স্কুল থেকে ফিরেই কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়ে পরশ। কোনো কোনো দিন স্কুলড্রেস খোলার কথাও মনে থাকে না। ঘরে ঢুকেই ব্যাগটা কাঁধ থেকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে খাটে। ঘামমাখা জামা-জুতা নিয়েই কম্পিউটারের সামনে নিজেকে হাজির করে। ওপেন বাটনে চাপ দিয়েই ঢুকে পড়ে কম্পিউটার জগতে। স্কীনে তুলে আনে গেম-রাজ্য। বেছে নেয় নিজের পছন্দের গেমটি। তারপর গেম রাজ্যের সম্রাট হয়ে ওঠে সে। পৃথিবীর আর কোনো বিষয়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি খাওয়া-দাওয়ার সাথেও না। আদরের মামণিকেও বিলকুল ভুলে থাকে। একমাত্র ছোট বোন মৌরিরও খবর থাকে না।
কেবল কম্পিউটার তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। বেলা দুইটা-আড়ইটা থেকে সন্ধ্যা নাগাদ একটানা কম্পিউটারে গেম খেলে পরশ। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। তবুও কম্পিউটার ছেড়ে ওঠে না। তার মা ডেকে তোলেন। বলেন, এই পরশ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পড়তে বস। মায়ের ডাক কানে যেতেই খানিকটা তৎপর হয়ে উঠতো সে। কিন্তু  এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। তার মা একবার দু’বার তিনবার ডাকে। পরশ কম্পিউটার ছেড়ে উঠতে চায় না। মা যখন ডাকে তখনই মৌরি এসে দাঁড়ায় পরশের পাশে। না সে মৌরির দিকে ফিরেও তাকায় না। ছোট্ট মৌরির বুকে ভীষণ অভিমান জাগে। ভাইয়া কেন তার সাথে কথা বলে না। খেলে না। কম্পিউটারে কি এমন আকর্ষণ যার জন্য ভাইয়া তাকে অবহেলা করে। ভুলে থাকে। মাঝে মাঝে মৌরি এসে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর ভাইয়ার হাত ধরে বলে- চলো না ভাইয়া আমরা লুকোচুরি খেলি।
পরশ চোখ টাটিয়ে ধমক দেয় মৌরিকে। ধমক খেয়ে মৌরি অবাক হয়। তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে। মৌরির কানড়বা দেখে আরো ক্ষেপে ওঠে পরশ। চিৎকার করে বলে, মা তোমার এই যন্ত্রণাটা নিয়ে যাও তো। মা পরশের কথায় বেশ অবাক হয়। কিন্তু মুখে হাসি টেনে বলে- এসো মৌরি তোমার ভাইয়াকে খেলতে দাও।
মৌরি দুই হাতে চোখ ডলতে ডলতে এসে মায়ের আঁচলের নিচে মুখ লুকায়। মা থুঁতনি ধরে এক পশলা আদর করে বলে এসো তুমি আমার সাথে খেলবে। মৌরি মার সাথে খেলতে আর কোনো আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে- আম্মু ভাইয়া আমার সাথে খেলে না কেন?
