টুনটুনি! তোমাকে আজ একটি গল্প শোনাবো তুমি যদি শুনতে চাও তাহলেই তোমাকে বলব। শোনাওনা ভাইয়া। তোমার গল্প আমার খুবই ভালো লাগে। তাহলে শোন- তখন আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। দুদিন আগ থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। রাত ৮টা। ভারত-পাকিস্তানের একদিনের ওয়ান্ডে ম্যাচ চলছিল। গ্রামের বাজারে ছোট্ট একটি টিনের দোকানে বিশ জনের সাথে আমিও খেলা দেখছিলাম। ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর ব্যাটিংয়ে আফ্রিদি নেমেছেন। বলার বল করবেন আমরা তাকিয়ে আফ্রিদির চার-ছক্কার ফুলঝুরি দেখার জন্য। হঠাৎ আমাদের মাথার ওপর থেকে টিনের চাল উড়ে গেলে সবাই বিস্মিত! হইচই চারিদিক। বাতাসের প্রচণ্ড শনশন শব্দ। দোকানঘর নড়ছিল। আমার চারপাশ থেকে সবাই ছুটছে তো ছুটছে সাথে আমিও। কেউ কাউকে হাতের নাগাল পাচ্ছে না। বিদ্যুৎও চলে গেছে ঝড়ের ভয়ে!
প্রচণ্ড অন্ধকার কিছুই দেখা যায় না। বাতাসের এত বেশি চাপ ছিল যার কারণে কেউ পেছনে যাবার তো দূরের কথা পেছনে তাকাতেও পারছে না। মনে হলো সুপারম্যানের মত বাতাসে উড়ছি! কার টর্চ লাইটের বদৌলতে দেখতে পেলাম বাজার সংলগড়ব পুকুরপাড়ের বিশাল নারিকেল গাছটা নুয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম। বাজারের পাশেই ছিল সরকারি প্রাইমারি স্কুল। কেউ যেন জোরে হাঁক মেরে ওদিকে যাবার জন্য ডাকছে। কোন দিশামিশা না পেয়ে ওদিকেই গেলাম। দেখতে পেলাম গ্রামের আশপাশের লোকজন এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কান্নাকাটি করছে, কেউ জোরেশোরে দরুদ পড়ছে, কেউ মানত করছে, কেউবা শেষ বারের মত চিরস্থায়ী খোদার দরবারে পানাহ্ চাচ্ছে। শিশু-বয়স্ক লোকগুলো শীতে কাঁপছে।
স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি বাজারের দোকানগুলোর টিন খুলে উড়ে এসে পড়ছে, কোথা থেকে বড় বড় ডালপালা উড়ে এসে স্কুলের সামনে পড়তে দেখছি! বাতাসের এমন বেগ এ জনমে কখনো দেখা হয়নি। আল্লাহ্-বিল্লাহ করতে করতে রাত ১২টা। বাতাসের বেগ কমে যায়। শীতের প্রকোপে আমি ও আমার বন্ধু মাসুম সিদ্ধান্ত নিলাম শীত থেকে বাঁচার জন্য পাশের কোন বাড়ি থেকে কাঁথা-কম্বল নিয়ে আসার। তাই দু’জনে স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাজারের উত্তর-পশ্চিম পাশে বিলাল ভাইয়ের বাড়ি থেকে কাঁথা নিয়ে আসার সময় মাসুমের মোবাইলের লাইটের আলোতে রাস্তার পাশে অনেক বিস্কুটের প্যাকেটের ওপর নজর পড়ে। বিস্কুটগুলো ছিল ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়া বেহাল ভাইয়ের দোকানের।
মাসুম কয়েকটি প্যাকেট হাতে তুলে নিলো। আমি বললাম অপরের বিস্কুট কেন তুমি তুলেছো। বন্ধু জবাব দিল-আমরা খাবো। সুযোগ একটা পেয়েছি। ধর তুইও ল। বিস্কুট দেখে আমার পেটের ক্ষুধাও জেগে উঠল। আমরা দু’জনে ওখানে দাঁড়িয়ে কয়েক প্যাকেট খাবার পর বাকি প্যাকেটগুলো নিয়ে নিলাম। বাকি রাতটা স্কুলেই কাটিয়ে দিলাম কাঁথার ভেতর। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলাম গ্রাম আগের মত নেই। বাজারের প্রায় সকল দোকান ভেঙে মাটিতে শুয়ে আছে। হঠাৎ আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে। তাই সেদিকে রওয়ানা হই।
কিন্তু রাস্তা! এ কী অবস্থা, দুই পাশের মাঝারি-বড় সেগুন, অর্জুন, বাবলা, মেহগনি, চাম্বল সব এলোমেলোভাবে ভেঙে-উপড়ে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে। ধানক্ষেতের অবস্থা করুণ। ভেঙে উপড়ে শুয়ে পড়া গাছগুলোর কারণে সামনে এগিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য।
