বাংলাভাষা আমাদের মাতৃভাষা। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বয়সও কম নয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই ভাষা এখন আন্তর্জাতিক আকাশ ছুঁয়েছে। ভাষা-শহীদ দিবস হিসাবে একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে এক বিশেষ খ্যাতি ও মর্যাদা। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সগৌরবে দেশে দেশে। এই মর্যাদা ও গৌরব কেবল বাংলাভাষার। এই সম্মানের অংশীদার সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ-বাংলাদেশ। তার সাথে সমান গৌরবান্বিত আমরাও।
বাংলা শুধু একটি ভাষারই নাম নয়, এটি এখন একটি রক্তাক্ত ইতিহাসের নাম। শাণিত সংগ্রাম এবং বিজয়ের নাম। সেই সাথে আমাদের সাহস এবং তারুণ্যের নামও। বাংলাভাষাকে এখন আর উপেক্ষা করার দুঃসাহস রাখে কে?
এই যে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাভাষা, এই ভাষা আজকের এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন হয়েছে বহু সংগ্রামের। অজস্র বাঁক পেরিয়ে তারপর সে পেয়ে গেছে তার আস্থার উপকূল। স্বপ্নের চাতাল। বাংলাদেশে বাংলাভাষা একটি স্মরণীয় ও বহু বর্ণিল অধ্যায়। সে এখন নিজেই একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস। এর মূলে রয়েছে মুসলিম অবদান। যখন এই বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন থেকেই সূচিত হলো বাংলাভাষার সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি। সেই ১২০৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। এই সময়ে তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি হিন্দ রাজা লক্ষণ সেনকে লখনৌতি থেকে বিতাড়িত করে বাংলায় সংস্কৃত চর্চার মূলে কুঠারাঘাত হেনে বাংলাভাষা চর্চার পথ উন্মক্ত করলেন।
সেই তো শুরু। তারপর থেকে ১৭৫৭ অর্থাৎ পলাশীর বিপর্যয় পর্যন্ত বাংলাভাষা ক্রমাগত এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে, সামনের দিকে। ১২০৩ থেকে ১৭৫৭ সাল। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচশো বছর ছিল বাংলাভাষার স্বর্ণযুগ। মুসলিম শাসক ও ইসলাম প্রচারকদের অক্লান্ত শ্রম, নিষ্ঠা ও ত্যাগ জড়িয়ে আছে এর সাথে। তারা যেমন রাজনীতি এবং ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলাকে সুসংহত করেছেন, ঠিক তেমনি তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় তখনকার লেখকদের হাতে অবহেলিত এবং মৃতপ্রায় এই বাংলাভাষা লাভ করেছিল নতুন জীবন।
বাংলাভাষার ক্রমবিকাশ ও আন্দোলনের ধারাক্রমে সেসবই আজ ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ হয়ে আছে। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর আগ পর্যন্ত বাংলাভাষার বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কোমল বাতাস। তার পর থেকেই বদলে গেল বাংলাভাষার চেহারা। ইংরেজ কূটকৌশল আর সংস্কৃত ভাষার আগ্রাসনে বাংলা হয়ে পড়লো কোণঠাসা, অবাঞ্ছিত এবং অবহেলিত এক শীর্ণকায় ভাষা। এই দুঃসহ অবস্থাটা চলছিল ক্রমাগত। সেও তো কয়েকশো বছরব্যাপী। কিন্তু তুষের আগুন ঠিকই জ্বলছিল বাংলার সচেতন মুসলমানদের বুকে। সে কেবল দানা বাঁধার অপেক্ষায় ছিল। মাঝে মাঝেই জ্বলে উঠতো। আবার প্রয়োজনীয় শক্তির অভাবে থেমেও যেত।
এই ধারাবাহিকতারই অংশ ছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আন্তরিক প্রয়াস। ১৯২০ সাল। ইংরেজ শাসন তখনো চলছিল। এই সময়ে কলকাতার শান্তিনিকেতনে একটি সভা হলো। কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সভাপতি। এই সভায় বাংলাভাষার পক্ষে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনকাড়া একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করলেন। প্রবন্ধটি পরে মোসলেম ভারত পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এ ছাড়াও বাংলার বহু লেখক বুদ্ধিজীবী বাংলাভাষার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে লেখা ও বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। এভাবেই চলছিল বাংলাভাষা আন্দোলনের মৃদু পা ফেলা, পা তোলা। দিন যত গড়াচ্ছিল, ততোই দুর্বার হয়ে উঠছিল ভেতরে সুপ্ত স্বপ্ন। বাংলাভাষার আন্দোলনও ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করলো। এলো ১৯৪৭। ১৪ আগস্ট। এই দিনে ইংরেজমুক্ত হয়ে আমরা পেলাম একটি নতুন দেশ।