আম্মু কি জবাব দেবে মৌরিকে। ভাবে ঠিকই তো। বেশ কিছুদিন থেকে পরশ মৌরিকে নিয়ে খেলে না। ওকে কাছে ডাকে না। বরং মৌরি কাছে ছুটে গেলে ধমক দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। কী আশ্চর্য এই কম্পিউটার নামের যন্ত্রটির সাথে কি চুম্বক আছে যা পরশকে তার সব খেলাধুলা থেকে টেনে নিয়েছে। এমনকি লেখাপড়ায়ও আগের মতো মন নেই। পড়তে বসলে উসখুস করে। মন থাকে উড়ুউড়ু। একরকম পলাতক মন নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে। প্রথম প্রথম বিষয়টি খেয়াল করেনি রুমা। ভেবেছে ছেলেটি নতুন কম্পিউটার পেয়ে খানিকটা সময় কাটাচ্ছে। তার কৌতূহল মেলে ধরছে কম্পিউটারে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে ততই সে কম্পিউটারের সঙ্গী হয়ে উঠছে। বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলছে রুমাকে।
সন্ধ্যায় টিচার আসে পড়াতে। স্যার আসার আগে টেবিল গুছিয়ে অন্তত পড়তে বসে পরশ। আজ ক’দিন তারও ব্যতিক্রম ঘটছে। টিচার এসে বসে থাকে পরশের অপেক্ষায়। পরশ নেই। কোথায়? সেই কম্পিউটারে। একরকম ধমক দিয়ে রুমা তাকে পাঠায় পড়ার টেবিলে। টিচার কিছুটা রাগ করেন- কি হলো তোমার? সন্ধ্যার সাথে সাথে পড়তে বস না ব্যাপার কি? টিচারের কথার কোনো জবাব দেয় না পরশ। অনমনে বই খাতা ঘাঁটতে থাকে। মনে হয় কোনো ঘোরের ভেতর ডুবে আছে। কোনোভাবেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। বিষয়টি টিচার পরশের আম্মুকে বলেছেন। বলেছেন ফিরে যাবার সময় পরশের অবর্তমানে। এও বলেছেন এমন অমনোযোগী হলে নির্ঘাত রেজাল্ট খারাপ করবে। তা ছাড়া এ ধরনের ছাত্র আমার পড়াতেও ভালো লাগে না। দেখেন আপনার ছেলের কী হয়েছে?
টিচারের কথায় বেশ লজ্জা পেয়েছে পরশের আম্মু। তার মনে নানান প্রশ্ন। কেন এমন হলো ছেলেটি? কম্পিউটার ছেলেটাকে নষ্ট করে দেবে? পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে ছেলেটি। বৃত্তির পুরস্কার হিসেবে কম্পিউটার কিনে দিয়েছেন পরশের আব্বু। কেনার সময় রুমা পরশে আব্বুকে বলেছিলো বাচ্চা ছেলে ও কম্পিউটার দিয়ে কী করবে? তা ছাড়া যদি লেখাপড়ায় ক্ষতি হয়।
রুমার কথাটি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন পরশের আব্বু। বলেছে- তুমি যে কী বলো। এখনকার পৃথিবী কি আগের মতো আছে? কত বদলে গেছে দুনিয়া। বদলে গেছে মানুষগুলো। স্কুলে যেতে শুরু করেনি কিংবা লেখাপড়া এখনো শেখেনি এমন অনেক শিশু এখন কম্পিউটার শেখে। শুধু তাই নয়, কম্পিউটারের নানান বিষয় আশয় ওদের নখদর্পণে। এখনতো কম্পিউটারেই বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হয়। আমার ছেলেটাও কম্পিউটার শিখবে। এতে তার লেখাপড়ার প্রতি আরো আগ্রহ বাড়বে।
পরশের আব্বুর কথায় যুক্তি আছে ভেবে আর কোনো কথা বলেননি রুমা। দু’জন মিলে ছেলের জন্য কম্পিউটার কিনে নিয়ে এসেছেন। যেদিন কম্পিউটার এলো বাসায় সে দিনের আনন্দ আজো মনে পড়ে রুমার। তার ব্যবসায়ী স্বামী কম্পিউটার কিনে তার একমাত্র ছেলেকে উপহার দিয়েছে। পরশ কম্পিউটার পেয়ে আকাশ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হলো। বললো আম্মু দেখো আমি আরো ভালো পড়ালেখা করবো। আব্বু আম্মু দু’জনকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। পরশের আব্বু ওকে কোলে তুলে আদরে আদরে ভরে দিলো। কিছু তেমন না বুঝেও সবার সাথে উল্লাস প্রকাশ করেছে মৌরি। প্রথম শ্রেণীতে উঠলো এবার মৌরি। অ আ ক খ ও চেনে। কিন্তু সব কিছু পড়তে এখনো শেখেনি। ভাইয়ার সাথে ওর দারুণ ভাব। সুতরাং ভাইয়ার আনন্দ মানে ওরও আনন্দ। দরজায় দাঁড়িয়েই এসব ভাবছিলেন রুমা। মৌরি এসে রুমাকে জড়িয়ে ধরে বললো আম্মু ক্ষুধা পেয়েছে। ভাত খাবো।
