“একটি লাল গোলাপের জন্য” তেল রঙ পোট্রেটটি আসলে একটি কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ। শাহেদদের বাসার ড্রয়িং রুমে কেউ বসলে পোট্রেটটি দৃষ্টি কাড়ে। কবি কি এ বাড়ির কেউ! শিল্পীর রঙতুলির আঁচড়ে পোট্রেটটি কত না আলোময়। কবিতার পাতায় পাতায় হয়ত ভালোবাসার গল্প অথবা বিদ্রোহের সুর….! এমনি অনেক ভাবনাই আগন্তুককে ভাবিয়ে তোলে। শাহেদ পোট্রেটটির খুব যত্ন করে। ধুলোবালি পড়তে দেয় না। মাঝে মধ্যে কারপিন তেল দিয়ে মুছে দেয়।
মার্চ মাস এলে এ পোট্রেটটি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এ বাড়ির মানুষদের কাছে। শাহেদদের ড্রয়িং রুমে কয়েক বন্ধু আজ আসর জমিয়েছে। স্বাধীনতা দিবসে প্রতি বছরের মতো এবারও তারা কিছু একটা করতে চায়। এ নিয়ে আলাপচারিতা।
নাহিদ: আচ্ছা শাহেদ তোর বড় চাচার এই কবিতার বই বুঝি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি?
শাহেদ : কেমন করে পাওয়া যাবে বল। ২৫ মার্চের সেই কালো রাতের পর দাদু সবাইকে নিয়ে গ্রামের পথে পাড়ি জমান। শহরের বাড়ি লুট হয়ে যায়। হানাদার বাহিনী আগুন ধরিয়ে দেয়। সব পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। বড় চাচা শুধু তার প্রিয় বই পোট্রেটটি সাথে নিয়েছিলেন। আব্বু তখন কিশোর। দাদু বেঁচে থাকতে বেশ স্মৃতিচারণ করতেন…।
জালাল আহমেদ সাহেব ঘরে ঢোকেন। উনি শাহেদের বাবা।
: আসসালামু আলাইকুম- সমস্বরে সালাম দিয়ে ওঠে ওরা।
: বসো তোমরা। তোমাদের কথা শুনে এগিয়ে এলাম। এ প্রচ্ছদটির পেছনে অনেক স্মৃতি অনেক কথা লুকিয়ে রয়েছে আমাদের।
নাঈম : চাচা! আমাদের সেসব কিছু কথা বলুন না।
: তখন আমার বয়স এগারো। আমরা খুলনা শহরে থাকি। আব্বা চাকরি করতেন। শহর ছেড়ে যাচ্ছে সবাই। বাবা অনড়। তিনি যাবেন না। রাতে ঘুমাতে পারতেন না। গুলির শব্দে আমরা চমকে উঠতাম। ভাইজান তখন কলেজে পড়তেন। পুরো নাম ছিল আজাদ রহমান। সবাই আজাদ বলে ডাকতো। ভালো কবিতা লিখতেন। ‘একটি লাল গোলাপের জন্য’ তাঁর প্রথম কবিতার বই। ভাইয়া ছিল খুব সাহসী। মিছিলের আগে থাকত। রাত জেগে পোস্টার লিখত। যুদ্ধ শুরুর ক’দিন পরই বাবা আমাদের নিয়েই গ্রামে চলে এলেন।
গ্রামের মাঠে যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য শারীরিক কসরত করত। আমরা ছোটরা পেছনে গিয়ে দাঁড়াতাম। একদিন সন্ধ্যায় ভাইয়া একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন। কবিতার বইটি নিতে ভোলেননি। বাবাকে কদমবুসি করলেন। মাকে জাপটে ধরে আদর কুড়িয়ে নিলেন। কেউ কিছুই বুঝতে পারলো না। ভাইয়া ঝড়োবেগে বেরিয়ে গেলেন। বাবা শুধু চোখের জল মুছলেন। কিছুদিন পর আমি বুঝলাম ভাইয়া যুদ্ধে গেছে।
টানা নয় মাস যুদ্ধ চললো। আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষ আসতো।
পরে শুনেছি ওরা মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ার খবর নিয়ে আসে। লাল গোলাপ ভাইয়ার খুব প্রিয় ছিল। একবার আমাকে লেখা এক চিঠিতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে- বাগানে লাল গোলাপ চারাটার যত্ন নিস। আমি শিগগি ফিরব।
জালাল সাহেব একটু থামলেন…।
তারপর আবার বলে চললেন। যুদ্ধ শেষে ভাইয়া আর ফেরেনি। মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে এসে ভাইয়ার একটি ডায়েরি দিয়ে গেলেন। আমার বড়বোন জেবুনেড়বছা জবা ডায়েরিটি বুকে চেপে খুব কাঁদলেন। মাকে প্রবোধ দিলেন, মাগো! তোমার সন্তান রক্ত দিয়ে একটি লাল গোলাপ ফুটিয়েছে…!
জালাল সাহেবের কণ্ঠ ধরে আসে। কিছুক্ষণ সবাই নিশ্চুপ থাকে।
নাঈম নীরবতা ভেঙে বলে, চাচা! স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমরা যে স্মরণিকা বের করতে যাচ্ছি তাতে ডায়েরির কিছু অংশ প্রকাশ করতে পারি কি?
: কেন পারবে না। অবশ্যই প্রকাশ করবে।
নাহিদ : চমৎকার আইডিয়া। চাচা! আপনাকে কিন্তু সহযোগিতা করতে হবে।
: অবশ্যই করব বাবা।
আজ ২৬ শে মার্চ। সকালটা বেশ আলোময় ঝলমলে। দক্ষিণা বাতাস জানালার পর্দায় কাঁপন তুলছে। কিছুক্ষণ পরই শাহেদের বন্ধুরা আসবে। স্মরণিকার প্রথম কপিটি তুলে দিবে ওর আব্বুর হাতে। শাহেদ পাখির নরম পালক দিয়ে পোট্রেটটি বুলিয়ে দিচ্ছে। জালাল সাহেব পেছন দিক থেকে এসে সন্তানের কাঁধে হাত রাখেন। বলেন, তোমরাও লিখে যাও স্বাধীনতার কবিতা।

Share.

মন্তব্য করুন