একটা মলা মাছ, একটা চেলা মাছ, আর একটা ঢেলা মাছ। তিন জনের মধ্যে খুব মিল। মিলের একটা কারণও আছে। সেটা হলো, তাদের কোন ছেলে নেই। তিন জনেরই একটি করে ফুটফুটে মেয়ে। মেয়ে তিনটির মধ্যেও খুব মিল। তারা একে অপরের সই।
মলা, চেলা আর ঢেলার মেয়েদের বাস ভাটির দেশের উত্তর প্রান্তে; ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী এক গ্রামের বিশাল ঝিলে। ঝিলটা দুধকুমার নদের খুব কাছেও নয় আবার দূরেও নয়। বাঁধের আড়ালে এক গহীন ঝিলে ওদের আপন জগত। তবে এখান থেকে ব্রহ্মপুত্রের তীর একটু কাছেই হবে।
মাছমেয়েরা ঝিলের জলে ভালই ছিল। কিন্তু যখন তারা শৈশব পেরিয়ে বালিকা বয়সে পা রাখল তখন তাদের মতিগতি গেল পাল্টে। মলার মেয়েটা বলল, এই ঝিলের পরে আছে এক বিল, সে এক তিন প্রহরের বিল; সেখানে গেলে আমাদের জীবন ধন্য হয়ে যেত। চেলার মেয়েটা সায় দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ। সেদিন এক মাছরাঙ্গা তার বউকে বলল, চলো, বেড়িয়ে আসি। বউ বলল, কোথায়? তারপর মাছরাঙ্গাটি সেই বিলের কথা বলল।
এবার ঢেলার মেয়েটি মুখ খুলল, শুনেছি খুব সুন্দর! তবে ওখানে পদ্মপাতার ওপর গোখরোর ছানাপোনারা নাচানাচি করে। ঢেলার মেয়েটি আঁতকে ওঠে। বলো কী! সর্বনাশা কথা; ওরাতো আমাদের কামড়ে বিষ ঢেলে দেবে। কে বলেছে তোমাকে এ কথা?
ঝিলের উত্তর পূর্ব কোণে যে কচুরিপানার দল আছে। তার তলায় বাস করে এক ঝাঁক কৈমাছ। সেই ঝাঁকের দলনেতা জানিয়েছে আমাকে। চেলার মেয়ের জবাব।
দলনেতা জানল কী করে? চেলার মেয়ের প্রশ্ন ।
গেল আষাঢ়ের এক থইথই বৃষ্টির দিনে সর্দার কৈয়ের সাথে আরও কয়েকটা কৈমাছ জোট পাকায়। তারপর যখন ঘোর বৃষ্টিতে প্রচণ্ড বজ্রপাত হচ্ছিল তখন তারা কানকো হেঁটে ওই ঝিলের জলে চলে যায়। চেলার মেয়ে বলল। তারপর?
তারপর আর কী, গোখরোর ফোঁসফোঁসানি শুনে উল্টো চলে এলো। ওদের দু’জনের কথা শুনে মলার মেয়েটি বলে, শোন, ও সব কই সাহেবদের গালগল্পও হতে পারে। নিজেরা একটু কানে হাঁটতে পারে তো, তাই যত রাজ্যের গল্প ওরা বানাতে পারে। তবু তোমরা যখন বলছ, তা হলে এবারের মতন ঝিলযাত্রা স্থগিত করি। তার চেয়ে চলো আমরা নদীযাত্রায় বের হই। সেটা হবে এক চমৎকার পরিভ্রমণ।
ঢেলার মেয়েটি বলল, নদীভ্রমণ আবার কী? চেলার মেয়েটি বলল, তাও বুঝলে না? আমরা এখান এক নদীতে যাবো, সেই নদী থেকে আরেক নদীতে। উহ্ কী দারুণ হবে!
মলার মেয়েটি একটু আমতা আমতা করে বলল, দারুণ হবে তো বুঝলাম, কিন্তু বিপদও আছে। আমরা কিন্তু সমুদ্রে ভেসে যেতে পারি।
সমুদ্র আবার কী? চেলার মেয়েটির প্রশ্ন।
ঢেলার মেয়ের সবকিছুতেই সবজান্তা ভাব। সে বলল, তাও জানো না? সাগর হলো নদীদের মামাবাড়ি। তাহলে চলো নদীপথ ধরে নদীদের মামাবাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসি। কথাটা বলল মলা মাছের মেয়েটা।
তিনটি মাছের দুরন্ত তিনটি মেয়ে হইহই করে উঠল। ঠিক হলো, তারা অভিযানে বের হবে এবং বিষয়টি কাউকে জানানো যাবে না।
অতঃপর মলার মেয়ে মেলি, চেলার মেয়ে চেলি আর ঢেলার মেয়ে ঢেলিটা মুখে কুলুপ আঁটল।
সে রাতে মেলি, চেলি আর ঢেলির চোখে ঘুম নেই। তারপর রাতটা পেরিয়ে ভোরটা যখন ‘ধলপ্রহর’ তখন ওরা তিন জন বেরিয়ে পড়ে। বিষয়টা ওদের মা বাবাও জানল না। ঝিলের স্বচ্ছ জলে ডুবে থাকা শাপলার ডগা, কলমির লতা, শেওলার ঝোপ, শালুক লতার ঝালর আর নানান ধরনের লতার জটাজাল পাশ কাটিয়ে তরতর সাঁতার কেটে মেয়ে তিনটি ঝিলের মুখে চলে আসে।
ঝিলের এ প্রান্তের মুখটা খালের মতন। দু’পাশে রাস্তা ওপরে কাঠের পুল। মুখটাতে জেলেদের ভেসাল পাতা রয়েছে। ভেসালের জাল দেখে মাছমেয়েরা আঁতকে ওঠে। ওরে বাবা! এর ভেতরে ঢুকলে আর রক্ষা নেই। সোজা টেনে তুলে মাছের ডালায় ছুঁড়ে ফেলবে। তারপর হাটে গিয়ে হাটুরেদের খালুইয়ে গিয়ে উঠবে।
ভেসাল বড় ভয়ংকর ফাঁদ! নিষ্ঠুর জাল। ছোট ছোট মাছগুলোকে একেবারে পানি থেকে সেঁকে তোলে। মেলি, চেলি আর ঢেলি সতর্ক হয়ে যায়। খুব সাবধানে জালের নিচ দিয়ে ঘাড়মাথা গুঁজে পার পাবার ফাঁক খোঁজে। কিন্তু কোথা থেকে এক গোঁয়ার গজারমাছ এসে ওদের গিলে ফেলার ভয় দেখায়। মাছমেয়েরা ভয়ে দিশেহারা হয়ে ভেসালজালের কোলের ভেতরেই ঢুকে পড়ে। খানিক পর বুড়ো জেলেটা অলস-দুর্বল দেহ নিয়ে ভেসালের ওপর চড়ে বসে। জালটা ধীরেধীরে ওপরে উঠতে থাকে। অসংখ্য মলা, ঢেলা, চিংড়ি-পুটির সঙ্গে ওরাও লাফাতে থাকে জালের ওপর। কেউ তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে পানিতেই পড়ে যায়। ভাগ্যক্রমে ওরাও গিয়ে পড়ল ঝিলের মুখে, একেবারে কাঠের পুলের পাশে। ব্যস, পড়ে গিয়ে দে ছুট ধানক্ষেতের ভেতরে । ছুটতে ছুটতে হঠাৎ মেলি থমকে দাড়িয়ে বলল, কী হলো ?
ঢেলি বলল, ও হ্যাঁ বুঝেছি। এখানে আবার বক সাহেবরা সাধু সেজে বসে থাকেন। হ্যাঁ, উনাদের ধ্যান ভাঙ্গা যাবে না। ওই দেখ, ধবধবে সাধুগণ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বকধার্মিক।
তারপর খুব সাবধানে জায়গাটা পার হয়ে ওরা হাল ছেড়ে বাঁচে। তারপর আরও খানিকপথ ফুরফুরে মেজাজে এগুলেই কয়েকটা তিঁতপুটি, খোলসে আর ডালকানার সঙ্গে দেখা হয়। ওরা ডেকে বলল, এই যে আপুরা, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
আমরা নদীদের মামা বড়িতে যাত্রা করেছি। সেতো ভাটির দেশের শেষ সীমানায়, সেই সর্ব দক্ষিণে। তা এদিকে কোথায় যাচ্ছো? আমরা যাবো ব্রহ্মপুত্রের বুকে; ওখান থেকে যাবো যমুনায়। চেলিটা বলল।
ওমা, তোমরাতো পথ ভুল করেছো। তোমরা সীমানা পেরিয়ে দুধকুমার নদে গিয়ে পড়ছ। এই সোজা যাও। নাক বরাবর সীমান্ত ছুঁয়েছুঁয়ে দুধকুমার।
দুধকুমার নদীর কথা শুনে ঢেলি আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে, আরে শোন শোন চেলি, ও মেলি, মন দিয়ে শোন। এই পথে নাকি দুধকুমার আছে। আহা ওই নদী আমার দাদার দাদা, তার দাদাদের নদী; বাবা আমাকে দুধ কুমারের কত গল্প শুনিয়েছে। চল যাই, একটু ঘুরে আসি। খলবল করে একগাল কথা বলে ঢেলিটা ছটফট করতে লাগল।
মেলি বলল, না সেটা হচ্ছে না। দুধকুমার তোমার বাপদাদার বাড়ি বলে সেখানে যদি যাও তবে আমাকেও যেতে হবে ধরলানদীর কূলে। ওই নদীতেই আমাদের পূর্বপুরুষরা থাকে। চেলি এবার চেঁচিয়ে উঠল, তা হলে আর তিস্তার বুকে যাবো না কেন? ওটাতো আমার মামাবাড়ি।
মেলি, চেলি আর ঢেলির কথা শুনে একটা তপসে মাছ তার গোঁফ নেড়ে বলল, তোমরা যদি যারযার নদীর কাছে যাও তবে অনেক সময় লেগে যাবে। তার চেয়ে বরং এক কাজ করো, তোমরা ওই ব্রহ্মপুত্র নদের মুখে গিয়ে ভেসে যাও। এভাবে ভাসতে ভাসতে তোমরা তোমাদের নদীর দেখা পাবে।
জ্ঞানী তপসের কথা শুনে বিস্ময়ে হা হয়ে যায় মাছমেয়েরা। ওরা এক সঙ্গে চিল্লিয়ে বলে, সেটা কী করে সম্ভব?
শোন মেয়েরা, এটা খুবই সম্ভব। কারণ এই তিস্তা, এই ধরলা, এই দুধকুমার সকলেই তার উৎস থেকে বয়ে বয়ে শেষতক ব্রহ্মপুত্রের বুকে গিয়ে মিশেছে।
কোথায় সেই ব্রহ্মপুত্র?
