বেশ ক’দিন চাঁদটা জোৎস্নার বিলাবার পর আজ হঠাৎ অমাবশ্যা রাতের মতো চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। বন্ধ জানালার ভাঙা কপাট খুলে বাহিরে তাকালেই শঙ্খর মোলায়েম শান্ত ঢেউ চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে পানির উপর বিচ্ছিন্নভাবে ভেসে থাকা চেরাগ। ঘরের কোণায় টিকটিক টিকটিক করে ঘড়ির কাঁটা নড়লেও দেখা যাচ্ছে না ক’টা বেজেছে। মায়ের মাথার উপর চেরাগ জ্বালানো ছিল ঘন্টাখানেক আগে। মা অসুস্থতায়
ভুগছেন দুই সপ্তাহ ধরে। মা বললেন- ‘বিছানা করে শুয়ে পর। চেরাগটা নিভিয়ে দিস।’ এখন তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি পাটি, বালিশ আর তাঁর সেলাই করা কাঁথা। আমার মধ্যরাতে ঘুম যাওয়ার অভ্যাসটা আজো পিছু ছাড়েনি। ছাড়ার কোনো আভাসও দেখছি না। এইতো গতো কয়েকদিন চাঁদের আলো আমার চোখে এসে পড়েছে বলে ঘুমোতে পারি নি। পাগুলো হাঁটুভাঙা দ এর আকৃতি করে মাথাটা হাটুর উপর রেখে তাকিয়ে থাকতাম শঙ্কের ওপর ভেসে চলা জেলেদের ডিঙির দিকে। রাত কেটে যেত। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির পাশ ঘেঁষে জেলেরা ডিঙি নিয়ে যায়। আমার ইচ্ছে করে তাদেরকে ডাক দিতে। থেমে যাবে আমার ডাক শুনে। পানিতে ভাসতে ভাসতে আমার কথাগুলো শুনবে আর শুনবে। কিন্তু না, আমার বিবেক বাঁধা দেয়। এতো রাতে! তাও এক পর পুরুষের সাথে? আব্বা জানতে পারলে চুল রাখবে না মাথায়। সকালে নাপিত ডেকে বাটি সাঁট দেয়াবে।
বেশ ক’দিন চাঁদটা জোৎস্নার বিলাবার পর আজ হঠাৎ অমাবশ্যা রাতের মতো চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। তারপরও শঙ্খের ঢেউ উথাল-পাথাল করে হৃদয়ে। কথা বলিই না, আর কী হবে? সাহস করে ডেকেই বসলাম- এই যে! শুনতে পায়নি আমার ডাক। আরেকটু সাহস যুগিয়ে আবার ডাক দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমুহূর্তে আব্বার কাশি ধরেছে। ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম একহাত। আমার সাহস যেন ভীতুর ডিম হয়ে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল! ভাবলাম- আব্বা যদি এখন সত্যি সত্যি জেগে উঠতো তাহলে বলতেন- মা এতো রাতে বসে আছিস কেনো? ঘুমিয়ে পড়। কাকে ডাকছিস এতো রাতে? আব্বার আগের সেই তেজ এখন কোথায় হারিয়ে গেছে। নরম হয়ে গেছে কথাবার্তা। আমি হয়তো কিছুই না বলে চুপ মেরে থাকতাম। তখনি হঠাৎ মনে পড়ল আব্বার সেই স্মৃতিময় কথা-‘যখন কোনো খারাপ কাজ করবি তখন সহযোগী হিসেবে যোগ দিবে শয়তান আর যখন কোনো ভালো কাজ করবি তখন আল্লাহকে তোর সাহায্যকারী হিসেবে পাবি। খারাপ কাজ করার পূর্বে বিবেক সতর্ক ঘন্টা বাজিয়ে বলবে, কাজটা ভালো হচ্ছে না কিন্তু! এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারলাম না।
