নদী!
সবুজ ঘাসের মতো তুলতুলে শরীর।
শিশিরের মত কোমল।
পুতুলের চেয়েও সুন্দর।
কী চমৎকার দেখতে!
গায়ে নতুন ফ্রক। ঘটি হাতা। জামার জমিনে ফুলের সমাহার। ঘনচুল। কোঁকড়ানো। ছোট বলে বেণি করতে পারে না। মাথার সিঁথির দু’পাশে রিবন বেঁধে ঝুঁটি তোলা। দারুণ স্বাস্থ্য।
ফুটফুটে চার বছরের মেয়ে নদী।
সে যেন পরীর দেশ থেকে এসেছে। ঠোঁটে-মুখে মিষ্টি হাসির রেখা লেগেই থাকে।
কান্নাকাটি নেই।
অযথা বায়না নেই।
খাবার-দাবারে অরুচি নেই।
সারা বাড়ি খেলা আর হাসি-খুশিতে মুখর করে তোলে নদী।
নদীর খুব ভাব মুরগি ও হাঁসের বাচ্চাদের সাথে। পাখির সাথে। ঝিঁঝি ও প্রজাপতির সাথে। রাতের চাঁদ ও জোছনার সাথে।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভাব ছাগলের বাচ্চা মনির সাথে।
বাচ্চাটির বয়স মাত্র দুই মাস। নদীর কারণেই বাচ্চাটির নাম রাখা হয়েছে মনি।
সারা দিন নদীর কাছে-পিঠে থাকে মনি। তারও কান্নাকাটি নেই। খিদে পেলে কেবল একটু দুধ খেয়ে আসে মায়ের কাছ থেকে। রাতে শোবার সময়ও নদী তার আদরের মনিকে রেখে দেয় পাশে।
যতক্ষণ ঘুম না আসে, ততোক্ষণ মনির গায়ে, কানে-মুখে আদর করে আর রাজ্যির গল্প শোনায়। যেসব গল্প সে শিখেছে ফুফু আম্মুর কাছে। নাদিম ভাইয়া ও মুশতারী আপুর কাছে।
আম্মুতো সারাক্ষণই ব্যস্ত। ঘর-বাড়ি সামলানো, বান্নাবাড়া আরও কত কি! সারাদিন ব্যস্ত থাকায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। রাতে সবার শেষে ঘুমুতে যান। সকালে উঠতে হয় সবার আগে। ফজরের নামাজ পড়ে গোয়ালঘরে যান। গরুর খাবার দেন। একটু বেলা উঠলেই গোয়াল থেকে গরু বার করে খলায় বেঁধে আসেন। এরপর ছাগল, হাঁস-মুরগি সামলে বসে যান থালা-বাসন মাজতে।
আম্মুর হাতের মাজা-ঘষা কাঁসার থালা-বাসনে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে। কেমন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সূর্যের আলোটা দারুণ ঢেউ তোলে। কাঁসার থালায় এ সময় মুখ দেখা যায়। থালায় একটু পানি রাখলে তার মধ্যে ভেসে ওঠে চমৎকার চেহারা। থালার দিকে মুখ করে মাথা আঁচড়ানো যায়। ঠিক যেন নতুন কেনা আয়না। পাড়া-গ্রামে কাঁসার থালা-বাসন-গ্লাস এখন প্রায় উঠেই গেছে। অথচ এ বাড়িতে এখনো আছে। এগুলো বনেদি বাড়ির স্মৃতি চিহ্ন।
শীতের সকাল।
আম্মু এখন খুব ব্যস্ত।
বাঁকে করে বারটি রসের ভাঁড় এনে বাইন তলায় সাজিয়ে রেখেছে আলী।
একটা ভাঁড়ে মাটির ঢেলা দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেয়া। তার মানে এই ভাঁড়ের রস সবচেয়ে মিষ্টি। আম্মু ভাঁড়ের মুখে পরিষ্কার কাপড় বেঁধে নিলেন।
তারপর রস ছেঁকে গ্লাসে ঢালছেন।
কাঁসার গ্লাসে টাটকা জিরন রস। কমলার চেয়েও গাঢ় রং।
গ্লাসের ভেতর পাটকাঠির নল দিয়ে চোঁ চোঁ করে টানছে নদী।
খেজুরের রস কি যে স্বাদ!