আর কিছুদূর এগিয়ে যাও। তোমরা তার কলস্বর শুনতে পাবে।
বিদায় জ্ঞানী বন্ধু তপসে, বিদায় ছোটবন্ধু ডালকানা ; যদি ফিরে আসি আবার দেখা হবে।
তরতর করে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায় মাছমেয়েরা। যেতে যেতে কত বিল, ঝিল, নালা পার হতে হয়। এভাবে সারাদিন কেটে যায়। বেলা গড়িয়ে গেল। ওরা ক্লান্ত। কে জানে ব্রহ্মপুত্র আর কত দূর! ঢেলি বলল, না আর বেশী দূরে নয় বোধহয়। ওই যে একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে, ওই যে মানুষজন হেঁটে যাচ্ছে। পুলের নিচ দিয়ে খালের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ওই স্রোতেই আমাদের বয়ে যেতে হবে। মেলি বলল।
ঠিক আছে রাতের যাত্রা বিপদজনক । এখন তো সন্ধ্যা হয়ে এলো। চেলি বলল। ঝিলের পাড় ঘেষে শাপলাদলের একটা বড় পাতার নিচে ওরা আশ্রয় নেয়। একটু দূরে রাস্তা। সূর্য ডুবেছিল ওই পশ্চিম তীরে। আর ওরা এখন পূর্বপাড়ে।
একটা কাঁকড়া পিলপিল করে হেঁটে এলো ওদের কাছে। মেয়ে তিনটি ভয়ে একটু জড়সড় হলো। চিমটা দিয়ে আঁকড়ে ধরবে না তো? কিন্তু না, কাঁকড়া মশাই বেশ গুরু গভীর স্বরে বলল, কী ব্যাপার, বাড়ি পালিয়েছো বুঝি? চটপটে চেলিটা বলল, না মানে… মানে আমরা একটু সমুদ্র সফরে বের হয়েছি।
ওরে বাব্বাহ, তোমাদের সাহস তো দেখছি কম না! বারবিল আর তেরঝিল খানাখন্দ, ডোবানালা পেরিয়েই তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছ ; তারপর ব্রহ্মপুত্রের বুকে পড়লে তো ভেসেই যাবে। কাঁকড়া বলল।
হ্যাঁ, আমরা এভাবে ভেসেভেসেই যমুনায় গিয়ে পড়ব, তারপর মিলবো গিয়ে পদ্মায়। সেখান থেকে মেঘনায়। কীরে মেলি, তাই না রে? ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে ঢেলামাছের মেয়েটা মেলির দিকে তাকিয়ে বলে।
কাঁকড়া মশাই অবাক! পুঁচকে মাছমেয়েগুলোর সাহস তো কম নয়! তবু সে তাদের নিরুৎসাহিত করে না। বলে, একটু বুঝেশুনে যেও। পথের অবস্থাতো বোঝোই, আর ওই দু’পেয়েদের নজর থেকে দূরে থাকবে। ওদের চোখের মতনই ওদের জাল, ওদের খালুই, ওদের কৌশল খুবই ভয়ংকর!
সে আমরা একটু আধটু খোঁজ নিয়েই পথে নেমেছি। তুমি শুধু আমাদের জন্য একটু শুভ কামনা রাখবে। আমাদের যাত্রা হবে খুবই সতর্কে, চোখকান খোলা রেখে। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে চেলি বলল। কাকড়া বলল, ঠিক আছে যাও, তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।
কাঁকড়া চলে গেলে রাত নেমে আসে। ওদের ঘুমঘুম পায়। চোখ সবেমাত্র ধরে এসেছে। অমনি দূর থেকে শোরগোল ভেসে আসে। মাছমেয়েরা তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠে। তারপর পাতার আড়াল থেকে ওপরে উঠে বোঝার চেষ্টা করে, কোথায় কী হচ্ছে।
শোরগোলটা অদূরে যে উঁচু বাধ, সেখান থেকেই ভেসে আসছে। দূরে তাকিয়ে দেখা গেল মানুষের আনাগোনা, হুড়োহুড়ি। মশালের আলোও দেখা গেল। কারা যেন বলছে ‘বাঁধ ভেঙ্গে গেছে’। মেলি চেলিকে জিজ্ঞেস করলো, তুই কী কিছু শুনতে পাচ্ছিস?
ঢেলি চলাফেরায় ঢিলেঢালা হলেও কানে খাড়া। সে বলল, ওরা বলছে ‘বাঁচাও’। কোন বিপদ হয়তো হয়েছে। হ্যাঁ, ওই তো শোনা যাচ্ছে, ওরা বলছে ‘পাড় ভাঙ্গছে, বাধ ভাঙ্গছে’। ওরা ডুবে যাবে । ওদের গ্রাম তলিয়ে যাবে। ওরা তাইতো হা-হুতাশ করে বড় রাস্তায় উঠছে।
ঢেলি, চেলি সাবধান, আমাদের রাস্তা ঘেঁষে ঘেঁষে থাকতে হবে ওই তো পানির তোড় শোনা যাচ্ছে, ভেঙ্গেচুরে সব আসছে, আমরা হয়ত বিচ্ছিন্ন হতে চলেছি। খুব সাবধানে থাকবো, পাশাপাশি থাকবো, যেন আমরা একা না হয়ে যাই। মেলি সবাইকে সতর্ক করে দেয়।

মাছমেয়েদের সমুদ্রযাত্রা । শেখ মনিরুল হকমাছমেয়েরা ভীত হয়ে ওঠে। খুব সতর্ক ভাবে ওরা রাস্তার কোল ঘেঁষে আশ্রয় নেয়। পানির হিসহিস শব্দ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিলের শেওলাগুলো দুলছে। ফুলে ফেঁপে উঠছে জলে। রাস্তার ওপরে আশ্রয় নেয়া লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ওরা বলছে, দুধকুমার জেগে উঠেছে। তারপর ফুঁসে ওঠা ব্রহ্মপুত্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এতে ব্রহ্মপুত্র ভয়ংকর রেগে গেছে। সীমানা হারিয়ে ফেলেছে সে। দুর্বার গতি নিয়ে সে ভাটির দেশের সমুদ্রে গিয়ে পড়তে চায়।
মধ্যরাতে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বড় রাস্তা ভেঙ্গে তলিয়ে যায়। বানের জলে কে-কোথায় ভেসে গেল, কে জানে ; মাছমেয়েরা শুধু তাদের আর্তচিৎকার শুনেছে। ছোট একটা শিশুকে ভেসে যেতে দেখলো ওরা। কষ্টে ওদের বুক ফেটে যায়। কিন্তু কী করবে ওরা, ওরাও যে ভেসে চলছে। রাতের আঁধারে মেলি, ঢেলি আর চেলি কোথায় ভেসে চলছে, কিছুই ঠাহর করতে পারে না। ভাসতে ভাসতে ওরা ক্লান্ত, ভীত-শঙ্কিত। একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টার লড়াইয়ে আছে ওরা।
অনেক কষ্টে একটা ধাতব পাত্রের নিচে একটু আশ্রয় পায়। ধাতব জিনিসটা যে তা অনুমান করার চেষ্টা করে মেলি। ঢেলি বলল, এটা একটা হাঁড়ি মনে হচ্ছে। চেলি বলল, এটা দুলছে। এটার মধ্যে কিছু একটা আছে।
ঢেলির কথাই ঠিক; হঠাৎ ছাগলছানার করুণ কান্না ভেসে আসে হাঁড়িটার ভেতর থেকে। কোন এক গেরস্থ ওকে বাঁচাবার জন্য হয়ত এই হাঁড়িতে করে ভাসিয়ে দিয়েছে। হয়তো ছাগলছানার মা আগেই ভেসে গেছে বা মরে গিয়ে থাকবে। আর ওর পালক বেঁচে আছে না ডুবে মরে গেছে, কে জানে। ওরা ছাগলছানাটাকে সতর্ক করে দেয়: খবরদার! নড়াচড়া করো না, চুপটি করে বসে থাকো, নইলে ডুবে যাবে। সকালে হয়তো কোন বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা কোন হাটবাজারের কূলে গিয়ে উঠবে।
ছাগলছানাটা ম্যাঁ-ম্যাঁ করে কেঁদে উঠল। তারপরেই পানির একটা তোড় এসে ওকে সহ পাতিলটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। মাছ মেয়েরা ওটার পিছু নেয়। জলের কলকল, স্রোতের তীব্রতা বাড়তে থাকে। অন্ধকারে হাঁড়িটা ভেসে চলে। ওরাও ভাসে। এক সময় ওরা খেই হারিয়ে ফেলে। পাতিলটা অন্ধকারে ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে যায়। ছাগলছানার ম্যাঁ-ম্যাঁ কান্না দু’একবার শোনার পর নদীর কলস্বরে মিলিয়ে গেল।
ছাগলছানা আর ভাসমান শিশুর কথা কিংবা বানবাসি আর বাঁধবাসিদের কথা ভেবে দুঃখ করে লাভ নেই। মাছ মেয়েরা নিজের মনকে বোঝায়। তারা ভাবছে পথে না-জানি আরও কত ঘটনা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। না, পেছনে ফেরারও উপায় নেই। কারণ বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে ওদের বিল-ঝিল-নদী-নালা একাকার হয়ে গেছে। এমন দুর্যোগে ওদের মা-বাবা স্বজনদের কথাই ভাবছে ওরা।
দুর্যোগের রাত যেন তাড়াতাড়ি পার হতে চায় না। এর মধ্যে এক আকাশ বৃষ্টি হয়ে গেল, তুমুল বৃষ্টি। আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি জলে নদী আরও ফুঁসে উঠেছে। অন্ধকারে মাছমেয়েরা ভেসে ভেসে এক নতুন জনপদে চলে এলো। এখানে আকাশ সুবোধ বালিকার মত। জলের ধারা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে পাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। ওদের মনে হলো এখানে মানুষজন আছে। অন্ধকারে মাছমেয়েরা একটা হাম্বা রব শুনতে পেল। মেলি নাক উঁচু করে গন্ধ নিয়ে বুঝল, এটা একটা জেলেপাড়া। জালের ভেজাভেজা গন্ধ ভাসছে বাতাসে। একটু পরে শোনা গেল মন্দিরার শব্দ। মনে হয় এখানে কোন মন্দিরও আছে। চেলি বলল, দু‘পেয়েদের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। ঢেলি বলল, শুনছো না…কল চাপাচ্ছে কে যেন।
এমন সময় দূর থেকে আজানের ধ্বনিও ভেসে আসে। মেলি, চেলি আর ঢেলি একটা শুভ সকালের প্রতীক্ষায় থাকে। সূর্য না ওঠা পযর্ন্ত ওরা তরীখোলা গ্রামের কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু একটু পরেই পাখিরা ডেকে উঠল। আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে এলো। অমন সুন্দর স্বস্তির সকালে একটা গোখরো ফোঁস করে উঠল। মাছমেয়েরা ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেয়ে ঢেলি বলল, খেয়ে ফেলবে নাকি আমাদের? ‘এই মেয়ে চুপ করো, অলুক্ষণে কথা যত, কোনদিন কি শুনেছ সাপেরা বিপদগ্রস্থদের খেয়ে ফেলে? আমাদের একটা ধর্ম আছে। তোমাদের মধ্যে যারা রাঘব-বোয়াল তারা কিন্তু তোমাদের ঠিকই গপ করে গিলে ফেলবে।’
ধন্যবাদ ,সর্পমামা। তা হলে এবার আমাদের একটু পথ বলে দাও। আমরা এখানে থেকে ব্রহ্মপুত্রে যেতে চাই।
কাকে কি বলছো? আমি চলছিলাম আমার বাপদাদার ভিটে বাড়ি নাগেশ্বরী নদীতে। কিন্তু বানের জলে ভেসে যে কোথায় এলাম, ঠাহর করতে পারছি না। মাছমেয়েরাও জানে না নাগেশ্বরী কোথায়। তবে নামটা শুনে কেমন ভয়ভয় লাগছিল ওদের। লাগবেই বা না কেন, পুরাকালে ওই নদীতে নাগিনী থাকত। কলমি লতার ডগায় কিলবিল করছিল পাঁচ-পাঁচটা জোঁক। ওরা বলল, এটাতো ব্রহ্মপুত্রের কূল। এই কূল ধরে এগিয়ে যেতে হবে দুধকুমার নদীর মুখে। ওই নদী দিয়ে যাওয়া যাবে নাগেশ্বরীতে।
ভুস করে ভেসে উঠল একটা কচ্ছপছানা। বলল, এই কূলে দুধকুমার কোথায় পাবে? এটাতো ব্রক্ষ্মার পূর্বকূল। এখানে অন্যদেশ, সর্প’দাকে যেতে হবে পশ্চিমকূলে। ওই ভাটির দেশের কূলে ।
সর্পদাদা মাথা নাড়লেন। মেলি, চেলি আর ঢেলি বিস্ময়ে হতবাক। ডেলি বলল, সারারাত বানে ভেসে ভেসে আমরা শেষতক ব্রহ্মপুত্রে এসে…তারপর আবার পূর্বকুলেও চলে এলাম! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
চেলি বলল, কাছিম ভাইয়া। ঠিকঠাক বলছো তো ?
