লোকটা এলো সন্ধ্যার খানিক আগে। সে সাহায্য তুলছে এ-গ্রাম ও-গ্রাম। মেয়ের বিয়ে। পাঁচ নম্বর মেয়ের। প্রথম চারটির বিয়েতেও এভাবেই সাহায্য তুলেছিল বিভিন্ন গ্রামে। লোকটির বাড়ি বেলনা। কামারগাঁ কাচারি পার হলেই শিব নদী। শিব নদীর ওপারে বেলনা গ্রাম। নদীর এপারের মানুষের সাথে বেলনা গ্রামের অন্য এক বুড়োর বেশ সখ্য ছিল। লোকটার নাম বোধ হয় কেউ জানত না। সবাই বেলনার বুড়ো বলেই ডাকত। বাঁকা কোমরের বুড়ো। মাটির হাঁড়ি-পাতিলের ভার কাঁধে নিয়ে, রাস্তার ধুলো ঘেঁটে ঠুকঠুক করে গ্রামে গ্রামে ঘুরতো বুড়ো। পা খুব একটা তুলতে পারত না; ধুলোর মধ্যেই ডুবে থাকত পা। হাঁড়ি-পাতিলের ভারেই হোক আর বয়সের ভারেই হোক, বুড়োকে যথেষ্ট কুঁজো দেখাত। তাকে দেখলেই সবার একটা মায়া হতো। ডেকে খাওয়াত। বসতে দিত। এমনও নজির আছে যে, প্রয়োজন না থাকলেও তার ভার কমাবার জন্যই কোন একজন কয়েকটা পাতিল বা রুটি সেঁকবার খোলা কিনে নিতো। আর গালি দিতো বুড়োর ছেলেদের। কেন বুড়ো বাপটাকে খাটায়।
তবে কন্যাদায়গ্রস্ত বুড়োর ওপর অতটা সদয় নয় এলাকার মানুষ। অনেকে অসন্তুষ্ট তার ওপর। মেয়ে তার বাড়তেই আছে। এ বছর এক মেয়ের বিয়ে হলো তো পরের বছর অন্য মেয়ের বিয়ে। এখন কেউ দেয় কেউ দেয় না। কেউ আবার বাঁকা কথাও শোনায়। শুধু গ্রামের বাড়ি নয়, বুড়ো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যায়। এখন কোন বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয় আবার কেউ দেয় না। ছাত্ররা আগে যারা পাঁচ টাকা দিত, এখন তারা দেয় দুই টাকা। আবার কেউ দেয় না।
এখন বুড়ো গ্রামের মধ্যে। পাড়িশো গ্রাম। এখন সে রাফিদের বাহির উঠোনে। ধানের মৌসুম। কাঁধে ভার নিয়ে দাঁড়ানো। ভারের দুই পাশের ডালিতে ধান আছে। একটা ব্যাগে চালও আছে। অর্থাৎ যে যা সাহায্য হিসাবে দেয়, বুড়োর নিতে কোন আপত্তি নেই। লোকটা এখন রাফিদের বাড়িতে। সন্ধ্যার খানিক আগে এলো। তবে কোন সাহায্য চাইল না। সরাসরি সে রাফির আব্বাকে বলল- বাবা আজকে রাতটা তোমাদের বাড়িতে একটু থাকতে দাও। রাতে আর কোথায় যাবো। দুটো ভাত দিলে, খেয়ে বাহির বারান্দায় থেকে যাবো বাপ। রাফির আব্বার দয়ার শরীর। কোন আপত্তি না তুলে রাজি হয়ে গেল। যদিও তার মা কিছুটা রাগ দেখাল, কিন্তু লাভ হলো না।
