শব্দহীন ফাঁকা এক মাঠ। নীরব এবং নিথর হয়ে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে দূরদিগন্ত থেকে দু’চারটা শব্দ বাতাসের ঢেউ ভেঙে ছুটে আসছে। খানিক বাদে তা আবার অন্য দিকে যাচ্ছে। চাঁদটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কোথাও কোথাও কুপি বাতির আলো হঠাৎ দেখা যায় আবার নিমিষেই নাই। ভূমিহীনপাড়া নামে একটা ছোট্ট এলাকা চা বাগানটার শেষ মাথায়। পাঁচ থেকে ছয়টা বাড়ি হবে সেখানে। এ ছাড়া তিন দিকের বিশাল ফাঁকা এ মাঠটি করতোয়ার চর বলে পরিচিত। মাঠের পশ্চিম দিকটা গিয়ে ঠেকেছে এ নদীর পানিতে। দক্ষিণে কুরুম ও কালিদহ নদী শশ্মান ঘাটের পাশ দিয়ে করতোয়ায় এসে মিলিত হয়ে এক বিশাল মোহনার সৃষ্টি হয়েছে। সেদিকেও কোনো ঘরবাড়ি নেই। আবার পূর্বদিকে কালিদহ নদীর একপাড়ে জনমানবহীন আরেকটা মাঠ। নদীর আরো পূর্বদিকে লম্বা বাঁশঝাড়, কলাবাগান আর ফসলিজমির সেই মাঠ মিলে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা ভূতের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত। মাঠের আরো খানিকটা পূর্ব দিকে কিত্তিনিয়া পাড়া। অল্প লোকজনেরই বসবাস সেখানে। বাড়িঘর খুবই ফাঁকা ফাঁকা। গ্রামের মুষ্টিমেয় দু’একজন ছাড়া সন্ধ্যার পর পরেই ঘুমাতে যায় সবাই। সারাদিন মাঠে ঘাটে কাজ করার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে জেগে থাকা তাদের কাছে নিষ্প্রয়োজন। ছাত্ররাই খানিকটা দেরি করে ঘুমায়।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে রায়হান। রাত ৯ টা ৪৫ মিনিট। চাচাতো ভাই জামাল ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে রায়হানের আম্মুকে। কী হয়েছে বলতেই কনক আব্দুল্লাহ স্যারকে একটু ফোন দিতে বলে সে।
“কেন?” প্রশ্ন করে রায়হানের মা।
সেটা ফোন দিয়েই শুনে নেন।
ফোনের ওপার থেকে কনক আব্দুল্লাহর কণ্ঠ ভেসে আসে, “ওদেরকে করতোয়ার চরে পাঠিয়ে দেন; আমি রাতুল, রিয়াদ, আকাশ এবং লিখনকে নিয়ে এখানে আছি।
“তুমি কবে এলে? আর এত রাতে ওখানে কী?” সচকিত প্রশ্ন রায়হানের মায়ের।
আজকেই এসেছি। আপনাকে আগে জানাতে পারিনি বলে দুঃখিত। ছেলেদের নিয়ে আজ অনেক রাত পর্যন্ত গল্পস্বল্প করার নিয়তেই এখানে জড়ো হয়েছি সবাই।
“আচ্ছা ওরা যাচ্ছে; কিন্তু তুমি সময় করে বাড়িতে এসো। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। তোমার ছাত্র রায়হান; আগের মতো আর নেই। ও আমার স্বপ্নকে ধুলোয় মিশাতে বসছে।” ভারি কণ্ঠে কথাগুলো বলল রায়হানের মা।
জামাল এবং রায়হানের ছোটবেলা থেকে কিছুদিন আগ পর্যন্তও প্রাইভেট শিক্ষক ছিল এই কনক। তাই বিশ্বাসের একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার সাথে। এলাকার বাইরে থাকে বলে এখন আর পড়ায় না তাদের। তবু ওদের বাবা-মা কনকের আদর ও শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিতে চায় না ছেলে দুটিকে। সময় ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পাহারা দিয়ে আর চরিত্র ভালো রাখা সম্ভব হচ্ছে না কোথাও। একজন প্রাইভেট শিক্ষকের নৈতিক শিক্ষার ভূমিকাও বড় কাজে আসতে মানুষের জীবনে। এমন আস্থা সবার ওপর রাখা না গেলেও কনকের ওপর পুরোপুরি ছিল ওদের বাবা-মায়ের। পরের ছেলেকে আর শাসন করতে ভালো লাগে না কনক আব্দুল্লাহর। এ কথা কিন্তু বুঝতে চায় না ওরা। কারণটা মনে হয় জীবনের একটা বড় অংশজুড়ে ছাত্রদেরকে ভালো পথে আগলে রাখা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ক্লাস ফোর থেকে নামাজ আদায় ও রোজা রাখার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল প্রাইভেট শিক্ষক এই কনক আব্দুল্লাই।
সমবয়সী বন্ধুদের পেছনে যত সময় ব্যয় করেছিল ছোটদের পেছনে তার চেয়ে একটু বেশিই করেছে সে। শুধু জামাল আর রায়হানই নয় রাতুল, সুমন, রিয়াদ, সোহাগ, আকাশ, লিখন, আসাদ, রিয়াজ, হৃদয়, মমিন, খলিল, আশরাফ, নাঈমরাও তার প্রাইভেট স্টুডেন্ট ছিল। সবার বেলায়ই সমান অভ্যাস গঠন আর সুন্দর আচরণ ব্যবহার শেখানোর চেষ্টা করেছে সে। কেউ তাকে স্যার বলে ডাকুক এমনটা চায়নি কোনদিন।