মেলি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, আরে হ্যাঁ ছোট্ট কাছিম ঠিকই বলেছে। ওই দ্যাখো, এই গ্রাম থেকেই সূর্য উঠছে। ওটার মুখটা পশ্চিম দিকে। চলো, আমরা তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাই। এদিকটায় নদী খুব শান্ত।
কাছিম ছানা বলল, চলো আমিও যাবো, দুধকুমার থেকে একটু নেয়ে আসি ।
মাছ মেয়েরা আবার যাত্রা শুরু করে। খুব সাহস করে, বুক বেঁধে সাথীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের বুকে নেমে আড়াআড়ি সাঁতার কাটতে শুরু করে। যেতে যেতে ঢেলি বলল, ও মাগো এখানে পানি এতো ঠাণ্ডা কেন?
গোখরোটা বলল, এই যে নদী, এর জন্ম ওই দূর পাহাড়ের এক মানস সরোবরে। শুনেছি ওখানে আছে এক বরফনদী। ওই নদী কাঁদে, আর তার চোখ থেকে গলেগলে ঝরে পড়ে শীতল পানি। তাই তো নদীর জল এত হিম।
মাঝ নদীতে এসে ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কাছিম ছানা বলল, সত্যি, আমাদের এত সাহস দেখানো ঠিক হচ্ছে না। মেলি বলল, পথে নেমে সাহস হারাতে নেই। এগিয়ে চলো, আর স্মরণ করো নদীর অধিপতির কথা।
ওরা গাজী গাজী বলে টিৎকার করে ওঠে। মধ্য নদীতে তখন ঢেউয়ের মাতম। কিন্তু কী চমৎকার খেলা করছে শুশুকের দল। তারা আটার বস্তার মতন ডুবে যাচ্ছে আবার ভুস্ করে উপরে ভেসে উঠছে। গোখরোটাকে দেখে ওরা জলের গভীরে তাকিয়ে লুকিয়ে পড়ে। একটা কলের নৌকা ভটভট শব্দ করে ওদের ওপর দিয়ে চলে যায়। ওরা তখন কূলের কাছাকাছি। একঝাঁক ভুরুঙ্গা মাছের সঙ্গে ওদের দেখা। চেলি জানতে চায় : ‘ও মাছেরা কোথায় যাও? কোথায় নাও, কোথায় খাও?’
মাছেরা বলল: ‘যাচ্ছি বাড়ি, ভুরুঙ্গামারি তোমরা কোথায়, জানতে পারি?’
ভুরুঙ্গামাছের দল শেষে মাছমেয়েদের গন্তব্যের কথা জানতে পারেনি। হঠাৎ ব্রহ্মপুত্রের বুকে আবার উথালপাথাল ঢেউ ওঠে। কীসের এত ঢেউ?
কাছিমছানা নদীর গহীনের অনেক গোপন খবর জানে। সে বলল, সমুদ্রসাধক জেগেছে। সে আসছে। মাঝে মাঝেই সে আসে। নদীর গতিপথ ঠিক রাখে। মাছমেয়েরা সমুদ্রসাধকের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে জানতে চায়, কে এই সমুদ্রসাধক?
কেউ তাকে দেখেনি। সেই সাধক সমুদ্রের তলদেশে হাঁটে। হেঁটে হেঁটে মানস সবোবর থেকে সাগর সিথানে গিয়ে আবার ফিরে আসে। ছোটবড় সব নদী সাগরে মিশেছে কী না; তার দেখভাল করাই তার কাজ।
মাছমেয়েরা সমুদ্রসাধককে দেখবার ইচ্ছা পোষণ করে। কাছিম বলল, তাকে দেখে যায় না, বাঁধা দিলেই সে ক্ষেপে যায়। সর্পদাদা বললেন, আমাদের গোত্রের সমুদ্রনাগেরা তাকে দেখতে পায়। সমুদ্রনাগেরা নাকি তাদের সাথে সমুদ্রে যায়। মেলি, চেলি আর ঢেলি সাহসী হয়ে ওঠে। গোগরোটাকে বলে, তুমি তো তাদেরই জাতভাই, তাহলে বুকে সাহস ধরো। এসো আমরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
গোখরো সাহস করে না। ছোট্ট কাছিম আর কী বলবে, সে বলল, আমার গিয়ে আর কাজ নেই। তোমরাই যাও।
একে একে ভুরুঙ্গামাছ, শুশুকের দল, গোখরো‘দা আর ছোট্টবন্ধু কাছিমছানা সবাই মাছমেয়েদের ছেড়ে গেল। মাঝনদীতে জলের একটা পাক দেখা গেল। ভংয়কর গর্জন হচ্ছে সেখানে। মেলি বলল, সাবধান সমুদ্রসাধক হয়তো এ পথেই আসবে। মেলি, চেলি আর ঢেলি প্রাণপণে ডুব সাঁতার দিয়ে কূলের দিকে ছোটে। এভাবে ছুটতে ছুটতে সূর্য যখন পশ্চিম তীরে ঢলে পড়ে তখন ওরা দুধকুমারের মুখে এসে পড়ে।
হল্লা করে ওঠে চেলি। এই তো আমার হারিয়ে যাওয়া নদী। তারপর ওরা তিনজন ছুটে চলে কূল ধরে যমুনার দিকে। যেতে যেতে ওরা খুঁজে পায় ঢেলির নদী আত্রাই। তারপর খুঁজে পায় চেলি তার প্রিয় নদী তিস্তাকে। তবু শেষ হয় না ব্রহ্মপুত্রের বয়ে চলা। হায় নদী! কত তোমার জল? কত ধারা তুমি ধারণ করে আছো?
তারপর, সাতদিন-সাতরাত পেরিয়ে এক সকালে ওরা এসে পৌঁছালো ব্রক্ষ্মপুত্রের শেষ মাথায়। এখানে নদী হয়ে গেছে যমুনা। যমুনার কূলে এসে ঢেলির শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়। তার গা জ্বরে পুড়ে যায়। সে বলল, তোরা এগিয়ে যা, আমি আর পারছি না। আমি এই যমুনার চরে পড়ে থাকি।
দু’বান্ধবী বলল, তা কী করে হয়? এমন তো কথা ছিল না। বরং আমরাও দু’দিন জিরিয়ে নেই।
ঠিক আছে তোরা যা ভালো বুঝিস ।
ঢেলি ক্লান্তশ্রান্ত ছোট্ট শরীরটা নিয়ে স্যাঁতসেঁতে পলি আর বালুর ওপর দেহটা এলিয়ে দেয়। গভীর ঘুমে সে ঢলে পড়ে। মেলি ঘুমায় না। সে ভাবছে, সমুদ্রে যেতে আর কতদিন লাগবে। চেলি বলল, এরপর আমাদের যমুনা পাড়ি দিয়ে পদ্মার সঙ্গে দেখা করতে হবে। তারপর যাবো মেঘনায়।
সে তো ঢের দূরের পথ। মেলি বলল সাহসটা ধরে রাখ। আয় ঢেলির পাশে আমরাও শুয়ে ঘুমিয়ে একটু ঝরঝরে হয়ে নেই। ক্ষিদে যদি পায় তো, খানিকটা পলিমাটির পায়েস খেয়ে নিতে পারিস। আমার ক্ষিদে নেই। এই আমি শুয়ে পড়লাম। ঢেলিকে ঘুমে রেখে ওরা দু’জন খাবারের সন্ধানে বের হয়। ব্রহ্মার কূল ধরে ওরা এগিয়ে যায়। একটা বড় বোয়ালমাছ বুনো ষাঁড়ের মতন ধেয়ে আসছিল। দূর থেকে চেলি লক্ষ্য করল ওটার মতিগতি। মেলি দেখল ওটা হাঙ্গরের মতন ছুটে আসছে। নিশ্চিত ওটা ওদের গিলে ফেলবে, ওরা দু’জন ছোট্ট একটা গর্তে লুকিয়ে পড়ে। বোয়ালটা রেগে যায়; কেন ওকে ফাঁকি দেয়া হলো। গর্তটা খুব ছোট, তাই ওটা ভেতরে ঢুকতে পারল না। রেগে মেগে বোয়ালটা ছুটে গেল চেলির দিকে। চেলি তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে ঘুমাচ্ছিল। হ্যাঁ, ওরা তো ওভাবেই ঘুমায়। বোয়ালটার দাপাদাপিতে চেলির কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়।
বিপদ টের পেয়ে সে পলির ভেতর লুকিয়ে পড়ে। হিংসুটে হিংস্র বোয়ালটা কতক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে চলে যায়। ভয়ে ঢেলি সিঁটিয়ে যায়। ওদিকে চেলি আর মেলি আটকা পড়ে আছে চরের এক নালাতে। যেখান থেকে তাদের মুক্তি পাবার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কার খানিক পরেই কূলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের সাথে পলিকাদা এসে নালার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া আর কিভাবে হবে; ছোট্টমাছেরা এখন জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত । খাওয়া বলতে এখন জুটবে শুধু যমুনার স্বচ্ছ জল ।

মাছমেয়েদের সমুদ্রযাত্রা । শেখ মনিরুল হকবেলা বাড়তে থাকে। সূর্য তেঁতে ওঠে। এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায়। পলিকাদা গরম হয়ে উঠলে ঢেলি একটু নড়েচড়ে শোয়। না, এখানে থাকা যাবে না। দু’চারটা তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়েই পাশের ধানক্ষেতে যাওয়া যাবে। কিন্তু এভাবে বেশি জায়গা বদলালেতো মেলি আর চেলি কে হারিয়ে ফেলবে ঢেলি। তাই সে একটুখানি লাফ দিয়ে ধানক্ষেতের হাঁটুজলে গিয়ে পড়ে। এখানে জলটা শীতল। শরীরটাও একটু ঝরঝরে লাগছে। ওদিকে মেলি আর চেলিও ছোট্ট নালাতে ছটফট করছে। প্রচণ্ড রোদে নালার পানি গরম হয়ে উঠেছে। এখানে থেকে পালানো দরকার। তা ছাড়া ঢিলেঢালা ভীতুব ডিম ঢেলিটার এখন কী হাল, তা জানার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। চেলি বলল, মেলিরে আমাদের সমুদ্রযাত্রা মনে হয় সফল হবে নারে। আমরা ছোট, আমরা সামান্য, আমাদে এমন সাহস করা বোধহয় ঠিক হয়নি। সমুদ্র সাধক হয়তো এটা পছন্দ করছে না। মেলি প্রতিবাদ করে বলে, না, সমুদ্রসাধক ভীতু, দুর্বলদের পছন্দ করে না। ওর পছন্দ দুর্মর, দুর্বার গতি। দেখো না, শোনো নি, যারা নদীতে বাঁধ দেয় তাদের কেমন গুড়িয়ে দেয়? থাক এসব কথা। বলো দেখি এখন কী করা যায়? চেলি বলল, পলিকাদা ঠেলে ঠেলে চলো বের হবার চেষ্টা করি। সো সমুদ্রসাধককে স্মরণ করি।
ওরা তাই করল। সমুদ্রসাধক যেন ওদের কথা শুনল। নদী জেগে উঠল। ওরা হেইও বলে নালার মুখে এসে এক লাফ দিল। তারপর পড়ল এসে এক ধান খেতে। তখন সূর্যমাথার ওপর। মেলি আর চেলি হারানো ঢেলিকে ডেকে বেড়ায় আর এদিক সেদিক তাকিয়ে খোঁজ করে। ঢেলির জন্য ওদের মনটা কেঁদে ওঠে। সত্যিই, বন্ধুকে হারাবার বেদনা কত কষ্টের! নদীর কূল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ওরা সাঁতরে চলে। কূল ঘেঁষে বিজন চর। ছপছপে বা হাঁটুজল আছে কোথায় কোথায়। সেই জলে ধান বুনেছে কূলের মানুষেরা। এখানেই কোথাও ঢেলি আটকা পড়ে আছে। দূর থেকে গাড়িয়াল ভাইদের গান ভেসে আসে।
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই
হাঁকাও গাড়ি তুমি চিলমারি বন্দরে…।’
চেলি জিজ্ঞেস করে মেলিকে, চিলমারি বন্দরে কি এসে গেছি?
