বৈশাখ মাস।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। আকাশের চারপাশ মেঘে ঢেকে গেল মুহূর্তেই। একটু আগেও কেমন ফকফকা রোদ ছিল। রোদের তেজে শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছিল।
কিন্তু হঠাৎ! হঠাৎ করেই একটা দমকা বাতাসে সবকিছু কেমন এলোমেলো করে দিল। মাঠের গাছ-গাছালির ডালপালা আর খেজুরের বাল্লেগুলো বাতাসে হেলে পড়ছে। আবার সোজা হচ্ছে। আবার হেলে পড়ছে। দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে যখন প্রচণ্ড বেগে ঝড়টা শুরু হয়ে গেল, তখন গাছের ডালপালা এমনভাবে একদিকে হেলে পড়লো, যেন সদ্য গোসল শেষে মাথায় চিরুনি দিয়ে কেউ চুল আঁচড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দূরে শুধু ধূলোর কুণ্ডুলি ঘন থেকে আরও ঘন হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। তারেকের দুই হাতে দুটো গরুর দড়ি। লম্বা দড়ি দুটো গোল করে পেঁচিয়ে ছোট করে নিয়েছে। গরু দুটোর নাম ধলা আর মোষে। ধলাটা সাদা, আর মোষেটার রং সাদা ও হালকা কালো মিশ্রিত। গরু দুটোর নামও দিয়েছে তারেক।
কালবৈশাখী । মামুন পারভেজস্কুল গরমের বন্ধ। ফলে হাতে অনেক সময়। সকালে বই পড়ে, পান্তা খেয়ে গরু দুটোকে নিয়ে মাঠে খাওয়ানোর জন্য বার হয়েছিল তারেক। গ্রামে কি আর ঘড়ি দেখে কাজ চলে? সূর্যই ওদের ঘড়ি।
তারেক যখন ধলা-মোষেকে নিয়ে বার হয়েছিল তখন সূর্যটা ছিল পুবের আকাশে। কখন যে সেটা নড়তে নড়তে মাথার ওপর এসেছে, তারপর হেলে পড়েছে পশ্চিমে, সেটা খেয়াল করেনি তারেক। কারণ, সকালে ঝালপোড়া আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা খেয়েছিল বেশি করে। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তার সাথে আবার ক’ফোঁটা মিশিয়ে নিয়েছিল খাঁটি সরষের তেল। আর যায় কোথায়!
যতক্ষণ পেটে ধরেছে, ততোক্ষণই খেয়েছে। তারেক ক্ষুধা অনুভব করছে না। তার চকচকে চোখ দুটো কেবল ধলা-মোষের পেটের দিকে। ওদের পেট এখনো খালি। মাঠের সরু রাস্তা। দু’পাশে ইরি-বোরোর ধান। হাত থেকে গরুর দড়ি ফসকে কিংবা ঢিলা হয়ে গেলেই বিপদ। গরু দুটো মুখ বাড়াবে কচি ধানের দিকে। সেটা হতে দেবে না তারেক। কারণ তাতে করে চাষীর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
খুব সাবধানে রাস্তার দু’পাশে গজিয়ে ওঠা তরতাজা সবুজ ঘাস খাওয়াচ্ছে তারেক। ধলা-মোষেও তেমনি। খুব দ্রুত ছিঁড়ছে আর মুখে ভরছে।
তারেকের মন ভরছে না। সে চায় আরও খাক ওরা। যত পারে খেয়ে নিক। ওদের পেট দুটো যতক্ষণ গোল না হয়ে উঠবে, ততক্ষণ আজ আর বাড়ি ফিরবে না সে।
খেয়াল করলো ধলা-মোষেরা পেটের দিকে। এখনো কিছুটা খালি মনে হচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ খাওয়ালে তারপর পেট দুটো ফুলে উঠবে। কিন্তু তার মধ্যেই দেখা দিল এই ধূলিঝড়ের বিপত্তি।
সময়টা যে কাল বৈশাখী সেটা অত খেয়াল ছিল না তারেকের। এখন সে গরুর দড়ি গুটিয়ে রাস্তার পাশে, বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক দাঁড়িয়ে নয়, শংকিত মনে আশ্রয় নিয়েছে। আকাশটা আরও ঘন হয়ে গেল মেঘে। যেন মস্তবড় এক একটি পর্বত। ভীষণ কালো। মাঝে মাঝে কড় কড় কড়াৎ বিকট শব্দে মেঘ ডাকছে। বিজলী চমকাচ্ছে মাঝে মধ্যেই।
যখন এমন ভয়ংকর আকার ধারণ করছে আকাশ, তখন কেঁপে উঠছে তারেকের বুক। ধলা-মোষেও কেমন অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
এমনই দুর্যোগ যে, তারেক বটতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস পাচ্ছে না, আবার ধলা-মোষেকে নিয়ে মাঠ থেকে বাড়ি আসতেও ভয় করছে। এক অজানা আতঙ্কে সে কেবলই কেঁপে কেঁপে উঠছে। না জানি রাস্তায় বার হলে ঝড়ে সে তাল সামলাতে পারবে না। কিংবা অকস্মাৎ বজ্রপাতও নামতে পারে।