সবাইকে আগের সম্বন্ধ ধরেই ডাকার উপদেশ দিয়েছিল। এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকেই ভালোবাসা হিসেবে গ্রহণ করে নেয় ছেলেগুলো। তৈরি হয় সুদৃঢ় এক বন্ধুত্বের সেতু। সে কারণে এখনো বাড়িতে এলেই তার সঙ্গী হয় একদল নবীনবন্ধু। আকাশ, রাতুল, রিয়াদ, হৃদয়, সুমনেরা তাকে ভাই বলে ডাকে। লিখন তাকে মামা বলে ডাকে।
রায়হান, জামালই একটু ব্যতিক্রম। ছোটবেলা থেকে ওরা তাকে স্যার বলেই ডাকে। এই সম্পর্ক রক্ষা করতে অবিরাম চেষ্টা সবার। সবাই মোবাইলের মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজখবর নেয় কনকের। সবসময় ওরা প্রহর গুনে তার বাড়ি আসার অপেক্ষায়। যেন একসাথে সবাই মজা করে আড্ডা দিতে পারে। এবারো ঢাকা থেকে বাড়ি আসার আগে নবীনদের নিয়ে করতোয়ার চরে বেড়াতে আসার প্ল্যান করেছিল সে। তবে প্ল্যানটা ছিল অদ্ভুত। জোছনা রাতে গল্পের আড্ডা। দীর্ঘদিন প্রকৃতির সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত ছিল বলেই এমন প্ল্যান। ভাগ্যক্রমে রাতটি ছিল পূর্ণিমার।
চা বাগানটার দক্ষিণ কোনায় ছন ঝোপের পাশে রাতুল, আকাশ, রিয়াদ ও লিখনকে নিয়ে নরম ঘাসের ওপর বসে ছিল কনক আব্দুল্লাহ। গ্রামের পাশে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর এই চরের বাতাসে নিঃশ্বাস না নিলে বাড়িতে আসাটাই অনর্থক। একদিক থেকে সোহাগ আর নাঈম এসে মিলিত হয় তাদের সাথে। অপরদিকে জামাল, রায়হান চলে আসে ঠিকমতো।
রাহিমুলকে সাথে নিয়ে এসোনি?
“না। ও ঘুমিয়ে গেছে।”
কী হয়েছে? তোমার মা এত রাগ করেছে কেন?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রায়হান। লজ্জাতে কিছুই বলতে পারছিল নাত প্রথমে। ও একটু লাজুক প্রকৃতির ছেলে।
আই ডন্ট মাইন্ড। তোমরা সবাই এখানে ছোট মানুষ। ছোটদের ভুল হবে এটিই স্বাভাবিক। এর সমাধানও তো আছে। ভুলের মাধ্যমে অনেক কিছু জানা যায়। বড় হতে হলে পৃথিবীকে জানতে হয় অনেক সুন্দর করে। নির্ভয়ে বলে ফেল কী হয়েছে।
কিছুটা সাহস নিয়ে বলতে চেষ্টা করে রায়হান“প্রশ্ গুলো আসলেই কঠিন এবং লজ্জাজনক। আপনি যেহেতু জানার জন্য উৎসাহ দিলেন সে জন্যই বলতে চাচ্ছি, যদি কিছু মনে না করেন।”
“নো টেনশন, ফ্রিলি বলে ফেল।” সবার জোরালো কণ্ঠ।
“আমাদের ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে অনেক বাজে বন্ধু আছে। যারা এই বয়সেই নানান কুকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ সিগারেট খায় এবং মেয়েদের সাথে চিঠি ও এসএমএস বিনিময় করে। ওদের দল অনেক শক্তিশালী। কারো নামে স্যারের কাছে নালিশ করলেও অবস্থা বেগতিক হওয়ার সম্ভাবনা। যদি কোনোভাবে জানতে পারে কে নালিশ দিয়েছে তার স্কুলে পড়া নিয়েই শঙ্কায় থাকতে হবে। আমি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে পারছি না আবার ওদের সাথে মিশতেও ভয় হয়। কিছুদিন আগে আমাকে এক হোটেলে নিয়ে গিয়ে সিগারেট খাওয়ার জন্য বারবার চাপ দিতে থাকে সেজান ও কামাল। শত রিকোয়েস্ট করে সেদিন ফিরে এসেছি কোনমতে। গত দুই দিন আগে একটি মেয়ে কার কাছ থেকে যেন আমার মোবাইল নাম্বার নেয়। রাতে ‘আই লাভ ইউ রায়হান’ লিখে একটি মেসেজত দেয়। মোবাইলটা ছিল আম্মুর কাছে। তিনিই প্রথম মেসেজটা অন করেছিলেন। অবহেলা করে কয়েকদিন নামাজ পড়িনি তার ওপর এই মেসেজ। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেঁদে ওঠে আম্মু। তখন থেকে আম্মুর আদরমাখা কণ্ঠ আর শুনতে পাইনি আমি। তিনি আমাকে সন্দেহ করেন অনেক বেশি। যদি আগে জানতে পারতো আপনি এসেছেন তাহলে আপনাকে আগে আমাদের বাড়িতেই যেতে হতো প্রথমে। এদিকে আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। কথাগুলো শেষ করতেই চোখের পানি টলমল করে গড়িয়ে পড়ছিল রায়হানের গাল থেকে। সবাই যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই।