নদী রসের গ্লাস নিয়ে বসে ছিল সূর্যের দিকে ফিরে। সাথে আছে মুশতারী আপা ও নাদিম ভাইয়া। পুবের মাঠের ও প্রান্ত থেকে গোল থালার মত টকটকে লালত সূর্যের প্রথম মিষ্টি আলো তার কপালে আছড়ে পড়লো। শীতের সূর্যের প্রথম আলোটুকু দারুণ মজার। ধরে রাখা গেলে নদী কোঁচড় ভর্তি করে রেখে দিত সারাদিন। তারপর যখন খুশি বার করে খেলতো তার সাথে।
কিন্তু যত মিষ্টিই হোক, রোদ তো আর ধরে রাখা যায় না কোঁচড় কিংবা বোতলে! নদীও বোঝে বটে! কিন্তু মনটা মানতে চায় না।
গ্লাসের রস শেষ হলো। চোঁ-চোঁ- চোঁ-না, যতই টানুক নল আর রস আসছে না মুখে।
নদী নলটা তুলে ফেলে দিল পাশে। মুশতারী আপা ও নাদিম ভাইয়ার গ্লাস বেশ বড়। নদীর গ্লাসটা ছোট। সে যে এখনও ছোট, তাই তার সবকিছুই ছোট ছোট। পানির গ্লাস, ভাতের থালা, বসার পিঁড়ে, খেলনার হাঁড়ি-পাতিল, ঢেঁকি, কুলা সব-সবই।
সূর্যের আলোটা বেশ তেজি হয়ে উঠেছে। এবার সেদিকে পিঠ দিয়ে বসলো তিনজন। রসের গ্লাস তিনটে পড়ে আছে পাশে। শূন্য। আশপাশের পিঁপড়ে রসের মিষ্টি গন্ধে পিলপিল করে ছুটে আসছে গ্লাসের দিকে। এর মধ্যেই দু’চারটে পিঁপড়ে গ্লাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই কারো। মুশতারী আপা ক্লাস টুতে পড়ে। নাদিম ভাইয়াও টুতে। দু’জনই দুই চাচার ছেলে-মেয়ে। নদী স্কুলে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেও আম্মু যেতে দেন না। তিনি বলেছেন, সামনের বছরে নদীকে ভর্তি করে দেবেন। মুশতারী আপু ও নাদিম ভাইয়া খেজুরের পাতা দিয়ে বোনা ছোট্ট পাটিতে বসে বই পড়ছে। নদী ওদের মত একটানা পড়তে পারে না। তবে বর্ণ-পরিচয়ের বইটি সামনে ধরে অ, আ, ক, খ বেশ পড়তে পারে। ছড়া কেটে বর্ণগুলো মুখস্থও বলতে পারে। ওদের সাথে সাথে নদীও মাথা দুলিয়ে পড়ছে।
তিনজনের পড়ার শব্দ উঠোনে কাজ করতে করতে শুনতে পাচ্ছেন আম্মু।
আজ শুক্রবার।
স্কুল বন্ধ।
মুশতারী আপু ও নাদিম ভাইয়া আজ স্কুলে যাবে না। তারা তিনজন আজ সারা দিনই খেলতে পারবে। কথাটা মনে হতেই নদীর মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।
আজ তারা বনফুল, ঘাস, লতাপাতা ধুলো-মাটি ইত্যাদি নিয়ে রান্না-বান্না করবে। নাদিম-ভাইয়া হাটবাজার করবে। কলার পাতা, কদুর ডাঁটা, ধুতরা ফুল সংগ্রহ করবে সে। মুশতারী আপু রান্না-বান্না করবে, উঠোন পরিষ্কার করবে। আর নদী ব্যস্ত থাকবে পুতুল সাজাতে।
আজ তাদের কত কাজ।
একটু পরে আম্মু ডাকলেন।
এখন খাবার সময়।
তিনজন রান্না ঘরের বারান্দায় লাইন দিয়ে বসেছে।
তারা খাচ্ছে আর গল্প করছে।
নদী জিজ্ঞেস করলো, ফুফু আম্মু কাল রাতে কি গল্প কইলো রে?
নাদিম ভাইয়া বললো, রাজপুত্রের গল্প। রাজপুত্র আসছে ঘোড়ায় চড়ে।
ঠক-ঠক-ঠক-ঠক শব্দ করে।
অনেক দেশ জয় করে।
ইসরে, কি তার সাহস।
মুশতারী আপু বললো রাজকন্যার গল্পও বলেছে ফুফু আম্মু। রাজকন্যার কঠিন অসুখ। তাকে ভালো করতে হলে বড় দীঘির পাতাল থেকে এক ডুবে তুলে আনতে হবে একটি বাক্স। সেই বাক্সের মধ্যে আছে ওষুধ। দীঘিতে আছে সাপ, আর জমিদারের ছেড়ে দেয়া কুমির।
কে যাবে, কে যাবে? সাহস করে কে নামবে দীঘিতে? থামলো মুশতারী আপু।
নদী বললো, কেন আমার নাদিম ভাইয়াই তো পারে।
নাদিম ভাইয়ার কত্ত সাহস! গেসে উঠলো নাদিম ভাইয়া ও মুশতারী আপু।
তাদের খাওয়া আর গল্প এক সাথেই চলছে। কোনোটাই শেষ হচ্ছে না।
তাদের চারপাশে চিঁ চিঁ করে ডাকছে মুরগির দশটি বাচ্চা। তাদের সদ্যফোটা হাঁসের বাচ্চা। তাদের বয়স পাঁচ দিন।
বাচ্চাগুলো কি যে সুন্দর! যেন ফোমের তুলতুলে পুতুল।
রঙবেরঙের বাচ্চাগুলো মুগ্ধ চোখে দেখছে নদী।