নিজের জন্যে যতোটা না ভাবনা, তারচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা তার ধলা-মোষেকে নিয়ে। ওদের কোনো আঘাতই যে সইতে পারে না।
একটু পরেই ঝড়ের বেগটা কমে এলো। শুরু হলো বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার টপাটপ শব্দ। প্রথমে বটগাছের ডাল-পাতায় গা বাঁচালেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেল না। পাবার কথাও নয়। কারণ বৃষ্টির পানি গাছ ও পাতার ফাঁক গলিয়ে নিচে পড়তে সময় লাগে যেমন, তেমনি একবার পড়া শুরু হলে বৃষ্টি থামার পরও পড়তে থাকে। গাছের ডালপালা ও পাতায় আটকে থাকা পানিটুকু তো পড়বেই।
একেবারেই ভিজে গেছে তারেক। পুরো গোসল হয়ে গেল তার। মাথার চারপাশ বেয়ে ঝরঝর করে পানি নেমে পড়ছে। পরনের লুঙ্গি আর কোমরে বাঁধা গামছাও ভিজে একাকার। ওদিকে ধলা-মোষের অবস্থাও একই রকম। মনে হচ্ছে কপোতাক্ষ থেকে এইমাত্র ওদের গা ধুইয়ে তুলে আনলো।
তো সবাই যখন ভিজে গেছে,তখন আর বটতলায় দাঁড়িয়ে থাকা কেন? কথাটা মনে হতেই ধলা-মোষেকে সামনে দিয়ে পেছনে দড়ি দুটো ধরে ছুটা শুরু করলো তারেক। মাঠ থেকে বাড়িটাও নেহায়েত কম দূরে নয়। ঝড় আর বৃষ্টির কারণে এখন কেউ আর মাঠে নেই।
তারেক আর একটু সতর্ক হলে সেও হয়তো ঝড়ের আগেই ফিরে আসতে পারতো।
কিন্তু ধলা-মোষের পেটের দিকে তাকাতে গিয়ে সে আর আকাশ কিংবা চারপাশ তেমনভাবে দেখতে পারেনি। ধলা-মোষে দৌড়াচ্ছে সমানে। পেছনে দড়ি হাতে তাল মিলিয়ে দৌড়াচ্ছে তারেক।
দৌড়িয়ে যখন সে বাড়ি ফিরলো তখন তিনটি প্রাণীই হাঁপাচ্ছে। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ওঠানামা করছে দ্রুত। ধলা-মোষেকে গোয়াল ঘরে বেঁধে সে উঠোনে এসে দাঁড়ালো।
কালবৈশাখী । মামুন পারভেজমা বারান্দায় বসে কষে ধমক লাগালেন। মায়ের সেই ধমকের মধ্যে রয়ে গেছে অশেষ মমতার ছোঁয়া। মা বললেন, তাড়াতাড়ি পুকুরে যা। গোসল সেরে জলদি ফিরবি। তারেক পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই চোখ গেল পুকুর পাড়ের আমগাছের দিকে। পুকুরটা তাদের, গাছও তাদের। এবার অনেক আম ধরেছে। ছোট ছোট আমের থোকায় গাছের কচি কচি ডালগুলো নুয়ে পড়েছে। দেখতে দারুণ। পুকুরে নামার আগে তারেক আমতলাটা একটু ভালো করে দেখে নিল। বাহ! নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠলো।
ঝড়ে অনেক আম ঝরে পড়েছে। সেগুলো কুড়িয়ে সে লুঙ্গির কোঁচড়ে ভরলো। কোঁচড়টি ভারী হয়ে গেছে। গোসল না করেই সে কোচড় ভর্তি আম নিয়ে দৌড় দিল বাড়ির দিকে। মা দেখেই তো অবাক। একি রে!
তারেক মায়ের সামনে কোঁচড়টি উপুড় করে দিয়ে বললো, এগুলো শিগগির কুচিয়ে নুন-ঝাল দিয়ে মাখ মা, আমি আসছি। তারেক গোসল করতে আবার পুকুরে ছুটলো। ছেলের কাণ্ড দেখে মা আদরের সাথে বললো, পাগল কোথাকার! ঝড় থেমে গেছে। বৃষ্টিও নেই এখন।
কাল বৈশাখী যেভাবে দ্রুত এসেছিল ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে, আবার সেভাবেই দ্রুত চলে গেল। এখন পশ্চিমের আকাশে আবার সূর্যটা ভেসে উঠেছে। কী লাল! কী তার মিষ্টি আভা! সেই দিকে তাকিয়ে আছে তারেক। আর তার ডান হাতটা বাটির ভেতর কেবলি ওঠানামা করছে। ঝালানো আম! আর কিছু? এর মাজাটাই আলাদা। তার মনে হলো, কালবৈশাখী ঝড়টা এভাবে এলো বলেই না এই মজাটা সে লুটতে পারছে। তারেক ঝালানো আম খাচ্ছে। এই যে সেই দুপুর থেকে ঝড়-বৃষ্টির সাথে তার টানটান যুদ্ধ গেছে, ধলা-মোষেকে নিয়ে সে যে ভয়ংকর একটা সময় পার করেছে। এখন সেসবের আর কিছুই মনে নেই তারেকের। বরং তার ঠোঁটের কাছে চলে এলো ‘ঝড় আয়, আয় ঝড়, কাঁচা-পাকা আম পড়।…’

Share.

মন্তব্য করুন