সব কিছুরই শেষ আছে। যে ক্রিকেটার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে দর্শকদের আনন্দে মাতিয়ে রাখেন তাকেও একদিন তুলে রাখতে হয় ব্যাট-প্যাড। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই একটা সময় পর একজন ক্রিকেটারকে বিদায় নিতে হয়। সুযোগ করে দিতে হয় নতুনদের। তবে সবাই চায় সুন্দর একটি বিদায়, বড় মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে। তাই একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের শেষ ঘোষণা করার জন্য বিশ্বকাপের চেয়ে বড় মঞ্চ আর হয় না। আগামী মাসেই শুরু হচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে চলে আসা অনেক ক্রিকেটার চাইছেন এই আসরের মঞ্চ থেকেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানতে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন এমন ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন করেও ঘোষণা আসতে পারে আরো। আবার ঘোষণা ছাড়াও অনেকে বিশ্বকাপ শেষে খুলে রাখতে পারেন প্যাড, গ্লাভস। আজকের এই লেখায় আমরা তেমন কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনা করবো।

ক্রিস গেইল

ক্রিস গেইল

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই যুগে ক্রিস গেইল নিজের নামের সাথে পেয়ে গেছেন নানান উপাধি। ‘ক্যারিবীয় দানব’, ‘ইউনিভার্স বস’- আরো কত উপাধি তার নামের সাথে। সেই গেইল ঘোষণা দিয়েছেন আগামী বিশ্বকাপের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর। গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের আগে বলেছেন, দেশের মাটিতে সেটিই তার শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজ। বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলবেন জাতীয় দলের হয়ে।
ক্রিকেটে বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারের অধিকারী ক্রিস গেইল। জ্যামাইকার কিংসটনে জন্ম নেয়া গেইল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের জার্সিতে খেলেছেন সেই ১৯৯৯ সাল থেকে। মাঝখানে বহু উত্থান পতন গেছে তার ক্যারিয়ারে। কখনো বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, বোর্ডের সাথে বিদ্রোহ করে জাতীয় দলে খেলা বন্ধ করেছেন। তবে দর্শকদের মাতিয়ে রাখা থেকে দূরে থাকেননি একটি বারের জন্যও।
বিশ্বকাপ খেলতে খেলতে বয়স চল্লিশ হয়ে যাবে। কিছুদিন ধরে ব্যাটিংয়েও যেন সেটি ফুটে উঠেছে। এ বছর বিপিএলে নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। গত বছর আইপিএলে নিলামে তাকে নিয়ে কোন কাড়াকাড়ি হয়নি। প্রথম দুই দফা নিলামে তাকে কেউ কেনেনি। তৃতীয় দফায় কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব কিনে নেয় ভিত্তিমূল্যে। অথচ এক সময় তাকে পেতে দলগুলো নিলামে টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হতো। এবার বিগব্যাশেও দেখা যায়নি গেইলকে। এক বছর ধরে জায়গা হচ্ছে না ওয়েস্ট ইন্ডিজ টি- টোয়েন্টি দলে। সব মিলে তাই শেষের ডাকটা হয়তো শুনতে পেয়েছেন তিনি। আর সামনে যেহেতু বিশ্বকাপের মত বড় আসর- এটাকে উপলক্ষ করেই বিদায় বলতে চান।
তবে ব্যাট হাতে ঝড় তোলার সামর্থ্য যে গেইলের ফুরিয়ে যায়নি সেটি তিনি প্রমাণ করেছেন বিদায় ঘোষণা দেয়া সিরিজেও। ৫ ম্যাচের সেই সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রম ম্যাচে ১২৯ বলে ১৩৫, দ্বিতীয় ম্যাচে ৬৩ বলে ৫০, তৃতীয় ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পণ্ড হয়। শেষ দুই ম্যাচে গেইলের স্কোর ৯৭ বলে ১৬২ এবং ২৭ বলে ৭৭। এক সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও গড়েছেন। শেষ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সবচেয়ে কম বলে ওয়ানডে হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন (১৯ বলে)। ঘরের দর্শকদের সামনে ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজে এমন অবিশ্বাস্য খেলে বিদায় বলতে পারা ক্রিকেটারের সংখ্যা হাতেগোনা।
টি-টোয়েন্টির রাজা হিসেবে খ্যাত হলেও গেইলের টেস্টে দু’টি ট্রিপল সেঞ্চুরি আছে (৩৩৩ ও ৩১৭)। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি (২১৫)। সব মিলে টেস্ট সেঞ্চুরি ১৫, ওয়ানডেতে ২৫ ও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ২টি। আর ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি ২১টি। দেশের হয়ে জিতেছেন দু’টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা ও একটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০০৪)। জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৩ বছর। এবার বিশ্বকাপে মনে রাখার মতো কিছু করতে পারলেই চমৎকার একটি সমাপ্তি হবে প্রায় ২০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের। এরপর হয়তো আরো কিছুদিন খেলবেন ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি।