মৌরির কথায় রুমা নড়ে উঠলো। ডাইনিং টেবিলে খাবার দিয়ে পরশকে ডাকলেন। মৌরিও বসে আছে ভাইয়ার জন্য। কিন্তু ভাইয়া তো আর আসে না। পরশ আবার ডাকলো রুমা। আসছি…।
আবার নীরবতা মা মেয়ে বসে আছে খাবার সামনে নিয়ে।
কিন্তু পরশের দেখা নেই।
একরকম ভেতরে রাগে ফুঁসে পরশের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো রুমা। দেখে কম্পিউটারের সামনে মগ্ন হয়ে আছে পরশ। স্ক্রিনে নানা ধরনের বিশ্রি ছবি। এক দৃষ্টিতে ছবির দিকে চেয়ে আছে সে। ছবিগুলো দেখে রীতিমতো বিস্মিত হলো রুমা। তার মনের রাগ আকস্মিক মাথায় চড়ে বসে। আগুন ধরে যায় মাথায়। কষে কিল থাপ্পড় ইচ্ছেমত দিল। এত কিল থাপ্পড় খেয়ে একটুও কাঁদলো না পরশ। ঝিম ধরে শক্ত হয়ে আছে ছেলেটি। অবাক হলো রুমা। সেই সাথে তার রাগও দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। আরো ক’টি চড় থাপ্পড় লাগালো। আগের মতোই টানটান হয়ে আছে পরশ। রাগে ক্ষোভে নিজেই কেঁদে ফেললো রুমা। বললো এই কম্পিউটার আমি পুড়িয়ে ফেলবো। যে কম্পিউটার আমার ছেলের লেখাপড়া কেড়ে নেয়, যে কম্পিউটার আমার ছেলের হাসিখুশি মন কেড়ে নেয়। সে কম্পিউটার রাখবো না আমি। বলেই হনহন করে বেরিয়ে আসে ডাইনিং টেবিলে। মৌরিকে বললো- মা তুমি খেয়ে নাও। আমি তোমাকে খাইয়ে দিই। না। আমি খাবো না। ভাইয়াকে ডাকো।
ওকে আমি আর ডাকবো না। মা তাহলে আমিও খাবো না। এই বলে হাত পা ছুঁড়ে মৌরি উঠে চলে যায় শোবার ঘরে। ছোট্ট মেয়ে সেও রাগ করছে তার মার সাথে। অবশ্য এটা ভাইয়ার প্রতি ভালোবাসা ভাবে রুমা। কিন্তু রুমার রাগ কমে না মোটেই। বারবার পরশের শক্ত হয়ে থাকার দৃশ্যটি তার চোখে ভাসে। কেবলই অবাক হয় সে। এ কেমন বদল হলো ছেলেটির। কখন এমন বদলে গেলো তার আদরের পরশ। নরম নরম কথা বলে একগাল হাসতো যে ছেলেটি। মাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে কত আদর করতো। সে কি না এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটালো। কিছুতেই মনকে মানাতে পারে না রুমা। মনের গভীর থেকে একদলা কান্না এসে ডুঁকরে উঠে কাঁদে রুমা। তার কান্না নিঃশব্দ কানড়বা কাউকে শোনাতে চায় না। তার খুব খারাপ লাগছে। এ প্রম পরশকে সে এভাবে মারলো। না মেরে তার উপায়ইবা কী? ছেলেটা কেমন বেয়াড়া হয়ে গেছে। আজ আসুক ওর আব্বু। সবকিছু খুলে বলতে হবে। এখন মনে হচ্ছে এ কম্পিউটারই তার ছেলের সকল নষ্টের মূল।