মেলি বলল, চিনি না। মায়ের কাছে শুনেছিলাম বন্দরের কথা। আগের দিনে কত মানুষ ওই বন্দরে ভীড় জমাতো, কত বাণিজ্য হতো। অনেক গেরস্থি তখন নাও ভাসিয়ে বাণিজ্যে যেতো। তখন তাদের বউ-ছেলেমেয়েরা একা থাকার বেদনায় ডুকরে ডুকরে কাঁদতো। মা বলেছে, নদীর ঘাটে মাঝির বউ তাকিয়ে থাকতো, কখন তার মানুষটা ফিরে আসবে। কত কী নিয়ে আসবে তার জন্য, তার আদরের ছেলেপুলের জন্য।
মেলি অনর্গল বলেই চলে আর চেলি শোনে। এভাবে এক দুপুর ওরা ওদের ছোট্ট, নরম ডানা আর লেজ নেড়ে সাঁতার কাটল। অবশেষে বেল গড়িয়ে ওরা যমুনার কাছাকাছি চলে এলো। তবু ওরা ঢেলিকে খুঁজে পেল না। শেষমেশ আশা ছেড়ে দেয় ওরা। কিন্তু আশা ছাড়ে না ঢেলি বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সে জয়ী হয়েছে। অবশ্য এর জন্য তাকে ঝুঁকি নিতে হয়েছে। সে এক রূপকথা যেন।
এই তো, কিছুক্ষণ আগের কথা। সোনারোদ বিকেল শেষ প্রায়। একটা বক সারাদিন খেয়েদেয়ে পরিতৃপ্ত মনে এবং তৃুপ্তির ঢেকুর তুলে বাড়ি ফেরার জন্য গা মুছছিল। ঢেলিটা জানে, ভরাপেটে বকটা ওকে খেতে চাইবে না। দেখা যাক, ওকে দিয়ে শেষ রক্ষা হয় কি না। মরে যেতে তো আর বাকি নেই। ঢেলি সিদ্ধান্ত নেয় বকটার সাহায্য নেবে। তাই সে সাহস করে, বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল, বক দাদা, বক দাদা, আমাকে গিলে ফেলো। আমি আর এ জীবন চাই না। সারাদিন ছোট্ট এই জলশয়ে রোঁদ-তাপা পানিতে থেকে আমি কষ্ট করে যাচ্ছি।
বকটা মাছমেয়ের চালাকিটা বুঝল। কারণ সে অনেক অভিজ্ঞ, পোড়-খাওয়া। সে বলল সারাদিনে আমি তোমাকে দু’তিনবার দেখেছি। তুমি এড়িয়ে গেছ, আমাকে ফাঁকি দিয়েছ। তার জন্য তোমার ওপর আমার খুব রাগ হয়েছে। কিন্তু এখন এই ভরা পেটে আর বাড়ি ফেরার সময় আমার কোন রাগ নেই। আমি তোমার ইচ্ছার কথা বুঝতে পারছি। এসো আমার কাছে। তোমাকে যমুনার জলে পৌছে দেই।
ঢেলির বুকটা কেঁপে ওঠে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, যদি খেয়ে ফেলো?
বকটা একটু রেগে বলল, তুমি ভালো করেই জানো, আমার পেট ভরা, একটা তিল-শস্যও আমার পেটে ঢুকবে না। আর আমার বাসায় ছেলেপুলেও নেই যে, ওদের জন্য তোমাকে নিয়ে যাব। বেশ ক’দিন হলো আমার বগিও নেই। মেলি জানতে চাইল, বগীর কী হয়েছে?
বগা বলল, দু’পেয়েরা যা করে, যমুনার তটে ওরা ফাঁদ পেতেছিল। আহা, এক সাথেই এসেছিলাম আমরা সেদিন। আমি ফাঁদ দেখে সতর্ক হলাম। ওকে সতর্ক করার আগেই ফাঁদের পুঁটি মাছটাকে গিলতে গিয়ে গলায় ফাঁস আটকে যায়। ব্যস, দৌড়ে এসে ফাঁদ তুলে নেয় একটা লোক। বগীটা কত যে ছটফট করল, কত কাঁদল। শিকারীকে বলল যে, বাসায় তার একটি ছানা আছে। কিন্তু লোকটা ছাড়ল না। বড় নিষ্ঠুর ছিল ওই শিকারী। আমি নিরুপায় হয়ে সব দেখলাম, ইচ্ছে করল ওর চোখ দু’টো আমার লম্বা ঠোঁট দিয়ে কানা করে দেই। কিন্তু পারলাম না। আমি আজও তার কানড়বা শুনতে পাই। ওই শোনো, দূর থেকে গান ভেসে আসছে, কে যেন গাইছে, ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…।
বগার গল্প শুনে ঢেলির মনটা কেঁদে ওঠে। আপন মনে নির্ভয়ে সে বগটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বগাটা ওকে ঠোঁটে তুলে নেয়। তারপর উড়াল দিয়ে চলে আসে যমুনার তীরে। ঢেলিকে জলে নামিয়ে দেয়। ঢেলি বলল, ছানা দুটোর কী হলো তাতো বললে না।
বক বলল পরপর দু’দিন আমি ওদের দানাপানি খাইয়েছি। তৃতীয় দিন আমি কোন খাবার পাইনি। সারারাত চুঁচা করে ভোরের দিকে চুপ হয়ে গেছে। আচ্ছা তবে যাই। তুমি কোন দিকে যাবে? এদিকটায় নদী অনেক বড়। সোজা গেছে যমুনা হয়ে। আর ওপাড় দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্রের পুরনো ধারা। আমি যাই। বকটা সুনীল আকাশে পাখা মেলে দেয়।
তখন ছিল সোনালি বিকেলের শেষ রোদ্দুর। সোনালি রোদের ছটা তার ধবল ডানায় পড়ে ঝিলিক মারছিল। সন্ধ্যার আগে শেষবারের মতন শোনা যায়, ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…। বকটাকে মৌখিক ধন্যবাদ জানাবার সুযোগ না পেলেও চিরকাল তাকে মনে রাখার প্রতিজ্ঞা করে। ব্রহ্মপুত্রের বাঁকে, যমুনার মুখে তখন ক্রমেই রাত নেমে আসে। ঢেলির মনে পড়ে যায় চেলি আর মেলির কথা।
দু’বান্ধবী ঢেলিকে খুঁজে পাবার আশা ছেড়ে দেয়। ওরা ব্রহ্মপুত্রের পুরনো ধারা পেরিয়ে সোজা যমুনায় গিয়ে পড়ে। ওরা যদি আর একটু অপেক্ষা করে, তাহলেই ঢেলি ওদের ধরে ফেলে। কিন্তু হায়! ভাগ্য ওদের খুব খারাপ। রাতের অন্ধকারে ঢেলি একা হয়ে গেল ব্রহ্মপুত্রের পুরাতন বাঁকে।
সেই কবে কোনকালে সমূদ্রসাধকের সঙ্গে ভয়ানক এক লড়াই হয়েছিল পাতাল দানবের সাথে। নদীর অধিপতি যোগ দিয়েছিল ওই লড়াইয়ে। সে কী লড়াই! পাতাল দানবের উথালপাথালিতে নদীর তলদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে। ফুলে ফেঁপে ওঠে ব্রহ্মার জল। ব্রক্ষ্মা অভিমান করে পশ্চিমের পাহাড়, টিলা, জনপদ ঠেলে ছুটতে থাকে। সমুদ্রসাধক বলল, সবটা চলে যেও না, নদীর অধিপতির দোহাই।
অমনি ব্রক্ষ্মপুত্রের বিপুল ধারা ছুটল দক্ষিণের দিকে। মেলি আর চেলি ছুটল দক্ষিণের ধারাতেই। এদিকটায় নদী যমুনা নামে ছুটছে। আর ঢেলি ছুটছে ব্রহ্মপুত্রের পুরাতন ধারায়। কিন্তু এদিকে নদী কেমন মৃতের মতন। যেতে যেতে একদল ঢেলা মাছের সঙ্গে দেখা হলো ঢেলির। স্বজাতি ভাইবোন, মামা, খালা, কাকাদের দেখে ঢেলি খুশি হলো। মনে একটু ভরসা পেলো।
প্রায় একপক্ষকাল সাঁতার কেটে ঢেলি পৌঁছালো শীতালক্ষার বুকে। এখানে নদী মরা, স্রোত নেই, স্বজাতি কাউকেই পেলো না ঢেলি। এ নদীর পানিতে জীবন নেই। ঢেলি ভাবে, যে নদীতে শাপলা নেই, শালুক নেই, ঝিনুক, শামুক, মাছ নেই। শেওলা, কচুরির দল নেই; সে নদীতে থেকে লাভ নেই। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় রাত পোহালেই আবার যাত্রা করবে। রাতের অন্ধকারে ঢেলি আশ্রয় নেয় একটা এঁদো ডোবায়। ডোবায় আরও কয়েকটা ছেলেমেয়ে ঘুমুচ্ছিল টেংরা মেয়েটা বলল আমাদের সাথে থাকবে নাকি?
