গাড়িটা দ্রুত বেগে চলছিলো। ডরোথী জানালা দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। গাড়ি থেকে চলমান দৃশ্যগুলো মনের গভীরে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। সিলেটের এই চা বাগান, সবুজ বন বনানী যেন বাবার কথাটা বার বার মনে করে দিচ্ছিল। বাবার সাথে কয়েক বছর আগেও তারা এসেছিলো সিলেটে বেড়াতে। আজ বাবা নেই। মনে হয় পৃথিবীটাই বুঝি অর্থহীন হয়ে গেছে। বাবার স্মৃতিটা মনের পটে ভেসে উঠতেই কানড়বায় ভেঙে পড়ে ডরোথী। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ডরোথীর কানড়বা শুনে সবাই চমকে ওঠে। মা গভীর মমতায় পিঠে হাত রাখেন।- কাঁদছিস কেন মা? কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? নিজেকে সামলে নেয় ডরোথী। না মা কিছু হয়নি।
– তবে কাঁদছিস কেন?
– বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। মনে আছে মা আমি যখন আরো ছোট ছিলাম তখন বাবার সাথে আমরা দাদু বাড়ি গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে পাশে নিয়ে বসেছিলো। আর এই চা বাগান। পাহাড় টিলা এসব নিয়ে কত গল্প করেছিলো আমার সাথে। আজ বাবা নেই অথচ আমরা এই পথ দিয়েই আবার সিলেট যাচ্ছি। বাবাবিহীন এক পথযাত্রা। বলে কষ্টের হাসি হাসে ডরোথী। মা পাশে এসে আরো ঘন হয়ে বসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। পিঠে স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন। সে স্নেহের রেণুগুলো ছড়িয়ে পড়ে তির তির করে।
– মা আমরা কি এবার দাদু বাড়িও যাবো?
– অফিসের কাজে তো এসেছি সোনা। আর দাদু বাড়িতে তো কেউ নেই। তবু তুমি যখন যেতে চাইছো তখন যাবো একবার। মা সান্ত্বনা দেন ডরোথীকে।
– মা দাদু বাড়িতে কেউ থাকে না সত্যি। তবু সেখানে গেলে আমি বাবাকে দেখতে পাবো আমার মনের গভীরে। বাবার লাগানো গাছগুলোতে হাত বুলিয়ে বাবাকে আদর করবো।
দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো ডরোথীর। ডরোথীর মা ইরা ডরোথীকে জড়িয়ে ধরেন। মা বাবাতো আমাদের ওপর থেকে সব সময়ই দেখছে। তুমি যদি মন খারাপ করো, বাবার জন্য কান্নাকাটি করো তবে তো বাবা কষ্ট পাবে।
ডরোথী এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়। চুপচাপ বসে থাকে। দু পাশে সবুজের এই সমারোহ ডরোথীর মনকে যেন বিশাল এক শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয়। দু’পাশে সবুজ ঘন চা গাছ আর তার ফাঁকে ফাঁকে বিশাল ছায়াতরুগুলো নিবিড় মমতায় যেন চা গাছগুলোকে ছায়া দিয়ে জড়িয়ে আছে। ডরোথীর মনে পড়ে এই তো কয় বছর আগেও বাবা তাকে এমনি জড়িয়ে রাখতো। স্কুলে যাবার সময় রিকশায় বসে ডরোথীকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখতো। স্কুলে পৌঁছার পরও বাবা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো। আজ বাবা নেই। ডরোথী যেন খাঁ খাঁ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নেই যে তাকে ছায়াতরুর মতো ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখবে। মা আছে। মা ওতো একা। মা সকালে ওকে স্কুলে পৌঁছে অফিসে চয়ে যান।
স্কুল ছুটির পর ডরোথী ওর এক প্রতিবেশী বন্ধুর সাথে ফিরে আসে বাসায়। ওর কাছে বাসার চাবিও আছে। বাসার তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই হা হা করা একাকিত্ব যেন ডরোথীকে গিলতে আসে। মার রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার যেন খেতেই ইচ্ছে হয় না। মা বাড়ি ফিরে রাগ করেন। কিন্তু ডরোথী মাকে বুঝতে অক্ষম। ওর মনের কথাগুলো শুনলে মাও মন খারাপ করবে তাই ডরোথী নীরবে মায়ের রাগকে হজম করে। রাতে এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে, কোথায়, কোন তারার মাঝে বাবা লুকিয়ে আছে? তারাগুলোকে খুঁটিয়ে দেখে ডরোথী।