ঘড়ির দিকে তাকায় রুমা। ১০টা পেরিয়ে গেছে। ১২টা ১টার আগে পরশের আব্বু আসবে না। ক্ষিদেও মরে গেছে। ডাইনিং টেবিল থেকে পরশের রুমের দিকে এগোয় রুমা। রুমের দরজা খোলা। কম্পিউটার অফ করে খাটের এক পাশে বালিশ ছাড়া ঘুমিয়ে পড়েছে পরশ। দেখে খুব মায়া হলো রুমার। খুব ধীরে মাথাটা তুলে একটি বালিশে রাখলো। কাঁথাটা গায়ে টেনে দিয়ে চারপাশ একবার দেখেনিলো। লাইট অফ করে বেরিয়ে আসে নিজের ঘরে। মৌরি উপুড় হয়ে খাটের মধ্যখানে ঘুমিয়ে আছে। তার চুলগুলো এলোমেলো ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। এক গোছা চুল একপাশ জেগে থাকা মুখে এসে পড়েছে। পরম মমতায় মেয়েকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো রুমা। লাইট অফ করে নিজেও একপাশে শুয়ে পড়লো। সাধারণত ১১টার দিকে বিছানায় যায় রুমা। এ সময়টা রুমা নানান বিষয়ে বই পড়ে। ১২টার দিকে পরশের আব্বু এসে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে। তখন রুমা গিয়ে পাশে বসে। পরশের আব্বু খাবার খায়। আর নানারকম গল্প করে রুমা। আজ টেবিলে খাবার সাজানো হয়নি পরশের আব্বুর জন্য।
মনটা ভীষণ খারাপ। ১১টার আগেই শুয়ে পড়েছে রুমা। হাতে কোনো বইও নেই। অথচ বই ছাড়া সে এ সময় কোনোদিন বিছানায় যায়নি। আজই তার ব্যতিক্রম হলো। লাইটও অফ করে দিয়েছে। কোনো রকম আলোও তার সহ্য হচ্ছে না। অন্ধকারে ডুবে আছে রুমা। শুয়ে শুয়ে দুনিয়ার ভাবনা ভাবে। কী হলো পরশের? তার এত আদরের ছেলে। এত ভালো ছেলে। কী সুন্দর করে কথা বলতো পরশ। সবাই অবাক হয়ে শুনতো। পরশের নানু বলতো দেখিস আমার পরশ পরশ-পাথরের মতো দামি মানুষ হবে। সেই পরশ কিনা আমূল বদলে গেলো। তার মুখে কোনো ভাষা জানা নেই। পরশু স্কুল থেকেও অভিযোগ এসেছে। ক্লাস টিচার চিঠি পাঠিয়েছে পরশ আগের মতো হোমওয়ার্ক করে আসে না।
রুমার মনে পড়ছে এই কিছুদিন আগের কথা। বিকেল বেলা সবার সাথে খেলছে পরশ। মাঠে হঠাৎ করে দেখা গেলো পরশ নেই। তার খেলার সাথীরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। কই গেলো পরশ। কেউ কেউ কাছে ছুটে এলো। বললো ওরা পরশকে খুঁজছে খেলার মাঠে এদিক ওদিক। না পরশ কোথাও নেই। এ সময় পাশের বন থেকে বাতাসে ভেসে আসে পাতার বাঁশির সুর। কান খাড়া করে রুমা। হ্যাঁ এ সুরই তার পরশের। অনেক দিন থেকে পাতার বাঁশি বাজায় পরশ। কার কাছ থেকে শিখেছে কে জানে। সুর লক্ষ করে এগিয়ে যান তিনি। বেশ খানিকটা ভেতরে যেখানে গাছগাছালি ঘন হয়ে উঠেছে সেখানে। একটি বড় হিজল গাছের গোড়ায় গাছের সাথে ঠেস দিয়ে পাতার বাঁশি বাজায় পরশ। চোখ দুটি বন্ধ। মনে হয় সে অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে। চাপা পায়ে নিঃশব্দে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে রুমা। ক’জন পরশের খেলার সাথীও দাঁড়িয়ে আছে রুমার সাথে। হাতের ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে নিজেও চুপ করে দেখছে পরশের কাণ্ড। পরশ সেই যে বাজিয়ে চলেছে আর কোনো দিশা নেই। কী মন দিয়ে পাতার বাঁশি বাজায় সে। অবাক হয় রুমা। একি তার আদুরে নরম ছেলেটি। যে কিনা এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না। একা গোসল করে না। জামা-জুতা পরিয়ে দিতে হয়। রুমার মনে নানান প্রশড়ব জাগে। পরশ পাতার বাঁশি বাজায়। একথা রুমা জানে। কিন্তু একদম একা এই নিঝুম বনে এসে গাছের সাথে ঠেস দিয়ে বাঁশি বাজাবে একথাতো কখনো ভাবেনি সে। তবুও খুশি হয় সে। মনে মনে ভাবতো হয়তো তার ছেলে একদিন বড় কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে বেড়ে উঠবে। তার মনে পড়ে কবি নজরুলের কথা। নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে জঙ্গলের ভেতর একা ভরদুপুরে একটি বটগাছের নিচে বাঁশি বাজাতেন। তার বাঁশির সুর কত মানুষকে আনমনা করে তুলেছে। সেই বাঁশিতে সুর তুলতে তুলতেই বুঝি নজরুল গানের দুনিয়ায় সুরের ঝড় তুলেছেন। তার পরশও হয়তো একদিন কবি হয়ে যাবে। অথবা হবে বড় শিল্পী। এরকম কত স্বপ্ন এস উঁকি দেয় রুমার মনে।