ইমরান, সোহাগ আর নাঈমের কণ্ঠ দূর থেকে ভেসে এলো। রাতুলের ডাকে এগিয়ে আসে তারা। মিলিত হয় এক সাথে। সবার উদ্দেশে আবার কথা শুরু করে কনক ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। আমি তো আগেই বললাম এই বয়সে এরকম ঘটতেই পারে। শুধু এইটা কেন? আরো কত কিছু যে ঘটবে তারও ইয়ত্তা নেই।
“মানে?” উৎসুক প্রশ্ন আকাশের।
মানেটা একদম সহজ। পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষ এবং জিন জাতিকে পাঠিয়েছে শুধু তারই ইবাদত করার জন্য। মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করার আগে তিনি ফেরেস্তা সৃষ্টি করেছিলেন। ফেরেস্তাদে ইবাদত আল্লাহর কাছে তেমন ভালো লাগেনি।
“কারণটা কী?” লিখনের প্রশ্ন।
কারণ হচ্ছে ফেরেস্তাদের আবেগ ছিল না, দুর্বলতা ছিল না, খাওয়া-ঘুম প্রবৃত্তির কোনো চাহিদা ছিল না আর ছিল না শয়তানের কোন ধোঁকা দেয়ার চান্স। ফলে তো তারা ভালো কাজ করবেই। অন্য দিকে মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এইসব দুর্বলতা দিয়ে। আর তাদের পেছনে নিযুক্ত করেছেন শয়তান যেন প্রকৃত আল্লাহপ্রেমিকদের তিনি চিনতে পারেন। মানুষ আল্লাহর বিধানকে মেনে চলে এবং শয়তানের খপ্পর থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলে পরকালে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। সে পুরস্কার এতই দামি যে তার পরিধি মহাবিশ্বের দশগুণের চেয়েও অনেক বড়। আর তা এমন দামি উপকরণ দিয়ে সুসজ্জিত যে পৃথিবীর সবকিছু বিক্রয় করলেও তার একটি চেয়ারের পায়ার মূল্যের সমান হবে না। এত দামি পুরস্কারটি কি এমনি এমনি পাওয়া যাবে? এর জন্যই তিনি আমাদেরকে পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন। আল্লাহর পথ থেকে আমাদের সরিয়ে রাখতে শয়তান তার সমস্ত ষড়যন্ত্র প্রয়োগ করে। যুবক ছেলেদের খারাপ বানানোর জন্য শয়তান নেশা এবং মেয়েদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। মেয়েদেরকে আবার খারাপ বানায় ছেলেদের মাধ্যমে ও বেপর্দার মাধ্যমে।
“আচ্ছা কেউ যদি এই পুরস্কার না চায় তার কী হবে?” রিয়াদের প্রশ্ন।
আল্লাহর পুরস্কার কেউ নিতে না চাইলে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাময় জাহান্নাম।
“এমনটা কেন হবে?” এবার প্রশ্ন করে জামাল।
‘তুমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর যদি কোন বছ ফাইনাল পরীক্ষা না দাও তাহলে কী হবে?’ উল্টো প্রশ্ন করে কনক।
“উপরের ক্লাসে ওঠা যাবে না এবং নিচের ক্লাস থাকতেও অপমানজনক মনে হবে।” জবাব দেয় জামাল।
‘এভাবে একটানা পাঁচ বছর ফাইনাল পরীক্ষা না দিলে কী হবে?’ দ্বিতীয় প্রশ্ন করে কনক।
“তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হবে এবং সচেতন গার্ডিয়ান হলে তাকে কাজে লাগিয়ে দেবে।” বলল রাতুল।
‘তোমাদের যদি এমন হয় কেমন লাগতে পারে তখন?’ তৃতীয় প্রশ্ন করে কনক।
“এরকম হলে তো কিছুই ভালো লাগবে না। আর এরকম হবেই বা কেন?” জবাব দেয় রিয়াদ।
সুন্দর বলেছ রিয়াদ। আসলে পৃথিবীতে এক জায়গায় ভালো না লাগলেও অন্য জায়গায় কষ্ট করে শিক্ষা অর্জন ছাড়া এবং আত্মীয়স্বজন ছাড়া থাকা যায়। কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে জান্নাত আর জাহা্ননাম ছাড়া অন্য কোন স্থান নেই। তাই মানুষের ঠিকানা হবে এ দু’টির যেকোন একটিতে। এখন তোমরা বলো কে কে জাহান্নামে যেতে চাও?
সবাই একযোগে উত্তর দেয় যে, কেউ না।
হঠাৎ রিংটোন বাজে কনকের মোবাইলে। হৃদয়ের ফোন। রিসিভ করতেই হৃদয় বললো- আপনি আসার খবর সুমনের কাছে শুনলাম।
কোথায় আছেন এখন?
– করতোয়ার চরে। তুমি না শুনলে কি হবে রিয়াদ তো আমার এখানে চলে এসেছে। আচ্ছা তুমি এখন কোথায়?
“সুমনদের বাসায়। কিন্তু করতোয়ার চরে এত রাতে কী করছেন ভাই?”