মহেন্দ্র সিং ধোনিমহেন্দ্র সিং ধোনি

ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। ক্রিকেটে সম্ভব এমন সব কিছুই বলতে গেলে ভারতকে এনে দিয়েছেন তিনি। অভিষেকের মাত্র ৩ বছরের মাথায় ২০০৭ সালে ভারতের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেন এমএস ধোনি। রাহুল দ্রাবিরের কাছ থেকে বুঝে নেয়া দায়িত্ব ছেড়েছেন ২০১৬ সালে বিরাট কোহলির কাছে। মাঝখানের সময়টাকে ভারতীয় ক্রিকেটে দিয়েছেন দু’হাত উজাড় করে। দায়িত্ব নেয়ার প্রথম বছরেই ভারতকে জিতিয়েছেন টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০১১ সালে এনে দিয়েছেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। এ ছাড়া একবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও দু’বার এশিয়া কাপ জিতেছে ভারত ধোনির নেতৃত্বে। টেস্ট র‌্যাংকিংয়ের এক নম্বর স্থানে উঠিয়েছেন দলকে।
শুধু জাতীয় দল নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটেও ধোনি ছিলেন সবচেয়ে সফল। আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসকে তিনবার চ্যাম্পিয়ন করেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি- টোয়েন্টি জিতিয়েছেন দুই বার। অর্থাৎ যেখানেই হাত দিয়েছেন সফল হয়েছেন এমএস ধোনি। দায়িত্বশীল ব্যাটিং, উইকেটের পিছনে গ্লাভস আস্থা আর ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিনায়কত্ব তাকে সহায়তা করেছে একের পর এক সফলতার সিঁড়ি অতিক্রম করতে। প্রতিভা আর পরিশ্রমের পাশাপাশি ভাগ্যেরও সহায়তা পেয়েছেন সবক্ষেত্রে। ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্রিকেটে খ্যাতি পেয়েছেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হিসেবে।
এসবের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও ছিলেন দুর্দান্ত। ৬-৭ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ম্যাচ শেষ করে আসাই ছিলো তার কাজ। যে কারণে খ্যাতি পেয়েছেন ফিনিশার হিসেবেও। বিপর্যয়ের মুহূর্তে ঠাণ্ডা মাথায় দলের হাল ধরা কিংবা উইকেট হাতে থাকলে চার-ছক্কার বন্যা বইয়ে দেয়া- কোনটাতেই জুড়ি নেই ধোনির। ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে ৭৯ বলে ৯১ রানের ইনিংস খেলে হয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে জন্ম নেয়া ধোনি ভারতের হয়ে করেছেন ১৬টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। সব ফরম্যাট মিলে আন্তর্জাতিক রান ১৭ হাজারের বেশি।
তিন বছর আইসিসির বিশ্বসেরা টেস্ট একাদশের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। ৮ বছর আইসিসি ওয়ানডে একাদশে জায়গা পেয়েছেন যার মধ্যে ৫ বার ছিলেন অধিনায়ক। ক্রিকেটে সাফল্যের জন্যই পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ পদক ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মানজনক লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদ পেয়েছেন। গত বছর দুয়েক ধরেই শেষের ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন ৩৮ বছর বয়সী ‘মাহি’। বয়সের ছাপ পড়েছে ব্যাটিংয়েও। দলে জায়গাটাও অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে কিছুদিন। এখনো ঘোষণা না দিলেও এবারের বিশ্বকাপের পর যে জাতীয় দলের নীল জার্সিটা চিরতরে তুলে রাখবেন সেটি অনেকটাই নিশ্চিত। হয়তো আরো কিছুদিন খেলবেন ঘরোয়া ক্রিকেট।