অবশেষে আমার বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। আমার বাড়িতে পাঁচটি কাঠের ঘর ছিল, চারটি ঘরই মাটির সাথে মিশে যায়। আমার মনে ভয় ঢুকল বাড়ির লোকজন কোথায়? অবশিষ্ট ঘরটি ছিল বড় কাকার। সেটি একটু বেশি মজবুত হওয়ায় ক্ষতি একটু কম হয়েছে। ও ঘরটাতেই দাদা-দাদী, শিশুদেরকে দেখতে পেলাম। ছোট কাকার মাথায় রাতে একটি সুপারিগাছ ভেঙে পড়ায় বেশ খানিকটা আহত হয়েছেন। ঝড় শুরু হওয়ার কারণে আশপাশে আশ্রয়স্থল না থাকায় তাদের সারা রাত ভীষণ ভয়ে কাটে। সৌন্দর্যমুগ্ধ বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখি বিশাল বড় বড় গাছের কোনটার মাথা নেই, কোনটার মাঝ বরারব ভেঙে গেছে, অধিকাংশ গাছ উপড়ে পড়ে আছে, সুপারিগাছগুলো বাঁকা হয়ে আছে। বাগানের বিভিন্ন রকমের ফল ঝড়ে নিচে পড়ে আছে।
চিন্তা করার বিষয়- যে গাছগুলোকে দু’চারশ লোকে বল প্রয়োগেও মাটির সাথে মিশাতে পারবে না সেই গাছগুলোকে ঝড় মুহূর্তের ভেতর তছনছ করে দিল! কত ক্ষমতা সেই হুকুমদাতার যার হুকুমে সেকেন্ডের ভেতর পৃথিবীর সব নত হয়ে যায়!
বিকালবেলা বাজারে গিয়ে শুনতে পেলাম বহুত লোক মারা গিয়েছে আশপাশ ইউনিয়নগুলোতে। কারো লাশ নদীর তীরে, কারো লাশ ধানক্ষেত, কারো লাশ বাগানের ডালের সাথে ঝুলছে।
অসংখ্য পশু-পাখি মারা গেছে। মৃত মানুষের আত্মীয় স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে যায়। চারদিকে হাহাকার। গাছের ডালপালা পড়ে পুকুর খাল বিলের পানি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। খাবারের সঙ্কট দেখা দেয়। যেসব এলাকায ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে সেইসব এলাকার যুবকরা বস্ত্র-চাল ডাল কালেকশন করে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে। কোন ত্রাণকর্মীরা ঐ এলাকাগুলোতে গেলে সকল বয়সের মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ছুটে আসে একবেলা খাবার নেয়ার জন্য। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো খাবারের অভাবে পরস্পর স্বার্থপর হয়ে যায়।
বিভিন্ন এনজিও ত্রাণ দিতে এলে তারা এলাকার মেম্বার- চেয়্যারম্যানদের কাছে দায়িত্ব দেয় ত্রাণের। দুঃখের বিষয় হলো, যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় তারা অধিকাংশ ত্রাণ আত্মসাৎ করে। এনজিওগুলো দুর্গত মানুষদের জন্য টাকা, ঘর, চাল ডাল, গম, ছোলা, কম্বল, গরু-ছাগল দান করলেও সরকারি কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করে নেয়।
মানুষের করুণ অবস্থার সময়ও অসৎ লোকদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় না, তা আগে জানা ছিল না। কিরে টুনটুনি, তোমার চোখে পানি! ভাইয়া তোমার গল্প শুনে মনটা হু হু করে উঠল। তারা বিপদে পাশে না দাঁড়িয়ে দুঃখী মানুষদের সাথে এমন করল!
শোন টুনটুনি – তখন থেকে নিজের মাঝে একটি স্বপ্ন লালন করছি, বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবো। এই অসহায় লোকগুলোর মুখে হাসি ফোটাবো। আর অসৎ মানুষগুলোকে দেশছাড়া করব। কিন্তু টুনটুনি, একটা কাজ আমার সবসময় ভীষণ নাড়া দেয়।
কি সেটা ভাইয়া?
আমার অপরাধের। সেই বেহাল ভাইয়ের ভেঙে পড়া দোকানের বিস্কুটের ঘটনা।

Share.

মন্তব্য করুন