– এখানে ভবিষ্যতের তিতুমীরদের নিয়ে গল্পগুজব করছি। পারলে তোমরাও চলে এসো।”
“আমরা এক্ষুনি যাচ্ছি।” ফোন কেটে দেয় হৃদয়।
“বর্তমান স্কুলগুলোর যে অবস্থা এইসব স্কুলে পড়লে কি জান্নাতে যাওয়া যাবে? আর রায়হানের সমস্যাটার সমাধান কী হতে পারে আমাদের বুঝিয়ে বলবেন কী?” নাঈমের অনুরোধ।
আজকাল ক্লাসের ছেলেদের কথা আসলে বলার মতো নয়। গ্রামে তো শহরের তুলনায় এখনো অনেক ভদ্র পরিবেশ আছে বলা যায়। ছাত্ররা সারা জীবন ধূমপানের বিরুদ্ধে পড়াশোনা করে। কত প্যারাগ্রাফ, রচনা মুখস্থ করে অথচ একটু বড় হয়ে নিজেই ধূমপান শুরু করে দেয়। এর জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। দুনিয়ার সকল শিক্ষাবিদই এ বিষয়ে একমত যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র গঠন। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মন, মস্তিষ্ক ও চরিত্রকে গঠন করার চেষ্টা প্রত্যেকটি সজাগ ও সচেতন জাতির প্রধান হাতিয়ার। উন্নত জাতিগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় বাইরের দিক দিয়ে অনেক সামঞ্জস্য থাকলেও তাদের সবার একই ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নেই। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থার মতো রাশিয়ায় হয় না। কারণ হলো তাদের আছে আদর্শের পার্থক্য। ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান, মূল্যবোধ, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে
ধারণা সবার এক নয়। এসবের সমন্বয়েই একটি আদর্শ গড়ে ওঠে। যে জাতির নিকট যে আদর্শ গ্রহণযোগ্য, সেই আদর্শকে সামনে রেখেই ঐ জাতির শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু কোনো আদর্শ নির্ধারণ না করলে কোন জাতিই উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। আদর্শ একটি জাতির লক্ষ্য। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের সময়ই জাতীয় আদর্শ নির্ধারণ করা দরকার। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভালো চরিত্র গঠনের জন্য তেমন কোন দিক নির্দেশনা দেয়া নেই। ৯০% মুসলমানের দেশে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শ ও কার্যকলাপ তুলে ধরা হয়নি। এ জন্য আমরা স্কুলে পড়ে সচরাচর যেমন ভদ্র হওয়ার কথা তা হচ্ছি না। একজন অন্ধ মানুষের হাতে যদি একটি আগুনের মশাল তুলে দেয়া হয় আর তাকে বলা হয় তুমি এই জনপদের লোকগুলোকে রাস্তা দেখিয়ে দিবে; তবে সে যত লোকের রাস্তা দেখাবে তার চেয়ে বেশি মানুষের বাড়িঘরে আগুন লাগাবে। কারণ তার চোখ নেই সেতো দেখতে পায় না। অনুরূপভাবে একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা না থাকার কারণে আমাদের সন্তানেরা পারিপার্শ্বিক নানারকম শিক্ষা অর্জন করে থাকলেও তারা আচার-ব্যবহারে ভদ্রতা শিখে না; নৈতিক শিক্ষার কোন বালাই তাদের মধ্যে নেই। তারা ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ততা রাখে না বলে পিতা-মাতার সাথে কেমন ব্যবহার করবে; শিক্ষকের সাথে কেমন ব্যবহার করবে; বন্ধুদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে; এসব শিখে না। এ জন্য নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে কোন ছাত্র যখন ধর্মকেই অবিশ্বাস করে তখন সে ছাত্র কেয়ামতের ভয়াবহ আজাবকে অবিশ্বাস করবে। এর ফলে সে যে জীবনধারা গ্রহণ করবে তাই সঠিক মনে করবে। সে মনে করে তার তো কোন হিসাব-নিকাশ কোনো কিছুই হবে না সে হিসাব-নিকাশ থেকে মুক্ত মনে করেই অন্যায় কাজগুলো দেদার করে যাবে। অন্যের জন্য সমাজের মানুষের জন্য পরিবারের জন্য তার যে অনেক দায়িত্ব আছে সেগুলো তার বেমালুম ভুলে যাওয়ার কথা। এভাবে সে নিজের বিবেককে জাগ্রত করতে পারে না ফলে নিজেকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন নাগরিক বলে মনে করে। আর এ জন্যই সে শয়তানের খপ্পরে পড়ে নানা রকম পাপ কাজে লিপ্ত হয়। আর মানুষ সৃষ্টি করার পর থেকেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে পরীক্ষার জন্য ইবলিস শয়তানকে পাঠিয়েছেন। ইবলিস শয়তান প্রতিনিয়ত আমাদের ধোঁকা দেয়। শয়তানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ যেন নৈতিকতার জ্ঞান অর্জন না করে। একজন মানুষ নৈতিকতার জ্ঞান অর্জন না করলেই তো তাকে দিয়ে সব ধরনের খারাপ কাজ করানো সম্ভব। এ জন্যই মহান আল্লাহ আমাদের কোরআন পাঠিয়েছেন আমরা যেন কুরআন থেকে এর উপদেশগুলো মেনে চলি; শয়তান থেকে বেঁচে থাকি এবং সৎভাবে জীবন যাপন করি।
আরেকটা কথা হচ্ছে এ জন্য কিন্তু সব খারাপ বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবে তা কিন্তু নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো পথ অনুসরণ করবো। তিনি ছোটবেলা থেকেই এমন একটি পরিবেশে বড় হয়েছেন যেখানে ভালো বন্ধুর চেয়ে খারাপ বন্ধুর সংখ্যাই ছিল বেশি। তারপরও তুলনামূলক ভালো বন্ধুদের নিয়ে মানুষদেরকে খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে ভালো কাজে উৎসাহিত করেছেন। তোমরা নামাজ পড়ার পর প্রতিদিন একজন করে খারাপ বন্ধুর জন্য যদি আল্লাহর কাছে দোয়া কর; তবে আল্লাহ খুবই খুশি হবেন। আর তোমার দোয়া ও ভালো ব্যবহারের বদলে তোমার বন্ধু সৎপথে ফিরে আসতে পারে। এই অভ্যাস তোমাকে ভালো থাকার জন্য সাহায্য করবে এবং তোমারই হেদায়াতের কারণ হবে। যুবকদের যে আল্লাহ বেশি ভালোবাসেন তার জন্য কুরআনের একটি গল্প তিনি নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা কাহাফে ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসূল!) আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করেছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎ পথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।’ আমি সময় পেলে আরেকদিন সে গল্প বলবো। অন্য দিকে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যৌবনের ইবাদত বৃদ্ধ বয়সের ইবাদতের চেয়ে অনেক বেশি দামি। আবার বৃদ্ধ বয়সের পাপ যৌবনের পাপের চেয়ে অনেক বেশি জঘন্য।’ বুখারি শরীফের আরেকটি হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাঁর (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ হলো সেসব যুবক-যুবতী; যারা তার রবের ইবাদতের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে।’ আর যারা যৌবনে ইবাদত-বন্দেগি ত্যাগ করে বিপথে জড়িয়ে গেছে, তাদের জন্যও আল্লাহ তাআলার রহমতের দরজা খোলা। তাদেরকে নিরাশ না হতে কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- ‘(হে রাসূল!) আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা যুমার : আয়াত ৫৩) এইটুকু বলার পর কনক আব্দুল্লাহ বললো, এবার আমি ভালোবাসা সমন্ধে একটু বলি?”
