সময়টা তখন শীতকাল।
ঢাকায় তখনও শীতের ঘনঘটা তৈরি হয়নি। হবেও বা কি করে! ঘনবসতি, বড় বড় দালান। নেই তেমন গাছপালা। নেই খোলা জায়গা। আর সেই সময় গ্রামাঞ্চলে ভোরে এবং রাতে ঠাণ্ডা পড়তো।
নভেম্বর মাস। হঠাৎ একদিন মুরাদ ভাই ফোন দিলেন আমাকে। আমি ফোনটা রিসিভ করলাম। মুরাদ ভাই বললেন, ভাই আজকে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান আছে আপনি অবশ্যই আসবেন। আমি কথা দিলাম ভাইকে। যথারীতি রাতে রওনা দিলাম পুরান ঢাকায়। পৌঁছানোর পর মুরাদ ভাইকে কল দিতে যাবো এমন সময় দেখি আমার পরিচিত বেশ কিছু ভাই রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাইকে এক সাথে দেখে খুবই ভালো লাগলে আমার।
খাওয়ার সময় মাসুদ ভাই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সামনে তো শীতকাল। এবারের শীত অন্যবার থেকে বেশিই পড়বে! যে যার সাধ্য মতো টাকা কালেকশন করতে হবে। এবার আমরা উত্তরবঙ্গে যাবো। কোন অঞ্চলে যাব সেটা পরে বলে দেয়া হবে। আমাদের সংগঠনের নাম হিউম্যান ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। আমার সংগঠনটি স্বেচ্ছায় রক্তদা কর্মসূচি, বিভিন্ন দুর্যোগকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, পথশিশুদের নিয়ে কার্যক্রম, গরিব ও অসহায়দের চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ এ পর্যন্ত বিভিন্ন মানবসেবামূলক কাজ করে আসছে।
আমি বাসায় যেয়ে ভাবতে লাগলাম যদি আমি ৫০০০ হাজার টাকা তুলতে পারি তাহলে বেশ কিছু কম্বল কেনা যাবে। পরের দিন সকালেই পরিচিতদের সাথে আলাপ করলাম। তারা রাজি হলো। সেদিন থেকেই টাকা তোলা শুরু করলাম। প্রথম দিকে পরিচিতদের কাজ থেকে টাকা নিতে যেয়ে খুবই বেগ পেতে হয়েছে। আল্লাহর রহমতে পরে সফলতাও পেলাম অনেক বেশি।
অসহায়দের পাশেএকদিন জরুরি মিটিংয়ের আয়োজন করা হলো হিউম্যান ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে। সেখানে কথা হলো যে, আমরা ২৫০টা কম্বল কিনেছি। আগামী ১৩ ডিসেম্বর আমরা কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার ধরণী বাড়ি ইউনিয়নের কিশমত মধুপুর, কেশতিরপাড়ম, মধুপুর, লাঠির খামার, মাদারটারী, নাপিতপাড়া, তেলিপাড়া, টারীপাড়া গ্রামে অসহায় দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করবো।
বাসায় এসে আমি আমার কাপড়গুলো গোছানো শুরু করলাম। আম্মু আব্বু এসে বললেন, কী ব্যাপার! কাপড় গুছাচ্ছ কেন? কোথায় যাবে। আমি বললাম কুড়িগ্রাম যেতে হবে আগামীকাল! আব্বু আর কিছু বললেন না! পরের দিন সন্ধ্যায় আমি মুরাদ ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম, ভাই আমি কোথায় আসবো? ভাই বললেন, গুলিস্তান আসেন। এখান থেকে আমরা সবাই রওনা দিব। আমি পৌঁছানোর পর দেখি প্রায় সবাই চলে এসেছেন। প্রথমে আমাদের টঙ্গী যেতে হবে। সেখানেইত আমাদের গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন মনির ভাই। রাত ১১টার দিকে টঙ্গীতে পৌঁছলাম। রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকার কারণে যেতে দেরি হয়েছে। মনির ভাই আমাদেরকে রাতের খাবার খাওয়ালেন। খাওয়া শেষ করে আমরা গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলছে। কিন্তু ড্রাইভার খুব বেশি ভিতু। হাইওয়েতে গাড়ি টানতেই পারছিলো না। যখনই একটা ট্রাক হর্ন দিচ্ছে তখনই এক সাইটে গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছে।