ইমরান তাহির

ইমরান তাহির

গত মার্চেই ইমরান তাহির জানিয়ে দিয়েছেন যে, আসছে বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন। বর্তমান সময়ে বিশ্বে যে কয়েকজন লেগ স্পিনার দাপটের সাথে খেলছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ইমরান তাহির। পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম নেয়া ইমরান তাহির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে। পাকিস্তানেই ক্রিকেট শুরু করেছিলেন তিনি। কিংবদন্তি লেগ স্পিনার আবদুল কাদিরের কাছে বোলিং শিখেছেন। পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও খেলেছেন; কিন্তু সেখানে সুবিধা করতে না পেরে কিছুদিন ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে খেলার পর খেলতে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানেই স্থায়ী হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভালো মানের স্পিনারের সঙ্কট আজীবনের। সেই সুযোগটা কাজে লাগান তাহির। নাগরিকত্ব পেয়ে যাবার পর জাতীয় দলে সুযোগ পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।
২০১১ সালে সবুজ জার্সিতে অভিষেক তার। দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশন ও পিচ বরাবরই স্পিনারদের জন্য প্রতিকূল। ঘাসযুক্ত পিচে বল টার্ন করানো কঠিন। তেমন জায়গা থেকেই ইমরান তাহির বিশ্বমানের স্পিনার হয়ে উঠেছেন প্রতিভা আর পরিশ্রমের জোরে। টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে না পারলেও ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে তিনি বোলারদের জন্য আতঙ্ক। ২০১৬ সালে প্রথম প্রোটিয়া বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ৭ উইকেট নিয়েছেন তাহির। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সবচেয়ে কম ম্যাচে একশ ওয়ানডে উইকেটও তার (৫৮ ম্যাচ)। টি-টোয়েন্টিতেও তার দেশীদের মধ্যে সবার আগে ৫০ উইকেট নিয়েছেন। ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিকও আছে একটি। ৯৫ ওয়ানডেতে উইকেট ১৫৬টি, ৩৭টি টোয়েন্টিতে ৬২টি আর ২০ টেস্টে উইকেট ৫৭টি।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে একই সাথে ওয়ানডে ও টি- টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ের এক নম্বরে উঠেছিলেন। আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলের ছিলেন ২০১৫ সালে। ৪০ বছর বয়সী ইমরান তাহির বিশ্বকাপে ভালো কিছু করেই বিদায় নিতে চাইবেন। আর সেটিই কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলবে তার প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের।

মাশরাফি বিন মর্তুজামাশরাফি বিন মর্তুজা

অনেকদিন ধরেই জাতীয় দলের হয়ে শুধু ওয়ানডে ক্রিকেট খেলছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। ইনজুরির কারণে খুব বেশি টেস্ট খেলতে পারেননি। আর টি- টোয়েন্টিকে বিদায় বলেছেন গত বছর শ্রীলঙ্কা সফরে। আগামী বিশ্বকাপের পর যে ওয়ানডেকেও বিদায় বলবেন সেটি অনেকটাই নিশ্চিত। মাশরাফির উত্থান, সাফল্য নিয়ে আগেও একাধিকবার লিখেছি তোমাদের জন্য, সবারই কমবেশি সেসব জানা আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পাল্টে দিতে মাশরাফির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০০১ সালে অভিষেক জিম্বাবুয়ের টেস্ট দিয়ে। ইনজুরি বাধা হয়ে না দাঁড়ালে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরো বর্ণাঢ্য হতে পারতো।
৩৬ বছর বয়সী মাশরাফি খেলা ছাড়ার আগেই যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে। হয়েছেন এমপি। হয়তো খেলা ছাড়ার পর ফুলটাইম রাজনীতিবিদ হিসেবেই তাকে দেখা যাবে। আগামী বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে সম্মানজনক একটি ফল এনে দিয়ে নিজেও চাইবেন পরিতৃপ্তির সাথে বিদায় নিতে।

এর বাইরেও আরো অনেক ক্রিকেটার আছেন যারা বিশ্বকাপের পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলতে পারেন। শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা, আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবি, নিউজিল্যান্ডের রস টেইলরের নাম থাকতে পারে সেই তালিকায়।

Share.

মন্তব্য করুন