ঢেলি বলল, থাকতে তো চাই কিন্তু এখানে নদীর নাব্যতা নেই। জলটা কেমন ভারভার। এখানে বুঝি নদীর অধিপতি নেই। এখানে কি সমুদ্রসাধক আসেনি?
ঢেলির কথা শুনে সবাই অবাক। টেংরা মেয়েটার সঙ্গে এসে জুটল কয়েকটা খোলশের মেয়ে। মেয়েগুলো কুচকুচে কালো। তেল ভাসা জলে থাকতে থাকতে এমনটি হয়েছে।
খোলশেদের একটা মেয়ে বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে জানতে চাইল, সমূদ্রসাধকটা আবার কে?
পরপরই টেংরা মেয়েটা বলল, নদীর অধিপতিই বা কে? ঢেলি বলল, শোনো মেয়েরা, নদীর জীবনের প্রতিপালক। তিনি সমুদ্রসাধককে পাঠান তার চলার পথকে গতিময় করতে। আমি আজ শত মাইল পেরিয়ে তোমাদের নদীতে এসেছি। আমি দেখেছি গতিময় ব্রহ্মপুত্রের ধারা তারপর ঘটনাচক্রে এলাম তোমাদের শীতলক্ষ্যায়। আমি যাবো ভৈরবে। সেখানে থেকে যাবো মেঘনায়। আমার গন্তব্য সমুদ্র সাধকের রাজ্যে।
মাছেরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে, সেই সাধক কি বঙ্গোপসাগরে থাকে?
ঢেলি বলল, হ্যাঁ তার আদিও চূড়ান্ত বসত ওই সমূদ্রের গহীনে। আমি তাকে গিয়ে বলল তোমাদের কথা। সে বলবে নদীর আধিপতির কাছে। কী দুদর্শায়ই না তোমরা আছো। ঢেলির কথায় সবাই উদ্বুদ্ধ হয়। ওরা বলে, চলো আমরাও তোমার সাথী হব।
চলো তা হলে, আজ রাতে আমরা নদীর অধিপতির কাছে প্রার্থনা করি। যদি তিনি দয়া করে আমাদের নদীর জন্য সমুদ্রসাধককে পাঠান। তারপর সে রাতে শীতলক্ষ্যার ছোটছোট মাছেরা প্রার্থনায় মগ্ন হয়। সে দৃশ্য দেখে বড় বড় মাছেরা হাসে। রাঘব-বোয়ালদের মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধি খেলে যায়। ওরা ঢেলিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করে।
তখন মধ্যরাত। সহসা শীতালক্ষ্যায় মাতম ওঠে। চতুর রাঘব-বোয়ালগুলো মাৎস্যনায় মেতে ওঠে। রুইকাতলা, পাঙ্গাস-বোয়ালরা ছোটদের ওপর হামলা চালায়। রাতের অন্ধকার ভেদ করে ট্যাংরা, খোলশে আর পুঁটিদের ‘বাঁচাও’ চিৎকারে। ওদের কতশত জন যে রাক্ষসদের পেটে গেল তার ইয়ত্তা নাই। যারা বেঁচে আছে তারা স্মরণ করল নদীর অধিপতিকে। অমনি নদীতে ভাব এলো, জোয়ার এলো। নদী দুলে উঠল। তারপর সে কি উথালপাথাল ঢেউ। মাছেরা ভরসা পেল; ওরা চিৎকার করে বলে উঠল ‘সমুদ্রসাধক এসেছে, সাবধান!’
ঢেলি বলে,
‘বাঁচাও হে নদীর অধিপতি
সমূদ্র সাধকে দাও অসীম গতি।’
ট্যাংরা-পুঁটি-খোলশেরা বলে ,
‘দয়া করো, হে দরিয়ার অধিপতি,
সমুদ্রসাধক পাঠাও সঙ্গে দুরন্ত গতি।’
অমনি শীতলক্ষ্যা যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠে। দু’কূল ছাপিয়ে জলের ধারা ফনা তোলে। রাক্ষুসেরা ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দু’পাশের যত দখলদাররা গেল ভেসে। যত আবর্জনা ভেসে গেল। নদী যেন প্রাণ ফিরে পেল। রাক্ষুসেদের শিক্ষা হলো। তবে রাতভর সমুদ্রসাধকের শুদ্ধি অভিযানে ঢেলিকে ভেসে যেতে হয় দূরের নদী ভৈরবে। বেশ কিছু সাঙ্গপাঙ্গসহ ঢেলির শুভ সকাল হয় ভৈরব নদীর সরব বন্দরে। তবে কষ্টের বিষয় ছোট ছোট অনেক মাছের মধ্যে ঢেলি এখন এক মাছের ডালার মধ্যে। সে এখন মাছের ডালায় ছটফট করছে। ডালাটা ছিল এক মাছব্যাপারীর নৌকায়। এই নৌকা যাবে মেঘনায়। কারণ মাছ ব্যাপারীরা বলছে যে, ভৈরবে আজ মাছের দাম কম? চলো মেঘনায় যাই।
ওদিকে মেলি যমুনার তীর ধরে এগোয়। তার লক্ষ্য আড়াআড়িভাবে শহরমুখি নদী হয়ে সাগরে যাওয়া যায় কিনা। যেতে যেতে সে পেল এক বিশাল সেতু। সেতুর ওপর দিয়ে যন্ত্রযানগুলো গোগো করে ছুটে যাচ্ছে। নীচ দিয়ে যাচ্ছে কলের নৌকা, মাঝির নৌকা আর লঞ্চ। সেতুর নিচে কতক্ষণ সে বিশ্রাম নেয় আর সব কথা মনে করার চেষ্টা করে। কূল ঘেঁষে কাদাপানির ভেতর থেকে মাথা তুলে একটা বেলেমাছ তাকে বলে, কাকে খুঁজছো? ঢেলি বলল আমার বন্ধু ঢেলি আর চেলিকে হারিয়ে ফেলেছি আর আমাকে যেতে হবে নদীর মোহনায়। ওখানে গেলে হয়তো ওদের দেখা পাবো। আর তখন তিন বন্ধু মিলে ছুটে যাবো সমুদ্রে।
সাদামাটা, হাবাগোবা কিংবা সহজ-সরল বেলেটা কিছুই বুঝল না ঢেলির কথার মাথা-মুণ্ডু। সে বলল, আমি যাবো পদ্মার পলিদ্বীপে। একটা বুড়োশামুক আমাকে সেতুর নীচ দিয়ে যেতে বলেছে।
ঠিক আছে, তুমি যাও, তোমার পথে। আমার গতি সমুদ্রের দিকে। আমি নগরনদীর বুক বেয়ে যাবো বুড়িগঙ্গায়। সেখানে থেকে যাবো মেঘনায়। একদল গুতুম মাছ আমাকে এই পথের কথাই বলেছে। আমি তা হলে যাই।
মেলি ছুটে চলল নগরনদীর সন্ধানে। চলতে চলতে, ভাসতে ভাসতে আর দুলতে দুলতে যমুনার পশ্চিম কূল ধরে গঙ্গার মুখে এসে পড়ে চেলি। আপন মনেই পথ চলে সে। কাউকে সে কিছু জিজ্ঞেস করে না। গঙ্গার মুখে এসে সে গঙ্গার দিকেই ঢুকে পড়ে। পরে ভুল বুঝতে পেরে সে পিছু ফেরে। চলে যায় নগরবাড়ি ঘাট হয়ে, আরিচার কূল ধরে পাটুরিয়া ঘাটে। শেষে গোয়ালন্দঘাটে এসে বিশাল পদ্মায় ঢুকে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে ভাসতে থাকে ভাটির দিকে।
রাতের যমুনা নিরব নিথর। পশ্চিমকূল ধরে চেলি আর মেলি কিছুদূর এগিয়ে একটা আশ্রয় খোঁজে। এখানে পাড় অনেক উঁচু; ভেঙে পড়ে পড়ে প্রায়। বলতে না বলতেই বিশাল এক মাটির চাপ এসে পড়ল নদীতে। চারদিকে পাড় ভাঙার শব্দ, পানির বিস্তার ; জলের আলোড়ন মধ্য নদীতেও তোলপাড় করে। জলের ছটা, ঢেউয়ের মাতামাতিতে মেলি আর চেলি দু’দিকে ছিটকে পড়ে। চেলি ছিটকে নদীর কূল থেকে গভীর জলে গিয়ে পড়ে। পরে দিক হারা হয়ে সাঁতরাতে থাকে মধ্য নদীর দিকে।
এসময় একটা জেলে নাও ওকে আরও দিশেহারা করে দেয়। তবু বাঁচার জন্য নৌকাটা ঢেলির গতিপথ ধরে প্রাণপণে সাঁতরাতে থাকে। রাতভর সাঁতার কেটে সে যমুনার অপর প্রান্তে চলে এলো। তখন ভোর হয়। লঞ্চের ভেঁপু শোনা গেল। চেলি ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে জাহাজ ঘাটে এসে পৌঁছায়। ক্ষুধাক্লান্তিতে সে নিস্তেজ প্রায়। আজ সারাদিন সে এই জাহাজ ঘাটেই জিরিয়ে নেবে। জাহাজ ঘাটে এখন আর জাহাজ নেই। নেই সেই কূলিদের হাঁকাহাঁকি। জাহাজ ঘাটেই কুলিরা এখন শহুরে হয়ে গেছে । মাছমেয়েদের ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তিন বান্ধবী আজ তিনদিকে। ওদের কষ্ট আর অনিশ্চয়তার শেষ নেই। কে জানে, ওরা কী ফের মুখোমুখি হবে কী না। তবু শীতালক্ষ্যামুখি ব্রহ্মপুত্র নদীর ক্ষীণ ধারার সাথে ছুটে চলছে ঢেলি, যমুনার পশ্চিমপাড় ধরে সতর্ক যাত্রায় আছে মেলি আর পূর্বপাড়ের শঙ্কিত যাত্রী চেলি; তাদের আশা: একদিন তাদের দেখা হবেই। হয়তো সমুদ্রসাধক এবং নদীর অধিপতি তাদের মিলিয়ে দেবে।
