ছাট্ট একটি ডুমুর গাছের দুটো পাতার ফাঁকে নিপুণভাবে নীড় তৈরি করল ছোট্ট আকৃতির টুনটুনি পাখি। পাখিটি টুনটুন শব্দ করে ডাকে। তার তৈরি করা ছোট্ট সুন্দর নীড়ে সে তার সঙ্গীকে নিয়ে বাস করে। দিনের বেলায় দু’জন চলে যায় খাদ্যের খোঁজে আর মিষ্টি মধুর কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের রাতের পরিসমাপ্তি ঘটে। দীর্ঘ দিনের প্রেমের ফসল হিসেবে তাদের ছোট্ট সংসারে এক অতিথির আগমন ঘটেছে। এখন থেকে তাদের সংসারে আরেকটি মুখের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের ভালোবাসার ফসল ছোট্ট ছানাটির কপাল এতই মন্দ যে, জন্মের পর তার দুটো চোখ জন্মদাতা বাবাকে দেখেনি। তার জন্মের দিন তার বাবা দুষ্ট ছেলেদের ফাঁদে বন্দি হয়। সেদিন থেকে সে তার বাবাকে দেখেনি। বাবার আদর সোহাগও তার কপালে জোটেনি। কারণ সেদিনের পর থেকে তার বাবা আর নীড়ে ফেরেনি। কতবার যে সে তার বাবার জন্য চোখের পানিতে বুক ভিজিয়েছে তার হিসাব নেই। মাকে বারবার জিজ্ঞাসা করার পরও মায়ের মুখে বাবার আসার খবর শুনতে পায় না। যতবার মাকে জিজ্ঞাসা করেছে ততবারই মায়ের চোখে সে পানি দেখতে পেয়েছে। ছানাটার যখন মাত্র ১৫-১৬ দিন তখন তাদের জীবনে নেমে আসে ভয়ঙ্কর বিপদ।
সেদিন ছিল শুক্রবার। ছানাটাকে নীড়ে রেখে মা পাখিটি তার ছানার জন্য খাদ্যের খোঁজে বাহিরে বের হলো। এক গাছ থেকে অন্য গাছ এভাবে সারাদিন কত কষ্ট করে রাতের বেলায় দু-একটা পোকা ধরে সুদূর থেকে উড়ে নিয়ে এলো প্রিয় ছানাটির জন্য। তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সেই সন্ধ্যাতেই প্রচণ্ডভাবে ঝড় তুফান হয়েছিল। যে ডুমুর গাছে তার নীড়টা ছিল এখন তো সে ঐগাছে তার নীড়টা দেখতে পেল না। এবার নীড়ের কথা ভুলে গিয়ে নিচে চারপাশে শুধু তার ছানাটাকে খোঁজা আরম্ভ করল।
ভালোভাবে এদিক ওদিকে খোঁজ করার পর দেখে তার ছানাটা আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছে। এটা দেখে মা পাখিটির অবস্থা আরো করুণ হতে লাগল। ছানাটাকে বাঁচাতে সে ফুড়ুত করে উড়াল দিয়ে মাটির উপরে বসে গেল। ছানাটাকে পা দিয়ে আঁকড়িয়ে ধরে আবার ফুড়ুত করে উড়াল দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেল। মা তার ছানাটাকে সুস্থ করার জন্য অনেক পরিশ্রম করল। ঐ রাতে মা তার ছানাটাকে নিরাপদে আশ্রয় দেয়ার জন্য আরেকটা গাছে অনেক পরিশ্রমের ফলে আরেকটি সুন্দর নীড় বানালো। ছানাটার ভীষণ সর্দি লেগেছে। মা তার ছানাটার সুস্থতার জন্য দিনের পর দিন অনেক কষ্ট করেছিল। তার খাবারের জন্য দিনে রাতে বাহিরে যেতে হয়েছিল। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে মা পাখিটি তার ছানার জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনতো।
একদিন মা পাখিটি খাবার আনতে অনেক দূরে গিয়েছিল। প্রায় শেষ বিকেলের দিকে মা পাখিটি তার ছানার জন্য খাবার নিয়ে উড়ে উড়ে আসছিল।
পথিমধ্যে কিছু দুষ্ট বালক ইটের কণা মেরে তার একটা পা ভেঙে দিল। মা পাখিটি হঠাৎ করে একটা গাছের ডালে পড়ে গেল। একটা দুষ্ট বালক তাকে ধরার জন্য গাছ বেয়ে উঠতে লাগল। উপায় না দেখে মা পাখিটি ভাঙা পা নিয়ে কোনোভাবে উড়াল দিয়ে তার নীড়ে চলে গেল। মা পাখিটি তার দুঃখ তার ছানাটাকে বুঝতে দিল না। ছানাটাকে খাবার খাইয়ে বলল তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। ছানাটা তার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে মাকে জিজ্ঞাসা করলো, মা তোমার কী হয়েছে?
মা পাখিটি বলল, নারে আমার কিছু হয়নি। তুই ঘুমিয়ে পড়। মা সারারাত পায়ের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারেনি। পা ফুলে গেল। পরের দিন সকালে ছানাটার খাবার সংগ্রহ করতে ভাঙা পা আর অসুস্থ শরীর নিয়ে উড়ে গেল পাশের জঙ্গলে। সারাদিন কষ্ট করে ছানাটার জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনল। নিজে না খেয়ে ছানাটাকে খেতে দিল। ছানার প্রতি মায়ের ভালোবাসা কোনোভাবে কমতি ছিল না। মা পাখিটার মনের কথা হলো আমার কষ্ট হোক তবুও আমার ছোট্ট ছানাটার যাতে কোনো কষ্ট না হয়। ছানার প্রতি মা পাখিটির ভালোবাসা ছিল অবর্ণনীয় ও অতুলনীয়। তাদের সংসার এভাবেই চলতে লাগল।

Share.

মন্তব্য করুন