কালো কুচকুচে বিড়ালটি চোখ পাকিয়ে যেন পাহারা দিচ্ছে তাদের। বিড়ালটি বেশ ভালো। সেও এ বাড়িতে এসেছিল অল্প বয়সে। এখানেই এতদিনে ভাব হয়ে গেছে হাঁস-মুরগি, ছাগলের সাথে। সে কখনই তাদের বাচ্চাদের ক্ষতি করে না। বিড়ালটিকে পুষছে ফুফু আম্মু, ফুফু আম্মুর নাম শেলী। সে কলেজে পড়ে। নাদিম, মুশতারী আর নদী-তিনজনই সমান ভাগ চায় ফুফু আম্মুর। তার আদরের ভাগ কেউ যেন বেশি নিতে না পারে সে জন্য তিনজনই সতর্ক থাকে। আজ তারা রান্নাবান্না শেষ করে ফুফু আম্মুকে দাওয়াত দেবে খাবার। ফুফু আম্মুই তাদের প্রধান মেহমান। তাদের খাওয়া এতক্ষণে শেষ হলো। তিনজনই উঠোনে নেমে বুক টান করে আড়মোড়া ভাঙলো। দীর্ঘক্ষণ পিঁড়ির ওপর বসে যেন মাজা ধরে গেছে।
আম্মু কাজে ব্যস্ত।
ফুফু আম্মু ব্যস্ত লেখাপড়ায়। ছোট আম্মু রস নিয়ে ব্যস্ত বাইন শালায়।
বাড়ির পাশেই আমন ধানের ক্ষেত।
ক্ষেতে পানি নেই। ধানও প্রায় পেকে উঠেছে। ক’দিন পরেই কাটা যাবে।
ধানের সোনালি রঙে পুরো মাঠ নতুনভাবে সেজে উঠেছে। ভোর এবং সন্ধ্যায় কুয়াশার চাদর গায়ে মাঠটি আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।
তারা তিনজন আবার চলে এসেছে উঠোনের পুব পাশে।
পাঁচটি গরু শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। মোষে গরুর ঝুঁটির ওপর একটি ফিঙে রাজা বসে আছে।
খয়েরি গরুর পিঠের ওপর লাফাচ্ছে একটি শালিক। তিনজনই অবাক বিস্ময়ে দেখছে পাখি দুটোর খেলা। আম্মু উঠোনের বরইতলা থেকে ডাকলেন নাদিমকে। নাদিমসহ তিনজনই হাজির হলো আম্মুর কাছে। আম্মু একটি মুরগির বাচ্চা বাম হাতের তালুর ওপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই বাচ্চাটির পা তারা কেউ ভেঙেছে কি না।
ওরা ভাঙেনি।
কে ভেঙেছে তাও জানে না।
বিড়ালটির কাজ কি না আম্মু ভাবছেন। শেলীকে জিজ্ঞেস করতেই ফুফু আম্মু ছুটে এলেন। বললেন, আমার বিড়াল এমন কাজ করতেই পারে না।
যেই করুক না কেন, নদীর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বাচ্চাটি ব্যথায় চিঁ-উ-চিঁ-উ করে কাতরভাবে ডাকছে।
আব্বুর হাত থেকে ফুফু আম্মু বাচ্চাটি নিলেন। দেখলেন ভালো করে। এরপর নদী বায়না ধরলো ওটা নেয়ার জন্য।
খুব যতেড়বর সাথে, সাবধানে নদী বাচ্চাটিকে হাতে নিলো। বাচ্চাটি করুণভাবে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে।
সে যেন কাঁদছে।
নদীর খুব কষ্ট হলো।
তার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। এক সময় নদীরত কচি দুটো চোখ থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়লো প্রথম বৃষ্টির ফোঁটার মতো বেদনার অশ্রু।
নদী পা ভাঙা বাচ্চাটাকে নিয়ে দৌড় দিল পুবের উঠোনে। হাঁটু গেড়ে বসে ছেড়ে দিল তাকে।
না, বাচ্চাটি আর দৌড়াতে পারছে না। খুঁড়িয়ে দু’পা গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আহত বাচ্চাটি চারপাশে মুরগির অন্যান্য বাচ্চা হাঁসের বাচ্চা এবং ছাগলের বাচ্চা মনি কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে খোঁড়া বাচ্চাটির দিকে।
তারা সবাই যেমন তাকে সমবেদনা জানাচ্ছে।
নদীর কচি হৃদয়টা ডুকরে কেঁদে উঠলো।
নাদিম ভাইয়া ও মুশতারী আপু তাকে ডাকলো। বললো, আমাদের রান্না-বান্নার কী হবে? তাড়াতাড়ি এসো না!
নদী নীরব, নিশ্চুপ।
ফুফু আম্মু নদীকে কোলে নিয়ে বললেন, এটা ভালো হয়ে যাবে। মন খারাপ করে না সোনা!
নদী নিশ্চুপ।
আম্মুও বুঝাচ্ছেন তাকে।
তবুও নদী কথা বলে না।
কেবল তার চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে বেদনার বৃষ্টি।
কেবলই…।

Share.

মন্তব্য করুন