‘ফারজানা! ফারজানা! ওঠ। সকাল হইছে।’ উঠে গেলাম আব্বার ডাক শুনে। মনে হচ্ছে কাজী নজরুলের ‘আমি হবো’ কবিতাটি একমাত্র আমার আব্বাই মনোযোগ সহকারে শুনেছে। চোখে ঘুমের ঘোর থেকেই গেলো। আব্বা আবার বললেন‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ এইতো চার পাঁচ দিন হবে। কি যেনো একটা গান শুনেছি,
‘সূর্য ওঠার আগে ওঠো
নইলে কিন্তু সূর্য ওঠা
দেখতে তুমি পাবে না।’
পরিবেশ কর্মের উপর প্রভাব ফেলে বলে একটা কথা কোথায় যেনো পড়েছিলাম ঠিক মনে নেই। সূর্য উঠার পর আমাদের ঘরে আর ঘুমানো যায় না। কারণ সুর্য উঠার আগে থেকেই জেলেরা এসে ভীড় করে। মাছ নিলামে তোলে । ক্রেতা বিক্রেতার হই হুল্লোড়। দর কষাকষি। একটি শক্তিশালী বাজারের আকারধারণ করে ।
‘ফারজানা, চা-পানি হইছে?’ ডাক শুনে অবচেতন মন ভাঙলো। বললাম- ‘অ হইছে। খাইয়া যান।’ আব্বা চা-পানি খেয়ে ঘাটে যাবেন। দু’একটা মানুষ পার করতে পারলেও কম কি। চা-পানি খেতে খেতে অনেক কথাবার্তা হলো আব্বার সাথে। গতোকাল দুপুরে আব্বা ভাত খেতে আসেন নি। ভেবেছিলাম- দূরে কোথাও ভাড়া নিয়ে গেছেন। তাই হয়তো আসতে পারেননি। অপেক্ষায় ছিলাম, ঘরের বারান্দায় বসেছিলাম অনেক্ষণ। নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম আশান্বিত দৃষ্টি নিয়ে। আব্বা ফিরে আসবে বলে।
আব্বা যখন ফিরে এলেন তখন পশ্চিমে সূর্য ডুবে গেছে। লাল আভা দেখা যাচ্ছিল। চেহারাটা মলিন। কোনো কথা বলছে না অন্যদিনের মতো। ডিঙি গাছের সাথে বেঁধে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে কি যেনো চিন্তা করছে। তারপর আমার দিক চোখ রেখে মৃদস্বরে বললেন- ‘খানাপিনা খাইছস? গরুরে খড়খুটো দিছস?’ বললাম- ‘অ, দিছি। দুপুরে ভাত খাইছেন?’ চেহারা আরো মলিন হয়ে গেলো। মনে হলো কেরোসিনের স্তুপে একটি জ্বলন্ত দেয়াশলাই ফেললাম। আব্বা উত্তর না দিয়ে বললেন- ‘তোর মার কী অবস্থা? ঔষধপত্র খাওয়াইছস?’ আজ তিন দিন ধরে আম্মার ঔষধ নাই সে কথা আব্বার জানা থাকার কথা। হয়তো এ মূহুর্তে ভুলে গেছেন।
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম- ‘আব্বা, আজ কোনো টাকা পয়সা পেলেন? আম্মার ঔষধ কিনতে পারমু?’ নিজেকে অপরাধী ভেবে মাথা নিচু করে চলে গেলেন পুকুর ঘাটে। ইতিমধ্যে মাগরিবের আযান শেষ। বারান্দা থেকে উঠে দেখি চারিদিকে অন্ধকারে ঘিরে ফেলেছে। ঘরে গিয়ে চেরাগ দুটো জ্বালিয়ে দিলাম। একটা আম্মার পাশে। অন্যটা নিয়ে এলাম পাকের ঘরে। বাসন-কোসন ধুয়ে আব্বার জন্য ভাত বেড়ে রাখলাম। তরকারি শুধু দুটি পোড়ামরিচ আর কটা সিদ্ধ আলু ছাড়া আর কিছু নেই । আব্বা হাত মুখ ধয়ে ভাত খেতে বসলেন। বললাম- ‘দুপুরে ভাত খাইতে আইলেন না যে আব্বা?’ আব্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- ‘না, কোথাও খাই নাই। ঘাটেই ছিলাম। একটা টাকাও কামাই করতে পারি নাই। শুধু শুধু ভাত খাইয়া চাউল ফুরানোর দরকার আছে?’ কথা শুনে মন বিষণ্ণতায় ভরে গেল। বললাম-