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মেলি। বন্ধুদের হারানোর বেদনায় সে কেঁদেছে। সারারাত সে নদীভাঙনের করুন সুর শুনেছে। যাদের ঘর বাড়ি ভেঙেছে তাদের কানড়বা ও আহাজারি শুনেছে; আর শুনেছে বাঁশি। সে কী করুন সুর! মনে হলো বাঁশি তো নয়, যেন কারো কান্না। উদাস হয়ে শুনেছিল মেলি। আর মনে মনে সে ভাবল, এই যমুনার কূলে কে কেমন করুণ বাঁশি বাজায়, কী তার দুঃখ, সে কি তার বন্ধু প্রিয় জনেই হারিয়েছে ? হয়তো তাই হবে। বাঁশি শুনে মেলির মনে পড়ে মার কথা। মা বলেছিল, আমাদের কালে যমুনার কূলে রাতে, মধ্যদুপুরে অথবা ঘোর সন্ধ্যায় বাঁশি বেজে উঠতো। কোন দেবতা নাকি সেই বাজাতো তার বন্ধুর জন্য। কিন্তু বন্ধু আসে না; রাগ করে চলে যায় দেবতা। তবে পরপরই সে আসতো তার খোঁজে। দেখা না পেয়ে সেও জলে যেত অভিমান করে।
এমনি করুণ বাঁশি শুনে মেলির ভোর হয় এক নদীভাঙা গেরস্থির বাড়ির কাছে। খুব সকালে সে বাড়ি থেকে এক অপরূপা মেয়ে কাঁখে কলসি নিয়ে যমুনার পাড়ে আসে।
ইতিউতি এদিকওদিক তাকিয়ে হাঁটুজলে নেমে কলসে জল ভরে নেয়। কিন্তু কলসে জলভরা যেন তার উদ্দেশ্য নয়, কাউকে খুঁজছে সে, না পেয়ে মলিন মুখে বাড়িমুখো হয়। দৃশ্যটা দেখে মেলির খুব খারাপ লাগে। নদীভাঙা মানুষের মনও ভেঙে যায়।
মেলি শেওলার আড়ালে অবস্থান নিয়ে বিশ্রাম করছে। সাত-সকালের সুন্দর পরিবেশে একজোড়া বালিহাঁস এগিয়ে আসে ওর দিকে। একটু সাবধান হয়ে যায় সে। হাঁসের দল চলে গেলে সে বিশ্রাম নেয়। তারপর শেওলার কুচি দিয়ে নাস্তা করে একটা ঘুম দেবার প্রস্তুতি নেয়। ওদিকে যমুনার পূর্বকূল ধরে চেলি চলছে তো চলছেই। চলার যেন আর শেষ নেই। তবে চেলিকে এখন চলতেই হবে। ওদিকে যেমন মেলি আর ঢেলিও চলছে। ছুটে চলা এখন ওদের অনিবার্য। ওরা হারিয়ে যাওয়া মাছমেয়ে। চেলির মাথার ওপর বিস্তীর্ন আকাশ। ওর চলার পথে, মাথার ওপর একটা উড়ো জাহাজ উড়ে চলেছে। কী যেন ওটা করছিল। চোখের মতন কী যেন একটা যন্ত্র মেলে ধরা আছে ওটা থেকে। ওই চোখে কত ছবি তুলে নিচ্ছে ইচ্ছে মতন। কত নদী, যমুনার জল, গ্রাম-জনপদ, ঢেউ, তরঙ্গমালা, নদীতে ভাসমান জলযান, জলজীব- সবকিছুর ছবি মনের মতন করে তুলে নিচ্ছে ।
ক্যামেরার চোখ একবার পূর্বকূলে তাকায় আর একবার তাকায় পশ্চিমকূলে। মধ্যনদীতেও ওটার চোখ স্থির। কোথায় পানির সুড়ংগ আছে, নদী কার বাড়ি ভেঙেছে, ঢেলির হারিয়ে যাওয়া, মেলির একাকি আর চেলির অনিশ্চিত যাত্রার সব ছবি কি ওই ক্যামেরা তুলে নিচ্ছে? কোথায় কোন পত্রিকার পাতায় হয়তো ওরা ছাপাবে অথবা কোর দূরদর্শনে তা দেখাবে। কিন্তু ওই চোখ কি সমুদ্রসাধককেও খোঁজে? কিংবা খোঁজে নদীর অধিপতিকে?
নদীর অধিপতি আর সেই সমুদ্রসাধক এখন শান্ত আছেন। সমুদ্রসাধক ফিরে গেছেন সাগর মোহনায় আর নদীর অধিপতি জলের সুড়ংগ দিয়ে অতল পাতালে গিয়ে ঘুমাচ্ছেন। মেলি, চেলি আর ঢেলি হয়তো আর মুখোমুখি হবে না কিন্তু সাধক আর অধিপতি ঠিকই ওদের সাহস যুগিয়ে যাবেন।
তখন গভীর রাত। ভরা পূর্ণিমায় আকাশ-নদীর জল উপচে পড়ছে যমুনায়। বিপুল স্রোতের মুখে চেলি চলছে ভেসে ভেসে। রাত পোহালেই সে গোয়ালন্দ ঘাটের কাছে গিয়ে পদ্মায় নেমে পড়বে। তার আগে সে গঙ্গার মুখে এসে থমকে দাঁড়ায়। এক মূহুর্তে ভাবল সে, উজান ঠেলে গঙ্গায় ঢুকে পড়বে কিনা। কিন্তু না মন এগুলেও শরীর এগোয় না। তার অবসাদগ্রস্থ দেহমন তাকে পদ্মার দিকেই ঠেলে দিলো। ওদিকে ভোরের আলোতে মেলি এসে ভেড়ে যমুনার পশ্চিম কূলে। একটু বিশ্রাম চাই তার। রাত শেষে বাকি জোছনা ঝরাতে ঝরাতে চাঁদের আলো ফিকে হয়ে আসে। সেই ফিকে আলোতে দেখা গেল একটা কদম গাছ। ওই কদম গাছের ডালে বসেই কোকিলরা কী ব্যাকুল সুরেই না ডাকে। কদমগাছটার পাশ দিয়েই নদী বাঁক নিয়ে ধলেশ্বরী হয়ে ছুটে চলছে। মেলি শেষরাতটা কদমতলার ঘাটেই কাটাবে। তারপর ভোরের আলো ফুটলেই ধলেশ্বরী দিয়েই ছুটবে। পাড়ের লোক আর মাঝিদের আলাপ থেকে মেলি বুঝে নিয়েছে, এই নদী শহর-নগর ভেদ করে মেঘনায় গিয়ে পড়েছে। মেলি তার নিস্তেজ শরীর টেনেটেনে কদমগাছ বরাবর গিয়ে দাঁড়ায়। কদমগাছের শেকড়বাকড় নদীর কূলের জল ছুঁয়ে আছে। হয়তো সে আজকালের মধ্যেই নদী-ভাঙনের মুখে পড়বে। আহা! কদম গাছটা আর থাকবে না? ওই কদমগাছে আর কোকিল ডাকবে না। কালা নামের কোন রাখাল ছেলে আর বাঁশি বাজাবে না। কোনো গ্রাম্যবধু কাঁখে কলস নিয়ে জল ভরতে আসবে না। কদম গাছটার গুঁড়ির ফোঁকরে ঢুকে পড়ল মেলি। গুঁড়ির আড়ালে আরও কিছু ছোটছোট মাছ ঘুমাচ্ছিল। তাদের পাশে খেলছিল একঝাঁক কাঁচকি মাছের ছানাপোনা। একটা বড়সড় চাপিলামাছ সবাইকে পাহারা দিচ্ছিল। মেলিকে দেখে সে তেড়ে ওঠে। একটা মলামাছও ছিল সেখানে। ওটা মেলিকে আগলে দাঁড়ায়। শত হলেও স্বজাতি বোন তো !
মলাটা চাপিলাকে কাকুতি-মিনতি করে বলে, থাক না চাপিলা ভাই, ও হয়তো বিপদে পড়েই ঢুকেছে। নদীতে নিষ্ঠুর ব্যাপারীরা কলের নৌকা নিয়ে এসেছে। ওরা সেই ভয়ংকর কারেন্ট-জাল পেতেছে। চাপিলাটা একটু নরম হলো; বলল, থাকুক তা হলে। দিনের আলোয় পথ দেখে ভালোয় ভালোয় চলে যেন যায়। তা কোথায় যাওয়া হবে শুনি!
মেলি বলল, আমি বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সমুদ্রে যাচ্ছিলাম।
চাপিলার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। তারপর শুরুগম্ভীর স্বরে বলল, ও রকম উঠতি বয়সে আমারও একবার সাধ জেগেছিল সমুদ্রে যাবার। কিন্তু সেবার বন্যার কারণে সারাদেশ এক মহাসমুদ্রে পরিণত হয়ে যায়। আমি তাই সমুদ্রে যাবার পথ হারিয়ে ফেলি।
মেলি বলল, তা হলে চলো এবার আমার সাথে।
চাপিলা আমতা আমতা করে বলল, না এবার আর আমার যাওয়া হবে না। শুনেছি সমুদ্রে এখন হাঙ্গরের দিন। ওরা ইলিশের ঝাঁককে তাড়া করে পদ্মায় তুলে দিয়েছে। ইলিশদের একদল উঠেছে মেঘনায়।
চাপিলার মুখে মেঘনার কথা শুনে ঢেলিকে মনে পড়ল মেলির। বেচারি, মেঘনার বুকে কী অবস্থায় আছে, কে জানে। ওদিকে গঙ্গা বেয়ে পদ্মায় নেমে ফের নগরবাড়ি, গোয়ালন্দ হয়ে মহাপদ্মায় ভাসতে ভাসতে চেলিও ভাবছে ঢেলির কথা। সে ভাবছে, হয়তো তিন বান্ধবী আবার একদিন একসাথ হবো। তারপর তিনদিন তিনরাতের সকাল-দুপুর-বিকেল পেরিয়ে গেছে। মেলি বেরিয়ে এসেছিল চাপিলার গর্ত থেকে। ওটা একটা অহংকারী মিথ্যুক মাছ। সেদিন বিকেলে সে নিজেকে সবচাইতে সুন্দর মাছ বলে দাবি করে। সে বলে যে, সে নাকি ইলিশ-গোত্রীয়, তার পূর্ব পুরুষরা নাকি ইলিশই ছিল। চাপিলাটা শেষ পর্যন্ত মেলি কে ‘মলা-ঢেলা-চেলা’ বলে তুচ্ছ করেছে। তাই মেলি মনে কষ্ট নিয়ে কদমতলা ত্যাগ করে। আসার সময় ওর সঙ্গী হয় ওরই স্বজাতি ভাই মলামাছটা। মলাটা ওর বন্ধু হয়ে শীতালক্ষ্যা, ধলেশ্বরী সাঁতরে এখন বুড়িগঙ্গার অদূরে আছে । বুড়িগঙ্গার অবস্থা ভয়ংকর। কুঁচকুঁচে কালো নোংরা পানির এক নরক যেন এ নদী। ওরা নদীতে ঢোকে না। তখন ঘোর সন্ধ্যা। বুড়িগঙ্গাকে দূর থেকে ঝলমল করতে দেখল ওরা। একট লঞ্চ ভেঁপু বাজিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে ওটা? চাঁদপুর না পাতার হাট? হয়তো ভাটির মুখে সাগরকূলের কোন দেশে যাবে ওটা। মেলি তার মলা বন্ধুকে নিয়ে ওটার পেছনে ছোটে। ওরা লঞ্চটার গায়ে গা লাগিয়ে মিশে থাকে। মলা বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মেলি বলল, সমুদ্রসাধকের সন্ধানে।
মলা বলল, ওই সাধক কি বুড়িগঙ্গায় আসবেন?