পরশের খেলার সাথীরা অবাক হয় পাতার বাঁশিতে কি দারুণ সুর তুলছে পরশ। পরশের পাতার বাঁশি রহস্য কারো জানা ছিলো না। তারা এটুকু শুনেছে স্কুলে একবার পাতা দিয়ে সুর তুলে অনেক বড় পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু পাতার সুর এত মধুর, এত মায়াবী এটা কে জানতো। রুমাও মন দিয়ে এর আগে এমন করে শোনেনি। তার গোটা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে আনন্দে শিহরণে। তার ছেলে পাতা দিয়ে এত সুন্দর সুর তোলে। তার ইচ্ছে হয় অনেক শুনতে। কিন্তু সূর্য ডুবে যাচ্ছে প্রায়। চারদিক থেকে জেগে উঠছে রাতের অন্ধকার। এ ঘনবন থেকে এক্ষনি বেরিয়ে পড়তে হবে। কত পোকা মাকড় থাকে বনবাদাড়ে অন্ধকার হলে কিছু বোঝাও যাবে না। কিন্তু এসবের কোনো খেয়াল নেই পরশের। সে কেবল বাঁশি বাজিয়েই যাচ্ছে। এক সময় তানভীর নামের একটি ছেলে রুমার পাশে চিৎকার দিয়ে উঠলো। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে একটি ডালের দিকে। মুখে বলছে সাপ সাপ। আঙুলের ইশারা লক্ষ্যে দ্রুত তাকায় রুমা। দেখে একটি সোনালু গাছের ডাল খানিকটা এগিয়ে এসেছে হিজল গাছের দিকে। ঠিক যেখানে পরশ হিজলের সাথে ঠেস দিয়ে বসা তার একটু উপরে ডালটি। সে ডাল থেকে মাথা বের করে ঝুলে আছে একটি বিষাক্ত গোখরো। তার ফণা যেনো বাতাসে শিস কাটে। পরশ সামান্য উঠে দাঁড়ালেই সাপের মুখ তার মাথায় ঠেকবে। সাপটি চোখে পড়তেই যেনো রুমার কলিজা চেপে ধরেছে কেউ। পরশ বলে এক অস্বাভাবিক চিৎকার করে রুমা। আকস্মিক চিৎকারে পরশও কেঁপে ওঠে। আম্মু তুমি? কী হয়েছে?
দাঁড়াস না বাপ। বসে থাক। দাঁড়াস না।
কিছ্ইু বোঝে না পরশ। না বুঝেই মায়ের নির্দেশ মতো বসে থাকে। আর এদিকে সবাই এক সাথে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে। এদের মধ্যে হামজা ছেলেটি বেশ সাহসী। সে পাশের গাছ থেকে একটি ডাল ভেঙে নিলো। ডালটির গোড়া সামনের দিকে ধরে সাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইত্যবসরে সোনালু গাছের ডাল বেয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো সাপটি।
এতক্ষণে যেনো বুকে শ্বাস ফিরে এলো রুমার। পরশকে জড়িয়ে ধরে আদর করলো। বললো তুই কেন একা এই জঙ্গলে পাতার বাঁশি বাজাতে এলি। মুচকি মুচকি হাসে পরশ। মায়ের কথার কোনো জবাব দেয় না সে। সেই ঘটনা থেকে পাড়ায় রটে গেলো পরশের পাতার বাঁশি শুনতে সাপও ছুটে আসে। পথে বের হলে দোকানে রাস্তায় মানুষজন কানাকানি করে। আঙুল তুলে দেখিয়ে আজগুবি খবরটা বলে পাতার বাঁশিওয়ালা যায়। চোখ বড় করে দেখে কেউ কেউ। কেউ আবার বলে কী ভয়ানক ঘটনারে বাবা। সাপ আসে তার সুরে।