‘তাই বলে কী উপোস থাকবেন? নিজেরে কষ্ট দিবেন?’ ধীরে ধীরে বললেন- ‘জানি আমার কষ্ট হইতাছে। তোর মা যে আমার জন্য কষ্ট পাইতাছে? তাঁর জন্য দুইটা ঔষধ আনতে পারতাছিনা।’
বর্ষার ঘনবৃষ্টি নিরবে ঝরতে লাগলো দুচোখ বেয়ে। আব্বা কয়েক লোকমা খেয়েই হাত ধুয়ে ফেললেন। বললেন- ‘সারাদিন মিল্লা একশ টাকা পাইলাম। কাইলকা সকালে ঔষধ আর বাজার আইনা দিমু।’ কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন- ‘আরে বড় মাইয়াটারে কোনো কিছু দিতে পারলাম না। কোনো খোঁজখবরও নিতে পারলাম না। মাইয়াটারে বিয়া দিলাম আইজ আট কি নয় মাস হইতাছে। ’
বলতে বলতে কপালে ঘাম জমে গেছে আব্বার। নিজে আফসোস করে বলছেন- ‘সেই যে পরের হাতে তুইল্লা দিলাম আর ফিরে চাইলাম না। কী রকমের অমানুষ হইয়া গেছি। তোর আপা একটু আধটু পড়ালেখা জানে। অথচ কোন এক অশিক্ষিত পোলারে তুইল্লা দিলাম। যে কিনা সম্মান কইরা কথাও বলতে পারে না। জানি না মাইয়াটা সুখে আছে কিনা?’
আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- ‘আমার তো আর কোনো পোলা নাই থাকলে খোঁজখবর নিতো। মাইয়াটার বিয়ার দিন কী যে কষ্ট পাইছি। তা আমারে আজন্মের কষ্টরে ভুলাইয়া দিছে। আমাগো পাড়ার কয়েকজন মুরুব্বীরে দাওয়াত করছিলাম। আর আমার বেয়াই বাড়ি থেকে পনেরো জন আসার কথা ছিল। তোর মা হিসাব কইরা পাক করছে। যেন সবাইরে হয়। অথচ তারা আইল সাতাশ জন। শুইনড়বা তো আকাশ ভাইঙ্গা পড়লাম। ঘরে অগ্রিম কিছুই ছিলো না তহন যা আয়োজন সব চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের উপর ধারকর্য করা।
ঐ মুহূর্তে একখান থাল লইয়া রাস্তায় বসা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। আবার তারা শর্ত দিল পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দেওন লাগবো। আমার মনটা আরো ভাইঙ্গা পড়লো। বললাম- মাসখানেক সময় দেন?
বলল- না। অনেক হাতে পায়ে ধইরা বললাম- জমি বিক্রি হইলেই পাঠাইয়া দিমু। তোর দাদা মারা যাওয়ার আগে দুই গন্ডা জমি দিয়া গেছিলো। সে জমি বিক্রি কইরা তার ক’টা দিন পর তিরিশ হাজার টাকা দিছিলাম। আর বিশ হাজার টাকা এখনো দিতে পারি নাই।’
শেষের দিকে এসে আব্বা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি। চেরাগের আলো মিটিমিটি জ্বলছে। নিভে যাবে যাবে অবস্থা। এক পোয়া কেরোসিন আর ক’দিন জ্বলবে। চারদিন জ্বলেছে তাও বেশ। অল্প সময়ে আমি দুটো খেয়ে শুয়ে পড়লাম। হাজারো চিন্তা মাথায় এসে ভীড় জমিয়েছে। আপুর শ্বশুর বাড়ি নদীর ওপারে। পাড় ঘেঁষে কিছুদূর গেলেই হাতের বামে খড়ের ছাউনি দেয়া ঘরটা।
শফি মাঝি আজ আমাদের বাড়ি এসেছিল। সে বলল-
‘নদীর ওপারে নাকি একটা পাগলি বইসা থাকে। তারে যে কোন প্রশ্ন করলে কিছু বলতে পারে না। শুধু হাত দিয়া আমাদের বাড়ি দেখিয়ে দেয়। আমাদের বাড়িটা একাই দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড় ঘেঁষে। মাসখানেক আগে যখন আপুর শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন আপু বলেছিল ঐ বাড়িতে নাকি একটা পাগলি আছে। যে কথা বলতে পারে না। মাঝে মাঝে কোথায় চলে যায় আবার ফিরে আসে।