লোকটার থাকবার জায়গা হলো বৈঠকখানায়। বৈঠকখানা খৈয়লানের অর্থাৎ বাহির উঠোনের এক কোনায়। এই খৈয়লানে ধান, সরিষা, গম ইত্যাদি মাড়াই হয়। বৈঠক-ঘরের দু’ধারে বড় বড় দু’টি খড়ের গাদা। খড়ের গাদাকে দূর থেকে বাড়ির মত মনে হয়। রাফি লোকটাকে আগে থেকেই চেনে। সকালেও কথা হয়েছে। রাফির স্কুলে আজকে লোকটা গিয়েছিল। রাফি পাঁচ টাকা দিয়েছে। বুড়োকে থাকবার ব্যবস্থা করে দিলো রাফি নিজেই। ঘর খুলে চৌকিতে বিছানা পেড়ে দিলো। বুড়ো অনেক দোয়া করল রাফির জন্য। দোয়ার উপসংহারে বলল- দাদু তোমার বিয়েতে কিন্তু বলো, আমি নাতবউকে আশীর্বাদ করে যাবো। পেটভরে খাবো। সুন্দর একটা উপহারও দেবো দাদু। রাফি তখন কোন কথা বলল না। মনে মনে হাসল।
একটা কথাও মনে পড়ল রাফির। ঠিক এমনই একটা কথা অনেক দিন আগে বলেছিল দু’জন অচেনা মানুষ। কালো কুচকুচে আর লম্বা মানুষ। কালো মানুষের দাঁত অন্তত সাদা হয়। লোক দুটোর দাঁতও কালো ছিল। সামনের দাঁতগুলোর মাঝ বরাবর গর্ত। হাসলে কেমন বিচ্ছিরি লাগে। তারা বলেছিল এমন কথা। তবে বলেছিল আরও আজব কথা। তারা নাকি ডোম। কোন এক ধনী সাঁওতালের একপাল শূকর চরাতে এসেছিল তারা। রাফিরা বলত কালো খাসি। প্রায় একশ খাসি। খাসিগুলো নিয়ে রাফিদের বাড়ির পাশে তারা আস্তানা গেড়েছিল। যেমন ছিল ইয়া বড় বড়, তেমনি আবার ছিল ছোট ছোটও। অনেকের বাচ্চাও হয়েছিল। কারো পাঁচটা, কারো ছয়টা। একটার হয়েছিল আটটা। খাসি চরানো লোকদের সাথে এক সময় খুব ভাব হয়েছিল রাফির। ভাব করেছিল একটা বিশেষ মতলবে।
চেনু কবিরাজের কাছে শুনেছিল, শুয়র চরানো লাঠি যদি চুরি করে বাড়িতে রাখা যায়, তবে তার বাড়িতে নাকি অনেক কবুতর হয়। বাহির থেকে কোনো কবুতর একবার বেড়াতে এলে আর ফিরে যায় না। রাফি দু’বেলাই যেত লোক দুটোর কাছে। দাদির চুনের খুঁটি থেকে মাঝে মাঝে চুন নিয়ে গিয়ে তাদের দিতো। তারা তামাক পাতা চুন দিয়ে হাতের তালুতে ডলে ডলে খায়। অবশ্য তামাক পাতাকে তারা আওলা পাতা বলে। নিয়মিত চুন দেবার কারণে তারা রাফিকে বন্ধু বলে ডাকত। আর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বলেছিল- এই বন্ধু, তুর বিহাতে হামাদের বুলিস। বড় বড় দুইটা খাস্সি দিয়া খানা খাবোহিনি। বুলিস কিন্তুক। কালো দাঁতগুলো মাড়িসুদ্ধ বের করে হেসেছিল দু’জনেই। রাফি লজ্জা পেয়ে পালিয়ে আসে। সে তখনও জানত না, শুয়োরের মাংস হারাম। অবশ্য পরে সবাই ঘটনাটা জানতে পারাতে অনেকদিন ভুগতে হয়েছিল তাকে। রাগাতে কেউ কমতি রাখেনি।
আজ দীর্ঘদিন পর এমন কথা আবার বলল আজকের এই বুড়ো। সাহায্য তোলা বুড়ো। বুড়ো রাফির পিঠে হাত বুলিয়ে আবার বলল- কী দাদু কিছু বলছ না যে? রাফি কিছুটা চমকে উঠে বর্তমানে আসে।
– কী আর বলব, তোমার মেয়েদের বিয়ে আগে শেষ কর। পরে না হয় অন্যের বিয়ের দাওয়াত খেও।
– তা ঠিকই বলেছ ভাই। কী আর বলব বল, একটা ছেলে নেব নেব করে এতগুলো মেয়ে হয়ে গেল। আমার বুড়ির নাড়িতে ছেলে নাই যে। তাআমি কী করব বল?