সোহাগ বললো, “অবশ্যই।”
ভালোবাসা এমন একটি শব্দ যা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কোনো অন্ নেই। ভালোবাসা নিয়ে বিভিন্নজনের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন প্রকার। ভালোবেসে কেউ সুখী হলে ভালোবাসাকে সুখের পরশে মেখে নেয়।
তার কাছে জীবন যেন শুধু মধুময়। আর কেউ কেউ একে জীবনের সবচেয়ে ভুল বলে অভিহিত করে। সে ভালোবেসে মনের মানুষটিকে পায়নি বলে জীবনে শুধু দুঃখই পেয়েছে। প্রকৃত কথা হচ্ছে ভালো-মন্দ মাপার জন্য এদের কাছে কোনো ক্যালকুলেটর নেই। সে কি দিয়ে মাপবে যে ঠিক করছে না বেঠিক করছে? এক্ষেত্রে অনেক পণ্ডিত নিজের বিবেককে বড় ক্যালকুলেটর বলে আখ্যায়িত করবে। তাই না?”
রায়হান বলল, “পণ্ডিতরা এরকম দাবি করে বসলেও তাদের কথা আসলে ভুল।”
ঠিক বলেছ। ভালো-মন্দ মাপার এই মানদণ্ড দিয়েছেন শুধুই আমাদের সৃষ্টিকর্তা। পবিত্র কুরআনুল কারীমে সূরা তাওবার ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ঘোষণা করেন – ‘হে নবী আপনি বলে দিন, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী (পরিবার পরিজন), তোমাদের আত্মীয় বংশ, তোমাদের উপার্জনকৃত ধনসম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যা তোমরা অচল হওয়ার আশঙ্কা কর, তোমাদের বাড়িঘর যা তোমরা (একান্তভাবে) কামনা কর, এই জিনিসগুলো যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসো তাহলে তোমরা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোন বিধান (আজাবের ঘোষণা) আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। (জেনে রেখো) ; আল্লাহ তায়ালা কখনো ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।’ কুরআনুল কারীমের এই আয়াতত পড়লে দু’টি অংশ পাওয়া যায়। প্রথম অংশে পিতা-মাতা, সন্তানাদি, স্বামী-স্ত্রী (পরিবার পরিজন), আত্মীয় বংশ, উপার্জনকৃত ধনসম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িঘর। আর দ্বিতীয় অংশে মহান আল্লাহ তায়ালা, আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর পথে জিহাদ। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে আমরাত দেখতে পাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা প্রথম ও দ্বিতীয় কোনো অংশের বিষয়কেই ভালোবাসতে নিষেধ করেননি। তার মানে সব বিষয়কে ভালোবাসতে হবে তবে একটু কম আর বেশি!