হয়তো সে পাগলিটাই নদীর তীরে এসে বসে আছে। শফি মাঝি বারান্দায় এসে বসে। মনে হয় পাগলটার জন্য তার খুব মায়া হয়। বললাম- ‘তো পাগলটারে একবার আনেনা কেন?’ বলল- ‘আইন্যা কি করমু? খাওয়াইতে পারবি, এ পাগলটারে?’ বললাম- ‘হ, খাওয়াইতে পারমু। আমরা যা খাই তা খাইব।’ বিরামহীন স্রোতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার নিশ্চুপ থাকে। শঙ্খের ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগলে অবচেতনার ভাঁজ কেটে যায়। বলে- আইচ্ছা, আনমু কাইলকা।
আমার নিশিথ রাতের সঙ্গী চাঁদকে মিস করছি খুব। বেড়ার ফুটো দিয়ে আমার চোখ বাইরে চলে যায়। শঙ্খের পাড় দিয়ে জেলেদের আনাগোনা কানে ভেসে আসে। আমার পুরো শরীরে একতরফা ঘুম নেমে আসে। কেটে যায় রাত। সূর্যটা সবেমাত্র পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে দাঁড়িয়েছে।
দেখি শফি মাঝি পাগলিটাকে নিয়ে হাজির। আব্বা ঘাটে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছেন। আমি উঠানে একটি মোড়া এনে দিলাম। কোন এক পরিচিত আগন্তুক মেহমানের ন্যায় বসে পড়ল। এক গ্লাস লবণ-চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে এগিয়ে দিলাম। আমাকে দেখে নিঃশব্দে মুচকি হেসে দীর্ঘদিনের তৃষ্ণার্ত মানবীর মতো হাত বাড়িয়ে গ্লাসটি হাতে নিল। তিনবার করে পান করেই হাত নেড়ে কি যেন বলছে। কিছুক্ষণ ভাব জমালাম তার সাথে। তৃপ্তিভরা হাসি উপচে পড়ছে তার মুখে। গল্পের এককালে হাতের ইশারায় বলল- ‘চলে যাব।’ শফি মাঝি ডিঙ্গি খুলতে গেল। পাগলি হাত বুলিয়ে দিল আমার মাথায়। যাওয়ার কালে একখানা সাদা কাগজ বের করে বলল- ‘পড়িও।’ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘাট ছেড়ে দিল। ভেসে ভেসে চলে যায় আপন স্থানে। হালকা বাতাস বইছে। বসে গেলাম নদীর পাড়ে। দুচোখ মেলে তাকিয়ে আছি ওপারে। যেখানে আমার আপু ষোল বছরের অপরিচিত ঘরে অচেনা জনের সাথে থাকে। যাদের সাথে কেটেছে এ দীর্ঘ জীবন, যাদের মায়া মমতায় বড় হয়েছেন। আজ তাদের ছাড়া কিভাবে একা একা সংসার করে? এসব ভাবলে আমার হৃদয় সংকীর্ণ হয়ে আসে।
ও আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম, পাগলির চিঠির কথা। কী হতে পারে? কার হতে পারে? কোথায় পেল? আমার ভেতরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করতে লাগল। ও মা! এতো আমার আপুর লেখা চিঠি। আমি খুশিতে এক লাফেই দাঁড়িয়ে গেলাম। দৌড়ে গেলাম ঘরের ভেতর। আব্বা আর মাকে বললাম- ‘মা, তোমার মেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।’ মা বললেন- ‘তাই নাকি? পড় দেখি!’ আমি শুরু করলাম আমার বোনের চিঠি। মা আর আব্বা আবেগ ভরা হৃদয় নিয়ে বসে আছেন মনযোগ সহকারে।

প্রিয় মা, বাবা ও ফারজানা!