– তা দাদু বুড়ির নাড়িতে নাই, নাকি তোমার নাড়িতে নাই। রাফি মুচকি মেরে হাসলেও বুড়ো হোহো করে হেসে উঠল।
– আচ্ছা দাদু তোমার কতগুলো মেয়ে?
– তা অনেকগুলোরে ভাই! বুড়ো এমনভাবে কথাগুলো বলল আর নিঃশ্বাস ফেলে বুকটা হালকা করবার চেষ্টা করল, যেন ইহ জন্মে মেয়েগুলোর বিয়ে দিয়ে শেষ করতে পারবে না।
– দাদু এটা কত নম্বর মেয়ে?
– এটা চার নম্বর মেয়ে রে ভাই। রাফি কিছুটা চমকে উঠল। খটকা লাগল মনে। এ খটকা চারটি মেয়ের জন্য নয়। চমকে উঠল অন্য কারণে। বুড়ো স্কুলে তো বলেছিল পাঁচ নম্বর মেয়ের কথা। এখন বলছে চার। তবে কি মানুষের কথাই ঠিক? অনেকে বলে এটা নাকি বুড়োর ব্যবসা। মেয়ের বিয়ের কথা বলে সে সাহায্য তোলে। ব্যবসা করে। রাফি প্রথমে কথাটা বিশ্বাস করেনি। সে বিশ্বাসই করতে পারেনি, মানুষ এমন মিথ্যা কথা বলে সাহায্য তুলতে পারে। এখন বিশ্বাস হলো। বিষয়টি বিশ্বাসে আনবার জন্য আরও কিছু যুক্তি নিজে থেকেই সামনে দাঁড় করালো। কিন্তু যুক্তি টিকে না। অবশেষে মনে মনে একটা ফন্দি আঁটল। বুড়োকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। আসল ঘটনাটা জানতে হবে। বুড়োর কাছ থেকে রাফি বিদায় নিলো। তবে বাড়িতে ঢুকলো না। দৌড়ে গেল রিফাতের কাছে। তাকে নিয়ে যেতে হবে জুনায়েদের কাছে।
রাফি, রিফাত আর জুনায়েদ তিন বন্ধু। পাশাপাশি বাড়ি। পড়েও একই ক্লাসে। তিনজনেই ঐ বুড়োকে চেনে। আজকে স্কুলে তারা টাকাও দিয়েছে। রাফির বুদ্ধিটা বাকি দু’জনের মনে বেশ ধরল। তিনজনেই হাত মিলালো। একটা শিক্ষা দিতেই হবে শালা বুড়োকে।
এশার আজান হলো। বুড়ো ওজু করছে। এমন সময় রাতের খাবার নিয়ে এলো রাফি। হারিকেনের ভলিউম কিছুটা বাড়িয়ে রাফি বলল- দাদু খেয়ে নাও।
– খাবো দাদু। নামাজটা একটু পড়ে নেই। তুমি একটু বস। রাফি চৌকিতে পা দুলিয়ে বসল। মনে মনে পাকানো ফন্দিগুলো বারবার আওড়াতে লাগল। আবার মনের মধ্যে খটকা লাগে, রিফাত-জুনায়েদ আসবে তো?
বুড়ো নামাজ শেষ করে দ্রুত উঠল না। কিছুক্ষণ তসবির দানাগুলো টিপল। খানিক পরে উঠে এসে তসবিটা রাফির মাথাতে রেখে অনেক দোয়া পড়ল। মঙ্গল কামনা করে তিনটা ফুঁ দিলো। লোকটার প্রতি কতকটা মায়া হলো রাফির। কিন্তু উপায় নেই, এরপরের ঘটনাগুলো ফাইনাল হয়ে গেছে। বুড়ো খেতে বসল। কাতলা মাছের পেটি। আছে কলমি শাক। বুড়ো দাঁতশূন্য গালে শব্দ ছাড়াই ঢেউ তুলে হাসল। কিন্তু এর ফাঁকে আর একটা বুদ্ধি খেলে গেল রাফির মাথায়। মূলপর্বে যাবার আগে একটু রগড়িয়ে নিবে বুড়োকে। একটা ভয় ধরিয়ে দিবে মনে।
– দাদু তোমাকে দেখে আমার একটা কথা মনে হলো।
– কী কথা দাদু। মাছের কাঁটা বাছাতেই বেশি মনোযোগ বুড়োর।
– তোমার মতই একটা দাদু এক বছর আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। সেও এই ঘরেই ছিল রাতের বেলা।
– ও আচ্ছা, আমিও আজকে আছি তার মতোই। তাই না দাদু।
– শুধু তাই নয় দাদু, সেদিন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনাও ঘটেছিল। সেই রাতে ঘুমের ঘোরে দাদুটার পরনের সব কাপড় হারিয়ে গেছিল।
– বল কি দাদু, এটা কি হয়? তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ, তাই না? বুড়ো হো হো করে হেসে উঠল।
– আমি কিন্তু ভয় পাবার বান্দা নই দাদু।
– সেই দাদুটাও তোমার মত এসেছিল সাহায্য তুলতে। তবে মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য নয়। সে এসেছিল বাঁশ ওঠাতে।
– বাঁশ ওঠাতে! এ আবার কেমন কথা।
– হ্যাঁ দাদু। তার নাকি বাড়ি পুড়ে গেছিল। কিছু অংশ পোড়া একটা বাঁশ কাঁধে নিয়ে আমাদের গ্রামে এসেছিল। সেই বাঁশটা নাকি তার ঘরের পোড়া বাঁশ। তা দেখিয়েই বাঁশঝাড়ওয়ালা বাড়িতে গিয়ে বাঁশ চাচ্ছিল। আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। তবে তোমার মতো সন্ধ্যেবেলা।
– এতো আজব কথা! আচ্ছা, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তার কাপড় উড়ে যাওয়ার সাথে এর কী সম্পর্ক?
– সে তো বলতে পারব না দাদু। তবে সকালে যখন দাদুটার জ্ঞান ফিরে এলো কেঁদেকেটে অনেক কথাই বলেছিল। বলেছিল তার ঘর পোড়ার গল্পটা মিথ্যা। এই পোড়া বাঁশটা সে চুলাতে দিয়ে পুড়িয়েছে। এটা তার একটা ফন্দি। বুড়ো যেন চমকে উঠল। মুখে ভাত দিলো ঠিকই কিন্তু চিবাতে পারল না। চাবলটা আটকে গেল।
– বলো কি দাদু, এটাতো আরও আজব কথা! মানুষ এমনটা করতে পারে?
– পারেই তো। দাদু তুমি কি ভয় পাচ্ছ? তোমার আবার ভয় কি, তুমি তো ভালো মানুষ।
– না না, আমি ওসবে ভয় পাই না। আমি ভাবছি ঐ বুড়োটার কথা। বুড়ো কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবে বললেও থালার ভাত শেষ করতে পারল না। কিছু ভাত থাকতেই থালাতে পানি ঢেলে দিলো।
– কী দাদু, পানি ঢাললে যে। এত তাড়াতাড়ি পেট ভরে গেল।
– নারে ভাই অনেক খেয়েছি। আর ঢুকছে না। বুড়ো তৃপ্তির ঢেঁকুরটাও যেন তুলতে পারল না। ভুলে গেল গামছাতে হাত মুছতে। লুঙ্গিতেই হাত মুছল। রাফি থালা-বাটি গুছিয়ে বাড়িতে গেল।
আর বলে গেল ভালো করে দরজা দিয়ে ঘুমাতে।
