বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি ভাল আছো। আর পড়াশুনা ঠিকঠাক মত চলছে। আজকে তোমাদের সাথে সেরকম একটি চলচ্চিত্রের পরিচয় করিয়ে দেব, যেখানে প্রিয় মানুষের নিবিড় সহযোগিতা ও ভালবাসায় Dyslexia রোগকেও হার মানিয়ে হয়ে ওঠে এক নতুন মেধাবী মুখ। যে কিনা তার প্রতিভা দিয়ে প্রিয় শিক্ষককেও হার মানিয়ে দেয়। তাহলে চলো শুরু করি।
২০০৭ সালের ২১ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত একটি হিন্দি চলচ্চিত্র তারে জমিন পার। চলচ্চিত্রের শিরোনাম সরাসরি হিন্দি থেকে তারার উপরত তারা থেকে অনুবাদ করে। আমির খানের প্রথম পরিচালিত সিনেমা এটি। ‘তারে জমিন পার’ পুরোপুরি শিশুদের ছবি। অন্ততঃ প্রযোজক, পরিচালক শিশুদের কথা মাথায় রেখেই ছবিটি বানিয়েছেন। শিশুদের সেই রঙিন জগৎ- যেখানে মাছ, প্রাণী, ফুল, পাখি আর আনন্দ কোলাহলে ভরা। যেখানে সকল বস্তুই নেচে-গেয়ে আনন্দে মত্ত থাকে। শিশুদের স্বপড়বময় এই জগৎটিই স্বার্থকভাবে চিত্রায়িত করেছেন পরিচালক আমির খান। প্রযোজকের খাতায় নামটি আগেই লিখিয়েছিলেন তিনি। এবার সফল পরিচালকের খাতায় নাম লেখালেন তারে জমিন পার-এর মাধ্যমে।
ছবির গল্পটা কিছুটা অন্যরকম। এমন একটি মানসিক সমস্যাকে পরিচালক তার মুভির মাধ্যমে তুলে এনেছেন যা সকল বাবা-মাকেই নতুন করে ভাবতে শেখাবে। মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্র ইশান নন্দী কিশোর আওয়াস্তি আট-নয় বছর বয়সি দুরন্ত বালক। আকর্ষণীয় এই বালকটি Dyslexia নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত। বানান ভুল করা আর পড়াশুনায় গোলমাল এ রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। ইশান ক্লাসে কিছুই পারে না, পরীক্ষাতেও তার নম্বর সবার শেষে। অথচ তার বড় ভাই ইয়োহান সবদিক থেকেই শীর্ষে। পড়াশুনায় তো বটেই, খেলাধুলাতেও সে খুব ভালো। ইশানের দুরন্তপনা আর অ্যাকাডেমিক রিপোর্টে চরম ব্যর্থতাকে ডিসিপ্লিনের আওতায় আনতে পাঠিয়ে দেয়া হয় বোর্ডিং স্কুলে। সেখানেও অবস্থা তথৈবচ। প্রিয় মা আর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইশান পাল্টে যায়। ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ ছেলেটি হয়ে যায়। হঠাৎ করেই একরাশ শীতল হাওয়ার মত স্কুলে আসলেন নতুন পার্টটাইম ড্রয়িং শিক্ষক নিকুম্ভ স্যার (আমির খান), যিনি নিজেও ইশানের মত এক দুঃসহ শৈশব কাটিয়েছেন ডিসলেক্সিয়া রোগের রোগী হয়ে। মুহুর্তেই পাল্টে যায় সবকিছূ। সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে পাঠদানের মাধ্যমে নিকুম্ভ স্যার সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু ইশানই একমাত্র ব্যতিক্রম। তার এই চুপচাপ  মনমরা ভাব নিকুম্ভ স্যারের মনযোগ কেড়ে নেয়। আস্তে আস্তে সব কিছু জেনে নেন তিনি। যোগাযোগ করেন ইশানের বাবা-মার সাথে। চেষ্টা করেন ছেলের সমস্যাটি বোঝাতে, কিন্তু ব্যর্থ হন। বিশেষ করে ইশানের বাবা কিছুতেই বুঝতে চাইলো না যে, তার ছেলে রোগে আক্রান্ত। কিন্তু তিনি মনে করেন যে তার ছেলে ইচ্ছা করে পড়াশুনা করে না, লিখতে চেষ্টা করে না। পরে নিকম স্যার তার সামনে থাকা একটি চায়না খেলনা গাড়ী ঠিকানা পড়তে বলেন তাকে। তিন পড়তে পারেন না। কিন্তু নিকম স্যার বলেন- আপনি শয়তানি করছেন, ইচ্ছা করে বলছেন না। তখন ছেলেটির বাবা বুঝতে পারেন যে, তার ছেলে আসলেই রোগে আক্রান্ত।