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। কেমন আছ তোমরা? আমি ভাল আছি। মা, তুমি সুস্থ আছ তো? ঠিকমতো ঔষধ খাচ্ছো তো? এখন তো তোমার খেদমত করতে পারছি না। ফারজানা কি তোমার দেখাশোনা করছে? বাবা, ভাল আছ তুমি? তুমি রীতিমতো ঘাটে আস তো? আসলে তো আমায় একবার দেখতে এসো। কেমন আছে তোমার মেয়ে? আচ্ছা তোমাদের কি আমার জন্য চিন্তা হয়না? পেট পুড়ে না? মন কাঁদেনা? আমার তো কাঁদে। আমার তো তোমাদের দেখতে যেতে ইচ্ছে করে। মন চায়, এ দুঃখের সংসার ছেড়ে তোমাদের কাছে ফিরে যাই। আমি তো চাই আমার জীবনে দিনগুলো অতিবাহিত হোক সুন্দর সুখময়। আমার ভীষণ দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে, আমাদের গরুটা ঠিকমতো ঘাস খায়তো? তোমাদের ছেড়ে যেদিন চলে যাবো আমি অন্যের ঘরে। সেদিন জন্মের কাঁদা কেঁদেছি। আমি তো প্রতিদিন বিকেল বেলা চোখের অশ্রু ফেলি। আমাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখের পানি গড়াতে গড়াতে শঙ্খের স্রোতে ভেসে যায়। আমি তো নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি, বাবা-তুমি আসবে বলে। তুমি যদি এই পাড় ঘেঁষে কখনো নৌকা নিয়ে যাও। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আমার হাতের রান্না করা দুমুঠো ভাত নিজের হাতে তোমার মুখে তুলে দেব বলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি। জানি কেনো আসছো না। আমার বিয়ের যৌতুকের টাকা এখনো বিশ হাজার বাকি। আমার শ্বশুর বাজার থেকে কতই না মাছ মাংস নিয়ে আসে। আজো আমি মাছ মাংস মুখে দিতে পারি নি। যখন এসব নিয়ে খেতে বসি তখনই মনে পড়ে মা বাবা বোলতো একবেলা খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। আমি তো সেই ঘরের মেয়ে। কিভাবে পারি বলো? জানি কেনো আসছ না, যদি বেয়াই বাড়িতে বেড়াতে আসো তাহলে সাথে বিশহাজার টাকা নিয়ে আসতে হবে। এখনো তোমার বিশ হাজার টাকা জোগাড় হয়নি। বাবা, তোমার জন্য বিশহাজার টাকা তো স্বপেড়বর মতো। এতো টাকা তোমাকে কে দেবে? তাই বলে কি তোমার মেয়ের বাড়িতে তুমি আসবে না? অবশ্যই আসবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে চলে এসো বাবা। একদিন। যাকে তুমি বাল্যকালেই মায়া-মমতাহীন একটা ঘরে নির্বাসিত করেছিলে। কী করে দিন কাটায় তোমার মেয়ে। কতো সুন্দর করে না সাজিয়েছি ঘরটাকে। ঘরের মানুষগুলোকে।
জানি বাবা। ঘরে অর্থের অভাবে দুঃখগুলো পিছু ছাড়ছে না। মা অসুস্থ। যে ঘরে একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে থাকতে হয়। সে ঘরে একজন রোগীকে ঔষধ খাওয়ানো বড়ই মুশকিল। বাবা, তাই বলে রীতিমতো যে মার খেতে হতো। কতো গালাগালি শুনতে হতো। তা কখনো বলার সাহস পাই নি। নিরবে সয়ে গেছি। জানো বাবা সে ঘরটাকে কতো সুন্দর করে সাজিয়েছি? একদিন সময় করে দেখতে এসো।
ফারজানা। তুমি কেমন আছো? এখন ঐ একলা ঘরটাতে কীভাবে তোমার দিন কাটে? আমি চলে আসাতে তুমি ভীষণ শূন্যতা অনুভব করছো তাই না? আমি থাকতে কত না উৎফুল্ল ছিলো ঘরটা। এখন আছে কি? অবশ্য থাকার কথা না। দুজনে একসাথে খেলেছি। একসাথে স্কুলে গিয়েছি। মাঝে মাঝে ঝগড়াও হতো। সেই স্মৃতিগুলো কী তোমার মনে আছে?
আচ্ছা পড়ালেখা ঠিকমতো চলছে তো? তুই আপুরে দেখতে আসতে পারছ না? গতো কমাস আগে একরাত থেকে না থেকেই চলে গেলি। আবার লম্বা ছুটি নিয়ে আসিস। ভালো থাকিস। মাকে দেখে-শুনে রাখিস। ঔষধপত্র কিনতে না পাড়লে খবর দিস। আব্বার দিকে খেয়াল রাখিস। খাওয়া-দাওয়া যেনো ঠিক মতো করে। দোআ করিস। খোদা হাফেজ।

ইতি
ফাতেমা আক্তার

Share.

মন্তব্য করুন