ভালোবাসার গাণিতিক হিসাবটা সম্পন্ন করে ভালোবাসার কাতারে যাওয়া প্রয়োজন। সে অনুপাতে ভালোবাসার তালিকাটা হবে: (১) মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা (২) আল্লাহর রাসূল (হজরত মুহাম্মদ সা. ও অন্যান্য নবী-রসূলগণ) (৩) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ (৪) পিতা-মাতা (৫) সন্তান-সন্ততি (৬) স্বামী-স্ত্রী (পরিবার পরিজন) (৭) আত্মীয়-স্বজন (৮) ধনসম্পদ (৯) ব্যবসা-বাণিজ্য (১০) বাড়িগাড়ি।
ভালোবাসার এই ক্যালকুলেটর কেউ অনুসরণ করলে তার তো অন্য মেয়ের পেছনে সময় ব্যয় করার চিন্তাই আসতে পারে না। আমি আশা করি তোমরা কেউ আল্লাহর অবাধ্য হবে না।” আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আল্লাহকে যারা ভালোবাসে ও ভয় করে তাদের মধ্যে ঈমানদার যুবকদের জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার।
“কী সেই পুরস্কার?” রায়হানের আবেগময়ী প্রশ্ন।
পুরস্কারটি হচ্ছে পরকালীন জীবনের। সহীহ বুখারী শরীফের ৬২৯ নং হাদিসে এবং সহীহ মুসলিম শরীফের ১০৩১ নং হাদিসে বর্ণিত আছে; সেইদিন হযরত আদম (আ:) থেকে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত সব মানুষ হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে এবং সবাইকে দুনিয়ায় যা করেছে তার হিসাব দিতে হবে। সবার মাথার ওপরে থাকবে উত্তপ্ত ঐ সূর্য। সূর্যের তাপে সে সময় মানুষের যে ভয়াবহ অবস্থা হবে তা বর্ণনা করার মতো নয়। সেই কঠিন বিপদের দিন ৭ শ্রেণীর মানুষের জন্য আল্লাহ তা’য়ালার আরশের ছায়ার ব্যবস্থা থাকবে। তারা হচ্ছেন-
১. ইমানদার ন্যায়বিচারক। ২. আলাহভীরু যুবক: যে তার যৌবনকালে আল্লাহর ইবাদত করেছে। কারণ এই বয়সে অপকর্ম ত্যাগ করা বেশ কঠিন। সব অপকর্ম ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত যুবকের জন্যই এ হাদিসে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। ৩. মসজিদের প্রতি আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনকারী ঈমানদার: মানে যার অন্তর সবসময় মসজিদের সাথে বাঁধা থাকে। অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে মসজিদে আদায় করে। ৪. আল্লাহর জন্য ভালবাসাকারী ব্যক্তিগণ: যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসেন, সৎ কাজ করেন, একত্রিত হন, আবার তাঁর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করেন অর্থাৎ দুনিয়ার কোনো স্বার্থে তারা সম্পর্ক সৃষ্টি করে না। ৫. আল্লাহর জিকিরকারী বান্দাগণ: যারা নির্জনে আল্লাহপাকের জিকিরে ও ইবাদতে মশগুল থাকেন এবং আল্লাহর ভয়ে যারা সব খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। ৬. সৎ চরিত্রের অধিকারীগণ: যাকে কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের রূপসী মেয়ে কামনা-লালসা পূরণের জন্য ভালোবাসার আহবান করে। কিন্তু এরূপ সুযোগ পেয়েও তাঁরা বলে, “আমি আল্লাহকে ভয় করি।” ৭. গোপনে দানকারীগণ।
কথাগুলো হৃদয়ে রেখাপাত করে প্রশান্তির ঢেউ তুলে দিলো তারুণ্যের সকল প্রাণে। বিস্ময় হয়ে অপলক দৃষ্টিতে সামনে চেয়ে আছে সবাই। একপাশে চায়ের বিশাল বাগান, আরেক পাশে ধুধু বালুচর, পেছনে কালিদহ আর সামনে করতোয়ার কুলুকুলু বয়ে চলা যেন প্রকৃতির উৎসব চলছে। এমন সময় হৃদয় এবং সুমন এসে সালাম দিয়ে যুক্ত হয় তাদের সাথে। এই চরে শেয়াল অথবা সাপ থেকে নিরাপত্তার জন্য ওরা হাতে করে দুটো বাঁশের লাঠি নিয়ে এসেছে। এ জন্য সবাই তাদের ধন্যবাদ জানালো।
“আজকের এ আড্ডা যেন চাঁদনী রাতের শীতল পাটির ওপর বসে রূপকথার গল্প শোনার মত বর্ণিল আয়োজন তাই না?” সুমন বললো।
অবশ্যই, তোমাদের এতজনকে একসাথে পাবো ভাবিনি। মাথা নিচু করে বসে আছে কনক। কিছুক্ষণ থেকে কথা বলছিল না সে। আকাশ ও লিখন কৌতূহলী হয়। লক্ষ্য করে দেখতে পায় চোখ থেকে পানি ঝরছে কনকের। “কী ব্যাপার আপনি কাঁদছেন কেন মামা?” প্রশ্ন কর লিখন।
খানিকটা ইতস্তত স্বর কনকের। না মানে; আমার মায়ের কথা মনে পড়লো হঠাৎ। তিনি প্রায় জোছনা রাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে উঠানে পাটি বিছিয়ে বসতেন। বলতেন পুরনো দিনের গল্প। রূপকথা ও জিন-পরীর গল্প শুনে হারিয়ে যেতাম স্বপেড়বর দেশে। প্রচলিত লোকগাঁথা, খলিফা ও বাদশাদের গল্পে ছিল শিক্ষা। নবী-রসূল-সাহাবীদের ঘটনা শুনে পেতাম অনুপ্রেরণা আর ঐতিহাসিক ঘটনার মাঝে খুঁজতে চেষ্টা করতাম আমাদের অস্তিত্ব। সেখান থেকে জেনেছি অনেক কিছু। ব্রিটিশ আমলের আগে ও পরের বাংলাদেশ, দেশ বিভাজন, মুক্তিযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ পীড়িত বন্যার্তদের ঘটনা, ঝড়-বৃষ্টি-ঠাণ্ডা আবহাওয়ার করুণ বর্ণনা মা অনেক বলতেন। সময়ের আবহে আ বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেসব গল্পের কতগুলো ইতিহাসকে আবার পরিবর্তনও হতে দেখা যায় এখন। আমার দুই বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে একজন মহিলা মানুষ হয়েও কত পরিশ্রম করেছেন তিনি। আমরা ভাই-বোন ছিলাম অনেকজন। বাবা যখন মারা যায় তখন সবাই ছোট। দুর্ভিক্ষপীড়িত আমাদের এ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না এমতাবস্থায় নাবালক ভাইয়েরা সংসারের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে ছিলেন অনভিজ্ঞ। এই কঠিন অবস্থায় আমার মা কিভাবে যে দিনগুলো পার করেছেন ভাবতেই পারি না।
“আগেকার সেই দিনগুলো অনেক কঠিন ছিল তাই না মামা?” বলল লিখন। যেমন কঠিন ছিল তেমন আনন্দ ছিল।
“তখনকার আনন্দগুলো কেমন ছিল বলবে কি?” আকাশের প্রশ্ন।
– আনন্দগুলো ছিল অন্যরকম। লেখাপড়া না জানার কারণে লোকমুখে যা শুনতাম তাই বিশ্বাস করতাম। আবার কিছু কিছু বিশ্বাস ডুবিয়ে দিত ভাবনার অতল গভীরে। এই ধরো আকাশে একগুচ্ছ তারকা দেখে সাত ভাই চম্পার গল্পের সাথে মিলাতাম। তোমরা তো নিশ্চয়ই এই গল্পটা শুনেছ সবাই। আমি ছোটবেলা থেকে একটু বেশি ভাবুক হওয়ার কারণে কল্পনার মহারাজ্যে চলে যেতাম। পরবর্তীতে অনেক কষ্ট করে নানান বিষয়ে জানার জন্য প্রচুর বই পড়েছি। সব ধরনের বই থেকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি কোন তথ্যগুলো সঠিক আ কোনগুলো ভুল?
