রাস্তার এক মোড়ে মাহিনদের বাসা। বাবা আজিজুর রহমান ও মা জাহানারা বেগমের একমাত্র আদরের সন্তান মাহিন। মাহিন ছেলেটা খুবই ছটফটে। বয়স কতই বা হবে আর; দশ-বারো বছর। পড়ে ৪র্থ শ্রেণীতে। ক্লাসের ফার্স্ট বয়। স্কুলের সব শিক্ষকসহ সবার মন জয় করে রেখেছে এই ছোট্ট মাহিন। তাই সবাই থাকে খুব আদর করে, ভালোবাসে।
মাহিনের বাসার পাশেই একটা বস্তি এলাকা। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে এলাকাটা। ছোট্ট ছোট্ট কিছু ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বস্তি। সারাদিন চেঁচামেচি, কান্নার আওয়াজ, ছোট্ট শিশুর আর্তনাদ- এই সব কিছুই ভেসে আসে ওই এলাকা থেকে। দেখতে খুবই নোংরা একটা জায়গা। যেতেও ইচ্ছা করে না। বমি বমি ভাব লাগে কাছে গেলেই। মাহিন বাসার ছাদ থেকে দেখে সবকিছু। তার খুব খারাপ লাগে সেখানে থাকা তার বয়সী ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের জন্য।
তার ওই ছোট্ট মনে প্রশ্ন জাগে, ‘তারা ওখানে থাকে কেন?, তাদের কি মা-বাবা নেই? তারা স্কুলে যায় না? তাদের কি ভাল কাপড় নেই পরার জন্য?’ এভাবে হাজারো প্রশড়ব জমা হয় মাহিনের মনে। সে একদিন ঠিক করল বাবাকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করবে, জানতে চাইবে সকল প্রশ্নের উত্তর।
আজ শুক্রবার। অফিস বন্ধ। আজিজুর রহমান আজ ফ্রি থাকবেন। তাই মাহিন আজকেই বাবাকে তার প্রশ্নগুলো করবে বলে ঠিক করল। সকালের নাস্তা সেরে বাবা প্রতিদিনই পত্রিকা পড়েন। আজও বাদ দেননি। মা অন্য কাজে ব্যস্ত। মাহিন বাবার পাশে গিয়ে বসল। বাবা মাহিনকে দেখে বলল, ‘কী খবর বাবা? লেখাপড়া কেমন হচ্ছে তোমার?’
– হুম বাবা ভালো। বাবা একটা প্রশ্ন করব?
– হুম কর!
– আচ্ছা বাবা, আমাদের পাশে যে বস্তিটা আছে না, ওখানকার মানুষগুলো এমন কেন? তাদের ছেলেগুলো কি লেখাপড়া করে না? তাদের কি আমার মতো ভাল জামা নাই?
– কেন আব্বু? হঠাৎ এই প্রশ্ন যে? ওদের কে কি তোমাকে কিছু বলছে নাকি?
– না বাবা, এমনিতেই। বল না প্লিজ।
– শোন, ওরা হচ্ছে ছোটলোক। ওদের কাজ হচ্ছে শুধু শুধু অন্যের কাছে চাওয়া। ওদের ছেলেগুলো খুব বাজে আর অপরিষ্কার। ওদের সাথে কিন্তু কোনদিনও মিশবে না। বুঝেছ?
– হুম বুঝেছি বাবা। আচ্ছা ওরা কি আমাদের মত শিক্ষিত হতে পারে না? ছেলেগুলোও কি লেখাপড়া করতে পারে না?
– শোন আব্বু আমার, ওরা যেমন থাকবে থাক এসব নিয়ে আমাদের চিন্তা করার দরকার নাই। ওরা হচ্ছে ছোটলোক, ওদের সাথে আমাদের তুলনা হয় না। তুমি এখন ওসব কথা মাথা থেকে ফেলে রুমে গিয়ে পড়তে বস। ঠিক আছে?
– আচ্ছা ঠিক আছে।
মাহিন চলে যায় তার রুমে। সে কোনমতে সেসব চিন্তা ফেলতে পারছে না। তার মনে হতে লাগল সেই শিশুগুলোর কানড়বার আওয়াজ, মুখের সামনে ভেসে উঠছে সেই মায়াভরা মলিন মুখটা।
একদিন মাহিন তার বাবার সাথে স্কুলে যাচ্ছিল। বাসা থেকে বের হয়ে তারা রাস্তার পাশে দাঁড়াল ড্রাইভার গাড়ি বের করছে তাই। এমন সময় বস্তির একটা ছেলে
এসে আজিজুর রহমান সাহেবের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ‘স্যার, কিছু টাকা দেন স্যার। আজ দুই দিন হইয়া গেল পেটেরে পানি ছাড়া কিছুই দিতে পারলাম না। ম্যালা ক্ষিধা পাইছে, কিছু টাকা দেন না স্যার।’ আজিজুর রহমান সাহেব বিরক্ত হয়ে ছেলেটাকে এক চড় দিয়ে বললেন, ‘সর বলছি, সর। মানুষ আর পাইলি না। আমাকেই ধরলি। এসব টোকাই যে কোথা থেকে আসে! যতসব ফালতু।’ মাহিন শুধু দেখতে থাকল সবকিছু। সে যেন তার ভাষাটাই হারিয়ে ফেলেছে। তার সামনে তার বাবা তার বয়সী একটা ছেলেকে এমন করল! ড্রাইভার এতক্ষণে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। গাড়িতে চেপে বসল তারা। সে বারবার চেয়ে আছে সেই ছেলেটার দিকে। খুব রাগ হচ্ছে তার বাবার ওপরে। কী প্রয়োজন ছিল এমন ব্যবহার করার? কিছু টাকা দিলে কি সব টাকা শেষ হয়ে যেত? অন্তত সুন্দর করে হলেও তো কথাটা বলা যেত? এভাবে অনেক প্রশ্ন উড়ে আসছে মাহিনের মন থেকে। চলতে চলতে গাড়ি এসে গেল স্কুলের সামনে। মাহিনকে নামিয়ে দিয়ে আজিজুর রহমান চলে গেলে অফিসে।
শুরু হলো ক্লাস। মাহিনের কিছুই ভালো লাগছে না। শুধু মনে পড়ছে সেই ঘটনার কথা। দেখতে দেখতে এক-দুই-তিন করে করে সব ঘণ্টা শেষে ছুটি হলো স্কুল। মাহিন স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য। কিছুক্ষণ পর চলে এলেন আজিজুর রহমান সাহেব। মাহিন গাড়িতে ওঠার পর স্কুলের সবার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। টিফিন খেয়েছে কী জিজ্ঞাস করলে মাহিন বলল, ‘না বাবা আজ টিফিনে কিছুই খাইনি।’
– কেন, মন খারাপ?
– না, মন খারাপ না বাবা, এমনিতেই ভাল লাগেনি তাই খাইনি আরকি।
– টাকাগুলো কী করেছ? টাকা দিয়েও তো কিছু একটা খেতে পারতে।
– আছে ওগুলো। আসলে আমার ক্ষুধা ছিল না আজ। তাই। গাড়ি চলছে। বাসার কাছাকাছি আসতেই মাহিন ড্রাইভারকে বলল, ‘আংকেল একটু দাঁড়ান তো। আমি আসছি।’ বাবা বলে উঠলেন, ‘কিরে কোথায় যাচ্ছ?’ মাহিন বলল, ‘এইতো বাবা, এখনই আসছি।’ এই বলে মাহিন সোজা চলে গেল দোকানে। আইক্রিম আর কিছু খাবার নিয়ে চলে গেল সেই বস্তি এলাকাই।
সকালের সেই ছেলেটাকে খুঁজে বের করে সব খাবার আর তার টিফিনটা দিয়ে দিল তার হাতে। সাথে সামান্য টাকাও দিল আর বলল, খাও। বস্তির ছেলেটা মাহিনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল। মাহিনও জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। এ দৃশ্য দেখে গাড়িতে আর নিজেকে রাখতে পারলেন না আজিজুর রহমান সাহেব। গাড়ি থেকে নেমে চলে এলেন মাহিনের কাছে। মাহিন আর বস্তির ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আজকে থেকে তোমরা দু’জন ভাই ভাই। আজ থেকে দু’জন একসাথে থাকবে, একসাথে লেখাপড়া করবে।’ এ কথা শুনে মাহিনের মুখে ফুটে উঠল এক টুকরো মিষ্টি হাসি।

Share.

মন্তব্য করুন