নতুন পতাকা। ভারত আর পাকিস্তান- এই দুটো অংশে বিভক্ত হলো মানচিত্র। আমরা হলাম পাকিস্তানের অধিবাসী। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। মূলত তারাই ছিল শাসনকর্তা। এই সময়ে আমাদের পূর্ব বাংলার লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বাংলাভাষার প্রসঙ্গটি আবার দুলে উঠলো প্রচণ্ডভাবে।
কিভাবে একে প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রসারিত করা যায়? ভাবনা শুরু হলো। ভাবনা থেকে পরিকল্পনা। পরিকল্পনা থেকে আন্দোলনের শুরু। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, তারপর বৃহৎ অংশ- এভাবেই ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো ভাষার দাবি।
ইংরেজ শাসনামলে এ দেশে চেষ্টা চলেছিল রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করার জন্য। আবার পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান চেষ্টা চালালো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। ভূমিষ্ঠ হয়েই আমরা যাদেরকে দেখি- তাদের ভাষা বাংলা। আমরা খেলি, বড় হই, পরস্পরের সাথে কথা বলি, ভাব বিনিময় করি- সে কেবল বাংলাতেই। তবে কেন বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা এখানে রাষ্ট্রভাষা হবে?
প্রশ্নটি ছিল যুক্তিসঙ্গত। ফলে বাংলাভাষার দাবিকে পশ্চিম পাকিস্তান তুচ্ছজ্ঞান করলেও আন্দোলনের অব্যাহত গতিকে তারা থামিয়ে দিতে পারলো না। তারা যতই বাধার সৃষ্টি করতে থাকলো, ততোই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে শুরু করলো আন্দোলনের গতি। সুতরাং ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই পূর্ব বাংলায় জ্বলে উঠলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এক প্রচণ্ড আগুন। তা ছিল এক উত্তাল স্রোতধারা, যা রুখবার ক্ষমতা ছিল না কারোর।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই সোচ্চার হয়ে ওঠে বাংলাভাষার দাবি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ সুধীজন বাংলার সপক্ষে লিখতে ও বলতে শুরু করেন।
১৯৪৪ সাল। তখন একশ্রেণীর শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখলেন। এর তীব্র সমালোচনা করে কবি ফররুখ আহমদ ১৩৫৪ সনের আশ্বিন সংখ্যায় মাসিক মোহাম্মদীতে লেখেন : পাকিস্তানের, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এ কথা সর্ববাদিসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলাভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপান্তরিত করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে এই তাদের অভিমত। কী কুৎসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি এর পেছনে কাজ করছে এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি।
আবুল মনসুর আহমদের বক্তব্য ছিল : উর্দু নিয়ে এই ধস্তাধস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাংলাকেই যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়ণে হাত দিতে পারবো।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বলিষ্ঠ উচ্চারণ ছিল : পূর্ব পাকিস্তানের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দিতে গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিকত পরাধীনতার নামান্তর হইবে।
১৯৪৭। বছরটি ছিল নানা দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আর এখন তো সেটা উচ্চকিত এক ইতিহাসেরই অধ্যায়। এই সালে, ১৪ আগস্ট আমরা পেলাম স্বাধীনতার স্বাদ। প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান। মাত্র পনেরো দিন যেতে না যেতেই দিকে দিকে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো বাংলাভাষার দাবির জোরালো ধ্বনি। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে গঠিতত হয় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস। এই প্রতিষ্ঠানই প্রথমত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। তারাই প্রথমত উন্মোচন করে ভাষার দাবিতে সংগ্রামের উত্তপ্ত পথ। সেই সিঁড়ি বেয়েই সংগ্রামের সুতীব্র বাতাস বয়ে চলে দেশের ছাত্র-শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীর চেতনায়। কী গতিশীল ছিল সেই ঝাঁঝালো প্রহরগুলি! তমদ্দুন মজলিসের এই দুর্বার আন্দোলনের নেতৃত্বের আসনে ছিলেন তখন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, এ.কে.এম. আহসান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শামসুল আলম, আজিজ আহমদ, অধ্যাপক নূরুল হক ভুঁইয়া, সানাউল্লাহ নূরী, শাহেদ আলী, আবদুল গফুরসহ অনেকেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। এই দিনে প্রকাশিত হয় বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা।
নাম-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু? প্রকাশনায় ছিল তমদ্দুন মজলিস। আর এটা সম্পাদনা ও সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। এতে লিখেছিলেন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাসেম। তাদের লেখায় প্রমাণ করা হয় যে, বাংলাভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার উপযুক্ত। সুতরাং বাংলাই হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে বিপুলভাবে জনমত গড়ে তোলার জন্য তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এক স্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত হয়। দেশের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ বহু ব্যক্তি এতে স্বাক্ষর করেন। মেমোরেন্ডামের একটি কপি সরকারের কাছে পেশ করা হয়। আর তার অন্য কপি পত্র-পত্রিকায় দেয়া হয় প্রকাশের জন্য।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে আরো সোচ্চার ও বলিষ্ঠ করারত জন্য প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর আহবায়ক নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল হক ভুঁইয়া। তমদ্দুন মজলিসের অফিসে সুরত জামাল মেসের পুরনোত ঘরটিতেই সংগ্রাম পরিষদের কাজ শুরু হয়। প্রথমদিকে কিছুটা গোপনে। পরে অবশ্য প্রত্যক্ষ ও জোরালোভাবেই কাজ চলেছে। তখন তাদের কোনও ভয়ই আর বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি।
আশঙ্কাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো যে, উর্দুই হচ্ছে রাষ্ট্রভাষা। সবাই উদ্বিগ্ন। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু নয়, বরং বাংলাই হত হবে। পূর্ব পাকিস্তানের শত শত নাগরিক এই স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন।
১৯৪৭ সালে মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। চলতে থাকে নানাবিধ কার্যক্রম। এইত আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রথম সংঘর্ষ বাধে ১২ ডিসেম্বর। স্থান ঢাকার পলাশী ব্যারাক। এই দিনে বাংলা বনাম উর্দু বিতর্কে বাঙালি ও অবাঙালির কেরানিদের মধ্যে সংঘষের্র সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষ এক পর্যায়ে তীব্রতর হয়। এতে ২০ জন আহত এবং ২ জন নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর ছাত্র ও সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা ধর্মঘট করে। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার লক্ষ্যে ঢাকা শহরে ১৫ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। ১১ মার্চ সম্পর্কে ভাষাসৈনিক বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ৪৮ সালের ১১ মার্চের আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। সত্যি বলতে কী, ১১ মার্চের আন্দোলন না হলে ’৫২-এর আন্দোলন হতো না, ’৪৮-এর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে যে সংগ্রাম শুরু হয়, ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি তা পূর্ণতা পায়।
মোহাম্মদ তোয়াহার দৃষ্টিতে, বস্তুত ৪৮-এর ১১ মার্চই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সংঘটিত গণবিক্ষোভ। আর কামরুদ্দীন আহমদ বলেছেন, এ আন্দোলন তৎকালীন সরকারকে রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। অথচ রক্ত দিয়েও ’৫২ সালে সরকারকে টলানো যায়নি। ভাষার দাবি উঠাবার নৈতিক বল যতটুকু এসেছিল তা ১১ মার্চের চুক্তির ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছিল বলেই ’৫২ সালের আন্দোলন মূলত ২১, ২২, ২৩ এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উত্তপ্ত ছিল। এরপর পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার এটাকে তছনছ করে দেয়।
