সকাল থেকেই ক্যাট্টু চিৎকার- চেঁচামেচি করে বাড়ি অস্থির করে তুলেছে। অন্য দিনেও চিৎকার- চেঁচামেচি করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে। তবে অন্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশি। অন্য দিনে ক্যাট্টুর ম্যাও ম্যাও শব্দগুলো মধুর শুনালেও আজ বড্ড কর্কশ লাগছে। সামনে পরীক্ষা। ভালো করে পড়তে হবে। কিন্তু ক্যাট্টুর ম্যাও ম্যাও শব্দে পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না রবিন। সে শুধু চেঁচামেচিই করছে না, রীতিমতো দৌড়াদৌড়িও করছে। দৌড়ে সে দাদুর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে যাচ্ছে, সেখানে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে, আবার রবিনের ঘরে এসে, ম্যাও ম্যাও করে ডাকছে। রবিনের কোনো সাড়া না পেয়ে ক্যাট্টু কখনো রবিনের পড়ার টেবিলে, কখনো বা রবিনের কোলে লাফিয়ে উঠছে। রবিন খানিকটা বিরক্ত হয়ে ক্যাট্টুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে পড়াতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। কমছে না ক্যাট্টুর জ্বালাতন। ক্যাট্টুর জন্য পড়াতে একটুও মনোযোগ আসছে না তার। ‘কেন যে নদীর কূল থেকে এই ক্যাট্টুকে এনেছিলাম!’ বিরক্ত হয়ে বলল রবিন।
রবিন বাবার সঙ্গে একবার যমুনা নদী দেখতে গিয়েছিল। যমুনার কূলজুড়ে তখন কাশফুলের সারি। সেই কাশফুলের সারির মধ্যেই ছোট্ট এই ক্যাট্টুটি ম্যাও ম্যাও করে কাঁদছিল। ক্যাট্টুর কান্না দেখে সেদিন রবিনের মায়া হয়েছিল। তাই বাবাকে বলে ক্যাট্টুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। রবিনের বাবাও বিড়াল ছানাটিকে বাড়িতে আনতে বারণ করেননি। কারণ, বিড়াল ছানাটি ছিল লাল। বিরল প্রজাতির বিড়াল এটি। সাধারণত ধূসর, কালো এবং সাদা রঙেরবিড়াল চোখে পড়লেও লাল বিড়াল দেখা যায় না। লাল বিড়ালটির প্রতি অনেকটা কৌতূহলী ছিলেন রবিনের বাবাও। বিড়াল ছানাটিকে বাড়িতে নিয়ে আসতে না আসতেই রবিনের ছোট ভাই মুবিন লাল ক্যাট্টু, লাল ক্যাট্টু বলে লাফাতে লাগল। মুবিনের বাবা মুবিনকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– তুমি তাকে ক্যাট্টু বলে ডাকছ কেন?
– বাবা, ক্যাট মানে বিড়াল, তাই না?
– হুম। কিন্তু তুমি ক্যাট্টু বলছ কেন?
– বাবা ক্যাট মানে বড় বিড়াল। আর ক্যাট্টু মানে ছোট বিড়াল।
মুবিনের যুক্তিতে সবাই সেদিন হো হো করে হেসে উঠেছিল। সেদিন থেকে সবাই বিড়াল ছানাটিকে ক্যাট্টু বলেই ডাকে। আর সেদিন থেকেই ক্যাট্টু এ বাড়িতে অনেক আদরেই বড় হচ্ছে। হঠাৎ দাদুর লাইব্রেরিতে কাচ ভাঙার শব্দ শুনে, রবিন দৌড়ে দাদুর লাইব্রেরিতে গেল। একি!
ক্যাট্টু লাফাতে লাফতে বুকসেলফের একটি গ্লাস ভেঙে ফেলছে! গ্লাস ভাঙার অপরাধে রবিন ক্যাট্টুকে, হাতে থাকা কাঠের স্কেল দিয়ে মেরে লাইব্রেরি থেকে বের করে দিলো। ক্যাট্টু ম্যাও ম্যাও করে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে গেল। এখন কী হবে? মা জানতে পারলে রবিনকেই বকা দেবে। মায়ের ভয়ে রবিন ভাঙা কাচের টুকরোগুলো আস্তে আস্তে কুড়াতে লাগল। এমন সময় রবিনের মা অন্যঘর থেকে বললেন,
– রবিন লেখাপড়া ফেলে লাইব্রেরিতে কী করছ?
