লর্ডস। এই একটি শব্দই যথেষ্ট জায়গাটিকে চেনাতে। পুরো নাম লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড। ক্রিকেটের মোটামুটি খোঁজ খবর রাখেন এরকম যেকোনো লোক এক নামে চিনবেন লর্ডসকে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অভিজাত ক্রিকেট স্টেডিয়াম লর্ডস। লন্ডনের এই স্টেডিয়ামকে কেউ কেউ ক্রিকেটের তীর্থস্থান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। যদিও লর্ডসের দর্শক ধারণক্ষমতা মাত্র ২৮ হাজার।

ইতিহাস
যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টারের সেন্ট জন্স উড এলাকায় অবস্থিত স্টেডিয়ামটি। লর্ডস কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সঠিক দিনক্ষণ জানা যায় না। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার টমাস লর্ড ১৭৮৭ থেকে ১৮১৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মোট তিনটি স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব বা এমসিসির প্রতিষ্ঠাতাও টমাস লর্ড। ক্লাব প্রতিষ্ঠার পরই তিনি তিনটি ভেন্যু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খেলার সুবিধার্থে। তার মধ্যে তৃতীয়টি লর্ডস- যেটির নাম রাখা হয় তার নামানুসারেই। লর্ডস স্টেডিয়াম অর্থাৎ লর্ডের স্টেডিয়াম। ইংল্যান্ডে দীর্ঘদিন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন টমাস লর্ড। পাশাপাশি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও ছিলেন অতুলনীয়।

লর্ডস১৮১৪ সালে এই স্টেডিয়ামের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচটি হয় মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) ও হার্টফোর্ডশায়্যারের মধ্যে। আর প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচটিত অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৮৮৪ সালের ২১ জুলাই। সে ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০১৪ সালে লর্ডস তাদের ২০০ বছরত পূর্তি পালন করেছে। এই দিন লর্ডসে এমসিসি বনাম বিশ্ব একাদশের মধ্যকার একটি প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন কর হয়। খেলায় এমসিসির অধিনায়ক ছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, আর বিশ্ব একাদশের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন। খেলায় সাত উইকেটে জিতেছিল এমসিসি একাদশ।

আজকের লর্ডস
লর্ডসের মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব এমসিসি ক্লাবের। তোমরা হয়তো আগেই জানো যে, ক্রিকেটের নিয়মকানুন তৈরি ও সংরক্ষণ করে ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটি। নানা কারণে লর্ডস অভিজাত স্টেডিয়াম হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। লডর্স সারাবিশ্বের ক্রিকেট ভেন্যুগুলোরত মধ্যে সর্বপ্রথম একশ টেস্ট ম্যাচ আয়োজনের কৃতিত্ব অর্জন করেছে। ২০০০ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার টেস্ট দিয়ে এই গৌরব অর্জন করে লর্ডস। এটি একমাত্র ক্রিকেট ভেন্যু যেখানে চারটি ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৫, ১৯৮৯, ১৯৮৩, ১৯৯৯)।
শুধু যে মাঠের খেলা তাই নয়- এর বাইরেও ক্রিকেট সংক্রান্ত নানাবিধ কাজ চলে স্টেডিয়ামটিতে। ক্রিকেটবিষয়ক নানান কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এই লর্ডস। ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি), ইউরোপীয় ক্রিকেট কাউন্সিল (ইসিসি) ও মিডলসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের অফিস এখানেই অবস্থিত। ২০০৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সদর দফতরও এখানে ছিল। লর্ডসের প্রবেশ মুখেই রয়েছে কিংবদন্তি ইংলিশ ক্রিকেটার ডব্লিউ জি গ্রেসের ভাস্কর্য (১৮৬৫ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি)।
লর্ডসে রয়েছে মোট আটটি স্ট্যান্ড বা গ্যালারি। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড, ওয়ার্নার স্ট্যান্ড, কম্পটন স্ট্যান্ড, প্যাভিলিয়ন, অ্যালান সেন্টার, এডরিচ স্ট্যান্ড, ট্যাভার্ন স্ট্যান্ড ও মাউন্ড স্ট্যান্ড। প্রতিটি স্ট্যান্ড নির্মিত হয়েছে বিখ্যাত স্থপতিদের করা নকশায়। ১৯৯৮-১৯৯৯ মৌসুমে লর্ডসের মিডিয়া সেন্টারটি নির্মাণ করা হয়। ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস’ কর্তৃক মিডিয়া সেন্টার নির্মাণের জন্য ১৯৯৯ সালে ‘স্টার্লিং পুরস্কার’ লাভ করে।