মেলি বলল, আমরা চাইলেই আসবে। নদীর অধিপতি তাকে পাঠাবেন।
মলা জানতে চায়, নদীর অধিপতি কোথায় থাকেন?
মেলি বলল, ওই তো মেঘনার মোহনায়। ওখানে নদীর অধিপতির বাড়িতে যাবার সুড়ংগ আছে। ওই সুড়ংগ পথেই যেতে হবে তার কাছে। তার কাছে বুড়িগঙ্গার করুণ কথা খুলে বলতে হবে।
মলা আর মেলি কথা বলতে বলতে একটু অমনোযোগী হওয়ায় ওরা লঞ্চের গা থেকে ছিটকে পড়ে। তারপর কূলের দিকে এগোয় ওরা।
তারপর এভাবে চলতে চলতে, ভাসতে ভাসতে ওরা মেঘনার মোহনায় চলে আসে। তবে তা এক দু’দিনে নয়। তা হবে হয়তো দিন সাতেক। ততদিনে ডাকাতিয়া নদীর কূল ধরে ঢেলিও চলে আসে মেঘনার মোহনায়। পথে তার কত না স্মৃতি। একটা বেদের বহর দেখেছিল ঢেলি। নৌকায় তাদের বাচ্চাকাচ্চাকে খেলতে দেখেছে। বেদে-তরুনীকে দেখেছে সাপ নিয়ে খেলা দেখাতে। মেঘনা নদীর তীরেতীরে ঢেলি বেশ কয়েকদিন ঘুরেছে। বন্ধুর সঙ্গে মেলিরও কম দেখা হয়নি। কত জলচর পাখিদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। তারা সত্যি কত ভালো। একটুও লোভাতুর দুষ্টিতে তাকায়নি ওরা। অবশেষে মাছের মেয়েরা তাদের দীঘল নদী সফরের কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হয়। দীর্ঘ এ সফরে নদীর জল ছাড়া তাদের আর কোন অবলম্বন ছিল না। ঢেলি আর চেলির কোন সঙ্গী ছিল না। শুধু মেলিই পেয়েছিল তার এক মাছবন্ধুকে। কিন্তু সেও হঠাৎ হারিয়ে যায় ত্রি-মোহনায় পৌঁছানোর আগেই।
একদিকে পদ্মা। অন্যদিকে মেঘনা। আর এক দিকে যমুনা। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ; তিন দিক থেকে তিন নদী এসে ত্রি-মোহনার সৃষ্টি হয়েছে। মোহনায় আছে জলের সুড়ঙ্গপথ। বিপুল বিক্রমে জলের সুড়ংগে ঢুকে পড়ে কত শত মাছ। ওরা সুড়ংগ পথে হারিয়ে গিয়ে নিশ্চয় সমুদ্রে গিয়ে ওঠে। মাছ মেয়েরা ভাবে, হয়তো এভাবেই একদিন সমুদ্রে যাওয়া যাবে। তিনটি মাছের তিনটি মন কিন্তু তিন জনের ইচ্ছেই এক। এটা ভাবতেই অবাক মনে হলেও তা ঘটতে যাচ্ছে। হয়তো নদীর মহান অধিপতি ইচ্ছেকে এক সাথে মিলিয়ে দিতে যাচ্ছে।
হঠাৎ এক আজব কাণ্ড ত্রিমোহনা বরাবর আকাশে সহসাই উড়ে এলো এক কলের পাখি। বিকট শব্দ করে ঘূর্ণায়মান ডানায় ভর করে সে হয়তো মোহনায় জলের সুড়ংগে এসে পড়বে। এ সময় তিন নদীর মুখ থেকে ধেয়ে এলো তিনটি কলের নৌকা। তারপর সে কী গোলাগুলি! নৌকাগুলো থেকে জেলেরা আর্ত-চিৎকার করছে। তারা বলছে, ‘বাঁচাও, বাঁচাও’। কিন্তু মুখে কালো কাপড় বাধা ডাকাতগুলো ওদের বুকে রাইফেল তাক করে রাখে। ওরা চুপ নৌকার খোলে ঢুকে পড়ে মরার মতন পড়ে থাকে।
গোলাগুলি থামে না। কেউ কাউকে ছাড়ে না। এক নৌকা থেকে সর্দার অন্য নৌকাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, সরে যাও, কেটে পড়ো, নইলে কপাল ফাটবে। এটা আমাদের জল-সীমানা। এখানকার সবমাছ আমাদের। কিন্তু অন্যরা তা শুনলো না, মানলো না। বশ্যতা স্বীকার করল না। শুরু হলো ফের গোলাগুলি। উপর থেকে কলের পাখিতে কালো পোশাক পরা রাজার সৈন্যরা তৎপর হলো। ওরা রাজার লোক। ওরা জলদস্যুদের শেষ করে দিতে কলের পাখি থেকে গুলি ছোড়ে। ওরা নদীতে শান্তি ফিরিয়ে দিতে চায়।
নদীর অধিপতি রাজার বাহিনীকে ভালো কাজে সাহায্য করল। জলডাকাতের নৌকাগুলোকে শিক্ষা দিতে এ সময় সমুদ্র সাধকও উঠে এলেন। ফুলে ফেঁপে উঠল তিন নদীর জল। জলের সুড়ংগ পথের মুখ বড় হয়ে গেল। দূর থেকে মাছমেয়েরা দেখল এক জলবৃদ্ধকে। শুভ্র-সমুজ্জ্বল দীঘল দাড়ি আর বাবরি চুল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। তার সে ঝাঁকুনিতে নদীর জল ওলোট-পালট হয়ে গেল। তারপর সব শান্ত হয়ে গেল; আর কিছু চোখে পড়ল না কারো। যখন নদী শান্ত হলো তখন জলডাকাতদের আর দেখা গেল না। দস্যুগুলোকে জলের সুড়ংগ পথে নিয়ে গেছে সেই সমুদ্র সাধক। নদীর অধিপতি ওদের বিচার করবেন। কিন্তু কোথায় সেই মাছ মেয়েরা? তারাও কি ঢুকে পড়েছে সমুদ্রসাধকের পিছুপিছু জলের সুড়ংগ পথে? হায় হায়, ওরা কি বেঁচে আছে তাহলে !
ত্রিমোহনার জলের সুড়ঙ্গ দিয়ে নদীর অধিপতির সাম্রাজ্যে পৌঁছানো যায়; তবে সহজসাধ্য নয়। অনেকটা পথ নেমে ওরা খুঁজে পেয়েছিল। সেটা ছিল জলের একটা গোলাকার কক্ষ। বলা যায় জলের বড়সড় বুদ্বুদের একটা বল। একদিকে তার মুখ খোলা। সেই খোলা মুখ দিয়ে তিনটি মাছের মেয়ে একসঙ্গে ঢুকে পড়ে। অনেকদিন পর একসঙ্গে হলো ওরা; কিন্তু কেউ কাউকে চিনল না। একজন আরেকজনকে শুধু জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কে?’ কিন্তু কেউ উত্তর দিতে পারে না। তবে ওরা পাশাপাশি সাঁতার কেটে গোলাকার জলের কক্ষটায় ঘুরতে থাকল। হঠাৎ কক্ষের মুখে এক বালক-মাঝিকে দেখা গেল। সে এলো সোনারঙ্গা জলের এক নৌকায় চড়ে। হাতে তার রূপালী জলের বৈঠা। তার মুখে মৃদু হাসি, আর তার দেহটা ছিল তামাপোড়া জলের তৈরি।
ঢেলি বলল, তুমি তো মেঘনাপাড়ের দুরন্ত ছেলে। শোনো বালকমাঝি, আমাদের পথ বলে দাও। আমরা নদীর অধিপতির সঙ্গে দেখা করে সমুদ্রসাধকের বাড়ি যাবো। ঢেলির স্পষ্ট মনে পড়ে: মেঘনাপাড়ের এই ছেলেকে সে মেঘনার বুকে নৌকা নিয়ে নাচতে দেখেছে। ছেলেটির সঙ্গে কত কথা বলেছে সে। তার হারিয়ে যাবার কথা সে তাকে বলেছিল। ছেলেটি তাকে বলেছে, এসেছো যখন, তখন আর পিছুফেরা নেই। এই দেখো না, মেঘনার বুকে আমি কেমন ভাসছি আর ডুবছি। আমিও একদিন যাবো নদীর অধিপতির কাছে, সমুদ্রসাধকের কাছে আমরাও যাওয়া চাই।
সহসা এক উত্তাল ঢেউ এসে মেঘনানদীর জেলে বালকটাকে কোথায় নিয়ে গেল। কেউ তাকে আর খুঁজে পায়নি। আজ তারই জলের মূর্তি দেখা গেল নদীর অধিপতির রাজ্যে। মেঘনানদীর নেয়েটা মাছমেয়েদের সঙ্গে কথা বলল না। নীরবে নৌকা বেয়ে চলে গেল। মাছ মেয়েরা ওর পিছু নিল। বালক মাঝি জলের গড়া নৌকা নিয়ে সুড়ঙ্গ বেয়ে নিচে নামছে। ওরা ওর পিছু নেয়। যেতে যেতে ওরা থামল আরেক কক্ষে। বালক হাত ইশারা করল। মাছ মেয়েরা ভাবলো, এ কক্ষে হয়ত নদীর অধিপতি থাকেন। কিন্তু ওরা দেখল আরেক দৃশ্য। তা দেখে মাছ মেয়েদের মন খারাপ হয়ে গেল। তারা দেখল ছোট্ট একটা শিশু হাত-পা মেলে নিশ্চুপ ঘুমিয়ে আছে। মেলির স্পষ্ট মনে পড়ল, এই শিশুটা সেই বানভাসি শিশু। রাতের আঁধারে বাধ ভেঙ্গে তলিয়ে যাওয়া কোন মায়ের কোল খালি করে ভেসে গিয়েছিল জলের স্রোতে। জলের কক্ষ থেকে বেরিয়ে ওরা বালকমাঝিকে পেল না। মাছ মেয়েরা সুড়ংগ বেয়ে আবার নামতে থাকে। তারপর নামতে নামতে ওরা কত যে সময় পার করে দিল। এখানে দিনরাত নেই সকাল-বিকাল-দুপুর নেই। তবে সারাক্ষণ স্বচ্ছ জলের চকচকে ভাব বিরাজ করে।
জলের সুড়ংগ পথে আরেক জগত; সে জগত জলের অধিপতির। মাছ মেয়েরা খুঁজছে তাকেই। কিন্তু সুড়ংগ পথের শেষটা কোথায়? কোন কক্ষে তিনি থাকেন, তা কে জানে! ওরাতো জানেই না। জলের উপর ভাগে, নদীর বুকে তখন দিন শেষে রাত নেমে আসে। রাতের পর আসে দিন। এভাবে মাঝি, যাত্রী আর জেলেদের কেটে যায় কয়েক পক্ষকাল। চেলি, মেলি আর ঢেলি প্রায় একসঙ্গেই গিয়ে উঠল নদীর অধিপতির প্রাসাদে তিনি তখন বিরাট এক জলের কুণ্ডলীর উপরে ভাসমান এক জলের সিংহাসনে বসে আছেন। তার সে সিংহাসনের দীঘল দীঘল পাগুলো পদ্মার ঘোলা জলে নির্মিত। সিংহাসনের বাকি অংশ নির্মাণ করা হয়েছে মেঘনার গহীন কালো জলে।
