চারিদিকে তখন হলুদ রোদের মিষ্টি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সেই মিষ্টি আলো গায়ে মেখে প্রকৃতি তখন হাসছে। কেমন স্তব্ধভাবে ঘরে এসে ঢুকল উমায়র। না, তার মুখে কোনো হাসি নেই। তার মনে কোনো আহ্লাদ নেই। কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব তার সমস্ত দেহমনজুড়ে। হ্যাঁ, তার চোখ বেয়ে বিগলিত স্বর্ণকণার মতো চকচকে অশ্রুফোঁটাও ঝরছে টপাটপ। কয়েক নিমিষেই ব্যাপারটি তার পিতার নজরে পড়ল। তিনি লাফিয়ে ওঠে বুকে জড়িয়ে নিলেন আদরের দুলাল উমায়রকে। জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছ কেন আব্বু! উমায়র ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে পিতার দিকে। উত্তর দেয় না কিছু। পিতাও চেহারাময় জিজ্ঞাসুভাব ছড়িয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে। উমায়র এবার নীরবতা ভেঙে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, এক সপ্তাহ পর অনুষ্ঠেয় স্কুলের বার্ষিক দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি যে নিশ্চিত গোল্লা পাব! আমার সব বন্ধু সহপাঠী সেখানে জড়ো হবে। ওদের চোখের সামনে তা আমার জন্য কেমন গা রি রি করা লজ্জার ব্যাপার হবে! সেই চরম লজ্জা আর অসম্মানের অনুভব আমার গায়ের প্রতিটি লোমকূপে কাঁটা বিঁধছে।
আহমদের কথায় পিতা বিস্ময়ে বাকহারা। ক্ষণকাল স্থির চক্ষে চেয়ে থাকেন তার দিকে। অতঃপর কপালে হাত চাপড়ে তার দেহের উষ্ণতা অনুমান করেন। না, তার কপাল একেবারেই নিরুষ্ণ হিমশীতল।
– কী হলো উমায়র? কোনো অসুস্থতাবোধ করছ?
– না!
– আচ্ছা উমায়র! যদি তুমি অসুস্থ না হও কিংবা এমন কোনো কারণও না থাকে যা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে অন্তরায় হতে পারে, তবে আর কিসের এতো ভয় করছো তুমি, যা তোমাকে প্রতিযোগিতায় নিশ্চিত গোল্লা পাইয়ে দিবে?
– না আব্বু, আমার সমস্ত অনুভূতিজুড়ে এ কথাই বিরাজ করছে। আমার মন বলছে, আমি নিশ্চিত প্রতিযোগিতায় ফেল করবো। অতএব আমি প্রতিযোগিতায় অংশই নেবো না। এটাই আমার জন্য নিরাপদ! পিতার চেহারাময় এক ঝলক আদুরে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আচ্ছা বাপু! তবে কি তোমার মনেরও একটা মুখ আছে আর তা দিয়ে বিড়বিড় করে তোমার সাথে মন কথা বলে!
এ কথায় উমায়র নেহাত চটে গেল। তার চাপাকান্না এবার গর্জিত রূপ নিলো। এমনকি রাগে-রোষে ধপাধপ মাটিতে পা চাপড়াতে লাগল।
পিতাও চেঁচিয়ে বললেন, বেটা, থামো! অমন করে বেঁকে বসলে চলবে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটিতে পদাঘাত না করে বরং এখান থেকে ওই দূরে একটা লম্ফ দাও, বুঝলে!
আহমদের কান্না এবার থামল। বিস্ময়ে বিস্ফারিত চক্ষু পিতার দিকে ফেরাল।
পিতার কথাটির মোটেও কোনো মানে-মতলব সে বুঝে উঠতে পারছে না। চক্ষু অবনমিত করে সে জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে ওই দূরে একটা লম্ফ দিতে কেন বলছেন আব্বু?
পিতা বললেন, কি জানি হতে পারে তোমার অজান্তে ওখানে কোনো গর্ত থাকতে পারে, আর লম্ফ দিতেই তুমি সেখানে হুমড়ি খেয়ে পতিত হবে।
উমায়র বিস্ময়ে হেসে বলল, কিন্তু আমরা যে আমাদের ঘরেই আছি আব্বু! এখানে কোনো গর্ত নেই তা আমাদের জানাই আছে! তাহলে?
পিতা বললেন, আমি বলছি, ওখানে কোনো গর্ত থাকতে পারে। তাই তুমি একটা লম্ফ দিয়ে দাও!
পিতার কথা শুনে আহমদের সন্দেহ হলো, কি জানি পিতার রক্তচাপ বেড়ে কোনো প্রলাপ বকছে কি না! সে পিতার কপাল হাত চাপড়ে উষ্ণতা অনুমান করে। তার কাণ্ড দেখে, পিতা খিল খিল হেসে উঠে বললেন, বেটা! আমার কথাটা তোমার কাছে কেমন প্রলাপ প্রলাপ ঠেকছে তাই না? কিন্তু এটা তো তোমার কাজেরই কথ্যরূপ! তুমি মনের মধ্যে মিছামিছি একটি ভয় পুষে চলেছ! এমনকি সে ভয়ে প্রতিযোগিতায় অংশই নিতে চাচ্ছ না। এটা এমন হয়ে গেল না, যে সম্পূর্ণই নিজের মনে মনে ধরে নেয়া একটা গর্তের ওপর ঝাঁপ দিতে রাজ্যির সব ভয় মনের ভেতর তোলপাড় কাণ্ড বাধিয়ে দেয়! অথচ নিশ্চিত সেখানে কোনো গর্ত নেই, শুধু লম্প ও যোগ শেখার জন্যই সেখানে ঝাঁপ দেয়া!
শোনো, নিয়মিত শারীরিক অনুশীলনগুলো চালিয়ে যাও। আর মিছামিছি ভয় ঝেড়ে ফেলে নিশ্চিত জেনে নাও, তুমি জিতবে। তাহলে তুমি জিতবেই! এটা আমার কথা নয়, আমাদের প্রিয় নবী মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি বান্দার সাথে তার ধারণা মতে আচরণ করে থাকি।” অতএব সর্বদা সর্বক্ষেত্রে ভালো কিছুর আশা করবে। হতাশাকে না বলে যাবে।

Share.

মন্তব্য করুন