অনেকে মনে করে ভূত মানে এক ভয়ঙ্কর জীব! না মানুষ, না পশু। ইয়া বড় নাক। ছুরির মতো ধারালো নখ। চোখ যেন মোটরগাড়ির হেডলাইট। সব সময় গনগনে আগুনের মতো জ্বলজ্বল করে। এমনটিই কল্পনা করে রাগিব। অবশ্য, এর পেছনে একটা কারণও আছে। একদিন টেলিভিশনে ভূতের নাটক দেখেছিল রাগিব। সেই থেকে ওর মনের ভেতর ভূত ভূত আতঙ্ক। রাগিব শুনেছে, ভূতেরা নাকি দিনে ঘুমায়, রাতে বিচরণ করে। বেলা ডোবার সাথে সাথে শুরু হয় ওদের রাজত্ব। বড় বোন আরিফা সুলতানা লিপি সাহস দেয়। বারবার বলে ভূত বলে কিছু নেই, সব কল্পকাহিনী। রাগিব নিজেও এটা বিশ্বাস করে। কিন্তু রাতের অন্ধকার যতো ঘনীভূত হয়, ওর কল্পনার ভূতটা যেন ততোই কাছে আসতে থাকে।
আসলেই কি ভূত বলে কিছু আছে? না থাকলে ভূত কথাটা কিভাবে এলো? কেনোইবা ওদের নাম শুনলে চোখের সামনে ভয়ঙ্কর ছবি ভেসে ওঠে? এমন ধরনের নানা প্রশ্ন গিজগিজ করে রাগিবের মাথায়। কোন উত্তর খুঁজে পায় না। সেদিন রাতের ঘটনার পর কিছুটা সমাধান পেয়ে যায় রাগিব।
‘শেষরাতের ভূত’ এভাবে আপুর হাতে ধরা খাবে ভাবতেই পারে না। ঘটনাটি মনে পড়লে আজও হাসি পায় রাগিবের।
যশোর শহরের একটা বহুল পরিচিত আবাসিক এলাকা বারান্দী মোল্লাপাড়া। এ পাড়ার পিচঢালা মেইন রাস্তার পাশে রাগিবদের একতলা বাড়ি। থাকে মাবাবা ভাই বোন মিলে ছয়জন। আগে এলাকা ফাঁকা ছিল। এখন বসতি বেড়েছে। চোর ছিনতাইকারীদের আনাগোনাও বেড়েছে। শান্তি কমিটির নাইট ডিউটির পরও মানুষের হাঁস-মুরগি, টিউবওয়েলের মাথা প্রায়ই চুরি হয়। শান্তি কমিটির পাশাপাশি পুলিশ টহলও চলে।
সেদিন রাগিবের মা ও বাবা বাড়িতে ছিলেন না। একটা মৃত্যুর খবর শুনে দুজনই মামাবাড়ি গিয়েছিলেন। বলতে গেলে পাহারাদারের মতো রাগিব ও তার তিন বোন বাড়িতে ছিল। রাগিব ঘুমিয়েছিল একাকী আর বোনেরা অন্যঘরে। রাত তিনটার দিকে ঠক ঠক শব্দ। পরপর দুবার। তারপর কিছুক্ষণ থেমে আবার ঘুম ভেঙে যায় রাগিবের। প্রথমে আমল দেয়নি। পরে লাগাতার শব্দত শুনে ওর গাছমছম করে ওঠে। ভাবে, চোর ডাকাত নক করে না। যেকোন কায়দায় ভেতরে ঢুকে সবকিছু লুটকরে নিয়ে যায়। না, এটা চোরের কাজ নয়। নিশ্চয়ই পুলিশ। কিন্তু পুলিশ তাদেও বাড়িতে আসবে কেন? হ্যাঁ, আসতে পারে। অনেক সময় ভুল ইনফরমেশনে ভাল মানুষও ধরা পড়ে। ভাবতে ভাবতে আরও দুবার শব্দ হয় এবং আগের চেয়ে জোরে। রাগিব ভয়ে আতঙ্কে অসাড় হয়ে যায়। পাশের রুমে বোনদের ডাকবে সে সাহসও পায় না। তার ভাবনা আরেক দিকে মোড় নেয়। পুলিশ হলে তো কথা বলতো, গেট খুলতে বলতো, বুটের শব্দ শোনা যেতো। তাহলে কি ভূত! রাগিব চোখ বুজে ভূতের ইয়া বড় নখ ও দাঁত আবিষ্কার করে আতঙ্কে আরো জড়সড় হয়ে যায়।
রাগিবের রাগ হয় শান্তি কমিটির ওপর। ওরা প্রতিমাসে নাইট ডিউটির টাকা নিয়ে যায়। অথচ এতোবড় বিপদেও সময় দেখা নেই। নৈশ প্রহরীদেও বাঁশির শব্দ শুনলেওতো একটা সাহস পাওয়া যেতো। রাতটাও যেন পোহাতে চায় না। এতো দীর্ঘরাত ‘ও’ আর কখনো দেখেনি। মনে হয় অনেকগুলা রাত একসাথে মিশে আছে। অন্যদিন রাত থাকতেই মসজিদের মাইক থেকে আযানের আওয়াজ ভেসে আসতো। টর্চ লাইট জ্বেলে মানুষ মসজিদে যেতো। আজ তাও হচ্ছে না। এমনি ধরনের নানা চিন্তা গিজগিজ কওে রাগিবের মাথায়। চিন্তার মধ্যে নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আরেকটি বড় শব্দ হয় বাড়ির পশ্চিম দিকে। রাগিব গায়ের কম্বল মাথার ওপর টেনে পুরো শরীরটা ঢেকে ফেলে। এরপর মোবাইল ফোন থেকে একটা মিসকল দেয় বড় বোন আরিফা সুলতানা লিপিকে। ঘুম ভেঙে যায় লিপির। পাশের রুমে মাত্র দুই ফুট দূরে থাকা একমাত্র ভাইয়ের মিসকল পেয়ে আঁতকে ওঠে সে। সাথে সাথে দরোজা খুলে রাগিবের পাশে এসে দাঁড়ায়।
: কিরে এতো রাতে মিসকল কেন?
: চোপ বাইওে বিপদ। আব্বু আম্মু বাড়ি নেই। কি যে হয় আল্লাই জানে।
: কি বিপদ?
: কোন কথা না বলে কান পেতে শোন।
কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে থাকে লিপি। শুনতে পায় সেই ঠক
ঠক শব্দ।
: নিশ্চয়ই পুলিশ।
: আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পুলিশ হলে তো ডাকাডাকি করতো। চলাফেরার শব্দ শোনা যেতো।
: কতক্ষণ শব্দ হইছে?
: প্রায় দুই ঘণ্টা।
: পুলিশ এতোক্ষণ অপেক্ষা করে না। কোন সাড়া শব্দ না পেলে গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকে। চোর ডাকাত কারো বাড়ি জানান দিয়ে আসে না।
: তাহলে আমার ধারণাই ঠিক-ভূত। এত রাতে ভূত ছাড়া কেউ এমন কাজ কেউ করতে পারে না।
: ধ্যাৎ। ভূত বলে কিছু আছে নাকি !
: চুপ কর। শুনতে পেলে ঘাড় মটকে দেবে। আব্বু আম্মু বাড়ি নেই। কোন কাক পক্ষীও জেগে নেই। এই সুযোগে ওরা যা ইচ্ছে তাই করে ফেলবে।
: এতোই যখন শক্তি ভেতরে ঢোকে না কেন?
বলেই মোবাইল ফোনের লাইট জ্বেলে জানালার কাছে এগিয়ে যায় লিপি। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকার পরও ভূতরহস্য আবিষ্কার করে ফেলে। হেসে ওঠে হোহো করে। নিস্তব্ধ রাতে ওর হাসির শব্দ শুনে অন্যরাও জেগে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে,
: তোর ভূতকে আমি হাতেনাতে ধরে ফেলেছি। শিগগির এদিকে আয়। সবাই ছুটে আসে। জানালার একটা পাল্লা খোলা ছিল। বাতাসে সেই পাল্লাটা বাড়ি খাচ্ছিল গ্রিলের সাথে। আর ঠকঠক কওে শব্দ হচ্ছিল। রাগিব ছাড়া সকলেই হো করে হেসে ওঠে। লিপি বলে, দেখছিস, সাড়া গাছের ভূতটা কোথায় এসে বাসা বেঁধেছে।
রাগিব মৃদুসরে জবাব দেয়,
: আমাদের জানালায় তাই না?
: জানালায় না। সাড়া গাছের ভূতটা তোর মনের ভেতর বাসা বেঁধেছে।
সবাই হেসে ওঠে আরেক বার। ততক্ষণে মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে আযানের ধ্বনি। নামাযের প্রস্তুতি নেয় ওরা।

Share.

মন্তব্য করুন