নদীর অধিপতিকে দেখা যাচ্ছিল না। তবে যমুনার স্বচ্ছ জলের ধারায় তৈরি একটা রাজমুকুট ওই সিংহাসনটার ওপর হেলেছিল আর দুলছিল। মেলির দেখে ভয়ভয় লাগছিল। ঢেলি বলল, ভয় নেই, আমরা তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। চেলি কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু পারল না। হঠাৎ একটা গ্রাম্য কিশোরী জলের অতল থেকে ভুস করে ভেসে উঠল। যেন জানতে চায়, কাকে চাও। চেলি বলল, তুমি কে? মেয়েটি কিছুই বলল না। যেমনি এসেছিল তেমনি টুবুক করে জলের অতলে হারিয়ে গেল। মাছমেয়েদের আর জানা হলো না কিছু। ওরা জলের সুড়ংগ ধরে বিনা সাঁতারেই এগিয়ে চলে। সুড়ংগের জলপথ এতক্ষণ খাড়া ছিল; জলের গতি ছিল ভয়ানক। পরে ধীরে ধীরে জলপথ সরল হয়। গতি হতে থাকে মৃদু। কী চমৎকার দৃশ্য! নদীর ভেতরে নদী! মাঝে মাঝে জলের বুদ্বুদ দিয়ে নির্মিত জলের বল। এগুলো জলের কক্ষ। মাছমেয়েরা নিরবে চলছে। কেউ কথা বলে না। জলের সুড়ঙ্গ পথটা এমনি এক জগৎ; এখানে কেউ কথা বলতে পারে না। অদৃশ্যে থেকে শুধু জলের অধিপতি কথা বলেন। সমুদ্রসাধকও নিশ্চুপ। মাছমেয়েরা ঘুরতে ঘুরতে আবার জলের অধিপতির কক্ষে চলে আসে। মাছমেয়েরা অবাক হয়ে যায়। তারা দেখলো সাদা একটা জলজমুকুট এগিয়ে আসছে। মুকুটটা পারদের মতন ঝলমল করছে। ওটা জলের অধিপতির মুকুট? মেলি, ঢেলি আর চেলি চিৎকার করে জলের অধিপতিকে ডাকতে চাইল কিন্তু পারল না। শুধু মনেমনে বলল, ‘হে জলের অধিপতি, হে আমাদের নদীর অধিপতি, আমাদের পথ বলে দিন। আমরা সমুদ্রে যাব।’
জলের মুকুট স্থির হয়ে গেল। তারপর ধীরেধীরে হেলতে দুলতে উপরে উঠতে লাগল। বেশ উপরে উঠে ওটা আবার আছড়ে পড়ল নীচের দিকে। জলের ধারায় মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল মুকুট। সেখানে একটা সুড়ংগ পথ তৈরি হলো। মাছমেয়েরা সুড়ংগের স্রোতে ঢুকে পড়ল। অনেকক্ষণ চলার পর ওরা এক বিশাল বুদ্বুদের বলের ভেতর প্রবেশ করল। বুদ্বুদের বলটা বিশাল একটা জলের কক্ষ। ভেতরে অবাক করা এক জগৎ। ঢেলি দেখল সেই গ্রাম্য মেয়েটা ঠোঁটে হাসি নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ঢেলির স্মৃতিটা মুহূর্তেই জেগে উঠল। তার মনে পড়ল মেয়েটাকে সে মেঘনার বালুচরে দেখেছে। মেয়েটা কী চঞ্চলতাই না দেখাত। ওর বাবা ছিল সাগর জেলে। কয়েকটা গরু ছিল ওদের। মা-মেয়েতে মিলে ওগুলোকে মেঘনার চরে চরিয়ে বেড়াত।
ঢেলির ভাবনা শেষ না হতেই নদীর অধিপতির উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। গমগমে গলায় এই প্রমবারের মতন তিনি কথা বলে উঠলেন: শোনো, মাছের মেয়ে, বাকিটা তুমি জানো না, আমি যা বলছি তা হলো পরের ঘটনা। শোনো মেয়ে, তুমি তো চলে এলে মোহনার মুখে আমার সাম্রাজ্যের দ্বারে। সেদিন বিকেলে মেঘনায় ঢল নামে। জোয়ারের জল কূলে উপচে গিয়ে পড়ে। আমিনার মা আমিনাকে বালুচরা থেকে গরুগুলোকে নিয়ে আসতে বলল। আমিনা দৌড়ে গেল বালুচরায়, ততক্ষণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস গ্রাস করে ফেলল মেঘনার বালুচর। আমিনা গরুগুলো তাড়িয়ে নিয়ে এলো অনেক দূর পযর্ন্ত; কিন্তু মানুষেরা বড় ভুল করে, তারা সমুদ্র আর তার জলরাশিকে খুব খাটো করে দেখে। তাই আমিনাকে গ্রাস করে মেঘনার ঢল। জেলেরা তার দেহটা খুঁজে পায় তাদের জালে। কিন্তু তার আত্মাটাকে সমুদ্রসাধক আমার কাছে এনে দেয়। আমি মেয়েটির আত্মাটাকে আমার এই জলজ জাদুঘরে আশ্রয় দিয়েছি। মেয়েটা এখানে ভালোই আছে। তোমরা আমার এই জলজ জাদুঘর ঘুরেঘুরে দেখ। এখানে তোমরা তোমাদের জলের তলে হারানো মুখ আর দৃশ্যপট খুঁজে পাবে।
সমুদ্রসাধক ঠিকই বলেছে। পথের কত ঘটন-অঘটন এখানে জমা হয়ে আছে। ঢেলির দেখা মেঘনাপাড়ের মাঝি ছেলেটা পাহাড় সমান ঢেউয়ের মাথায় হারিয়ে গিয়েছিল। তার আত্মার দেখা মিলল এই জলজ জাদুঘরে। চেলি পদ্মানদীর বঞ্চিত কুবের মাঝির মতন একজনকে দেখল। আহা! বয়োবৃদ্ধ মাঝি টাল সামলাতে না পেরে নৌকা থেকে পড়ে মারা যায়। মেলি দেখল, খেয়া পারের শিশুমৃত্যুর করুণ দৃশ্য; ফুটফুটে শিশুর আত্মাটার জলজমূর্তিও আছে জাদুঘরে। জাদুঘরে দেখাগেল জলদস্যুদের মৃতদেহ, যাত্রি বোঝাই লঞ্চডুবিতে হারিয়ে কত মৃতমুখ। দেখল সেই কতকাল আগের একটা স্টিমার। নদীর অধিপতি গুরুগম্ভীর কন্ঠে মাছমেয়েদের বললেন, তোমরা ধন্যি মেয়ে, তোমরা সমুদ্রযাত্রা জয় করতে যাচ্ছো। পথের সংগ্রামে তোমরা টিকে আছো; যদি হেরে যেতে তা হলে তোমাদের নিশ্চিত অবস্থান হতো আমার এই জলজ জাদুঘরে। এই জলজ জাদুঘর দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছি সমুদ্রসাধককে। তোমরা তার দেখা পাবে। এসো আমার পেছনে পেছনে।
জলের মুকুট আবার জেগে উঠল। মাছমেয়েরা মুকুটের পিছু নিল। কিছুদূর গিয়ে নদীর অধিপতির মুকুট স্থির হয়ে দাঁড়াল। জলের মুকুট স্থির হয়ে গমগমে গলায় বলল, শোনো মাছমেয়েরা, তোমরা তিনবন্ধু ছিলে, কিন্তু আজ তোমরা কেউ কাউকে চিনছো না। তবে আমি তোমাদের বর দিচ্ছি, তোমরা পৃথিবীর জ্ঞান ফিরে পাবে, তবে তা কিছুক্ষণের জন্য। পরে তোমরা যে-যার পথে সমুদ্রসাদকের দেখা পাবে। তারপর সত্যিই মাছমেয়েরা বেবি ফিরে পেলো। তারা একে অপরকে চিনতে পেরে কতক্ষণ পানিতে ঝাপটাঝাপটি করলো। একে অপর জড়িয়ে ধরল, চুমু খেলো। তা দেখে নদীর অধিপতি অদৃশ্য হাসি হাসল। পুলকে তার বিস্ময়কর জলজ মুকুট হেলতে দুলতে লাগল।
এভাবে কতক্ষণ আনন্দে কাটল ওদের। কিন্তু জলের অধিপতি যখন ওদের বললেন, এবার তৈরি হও, শুরু করো চূড়ান্ত সমূদ্রযাত্রা; তখন ওরা কেঁদে ফেলল। জলের অধিপতি বললেন, শোনো ঢেলামেয়ে, দক্ষিণপূর্ব কোণে তাকাও, তুমি যাবে এই পথে। যেতে যেতে তুমি পাবে স্বচ্ছ এক জলের জগত। যেখানে প্রবালেরা জীবিত চরে বেড়ায়। ঝিনুক, শালুক, লাল-কাঁকড়াদের বন্ধুত্ব পাবে। যেতে যেতে তুমি নিঝুম এক দ্বীপ পেতে পারো। সেখানে দেখবে হরিণেরা চরে বেড়ায়। যাও এখুনি ঢুকে পড়ো, পথে নামো। তোমার সমুদ্র যাত্রা শুভ হোক, তুমি সাত-সকাল আর সাত-দুপুরের পর তার দেখা পাবে। জলের অধিপতি এবার মেলিকে বললেন, নাক বরারর দক্ষিণে যেতে। বলল, তুমি গিয়ে উঠবে এক মহাবনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নীল জলরাশিতে। শুরু হোক তোমার যাত্রা, তুমি সাত-দিন, সাত-রাত পর সমুদ্র সাধকের দেখা পাবে। সবশেষে চেলিকে বলা হলো, তুমি এই দক্ষিণপশ্চিম বরাবর জলের সুড়ঙ্গ পথে ছুটে যাবে সাত-বিকেল আর সাত-গহীনরাত পর্যন্ত। তারপর তুমি গিয়ে পৌঁছাবে প্রাচীন এক ব্যঘ্রতটে, যার চারপাশটা নীলাভ জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছে। সেখানেই তুমি সমুদ্রসাধকের দেখা পাবে। যাও মাছমেয়েরা, যাত্রা তোমাদের শুভ হোক।
অতঃপর তিনটি মাছের মেয়ে কেঁদেকেঁদে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জলরাজ্যের তিনটি ভিন্ন পাতালপথে সমুদ্রের কোলে ওঠার যাত্রা শুরু করে। কেননা, অথই নীলাভ জলের গভীরে দরদী এক সমুদ্রসাধক ওদেরকে স্বাগত জানাতে অধীর অপেক্ষায় আছেন।

Share.

মন্তব্য করুন