এভাবেই ঠেলাগাড়ির মত চলতে চলতে গাজীপুর গেলাম। সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠলো! বিশাল জ্যাম। জ্যামে বসে থাকতে খুবই বিরক্ত লাগছে। এমন সময় আমাদের ওমর ভাই কৌতুকে মেতে উঠলেন! তখন আর এতো বিরক্তি লাগছে না। কিন্তু কতক্ষণ আর মজা করা যায়। গাড়িই যদি না চলে। টুক টুক করে এগোচ্ছে আমাদের গাড়ি। ড্রাইভারকে যতই বলা হচ্ছে একটু দ্রুত চালাতে ততই সে আস্তে চালাচ্ছে। এক সময় সবাই বিরক্তিবোধ করলো। কিন্তু কিছুই করার নেই। সারা রাত গাজীপুরেই কাটিয়ে দিলাম। সকালে জ্যাম ছুটলে গাড়ি আবার চলতে লাগলো।
আর সবাই এক সাথে থাকার কারণে গান, হাসি, ঠাট্টা, কৌতুক, কবিতা আবৃত্তি সবই হলো। বেশ উপভোগ করতে লাগলাম। আমরা ১৪ তারিখ রাত ৮টায় কুড়িগ্রামে পৌঁছলাম। টানা ২২ ঘণ্টা জার্নি করলাম। একেকজনের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আর আমার তো শরীরের অবস্থা পুরাই কেরোসিন! রাতের খাবার কোন রকমে শেষ করেই ঘুমোতে গেলাম।
গালিব ভাই বললেন, সকাল ৭ টার দিকে একবারে বের হবো। হোটেলে শুধু ব্যাগ থাকবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডি হলাম। বাইরে যেতেই অনুভব করলাম প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। অথচ ঢাকায় এখন গরমে ফ্যান চালাতে হচ্ছে। সকালের নাস্তা শেষে আমরা গ্রামের ভেতরে যাওয়া শুরু করলাম।
অসহায়, বৃদ্ধদেরকেই মূলত কম্বল দিবো। সে জন্য আমরা গ্রুপ করে ভাগ হয়ে গেলাম। প্রত্যেকটা বাড়ি বাড়ি যেয়ে দেখে এলাম কাদেরকে স্লিপ দেয়া যায়! আর স্লিপ যাদের কাছে থাকবে শুধুমাত্র তারাই কম্বল পাবে। পায়ে হেঁটে কোথা থেকে কোথায় যে গেছি বলে বুঝাতে পারবো না।
আঁকাবাঁকা রাস্তা, রাস্তার খুবই করুণ অবস্থা! একটা মোটরসাইকেল যেতে পারবে। একেবারেই সরু রাস্তা। কোন ভ্যান সে রাস্তা দিয়ে যতে পারবে না। ভাবুন একবার, কোন জরুরি মুহূর্তে কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাকে নিয়ে যাবে কিভাবে?
যখন আমরা বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি তখন তাদেরকে দেখলাম এমনিতেই ঠাণ্ডা গায়ে একটা ছেঁড়া জামা পরে আছে। আমার চোখ দুটো ছল ছল করছিলো। এভাবে সারাদিন কার্ড বিলিয়ে বেড়ালাম। দুপুরের দিকে মুরাদ ভাই আমাকে কল দিয়ে বললেন, ভাই আপনারা কোথায়! আমি বললাম ভাই কার্ড বিলি করে এখন বাজারে এলাম। বললেন ঠিক আছে বাজারে থাকেন আমরা আসছি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখি আমাদের কম্বলের গাড়ি এসে গেছে।
কম্বল বিতরণ শেষে বাজারে এলাম সবাই খুবই ক্লান্ত। দুপুরে যারা খেতে পারিনি তারা হোটেলে ঢুকলাম। গালিব ভাই বললেন কী আছে ভাতের সাথে। বলল মুরগি! আমি বললাম দাম কত? বললো বিশ টাকা। আমি বললাম একশো বিশ? তিনি হাসি দিয়ে বললেন না মামা মাত্র বিশ টাকা। আমি তো হতবাক। বিশ টাকায় আবার মুরগিও পাওয়া যায়? খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠলাম। ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে যাবে। রাতের বেলায় কি আর কিছু দেখা যায়! তারপরও গেলাম আর যদি আসা না হয় তাহলে! প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করলাম। এরপর ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম।
সবাই খুবই ক্লান্ত! গাড়িতে উঠার পরই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুম আমাকে কাবু করতে পারেনি। ভাবনার বাতায়ন খুলে গেল। শুধুই সেসব বঞ্চিত মানুষকে নিয়েই ভাবছি। সমাজের বিত্তশালীরা যদি একটু তাদের দিকে তাকাতো তাহলে আমার মনে হয় না আর কেউ অসহায় মানুষ বলে কিছু থাকতো। তা ছাড়া আমরা সকলেই যদি একত্রে মিলে কাজ করতে পারি তাহলে হয়তো বা আর কেউ অনাহারে থাকতো না। আল্লাহপাক আমাদেরকে জ্ঞান, শক্তি, সাহস ও সহযোগিতা দান করুন।

Share.

মন্তব্য করুন