মোবাইল চেপে ঘরে দেখে রুমা। সাড়ে ১২টা বাজে। কী ব্যাপার পরশের আব্বু এখনো এলো না। ১২টা পার হলে মোবাইলে খবর নেয় রুমা। অবশ্য মাঝে মাঝে ১টাও বেজে যায়। ব্যবসার কাজে দেরি হলে কী করার থাকে। মোবাইল করতে মন চাইছে না। মোবাইলটা হাতে নিয়েও এক পাশে সরিয়ে রাখে সে। শোয়া থেকে উঠে বসে। তার মন খুব খারাপ হয়ে আছে পরশের জন্য। ছেলেটাকে এমন করে মারলো সে। খাট থেকে নেমে আসে রুমা। এক নজরে দেখে যাবে পরশকে । গুটি পায়ে এগিয়ে যায় পরশের রুমের দিকে। রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রুমা। দরজা বেজানো। তার স্পষ্ট মনে আছে দরজা খোলা ছিলো। তাহলে পরশ উঠে দরজা চাপিয়ে দিয়েছে। একদম দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রুমা। পরশ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে। চারিদিক নীরব শহরতলির এ বাড়িটি পরশের আব্বু জমি কিনে বানিয়েছে। একতলা বাড়ির পাঁচটি কক্ষ। গেস্টরুমটি প্রায়ই বন্ধ থাকে। একই ড্রইং। একটি ডাইনিং। অন্যটিতে মা পরশের আব্বু আর মৌরি থাকে। এ রুমটি পরশই বেছে নিয়েছে।
দরজা আবজানো থাকলেও সামান্য ফাঁকা দিয়ে একরকম ডিম লাইটের মতো আলো বেরিয়ে আসছে। অবাক হয় রুমা। পরশের রুমের ডিম লাইটতো নষ্ট। ক’দিন আগেই নষ্ট হয়েছে বাল্বটি। পরশের আব্বুকে এখনো বলা হয়নি। বললেই আর দেরি নয়। ছেলের প্রয়োজন তার কাছে সব থেকে বড়। কিন্তু মনে ছিলো না বলে বলা হয়নি। তবে পরশ তাকে না জানিয়ে ডিম লাইটও কিনলো? কিন্তু বাল্বটি লাগবে কী করে। খাটের ওপর চেয়ার রেখেও বাল্বটি পরশের পক্ষে লাগানো সম্ভব নয়। তবে? তার মাথায় কিছু ধরে না। দরজা খুব সাবধানে একটু ঠেলে ভেতরে চোখ রাখে রুমা। ভেতরে চোখ যেতেই তার চোখ ছানাবড়া। একি কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে আছে তার আদরের দুলাল। বিশ্রি সেই সব ছবি ভাসছে কম্পিউটারের পর্দায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারে না রুমা। সারা শরীরে তার ঝিম ধরে যায়। পা দু’টি যেন মেজের সাথে আটকে গেছে। নড়াচড়া করার শক্তিও বুঝি নেই। সেকি এখন ভেতরে ঢুকবে? নাকি তার রুমে ফিরে আসবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বুকের ভেতরটা যেনো ভেঙে যাচ্ছে তার। কত আশা কত স্বপ্ন এই ছেলেকে নিয়ে ছেলে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। কবি কিংবা শিল্পী হবে। তার সম্মান বৃদ্ধি পাবে। রুমা এমএ পাস। অথচ কোথাও কোনো চাকরি নেয়নি। নেয়নি তার এই দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য। তার সেই স্বপ্ন যেনো ভেঙে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
এ সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। ঠিক সেই সাথে আলো নিভে যায় পরশের রুমের। ড্রইং রুমের লাইট জ্বালায় রুমা। দরজা খুলে দাঁড়ায় পরশের আব্বুর মুখোমুখি। ওমা একি? ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে রুমা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে পরশের আব্বুর পিএস।
তুমি? বিস্ময় ঝরে পড়ে রুমার কণ্ঠে। তোমার স্যার।