ইশানের বাসায় গিয়ে নিকম স্যার আরোও জানতে পারেন যে, ছেলেটি অসাধারন পেইন্টিংও করতে পারে। তার আঁকা ছবি দেখে নিকম স্যার অবাক হয়ে যান এবং বুঝতে পারেন যে, ছেলেটি অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। তার শুধু দরকার সহযোগিতা ও নিবিড় ভালবাসা। স্যার ইশানের পেইন্টিংগুলো সাথে করে এনে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, এই ছেলে অসাধারন প্রতিভার অধিকারী কিন্তু সে Dyslexia নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত তাই সে পড়ালেখায় দূর্বল।
কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার মানতে চান না যে, ছেলের আদৌ কোনো প্রতিভা আছে। কারণ সকল বিষয়ের শিক্ষকগণ খারাপ রেজাল্ট দেখায়। নিকম স্যার নিজেই তাকে শেখানোর দায়িত্ব নেন এবং প্রিন্সিপাল স্যারকে অনুরোধ করেন সকলের অংশগ্রহণে একটি ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে। অবশেষে প্রিন্সিপালের অনুমতিক্রমে ইশানকে ব্যক্তিগতভাবে এবং তার ছবি আকাঁর অসাধারণ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তাকে সারিয়ে তোলেন। ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় ইশান চ্যাম্পিয়ন হয়, নিকুম্ভ স্যার হন রানার আপ। বাকি গল্প সহজেই অনুমেয়; ইশানই হয় ক্লাসের সেরা ছাত্র।
মুভি শুরু হওয়ার আধাঘন্টা বাদেই দর্শক হয়তো আঁচ করতে পারবেন শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে। কিন্তু তারপরেও ছবির সামনে থেকে উঠতে মন চাইবে না। শুরুর দৃশ্যে ইশানের ড্রেন থেকে মাছ ধরে বোতলে করে বাড়ি নিয়ে আসা কিংবা রাস্তা থেকে চকচকে বস্তুটি তুলে নিয়ে পকেটে ভরার দৃশ্য মার্ক টোয়েনের সৃষ্টি হাকলবেরি ফিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু একটু পরেই বোঝা যায়, মুভির গল্প এগোচ্ছে নিজ গতিতে। শিশুদের জন্য বলেই হয়তো জায়গামত এবং অত্যন্ত পরিমিতভাবে অ্যানিমেশন ব্যবহার করেছেন পরিচালক। ছবির আরেক প্রধান চরিত্র নিকুম্ভ স্যাররূপী আমির খান পর্দায় প্রবেশ করেছেন মুভি শুরুর প্রায় একঘন্টা পরে যা ভিন্নতায় আমেজ বহন করে। চমৎকার লোকেশন, শ্রুতিমধুর গান, আর প্রত্যেক চরিত্রের বাস্তব অভিনয় ছবিটিকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছুতে সাহায্য করেছে। সিনেমাতে সকলেই মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন। তবে যার কথা বিশেষভাবে বলতে হয় তিনিত ইশান অর্থাৎ দার্শিল সাফারি। জীবনের প্রথম ছবিতেই তিনি বাজিমাত করেছেন। শিখন প্রতিবন্ধী শিশুর চরিত্রে তার অভিনয় বিশেষত মুখের যে অভিব্যক্তি তিনি দিয়েছেন তা অসাধারণ। আমির খান স্বভাবসুলভ ভাবেই ভালো অভিনয় করেছেন।
সব মিলিয়ে বলতে হয়, তারে জমিন পার একটি অসাধারণ ভালো ছবি। পরিচালক আমির খান এ ধরনের ভিন্ন কাহিনীচিত্র নির্মাণ করে সকলের প্রশংসা কুড়ানোর যোগ্য কাজটিই করেছেন। পুরো ছবিটিই যেন তার ট্যাগলাইন এভরি চাইল্ড ইজ স্পেশালকেই প্রতিফলিত করেছে। সুতরাং প্রত্যেকের জন্যই আলাদা ট্রিটমেন্ট, আলাদা যত্ন প্রয়োজন।

Share.

মন্তব্য করুন