লর্ডসপ্যাভিলিয়ন
লর্ডসের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এর প্যাভিলিয়ন। ১৮৮৯-৯০ মৌসুমে বিখ্যাত স্থপতি টমাস ভেরিটির নকশা অনুযায়ী ভিক্টোরিয়া যুগের স্থাপনা হিসেবে প্যাভিলিয়নসহ লং রুমটি স্থাপিত হয়। প্রধানত এমসিসি ক্লাবের সদস্যদের জন্য প্যাভিলিয়নটি তৈরি করা হয়েছে। এখানে ভিআইপি দর্শকদের বসার জায়গা রয়েছে। তার পেছনে খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুম। দ্বিতীয় তলায় প্যাভিলিয়ন ভবনের দুই পাশে রয়েছে দু’টি বারান্দা যেখানে বসে খেলোয়াড়রা খেলা দেখেন, মাঠে নামার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করেন। ২০০২ সালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এই বারান্দায় ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির জার্সি খুলে মাথার ওপরে ঘোরানো ক্রিকেট বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছে আছে। এ ছাড়া লং রুম, লং রুম বার, বোলার্স বার, সদস্যদের জন্য দোকানপাট ইত্যাদি সুবিধাদি এখানে রয়েছে। অনার্স বোর্ডও এই ভবনে রাখা আছে।

লর্ডসক্রিকেট জাদুঘর
বিশাল একটি জাদুঘর রয়েছে লর্ডসে। ক্রিকেট বিষয়ক সর্বপ্রথম জাদুঘর এটি। ১৯৫৩ সালে এইচআরএইচ ডিউক অব এডিনবরা লর্ডসে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৪ সাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের সব খেলার তথ্য ও বিভিন্ন স্মারক রাখা আছে এখানে।লর্ডস
জাদুঘরটি দোতলা, নিচের তলায় একটি টিভিতে চলতে থাকে ইংল্যান্ড জিতেছে এমন সব ম্যাচ, আর রয়েছে লর্ডসে রেকর্ড গড়া খেলোয়াড়দের ব্যবহৃত জার্সি, ব্যাটসহ অনেক জিনিস। ডন ব্রাডম্যান, ডব্লিউ জি গ্রেসসহ এ কালের ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরাম, কুমার সাঙ্গাকারা- অনেক ক্রিকেটারের ব্যবহৃত ক্রীড়াসামগ্রী সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে। একমাত্র বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ব্যাট জায়গা পেয়েছে লর্ডসের জাদুঘরে। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে যে ব্যাটটি দিয়ে সেঞ্চুরি (১৪০) করেছিলেন বুলবুল। এ ছাড়া অ্যাশেজ ট্রফির সেই বিখ্যাত ছাই, বিশ্বকাপ ট্রফি ছাড়াও ক্রিকেটের চারশ বছরের ইতিহাসের অনেক কিছুই রয়েছে এখানে।
লর্ডসে যেদিন ম্যাচ থাকে সেদিন ম্যাচের টিকিট দিয়েই দর্শকরা জাদুঘর ঘুরে দেখতে পারেন। তবে অন্য দিনগুলোতে আলাদা টিকেট কেটে জাদুঘর ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।

অনার্স বোর্ড
লডর্স স্টেডিয়ামে রয়েছে একটি অনার্স বোর্ড। যেখানে এই ভেন্যুতে ভালো খেলা ক্রিকেটারদের নাম লেখা থাকে। ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি ও বল হাতে ৫ উইকেট নিতে পারলে নাম ওঠে অনার্স বোর্ডে। বাংলাদেশীদের মধ্যে তামিম ইকবালের নাম আছে এই বোর্ডে। ২০১০ সালে তামিম ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন লর্ডসে (১০৩)। বোর্ডের পাশে রয়েছে একটি ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড, সেখানেও ঘুরে ফিরে আসতে থাকে নামগুলো।
এছাড়া খেলার সামগ্রী বিক্রয়ের জন্য একটি স্যুভেনির শপ, বড় একটি লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, ব্রিটিশ রানীর জন্য খেলা দেখার বিশেষ স্থান রয়েছে লর্ডসে।

Share.

মন্তব্য করুন