জি ম্যাডাম। স্যার রাতের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম গেছেন আপনার মোবাইলে রিং করেছে বারবার। কোনো উত্তর না পেয়ে আমাকে ফোন করলেন। আমি যেনো খবরটা আপনাকে জানাই। আমি আসি। আসল্লামু আলাইকুম। দরজাটা লাগিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলেন রুমা। মনে মনে বেশ রেগে যায়। পরশের আব্বুর ওপর। তাকে না জানিয়ে এভাবে চলে গেলো। মোবাইলটা তো সে পাশেই রেখেছে। কই মোবাইলেতো কোন কল বাজেনি। ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো। লাইট বাটমে চাপ দিতেই দেখে বেশ কয়টি মিসডকল জেগে আছে। সবকটি পরশের আব্বুর। অবাক হয় রুমা। ঘটনা কী? বটম চেপে বোঝে কিভাবে যেনো সাইলেন্ট হয়ে আছে মোবাইলটি।
ঘড়ির দিকে তাকায় রাত ১টা। এত রাতে আর ফোন করবে না পরশের আব্বুকে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো রুমা। কখন ঘুম এসে গেছে আর দিশা পায়নি। দুপুরেই ফিরেছে পরশের আব্বু। তার মন খুবই ভালো। ব্যবসায়ে নতুন অগ্রগতি হয়েছে। রুমার জন্য বেশ দামি একটি শাড়ি এনেছে। মৌরির জন্য বেশ কিছু খেলনা এবং এক সেট জামা কাপড়। আর পরশের জন্য একটি মোবাইল সেট। পরশের জন্য মোবাইল সেট! চমকে উঠে রুমা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় কিছুতেই এই ছেলের হাতে কিছুতেই মোবাইল তুলে দেয়া যাবে না। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না।
রুমার মন খারাপ এ কথা বুঝতে পেরেছে পরশের আব্বু। কিন্তু কেন খারাপ বিষয়টি তার মাথায় ঢুকছে না। কথায় কথায় একবার জিজ্ঞেস করলো সে। আবার পরশকেও মন মরা মনে হচ্ছে। বিষয়টা কী?
দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলো রুমা তোমার মন বেশ খারাপ! কোনো সমস্যা?
রুমা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলো সব কথা পরশের আব্বুকে বলবে। এবং এখনই। একে একে সব খুলে বললো। শুনে পরশের আব্বুও খানিকটা ভাবনায় পড়লো। একটুক্ষণ। তারপর বললো ঠিক আছে বিষয়টি আমি দেখছি।
বিকেল বেলা পরশ ও মৌরি কত রঙের প্রশ্ন হাজির করে তার যেনো শেষ নেই। কিন্তু পরশ কোনো কথাই বলছে না। চুপচাপ নিজের ভেতর নিজেই যেনো ডুবে আছে। পরশের আব্বুই কথা বললো পরশ আমার এবার কোন দিকে যাবো?
পরশ আব্বুর কথা কানে যেতে একবার দেখে নিলো তার আব্বুকে, না। তার আব্বুর চেহারায় চোখে কথায় কোনো রকম রাগ নেই। শাসনের চিহ্ন নেই। বরং বেশ আন্তরিকতার গন্ধ তাকে স্পর্শ করে। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে পরশ। মাথা চুলকিয়ে বললো- আব্বু চলো বনের দিকেই যাই?
সাথে সাথেই তার আব্বু বললো হ্যাঁ তাই চলো।
তারা তিনজন যাচ্ছে বনের দিকে। এতক্ষণ পরশ ছিলো পেছনে। এবার সামনে সামনে চললো। খেলার মাঠের ছেলেরা একরকম চিৎকার করে বলছে ঐ দেখো মাঠের ছেলেরা একরকম চিৎকার করে বলছে ঐ দেখো পাতার বাঁশিওয়ালা যায়। কেউ বলছে সাপের সুরওয়ালা যায়। আবার কেউ বলছে নতুন হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা অবাক হন পরশের আব্বু। তার ছেলেকে ঘিরে এত কথা। পাতার বাঁশির প্রভাব এতটা।
পরশ আগে আগে ছুটে গেলো সেই হিজল গাছের গোড়ায়। তার আব্বুকে বললো আব্বু আমি একটু বাঁশি বাজাই।
হ্যাঁ বাজাও।
একে একে পাতা ছিঁড়ে সে। কোন পাতার বাঁশি আজ বাজাবে? সেই যে সাপের ভয়ে তার আম্মু তাকে আর বাঁশি বাজাতে দেয়নি। একদম নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। সেদিন হিজল পাতা দিয়েই বাজিয়েছিলো। আজ? আজো কি হিজল পাতা বাজাবে? নাকি সোনালু পাতা?
ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়লো সোনালু ডালের সাপটির কথা। যে ডালটি বেয়ে সাপটি এসেছিলো হিজল গাছটির দিকে। ডালে উঁকি দেয় পরশ। তার চোখ সাপটিকে খুঁজছে। কিন্তু সেই ডালে সাপ নেই। মনে মনে ঠিক করে সে সোনালু পাতা দিয়েই বাঁশি বাজাবে। একটি নরম সুন্দর পাতা বেছে নিলো পরশ। হৃদয় ঢেলে বাজিয়ে চললো পাতার বাঁশি।
সুর শুনে অবাক হন পরশের আব্বু। তার ছেলের কণ্ঠ থেকে এ কেমন সুর ছড়িয়ে পড়ছে বনে। কেমন যেন করুণ কান্না মিশিয়ে সুরটা বাতাসে বেজে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সব গাছগাছালি চুপটি করে পরশের সুর শুনছে। মৌরি না বুঝে কিছুটা অবাক হয়, তার জিজ্ঞাসা কিভাবে ভাইয়া পাতা দিয়ে এমন সুর তোলে?
পাতার বাঁশির সুর ছড়িয়ে পড়েছে বনে। পাতায় পাতায় বেজে যায়। তার সুর বন ছাড়িয়ে পাশের মাঠেও ছড়িয়ে পড়েছে। একটুক্ষণ পর পরশের আব্বু দেখলো মাঠের সব ছেলেরা এসে জড়ো হয়েছে পরশকে ঘিরে। মুখে কারো কথা নেই। চুপচাপ। কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ বসে। সবার চোখে কৌতূহল কিভাবে পরশ পাতার বাশি বাঁজায়। পরশ চোখ বন্ধ করে বাঁশি বাজিইে চললো। তন্ময় হয়ে শুনছে সবাই। বন্ধ করো পাতার বাঁশি নির্দেশটি শুনে সবাই তাকালো পরশের পেছনে দাঁড়ানো একটি মহিলার দিকে। তিনিই কড়া নির্দেশটি জারি করলেন।
কিন্তু পরশ থামে না।
এই বন্ধ করো বলছি- আরো খানিকটা চেঁচিয়ে বললো মহিলাটি। সবাই অবাক। কিন্তু কেউ মুখ খোলার সাহস করে না। কখন যে পরশের আম্মু এসে উপস্থিত হলো কেউ টেরই পেলো না।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন পরশের আব্বু। বললেন- রুমা ওকে বাঁশি বাজাতে দাও। ও মন খুলে আজ বাঁশি বাজাবে। ও কম্পিউটারও চালাবে। মোবাইল ব্যবহার করবে এবং পড়ালেখাতেও শ্রেষ্ঠ হবে।
রুমা অবাক হলেন পরশের আব্বুর কথায়। কিন্তু… না আর কোনো কিছু নয়। আমাদের পরশ অনকে বড় মানুষ হবে। তুমি আর ওকে পাতার বাঁশি বাজাতে নিষেধ করো না। এতক্ষণ যত কথা হলো পরশ যেনো কিছুই শোনেনি। সে একটানা সুর বাজিয়ে যাচ্ছে। পরশের আব্বুর কথার জবাবে তার আম্মু খানিকটা ভেজা কণ্ঠে বললো- ঠিক আছে। আমি আর ওকে নিষেধ করবো না। না শব্দটি কানে যেতেই তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো পরশ। এক পা এগিয়েই মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের ডান হাতটা তার দু’হাতে ধরে বললো- আম্মু আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, লেখাপড়ায় আমিও কখনো আর ফাঁকি দেবো না। তুমি দোয়া করো আম্মু। দোয়া কর। আমি অনেক বড় মানুষ যেন হতে পারি। আবেগে কেঁদে ফেললো রুমা। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বললো বাবা তুই আমার স্বপ্নে ধন। তুই বড় হবি এটাইতো আমার একমাত্র আশা। আজ চল। তোর প্রিয় খাবার ফালুদা বানাবো। আনন্দে সব ছেলে হই চই করে উঠলো। দুষ্টু হামজা শ্লোগান তুললো পাতার বাঁশিওয়ালা জিন্দাবাদ।
মৌরিকে বামহাতে ধরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন পরশের আব্বু।

Share.

মন্তব্য করুন