আমার কাছে মনে হচ্ছে, বেশ ক’বছর পর ঈদটা যেন পূর্ণতা পাচ্ছে। কারণটা একটু বিচিত্র। অনেক দিন পর ভাইয়া আমেরিকা থেকে এসেছে আমার সাথে ঈদ করতে। সে আমেরিকার সেন্ট্রাল মিশিগানের লেকচারার। সেই ইউনিভার্সিটিতে সে পিএইচডিও করছে। এতদিন পর ভাইয়াকে ঈদে আমাদের মাঝে পাওয়াটাই ঈদের আনন্দ আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সে যাই হোক, ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরেই দেখি আমাদের খালাতো ভাই অর্ণব বাসায় এসেছে। ভাইয়া ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই সে এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বললো, ‘ভাইয়া, আমার সালামি কই?’ ভাইয়া তখন মুচকি হেসে মানিব্যাগ বের করলো। হঠাৎ আম্মা ডাকায় আমি ভেতরে চলে গেলাম।
কিন্তু ঠিক তখনই আবার ভাইয়া ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করলো আমার কাছে কোনো পাঁচ শ’ টাকার নোট আছে কিনা। আমি মজা করে বললাম, ‘আমেরিকান লেকচারার সাহেবের কাছে পাঁচ শ’ টাকাও থাকে না?’ ভাইয়া গলার স্বর চেপে বললো, ‘আরে, আমার কাছে পাঁচ শ’র ছোট-বড় অনেক নোটই আছে। কিন্তু আমি ওকে পাঁচ শ’ টাকার নোটই দেবো।’
পাঁচ শ’ টাকার নোটই কেন হতে হবে- যেই জিজ্ঞেস করতে যাবো, ঠিক তখনই আমার বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। ভাইয়া এখন যেই ঘটনাটার কথা ভাবছে, তা আজ থেকে বছর সাতেক আগের।
দিনটি ছিলো বুধবার। ভাইয়া তখন কলেজে পড়ে। আমি তখন একটা ইংরেজি প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করছিলাম। ভাইয়া শীস দিতে দিতে রুমে ঢুকে বললো, ‘আমার টাকা নিয়ে কষ্ট শেষ।’ আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন খুব একটা ভালো ছিলো না। ভাইয়া বাবার কাছে হাত খরচের টাকা চাইলে সব সময় প্রয়োজন মতো পেতো না। আমি বই থেকে মুখ তুলে বললাম- ‘ব্যাপারটা কী?’ ভাইয়া ছোট একটা লাফ দিয়ে বললো, ‘আদিল, তুই বিশ্বাস করতে পারছিস? আমি একটা টিউশনি পেয়ে গেছি।’ আমি বললাম, ‘সত্যি? কাকে? কিভাবে? বেতন কত?’ ও তখন একটা ভাব ধরে চেয়ারে বসে বললো, ‘বেতন খারাপ না। পাঁচ শ’ টাকা। পড়াবো অর্ণবকে। তার সামনে পরীক্ষা তো, এই সামনের একটা মাসই পড়াতে বলেছেন।’
অর্ণব শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। খালার সাথে আমাদের কেমন যেন একটা দূরত্ব আছে। খালামণি যেন আমাদের ঠিক পছন্দ করেন না। তাদের বেশ টাকা-পয়সা তো, আমাদের পারতে এড়িয়ে চলেন। এরই মধ্যে খালার ছোট ছেলেকে পাঁচ শ’ টাকা বেতনে পড়ানোর অফারটা কেমন যেন অবাস্তব ঠেকছে।
তা যাই হোক, প্রথম যে দিন টিউশনিতে যাবে, সেদিন ভাইয়া আমাকে বললো, ‘দোয়া রাখিস।’ সে এর আগে কখনো আমার কাছে এভাবে দোয়া চায়নি। যাওয়ার আগে সে গোসল করলো, তারপর নারকেল তেল দিয়ে চুল জুবজুব করে আঁচড়ালো। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আমাকে বললো, ‘কিরে? সুন্দর লাগছে না?’ আমি কোনো মতে হাসি চেপে বললাম, ‘একদম হিরো লাগছে দেখতে।’ ভাইয়া আমার কথার ওপর ভরসা করে কাঠফাটা রোদে এক শিক ভাঙা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সে ফিরে আসতেই আমি গিয়ে ধরলাম। ‘কী অবস্থা?’ জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘চিনি ছাড়া চা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আর মাঝে মাঝে দু’একটা বাসি খাবার খেলে খুব একটা ক্ষতি হবে না, তাই না?’
ওই একটা মাস সে খালি পরিকল্পনা করতো। কোনোভাবেই পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে তার সব শখের বাজেট মেলাতে পারতো না। কখনো কখনো বলতো, ‘টিউশনিটা আরো দু’এক মাস বেশি থাকলে সব খরচই কুলিয়ে যেত। একটু ভালো করে পড়ালে নিশ্চয়ই পরীক্ষার পর আবার ডাকবে।’ প্রথম যে দিন বেতন পাওয়ার জন্য যাবে, সেদিন আমার কাছে ওয়াদা করে গেল, ফেরার পথে আমার জন্য এক শ’ টাকা দিয়ে একটা ঘড়ি কিনে আনবে। কিন্তু যখন সে ফিরে এলো, তখন তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, খালা বলেছেনত- ‘তোর আম্মার কাছে আমি পাঁচ শ’ টাকা পাই। ওটা না হয় আর দিতে হবে না।’ বাসায় ফিরে ভাইয়া বালিশে মুখ চেপে খানিকক্ষণ কেঁদেছিলো। আম্মার কাছে বললে আম্মা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন- ‘কী জানি কী, হতে পারে।’
‘কিরে? থাকলে দে।’ ভাইয়ার কণ্ঠে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম। মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচ শ’ টাকার নোট বের করে ভাইয়ার হাতে দিয়ে তার সাথে সাথে ড্রয়িং রুমে গেলাম। ভাইয়া অর্ণবের হাতে টাকাটা দিতেই সে লুফে নিয়ে পকেটে রেখে দিলো। পাচ শ’ টাকার নোট সালামি পেয়ে তার চোখ চকচক করতে দেখলাম আমি।

Share.

মন্তব্য করুন