এরা খুব অল্প সময়েই বংশবিস্তার করতে সক্ষম। ফলে খুব অল্প সময়েই এদের প্রজন্ম সম্পর্কে গবেষণা করা যায়। এমনকি ইতিমধ্যে এদের জিনোমের সম্পূর্ণ ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া প্রাকিন্সন এবং হান্টিংটনসহ বেশ কিছু মানব রোগের জেনেটিক মডেল হিসেবেও এদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
মূলত এসব কারণেই এসব ফলের মাছি হলো এবার নভোচারীদের জেনেটিক মডেল। কিন্তু কেনই নাসার বিজ্ঞানিরা মাছিকেই বেছে নিলেন মানুষের জেনেটিক মডেল হিসেবে? এ ব্যাপারে রয়েছে ইতিহাস, যা শুরু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে।
স্পেসে মাছিদের পাঠিয়ে গবেষণা করার কথা বলা হয়। এই গবেষণার নাম দেওয়া হয় ড্রসোফিলা। গবেষণার মাধ্যমে ড্রসোফিলা এবং মানুষের জীনের উপর মহাকাশ ভ্রমণের প্রভাব জানা সম্ভব হবে। এটা নাসার কাছে খুবই আগ্রহের বিষয়। কেননা মহাকাশ ভ্রমণের সময় নভোচারীরা মহাকর্ষ বলের বাহিরে চলে যায়। যেমন মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণের সময় একজন নভোচারী যাত্রার শুরুতে নিজের ওজন কয়েক গ্রাম অনুভব করবে, পরে ওজন শূন্য গ্রাম হয়। আবার মঙ্গলে নামার সময় ওজন কয়েক গ্রাম হয়। কিন্তু এই সব পরিবর্তনের সাথে সাথে জীনরা ঠিক কী রকম প্রতিক্রিয়া করবে? তারা কি কোন নতুন বা অপ্রত্যাশিত ভাবে নিজেদের প্রকাশিত করবে? বেকিংহাম বলেন, জীনরা কোষকে প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেয়। মানবদেহে ৫০০০০ এর মতো বিভিন্ন রকমের প্রোটিন আছে এবং এরাই মূলত সব কাজ করে থাকে। এরা আমাদের খাদ্য হজমে, রক্ত জমাট বাধা, ক্ষত নিরাময়সহ অনেক কাজেই সাহায্য করে থাকে। এরা আমাদের কোষ ও টিস্যু গঠন করে। তাই মহাকাশে কম মহাকর্ষণের জন্য জীনরা যদি ভিন্ন গঠনের প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেয়, তাহলে আমাদের শরীরে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটতে পারে।

মাছির মহাকাশ যাত্রা । শাহেদ উদ্দিন
মহাকাশ ভ্রমণ জেনেটিক কাজে প্রভাব ফেলে এ ব্যাপারে গবেষকরা নিশ্চিত হলেও, আসলে ঠিক কোন কোন জীনে বা কীভাবে প্রভাব ফেলে তা এখনও তারা বের করতে পারেননি।
আর এ জন্যই ফ্রুট ফ্লাই বা ফলের মাছি। বেকিংহামের টিম মহাকাশে আই. এস. এস-এ থাকাকালে ড্রসোফিলার ৯টি প্রজন্ম পর্যন্ত প্রজনন ঘটাবে এবং প্রতি প্রজন্মে প্রায় ১২০ টি করে মাছি থাকবে। প্রতি ব্যাচ থেকে ৩টি করে মাছি সংগ্রহ করে হিমায়িত করা হবে। পৃথিবীতে ফিরে এসে তারা এইসব সংগৃহীত মাছির আর. এন. এ এবং প্রোটিন পরীক্ষা করবেন এবং দেখবেন কোন জীনগুলো অরবিটে বেশিবা কম সক্রিয় ছিল।
মহাকাশে আই.এস.এস-এ থাকার জন্য এই সব মাছিদেরও একটি বিশেষ ঘর থাকবে এবং তারা এদের সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করবেন। এইসব মাছিরা তাদের মহাকাশ যাত্রা শুরু করবে ডিমরূপে এবং স্পেস ষ্টেশন এ পৌছবে লার্ভার আকারে। বেকিংহাম আশা করেন পৃথিবীর ৯০ দিনের মধ্যেই এইসব বাচ্চা মাছিরা বড় হবে, প্রজনন করবে এবং এক জাঁক মাছিতে পরিণত হবে।
একদিন মানুষও হয়ত এভাবে মহাকাশে বা মঙ্গলে যাবে এবং দীর্ঘকাল সেখানে বসবাস করবে। তখন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাদের কী পরিবর্তন ঘটতে পারে তারই এক অগ্রিম উদাহরণ হয়তবা এই ফলের মাছিরা আমাদের দিতে পারবে। তাই মাছি বলে এদের আর অবহেলা করা চলবে না।

Share.

মন্তব্য করুন