– কিছু না মা। এখনই পড়ার ঘরে যাচ্ছি।
রবিন কাচের টুকরোগুলো নিয়ে দ্রুত তার পড়ার ঘরে আসতেই একটি কাচের টুকরো টং করে মেঝেতে পড়া গেল। রবিনের মা দৌড়ে রবিনের কাছে এসে বললেন,
– এ কী রবিন? তোমার হাতে কাচের টুকরো কেন? কোথায় পেলে এগুলো?
রবিন ভয়ে জড়সড় হয়ে কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বলল,
– আমি না মা। ক্যাট্টু দাদুর বুকসেলফের গ্লাস ভেঙে ফেলেছে।
– কেন মিথ্যে বলছ রবিন? ক্যাট্টু কিভাবে বুকসেলফে এতো মোটা গ্লাস ভাঙবে?
– সত্যি বলছি মা। আমি গ্লাস ভাঙিনি। ক্যাট্টুভেঙেছে।
রবিনের মা রবিনকে ধমক দিয়ে বললেন,
– আবারও মিথ্যে কথা বলছ?
মায়ের ধমক খেয়ে রবিন কান্নাজুড়ে দিল। রবিনের কান্না শুনে রবিনের বাবা এসে বললেন,
– কী হয়েছে রবিন?
রবিন বাবাকে সব কথা খুলে বলল। রবিনের বাবা রবিনের মাকে বললেন,
– না জেনে ছেলেকে কেন দোষারূপ করছ? গতকাল রাতে একটি বই খুঁজতে গিয়ে চেয়ারের কোনা লেগে, আমার হাত থেকেই গ্লাসটি ভেঙে গিয়েছিল। তবে সেই ভাঙাটি ছিল অল্প, এতো বেশি না। ক্যাট্টু সেই সামান্য ফুটো দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিল বলেই হয়তো পুরো গ্লাসটি ভেঙে গেছে।
রবিনের মা বললেন,
– কিন্তু ক্যাট্টু বুকসেলফের ভেতরে ঢুকতে যাবে কেন?
– হুম। এটাও ভাবনার বিষয়।
বাবার জবানবন্দিতে রবিন এতক্ষণে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে বলল,
– বাবা ক্যাট্টুর প্রিয় খাবার ইঁদুর। ইঁদুর ধরতেই হয়তো সেলফের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেছিল ক্যাট্টু।
– তাইতো। এমনটিই হতে পারে। এসো খুঁজে দেখি।
সবাই মিলে বুকসেলফের বইগুলো আস্তে আস্তে সরাতে লাগলেন। বই সরাতে সরাতে চোখে পড়ল একটি গেছো ইঁদুর। না, না একটি নয়, দুটি! অনেক বড় দুটি গেছো ইঁদুর। ঘরের দরজা বন্ধ করে, অনেক কষ্টে তারা দুটি ইঁদুরকে মেরে ফেলল। ইঁদুর দুটি মারতে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে রবিনের বাবা বললেন,
– রবিন তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার আইডিয়া না পেলে এই ইঁদুর দু’টি আমরা মারতে পারতাম না। আর ইঁদুর দুটি না মারা পড়লে, অল্প দিনেই হাজার হাজার টাকার বইগুলো কেটে তারা টুকরো টুকরো করে ফেলত।
রবিন বলল,
– বাবা ধন্যবাদটি আমাকে নয়, বরং ক্যাট্টুকে দিন। কারণ, ক্যাট্টু যদি ওদেরকে দেখতে পেয়ে এই গ্লাসটি না ভাঙত, তবে আমার মাথায় আইডিয়া আসত না, আর ইঁদুর দুটিও মারা পরত না।
– তাইতো, ঠিক বলেছ তুমি। তোমাদের দু’জনকেই ধন্যবাদ। রবিনের বাবার সঙ্গে এবার রবিনের মাও হো হো করে হেসে উঠল। কিন্তু ক্যাট্টু কোথায়? ক্যাট্টুকে তো বাড়িতে দেখা যাচ্ছে না। রবিনের কাঠের স্কেলের আঘাতে অভিমান করে, ক্যাট্টু হয়তো বাইরে চলে গেছে। রবিন মনের আনন্দে ক্যাট্টুর অভিমান ভাঙানোর জন্য দৌড়ে বাইরে গেল।

Share.

মন্তব্য করুন