অবশেষে ক্লান্ত শ্লান্ত পায়ে ঘরে ফিরে আসে। মা তখন রান্নায় ব্যস্ত। টিভিও দেখতে ইচ্ছে হয় না। পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে। এখন ডরোথী অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে সামনেই জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা।
বাবার ছবিটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাবার স্মৃতি ডরোথীকে অহরহ কাঁদায়। বাবা চমৎকার এক মানুষ ছিলেন হাসি দিয়ে গল্প দিয়ে মা আর ডরোথীকে মাতিয়ে রাখতেন। সেই বাবা একদিন আর ঘুম থেকে উঠলো না। সকালে মা বাবাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য গিয়ে দেখেন বাবার সমস্ত শরীর যেন ঠাণ্ডা বরফের মতো। মা চিৎকার করে ডরোথীকে ডাকে-
– ডোরা তোর বাবা তো সাড়া দিচ্ছে না। ডরোথী দৌড়ে যায় বাবার পাশে। আব্বু বলে জাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাবা আর জেগে ওঠে না। ডরোথী অবাক হয়ে ভাবে তার বাবা কি করে বরফ শীতল হয়ে গেলো। অথচ বাবার তো উষ্ণতায় তাদের পরিবার সব সময়ই পরিপূর্ণ থাকতো ভালবাসায়। তাঁর সেই হাসি খুশি বাবা হঠাৎ করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ডরোথী আর তার মাকে যেন ফেলে দিয়ে গেলো একত গভীর খাদে। সেই প্রথম বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া। কিভাবে সংসার চলবে। কে বাজার করবে? কে তাদের দেখাশুনা করবে? তখন সেই গভীর খাদ থেকে ওরা প্রাণান্তকর চেষ্টায় মা তখন চাকরির চেষ্টা করলেন। বাবার পরিচিত জনেরা সবাই তখন মাকে সাহায্য করলেন। মা একটা চাকরি পেলেন। বাবার ফ্ল্যাটটা ছিলো পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। তাই বাড়ি ভাড়ার কবল থেকে বাঁচা গিয়েছিলো। মায়ের চাকরির সেই বেতনে মা ও মেয়ের গ্রাসাচ্ছাদন ভালো ভাবেই হয়েছিলো। মা ডরোথীকে তখন সাহস জোগাতেন- ডোরা তোমাকে কিন্তু ভালো করে লেখাপড়া করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে তবেই তোমার বাবার নাম উজ্জ্বল হবে।
সেই থেকে নিয়মিত লেখাপড়া শুরু করে। তাকে যে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। বাবার নাম পরিচিতি সবই সে রক্ষা করবে। এই প্রত্যয়ে জীবনে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। গতকাল মা অফিস থেকে ফিরে বললেন- ডোরা কাল আমাকে সিলেট যেতে হবে। তোমাকে তো একা রেখে যাওয়া যাবে না। তাই তোমারও টিকেট করে নিয়ে এসেছি। আনন্দে লাফিয়ে ওঠে ডোরা- দাদু বাড়ি তো যাবো তাই না মা?
– না সোনা আমাকে অফিসের কাজে যেতে হবে।
– তবে দাদু বাড়িতে যাবো না? চোখে পানি আসে ডরোথীর।
– ঠিক আছে। কাজ শেষ হওয়ার পর ওখান থেকে ঘুরে আসবো। স্বপ্নের জাল বুনে ডরোথী। ওখানে গেলে অবশ্যই বাবার ছোঁয়া পাওয়া যাবে। সেই বাড়ি সেই ঘর শুধু বাবাই নেই আজ। তবু সেখানে গেলে আশপাশে সবাই বলবে- তুমি তমালের মেয়ে? ডরোথীর বুক গর্বে ফুলে ওঠে। হ্যাঁ সেতো তমালেরই মেয়ে। বাবার স্বপড়ব, বাবার আশা সবই পূর্ণ করবে বড় হয়ে। হঠাৎ মায়ের স্পর্শে বাস্তবে ফিরে আসে ডরোথী।
– চল এবার নামতে হবে। আমরা পৌঁছে গেছি। ডরোথী মনে মনে বলে এই আমার দেশ, আমার বাবার দেশ। মায়ের ডাকে ডরোথী বাস থেকে নেমে সামনে পা বাড়ায়। জীবন চলার পথে যে চলতেই হবে।

Share.

মন্তব্য করুন