হঠাৎ ইমরানের প্রশ্ন; “ভাইয়া! তাহলে ঐ তারাদের সৃষ্টি কোথা থেকে হয়েছে আর তারাগুলো এত বিস্ময়কর কেন একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?”
অবশ্যই, আমি তোমাদেরকে এ জন্যই তো ডেকেছি।
তোমাদের মনে যত প্রশ্ন জাগে আমাকে বল।
শরতের মেঘমুক্ত রাতে সবার চোখ তখন মাথার ওপরে বিশাল আকাশের দিকে। যেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকের দল, ঝলমল করছে অন্তরীক্ষে। এই আলোকের দল মিলেমিশে আছে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। কনক বলল ‘আমাদের এ পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ মাত্র। সূর্য এবং তা চারদিকে ঘূর্ণায়মান বিভিন্ন গ্রহ আকারে প্রকারে কোটি কোটি তারকার রাজ্যে খুবই ক্ষুদ্র। সৌরজগতে আলোর গতি যদি ঘণ্টা হিসেবেও ধরা হয়, তাহলে সমগ্র তারকারাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে ঘন তারকাগুচ্ছের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আলো পৌঁছাতে প্রায় ৯০ হাজার বছর সময় লেগে যাবে। একটি সাদা  শাড়ির আঁচলের মতো, খানিকটা দুগ্ধ সরের মতো কিছু দেখতে পাচ্ছ কি সবাই?’
একযোগে উত্তর এলো “হ্যাঁ ওইতো।”
এইটার নামই ছায়াপথ। মানে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, এখানেই আমাদের বসবাস। প্রাচীনকালের ভারতীয়রা আকাশের এই সাদা পথ দেখে এর মাঝে খুঁজে পেয়েছিল তাদের সুখ-দুঃখের নদীগঙ্গাকে। তাই এর নাম দিয়েছিল আকাশগঙ্গা।
জামাল বলল “গঙ্গা নদী কোনটা?”
– ভারতের বিখ্যাত নদীর নাম গঙ্গা। যার একটি শাখা আমাদের দেশে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। আর তা রাজশাহী হয়ে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার দৌলতদিয়ায় যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। এরপর বড় পদ্মা বা মূল পদ্মা নামে চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। আমাদের এ করতোয়া নদী যেমন দিনাজপুরের খানশামায় শেষ হয়ে আত্রাই নামে পরে চলনবিল হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। গঙ্গা নদীকে কিন্তু হিন্দুদের পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করে। আর তারা সেই গঙ্গার জলে গোসল করলে পবিত্র হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করে। ঐ গঙ্গা নদীর নাম অনুসারেই এই ছায়াপথের নাম কিন্তু আকাশগঙ্গা রেখেছে। অন্যদিকে গ্রিকদের মনে হয়েছিল আকাশে বুঝি ছড়িয়ে আছে তাদের দেবী অ্যান্ড্রোমিডার দুগ্ধসর। তোমরা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখ এটাকে কিন্তু দুধের সরের মতোও মনে হচ্ছে। আর গ্রিকদের দেবতা জিউস-হারকিউলিসের রূপকথাকার নাম অনুসারে এর নাম দিয়েছে মিল্কিওয়ে। নক্ষত্রখচিত এই আকাশে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখবে অদ্ভুত একটা মোহ আসে। ভালো লাগায় ভরে যাবে মন। মাঝে মাঝে আকাশের এই বিশালতায় নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে হয়। তাই না?