বুড়ো ভালো করে দরজাতে খিল এঁটে দিলো। জানালা আটকাতে গিয়ে হুমড়ি খেল বুড়ো। জানালার একটা পাল্লা ভাঙা। তারপরেও যেটা আছে সেটাই ভালো করে ভিড়ালো। লুঙ্গিতে ভালো করে গিঁট দিলো। হারিকেন নিভালো না। কিছুটা খাটো করে পাশেই রাখল। তার জানা দোয়া কালেমার কোনটাই বাদ রাখল না। শোবার আগে ঘরের চারিদিকে আরও একবার দেখে নিলো। লেপটা গায়ে দিয়ে ঘুমাবার ভাণ করল বুড়ো। খুব আয়েশ করে খেয়েছে। পেট যথেষ্ট ভার। শোয়া মাত্রই ঘুম আসবার কথা; কিন্তু ঘুম আসে না। ভেতরে একটা বমিবমি ভাব। তার বারবার মনে হতে লাগল পোড়া বাঁশ দেখিয়ে সাহায্য তোলা লোকটার কথা। দু’জনার মধ্যে মিল খোঁজে বুড়ো। একজন দেখায় বাঁশ, অন্যজন দেখায় বিয়ে। একজন বলে বাড়ি পোড়ার কথা, অন্যজন বলে মেয়ের বিয়ের কথা।
রাত কিছুটা গভীর হলো। শীতের রাত একটু আগেই গভীর হয়। চারদিকে কুয়াশা। বাঁশের পাতা চুঁইয়ে চুঁইয়ে কুয়াশারা বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। এমন সময় একত্রিত হলো তিনজন। রাফি, রিফাত আর জুনায়েদ। রিফাত কথা মত বড় বড়শিওয়ালা একটা লম্বা ছিপ এনেছে। আরও একবার শলা-পরামর্শ করে নিলো তিনজন। খেলতে নামবার আগে খেলোয়াড়রা যেভাবে মাথাগুলো এক করে পরিকল্পনা ফাঁদে, ঠিক সেইভাবে পরিকল্পনাগুলো আরও একবার ঝালিয়ে নিলো।
এবার খেলার মূলপর্বে নামবার পালা। তিনজনে এলো বৈঠকঘরের জানালার কাছে। এক পাল্লা ভাঙা জানালার কাছে। হারিকেনের আলো টিমটিমে হলেও দেখা যায় বুড়োকে। শোয়া অবস্থায় বুড়োকে বেশ লম্বা দেখাচ্ছে। লেপ দিয়ে মুখ ঢাকা। মশার হাত থেকে বাঁচবার ফন্দি এটা। কিংবা ভয়ের হাত থেকে। চার না দিয়েই ছিপ ফেলল রাফি। পুকুরে নয়।
বৈঠক ঘরে। ভাঙা জানালা দিয়ে আলতো করে ছিপটা ঢুকিয়ে দিলো। বড়শি ফেলল বুড়োর পায়ের কাছে। না, পায়ে বিঁধাল না। বড়শি বিঁধাল লেপের ওয়াড়ে। রাফি কায়দা করে ছিপের গোড়া ধরে টান দিলো। আস্তে আস্তে সুড়সুড় করে। লেপটা ক্রমশ বুড়োর মাথার দিক থেকে পায়ের দিকে নেমে আসছে। বুড়ো বোধ হয় ভালো করে তখনো ঘুমায়নি। তবে চোখে ঘুমের আঠালো ভাব আছে। সেই আড়ষ্ট চোখেই সামনের দিকে তাকালো। কিছু দেখতে পেল না। এবার ডানে বামে তাকালো। না তবুও কিছু দেখতে পেল না। লেপটা এবার হাত দিয়ে চেপে ধরল। কিন্তু তার হাত থেকে লেপটা জোর করে সরে যেতে চায়। এবার সমস্ত শক্তি দিয়ে মাথাটা একবার তুলল। লেপটা তখন কোমরের কাছাকাছি। বুড়ো এবার স্পষ্ট দেখতে পেল, জানালার ওপারে কে যেন দাঁড়িয়ে। ঘন কুয়াশার সাথে মিশে গেছে সে। মনে হলো সাদা কাপড় পরা ভূত। ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল বুড়ো। তবে এ কাঁপন শীতের কারণে নয়, ভয়ের কাঁপন। ভূতের ভয়, জিনের ভয়, মানুষকে মিথ্যে বলে ঠকানোর ভয়। চিল্লিয়ে কী যেন বলতে চাইল বুড়ো; পারল না। কথাগুলো গলার কাছে এসে গুলটি গুলটি হয়ে আটকে গেল। বাসি ধুপিপিঠা দ্রুত খেতে গেলে যেভাবে আটকায়; ঠিক সেভাবে আটকালো। তবুও শরীরের সমস্ত শক্তি মিশিয়ে ভাঙা গলায় বলল- কে বা..বা ও..খানে?
প্রস্তুত ছিল রিফাত। সে নাক চেপে কেমন একটা ন্যাকা ন্যাকা কথা বলতে পারে। অন্ধকারে হলে ভূত ভেবে মানুষ নির্ঘাত ভয় পাবে। আর এমন অবস্থায় বুড়ো বিছানা ভিজাতেও পারে। রিফাত সেই একই ঢঙে শেখানো কথাগুলো বলতে লাগল- আঁমরা গোঁ, সাঁহায্য নিঁবে না টুঁমি।
– না বাপ আ-আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আ-আর কক্খনো আসব না। বুড়ো লেপ ছেড়ে এবার লুঙ্গির খুঁট খামচে ধরে। লেপ গেল, এবার হয়তো লুঙ্গির পালা।
– কেঁনো গোঁ পাঁচ নঁম্বর মেয়ের বিঁয়ে দিঁবে না।
– না আ-আব্বা, আ-আমার কোন মেয়ে নাই। আর কক্খনো মিথ্যা বলে সা- সাহায্য তু-তু তুলব না। এবারের মত ছে ছে ছেড়ে দাও।
– তাঁ বঁললে তোঁ হঁবে না। তোঁর দঁশ নঁম্বর মেয়েরও বিঁয়ে দিঁব।
– আ-আব্বা আ-আর আসব না বা-আপ। আল্লার কসম, আ-আর ভুলেও আ-আসব না।
– তাঁই বঁললে কিঁ হঁয়। হিঁ হিঁ হিঁ…..। এই হাসিটা তিনজনেই নাক ধরে হাসল। রাফি, রিফাত আর জুনায়েদ।
– ছে-ছে ছেড়ে দাও। মা বা-বাবা.. না না না না…..। বুড়ো আর চিল্লাতে পারল না। থেমে গেল বুড়োর সকল শব্দ। বুড়ো জ্ঞান হারালো। তবে ভয় পেল জানালার বাইরের তিনজন। তারা কোন রকমে লেপের কভার থেকে বড়শিটা ছাড়িয়ে নিয়ে যে যার বাড়ি পালালো।
খুব সকালে সবার আগে উঠেছে জুনায়েদ। সে বৈঠক ঘরে এসে দেখে দরজা খোলা। বুড়ো নেই। এরপর এলো রাফি। বুড়ো নেই। খানিক বাদে এলো রিফাত। বুড়ো নেই। তার সাহায্য তোলা ধান-চাল পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। তবে কাজের কাজ যেটা করেছে- বিছানা নষ্ট করেছে বুড়ো। এক এক করে বাড়ির সবাই এলো বৈঠকঘরের কাছে। রিফাতের মা রাগ ঝাড়ে স্বামীর ওপর।- নাও এখন বিছানা পরিষ্কার কর। দাতা হাতেম হলে। আমি বারবার নিষেধ করলাম। শুনলে না। দূর থেকে মিনি বিড়ালের মত হাসে রাফি, রিফাত আর জুনায়েদ। পাড়ার প্রায় অর্ধেক মানুষ জুটল সেখানে। সবার এক কথা, বুড়ো বিছানা নষ্ট করে সেই লজ্জাতেই ভোর রাতে পালিয়েছে। তবে পাশ থেকে ঘিওন বুড়ি জ্বলে উঠে বলল- এতদিন জানতাম, মানুষ বিছানাতে স্বপ্নে পেচ্ছাপ করে, পায়খানা করে শুনিনি। এটা ওই বুইড়ার শয়তানি ছাড়া কিচ্ছু নয়। অনেকেই অনেক কথা বলল। শুধু বলল না বাকি তিনজন। রাফি, রিফাত আর জুনায়েদ।
বুড়োকে নিয়ে এই গুঞ্জন চলল বেশ কিছুদিন। আবার একদিন মিলিয়েও গেল। তবে বুড়োকে এদিকে আর দেখা যায়নি কোনদিন।

Share.

মন্তব্য করুন