১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। সফরকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনিসিয়াম মাঠে এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ছাত্রদের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি-সংবলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মেমোরেন্ডাম পাঠ শেষে লিয়াকত আলী খানকে প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক মেমোরেন্ডাম সম্পর্কে বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন : বস্তুত সে মেমোরেন্ডাম ছিল রাষ্ট্রভাষার দাবিসহ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি-সংবলিত এক ঐতিহাসিক দলিল।…উক্ত মেমোরেন্ডামে প্রতিরক্ষা বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানের সম-অধিকার, চাকরির ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রামে নৌসদর স্থাপন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দাবিসমূহ সন্নিবেশিত ছিল।
এই মেমোরেন্ডাম সম্পর্কে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, ডাকসুর জি.এস. হিসেবে আমি ঐ মেমোরেন্ডাম পাঠ করি। রাষ্ট্রভাষার কথাটি ছিল মাঝামাঝি। এর পূর্বে আঞ্চলিকতা ও প্রাদেশিকতার নিন্দা ছিল। মনে পড়ে, রাষ্ট্রভাষার দাবির প্যারাটি দু’বার পড়েছিলাম। একবার পড়ার পর ছাত্রসমাবেশে তুমুল করতালি পড়ে। করতালি শেষ হলে আমার কানে এলো বেগম রানা লিয়াকত আলী রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্যারাটি শুনে লিয়াকত আলী খানকে বলেছেন, ল্যাঙ্গুয়েজকে বারে মে সাফ সাফ বাতা দেনা। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে স্মারকলিপি পাঠ করছিলাম, তার পাশে রানা লিয়াকত আলী বসেছিলেন। তাঁর কথা শুনে আমি Let me repeat this বলে আবার ভাষার দাবির প্যারাটি পড়লাম। আবারও এ দাবির সমর্থনে সমাবেশে তুমুল করতালি পড়ে। বক্তৃতার একপর্যায়ে লিয়াকত আলী খান বলেন, It is not provincialism, then what is provincialism? তাঁর এ কথাগুলো শুনে আমরা ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু না, তিনি কিছু বলেননি। গোটা প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যান।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি। এদিন পল্টনের এক জনসভায় খাজা নাজীমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করেন, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। তার এই ঘোষণা ছিল ৪৮ সালের ১৫ মার্চে গৃহীত রাষ্ট্রভাষা চুক্তির সরাসরি খেলাফ। ফলে তার এই ঘোষণার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এই ৩০ জানুয়ারি বিকালে বার লাইব্রেরি হলে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৪০ জনের অধিক সদস্য নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। এর আহবায়ক নিযুক্ত হন কাজী গোলাম মাহবুব। এই কর্মপরিষদের উদ্যোগে ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে ঢাকা শহরে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। এইদিন বিকালে কর্মপরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এক জনসভা। সভায় মওলানী ভাসানী, আবুল হাশিম ও অন্যান্য রাজনীতিক ও ছাত্রনেতা লীগ সরকারের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নিন্দা করেন। তারা বাংলাভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আরও ঘোষণা করা হয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হবে। সিদ্ধান্ত মুতাবিক ধর্মঘট সংক্রান্ত সকল প্রস্তুতি এগিয়ে চলছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি। এই রাতে সরকার বেশামাল হয়ে জারি করে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা। বলা হয়, ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে পরবর্তী এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে এবং সকল প্রকার ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ থাকবে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! সংগ্রামের যে তীব্র আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র, সে আগুনকে সরকার দাবিয়ে রাখবে কেমন করে? হোক না ১৪৪ ধারা জারি! ১৪৪ ধারা কেন, পর্বতপ্রমাণ বাধাও তখন তুচ্ছ। সাহসের সাথে সামনে এগুবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন কর্মপরিষদের নেতৃবৃন্দ। সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কোনও মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। এবং কালই, ২১ শে ফেব্রুয়ারি।
যে কথা সেই আজ। ২১ ফেব্রুয়ারি। ঘন কুয়াশা ঘেরা সকাল। হিম-হিম ঠাণ্ডা। রক্তবরণ ধারণ করেছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল। সবার ভেতরে রয়ে গেছে এক আন্দোলনের উত্তাপ। ঢাক শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে দলে দলে ছুটে আসছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা। তারা জমায়েত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। বিপুল সংখ্যক উপস্থিতির এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করলেন জনাব গাজীউল হক। সমাবেশ শুরু হলো বেলা প্রায় সাড়ে বারোটায়। সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের শপথে সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রীরা হয়ে ওঠে উজ্জীবিত। চলতে থাকে ক্রমাগত প্রতিবাদী শ্লোগান এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রচেষ্টা।
ছাত্র-ছাত্রীদের সংগ্রামের উত্তাল সমুদ্রের গর্জনে কেঁপে ওঠে শাসকের ভিত। দিশা না পেয়ে তারা পুলিশকে নির্দেশ দেয় গুলির। বিক্ষুব্ধ মিছিলের ওপর চললো নির্বিচারে পুলিশের লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলি। মুহূর্তেই রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। মাটিতে ঢলে পড়লেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সালাউদ্দিনসহ অনেকেই। তাদের অমোচনীয় রক্তে লেখা হলো ২১ শে ফেব্রুয়ারি। আর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নতুন করে জেগে উঠলো সারা দেশ। তা ছিল রক্তের বিনিময়ে অধিকার আদায়ের এক তীব্রতম সংগ্রাম। সে ছিল বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম, সে ছিল মূলত বাংলাভাষার লড়াই।
শহীদের তাজা খুনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের বাংলাভাষার মর্যাদা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং একই সাথে রাষ্ট্রভাষা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই ভাষার মর্যাদাপূর্ণ পতাকা আজ সগৌরবে পতপত করে উড়ছে বিশ্বের দরবারেও।
যাদের সীমাহীন ত্যাগ, সংগ্রাম আর আন্দোলনের মাধ্যমে প্রিয় বাংলা আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা সবাই ইতিহাসের নন্দিত পথিকৃৎ। কালের অক্ষরে অমর। তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাও তাই অশেষ। এখন আমাদের উচিত, প্রাণের ভাষা বাংলার সামগ্রিক মর্যাদা রক্ষার জন্য অব্যাহত চেষ্টা করা।
বাংলা রাষ্ট্রভাষার অর্থ কিন্তু অপরাপর ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো নয়। ইংরেজি, আরবিসহ সকল ভাষাই আমাদের শিখতে হবে, এসব ভাষায় আমাদের দক্ষ হতে হবে, কিন্তু বাংলার প্রতি সার্বিক শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ থাকতে হবে পৃথকভাবে। বাংলার আসনটি থাকবেত আমাদের হৃদয়ে অন্যভাবে, সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক ক্যানভাসে।
১৯৫২ থেকে ২০০৭। এর মধ্যে বয়ে চলেছে পঞ্চান্ বছর। একুশে ফেব্রুয়ারির পঞ্চান্ন বছর পূর্তি আমাদের কাছে বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসে দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেন কখনও ভুলে না যাই আমাদের সেই গৌরবান্বিত ইতিহাসের কথা। সেই সাথে যেন ভুলে না যাই বাংলাভাষায় মুসলিম অবদানের গৌরবজনক অনিবার্ সেই অবিস্মরণীয় ইতিহাসের কথাও।

Share.

মন্তব্য করুন