সবাই বলল “হ্যাঁ”।
আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে খালিচোখে কতগুলো তারা দেখি আমরা? এই খোলা মাঠেও পুরো দিগন্তসমেত এই আকাশেও কিন্তু আমরা ২৫০০ এর বেশি তারা দেখতে পাচ্ছি না। যা কিনা এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ১০০ মিলিয়ন ভাগের একভাগ মাত্র। আর ব্যাপ্তি হিসেবে আমাদের দৌড় মাত্র ১০০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত, যা ছায়াপথের মোট ব্যাসের ১% মাত্র। অথচ এই এক ছায়াপথেই আছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। আর বিজ্ঞানীদের ধারণা আমাদের মহাবিশ্বে ঠিক ১০০ থেকে ৪০০ এর মতোই আবার ছায়াপথও আছে। অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীতে যত বালুকণা আছে তার প্রত্যেকটি বালুকণার বিপরীতে আছে ১০,০০০টি তারা। এত তারার দেশে নিশ্চয়ই এদের নিজেদের চারপাশেও আছে এক একটা জগৎ। যেখানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে গ্রহদের দল।
“আরেকটা জগৎ মানে?” ইমরানের কৌতূহলী প্রশ্ন।
শুধু কি সূর্য নামক এই একটি তারার জগতেই প্রাণীর বিস্তারণ?
আমাদের মতো অন্য কোন গ্রহে কোনখানে জীবে বসবাস আছে কিনা এটি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। কারো কারো মতে প্রতিটি সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো গ্রহ থাকার সম্ভাব্যতা অর্ধেকেরও বেশি। এদিকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, কম করে হলেও এ সম্ভাব্যতা ২২%। আমরাও কম ধর আগালেও অর্থাৎ ৫০০ বিলিয়ন সূর্যের মধ্যে ২২% সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো একটি করে গ্রহ আছে। সংখ্যার বিচারে, এ মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে, যা কিনা মহাবিশ্বের মোট তারার ১ শতাংশ। তার মানে পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণার বিপরীতে আছে ১০০টি করে পৃথিবী। সমুদ্রসৈকতে গেলে আমাদের পায়ের তলার একমুঠো বালির বিপরীতে কতগুলো পৃথিবী আছে ঐ বিশাল মহাবিশ্বে, ভাবা যায়! কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে আল কুরআনে অনেক আয়াতে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে শুধু আমাদের এই পৃথিবী নয় অন্য কোনো অজানা প্রান্তেও রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টি জীব। কিন্তু এর বিপরীতে মহাবিশ্বের কোথাও কোন প্রাণ নেই এরকম কোন বার্তা আল কুরআন দেয়নি।
সূরা মুমিনের ৬৪ ও ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন- আল্লাহ পৃথিবীকে করেছেন তোমাদের জন্য বাসস্থান, আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি সুন্দর করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন পরিচ্ছন্ন রিজিক। তিনি আল্লাহ, তোমাদের পালনকর্তা। বিশ্বজগতের পালনকর্তা, আল্লাহ বরকতময়। তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব, তাঁকে ডাক তাঁর খাঁটি এবাদতের মাধ্যমে। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর জন্যই।
আল্লাহর নবী হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ফিরাউনকে মহান আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করতে বলেন তখন যে কথোপকথন হয় তা পবিত্র কুরআনের সূরা আশ শুআ’রার ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন“জগৎসমূেহর প্রতিপালক আবার কি? তিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবীসমূহ এবং উহাদিগের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালক; যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।
সূরা আশ শুরার ২৯ নম্বর আয়াতে বলেন“তার এক নিদর্শন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং এতদুভয়ের মধ্যে তিনি যেসব জীব-জন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন সেগুলি। তিনি যখন ইচ্ছা এগুলোকে একত্রিত করতে সক্ষম।”
বিজ্ঞানীদের গবেষণার চোখে ধরা পড়ুক আর না পড়ুক আমাদের এই পৃথিবীর বাইরে আরো প্রাণের অস্তিত্ব আছে। বিজ্ঞানীরা তো সচরাচর এটাও বলে আসছে যে আকাশ মানেই ফাঁকা জায়গা। যারা আকাশ মানে শুধুই ফাঁকা বা শূন্যস্থান ধরে নেয় ওদের এই তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি বিশ্বাস করাতে হয়তো অনেক সময় লাগবে। সুতরাং আকাশও অনেক আছে এবং পৃথিবীও অনেক আছে। কেউ বিস্মিত হতে পারে যে, আমাদের এ পৃথিবীর মতো আরও পৃথিবী আছে? আমাদের আমল পর্যন্ত এ সত্য অবশ্য এখনও মানুষের দ্বারা প্রমাণিত হয়নি, তবে সূরা তালাকের ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আগাম খবর দিয়েছেন“আল্লাহই সৃষ্টি করিয়াছেন সপ্তাকাশ এবং পৃথিবীও অনুরূপ ভাবে, আকাশ ও পৃথিবীর সর্বস্তরে নামিয়া আসে তাহার নির্দেশ; ফলে, তোমরা বুঝিতে পার যে, আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং সমস্ত কিছু তাহার জ্ঞানগোচর।”
পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্ত হলেও তথ্যবহুল একটি কথা মহান আল্লাহ কুরআনে উদ্ধৃত করেছেন, যা বর্তমান বিশ্বের সাড়া জাগানো বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস-এর বিগব্যাঙ থিউরির সাথে মিলে যায়। বিগব্যাঙ-এর থিউরিতে এ পৃথিবী প্রথমেত গ্যাসীয় পিণ্ডের মতো ছিল বলে উল্লেখ করে।
পবিত্র কুরআন এক ধোঁয়ার পুঞ্জ বলেছে। যেমন- সূরা আম্বিয়ার ৩০ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন“অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যাহা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অনন্তর তিনি উহাকে ও পৃথিবীকে বলিলেন, ‘তোমরা উভয়ে আমার আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হও ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। উহারা বলিল, ‘আমরা তো আনুগত্যের সহিত প্রস্তুত আছি।”
(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন