টুসি একটা মেয়ের নাম। খুব ছোট। বয়সের চেয়ে যেন আরো ছোট। বাড়ির সবাই ওকে বলে, ছোট রাজকুমারী। শুনে টুসি মুখ টিপে হাসে।
ওর কাজ বাড়ির চারদিকে কেবলই ঘুরঘুর করা। ঘরের কোণে বসে থাকতে ওর মোটেও ভালো লাগে না। ঘুম-খাওয়ার বাইরে মা আর আপুর চোখ এড়িয়ে ও কেবল বাইরে ঘুরে বেড়ায়। তাই বলে সে দূরে কোথাও যায় না কিন্তু। ওর ঘোরাঘুরি কেবলই বাড়ির আশপাশে।
টুসি রোজ তার চারপাশে অনেককেই উড়তে দেখে। এই যেমন রঙবেরঙের পাখি। প্রজাপতি। মৌমাছি। ফড়িঙ। বাড়ির কাঠের খোপ-খোপ ঘরে থাকা কবুতরগুলোও উড়ে বেড়ায়। এসব দেখে ওর মন ভরে যায়। দেখতে দেখতে টুসিরও যে উড়তে ইচ্ছে করে!
ওর এই ইচ্ছের কথা সেদিন তাই মাকে বলেই ফেলল। মা তাকে পাত্তাই দিল না। হেসেই উড়িয়ে দিল।
বলল ওর বড় আপুকেও। সে শুনতে চাইল না। না শোনার ভান করল। তবুও টুসির বকবকানি। ওর বকবকানি থামাতে আপু বলল, ছোট বয়সে কত কিছু করতে ইচ্ছে করে! আমারও করত। কিন্তু পারিনি কিছু করতে। আপু আরো বলল, মানুষ তো উড়তে পারে না খুকুপাখি।
আপুটা ওকে মাঝে-মাঝে খুকুপাখি বলে ডাকে। শুনতে ভালোই লাগে আপুর মুখে ‘খুকুপাখি’। টুসি একদিন আপুনির কাছে জানতে চেয়েছিল, সে কেন তাকে খুকুপাখি ডাকে? আপু বলেছিল, কেন গো! এই যে তুমি আমাদের চারপাশে ছোট্ট পাখিটির মতো ঘুরঘুর করো। উড়ে উড়ে বেড়াও। পাখিরা যেমন এক জায়গায় থাকে না, তুমিও তো এক জায়গায় থাকতে চাও না, তাই।
আপুর কথা- মানুষ যদি উড়তে পারত, তাহলে আমিও তো উড়তাম। মা-বাবাও উড়ত। কই উড়েছি কখনো? উড়তে দেখেছ কখনো? আসলেও তো তাই। তারা কেউ তো ওড়েনি। উড়তে দেখেওনি কখনো। আর উড়তে হলে তো পাখির মতো দুটো ডানা থাকা চাই। মানুষের তো কোনো ডানা নেই। উড়বে কেমন করে? টুসি ভাবে, আহারে, যদি ওর দুটো ডানা থাকত! এই নিয়ে টুসি কেবল ভাবতেই থাকে। ভাবতে ভাবতে ভাবতে…
একদিন। বিকেল। টুসি বাড়ির উঠোনে খেলছিল। হঠাৎ মনে হলো টুসিকে কে যেন ছোঁ মেরে তুলে নিল। সে শূন্যে ভাসছে! নিজেকে কেমন যেন হালকা মনে হলো। তার পাশে কাউকে সে দেখতে পেল না। তবে সে উড়ছে এটাই বিষয়। ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠল। কিন্তু এটা সম্ভব হচ্ছে কিভাবে? সে ভেবে পেল না। একমনে কিছু সময় ভাবল সে। ভেবেও পেল না তেমন কিছু। ওড়ার মতো দুটো ডানাও পেয়েছে সে।
যাই হোক, সে ভেবে ভেবে সময় যেতে দিতে চায় না। উড়তে পারার এই আনন্দ তাকে অনুভব করতে হবে। খুশির পাখায় হাওয়া লাগাতে হবে। না হলে এই আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। উড়তে উড়তে টুসি একেবারে মেঘের কাছে চলে গেল। ‘মানুষ টুসি’কে দেখে মেঘেরাও কেমন যেন ‘মানুষ মানুষ’ হয়ে গেল। যেন একেকটা মানুষের মুখ!
টুসি এর আগেও দেখেছে, আকাশে যখন মেঘ ভাসে। ওই সময় আকাশের দিকে তাকালে মেঘেদের কারো বা মানুষ, কারো বাঁহাতি, কারো বা বড় বটগাছ মনে হয়। এখনো তাই-ই মনে হচ্ছে। মেঘেরা ভাসতে ভাসতে টুসির কাছে চলে এলো। চারপাশ থেকে ওকে ঘিরে ধরল। দুলে দুলে নাচতে লাগল। ওদের মাঝে টুসিও যেন এক টুকরো মেঘ। আহা! কী যে ভালো লাগছে ওর! এই সময় তাকে আপু যদি দেখত, মা যদি দেখত। তাহলে টুসির আরো ভালো লাগত।
এই ভাবতে ভাবতে টুসি একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। এক মেঘমানুষ বলল, কী গো মেয়ে, অমন মনমরা কেন? মেঘের দেশে এলে আনন্দে থাকতে হয়। খুশির দোলায় ভাসতে হয়। এক মেঘপাখি বলল, মন খুলে আলাপ করতে হয়। গলা ছেড়ে গান গাইতে হয়। হাত-পা নেড়ে নেচে বেড়াতে হয়, বুঝেছ মেয়ে? এক মেঘগাছ বলল, এই যে দেখো না, আমরা কেমন নেচে নেচে আনন্দ করছি। আজ তোমাকে ঘিরেই আমাদের আনন্দ। তোমাকে নিয়ে আজ আমরা খুব মজা করব টুসিপাখি। এই যা! মেঘেরা ওর আবার নতুন নাম দিল। ‘টুসিপাখি’!
দুধসাদা মেঘরানি বলল, তোমার না খুব উড়তে ইচ্ছে করত? টুসি বলল, হ্যাঁ, খুব ইচ্ছে করত। ‘হুম, সে কথা জেনেই তো তোমাকে মেঘের দেশে নিয়ে এলাম। খুশি হওনি তুমি?’ টুসি মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এই জন্য তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। দুধসাদা মেঘরানি বলল, তোমার সঙ্গে আমরাও খুশি তোমাকে আনন্দ দিতে পেরে। আর কোনো কথা নয়। এসো আমরা এখন আনন্দ করি। খুশিতে ভেসে বেড়াই মেঘরাজ্যের কিনারে কিনারে।
কথা না বাড়িয়ে টুসিও ভেসে চলল ওদের সঙ্গে। ও ভাবছে, মেঘের দেশের সবকিছু দেখে এই মজার দেশের কথা আপুনি আর আম্মুকে বলে অবাক করে দিতে হবে।

Share.

মন্তব্য করুন