ইনকা শব্দটি আমাদের মনে এক ধরনের আগ্রহের সৃষ্টি করে। ইনকা শব্দের মানে হলো অজস্র সোনার অলংকার, তীর, ধনুক, বর্ষা হাতে সারা শরীরে উল্কি পরাবিশাল দেহী তেজী পুরুষ যারা নাকি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও অগ্রসর ছিলো। নানা মায়াকাহিনী প্রচলিত রয়েছে ইনকাদের নিয়ে। বাস্তব কল্পনা মিশিয়ে কত না তত্ত্ব, কত ব্যাখ্যা। আমরা কম বেশি সবাই এই রহস্যময় সভ্যতার নাম শুনেছি।
ইনকা সভ্যতা মাচুপিচু
ধারণা করা হয়,আমেরিকার অন্যান্য জাতির লোকদের মত বেরিং প্রণালী পার হয়ে এশিয়া থেকে আমেরিকা মহাদেশে আসে।
এই বেরিং প্রণালী যখন বরফে জমাট বেধে ছিলো তখন তারা এখানে আগমন করে। আনুমানিক ১০ হাজার বছর আগে এটা
ঘটেছিলো। কালক্রমে এই জাতি নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পরে এবং এরা আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন ইকুয়েডর,
পেরু, বলিভিয়া, উত্তর পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়া বসতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্থাপন করে যার উদাহরণ আমরা আজো অবলোকন করি।
এরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই, যেমন যুদ্ধে জয়ী হয়। এই সকল যুদ্ধের সূত্রে এদের ভিতরের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা সমাজে সম্মানিত এবং ক্ষমতাধর হয়ে উঠে আর এই সকল যোদ্ধারা সমাজের শাসক হত। যে সমাজের শাসক হয় বীর সেই সমাজ বা জাতীগত যুদ্ধবাজ হবেই এবং হয়েছিলোও বটে। এরপর এই সকল যোদ্ধাদের সমর্থনে কেন্দ্রীয় নেতার উদ্ভব হয়েছিল যা আধুনিক সময়ে আমরা রাষ্ট্রগত চিন্তা বলি। ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এই ব্যক্তি ‘কাপাক’ নামে অভিহিত হতে থাকে। এবং মানুষকেন্দ্রিয় সরকার বা বস্থার সাথে অভ্যস্ত হয়ে পরে এবং এর উপকারিতাও বুঝতে পারে।
ইনকাদের ভাষায় ‘কাপাক’ শব্দের অর্থ শাসক। যেমন আমরা মনে করি ফিরাউন মানে একটি ব্যক্তির নাম। মূলত ফিরাউন মানে রাষ্ট্রপতি যা শাসক। এই কেন্দ্রিক সরকারের অধীনে ধীরে ধীরে এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে এদের বসবাসের এলাকা বৃদ্ধি পায় যা পুরো ল্যাটিন আমেরিকা এমন কি উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এই সময় অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পরে এবং ক্রমেই আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।
ইনকা সভ্যতা
অবাক করা ব্যাপার হল ১১০০-১২০০ সালের দিকে এই ইনকাদের একটি ছোটো দল দক্ষিণ আমেরিকার অন্দিজ পর্বতমালার উচ্চভূমির দিকে চলে আসে এবং বসতি স্থাপন করে। ন্যাটিভ বাসিন্দাদের নামানুসারে এদেরকে বলা হয় কেচুয়া জাতি। ইনকারা এই অঞ্চলে জঙ্গল কেটে কৃষিভূমি নিজেরাই তৈরি করে এবং চাষাবাদ করতে থাকে। এদের অন্যতম ফসল ছিল ভুট্টা এবং আরো অন্যান্য ফসল। প্রাথমিক অবস্থায় এই জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে একটি রাজত্ব গড়ে তোলে। যা আস্তে আস্তে পুরো মহাদেশের আনাচে কানাচে আধিপত্য বিস্তার করে।
দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার এই পার্বত্য ভূভাগে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যে কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল তার মধ্যে এই ইনকারাই আধুনিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিলো। যদিও সম্মিলিতভাবে এসব সভ্যতাকেই মূলত আন্দীয সভ্যতা বলা হয়ে থাকে তবুও ইনকারাই হলো আধিপত্য বিস্তারকারী। এমন কি এরা সোনার পাত্রে খাবার খেতো। এরা যে বিলাসিতার জন্য এটা করত ব্যপারটা তা না। এটা করত কারণ সোনা ছিলো খুব সস্তা।
আজ আমরা ইনকাদের অবস্থানের নিদর্শন সরূপ আতাকামা মরুভূমি পর্যন্তবিস্তৃত এক বিশাল ভূভাগ পাই। এই সভ্যতাগুলির বিকাশ ও বিস্তৃতির সাক্ষ্য এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যায় এবং পাওয়া যায় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। বিশেষ করে আজকের পেরু ছিল এই প্রাচীন সভ্যতার বিকাশের মূলধারা।
ইনকাদের অবদান অনেক। ইনকারা মুদ্রা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। বাধানো রাস্তার ব্যবহার তারা শুরু করেছিলো। তারা খাদ্য প্রস্তুত এবং সংরক্ষণীয় বিদ্যায় পারদর্শী ছিলো। আর কৃষিতে ইনকারা অনেক অনেক উন্নতি করেছিলো। অন্যান্য সভত্যা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে এই ইনকারা অনেক উন্নতি করেছিলো। অন্যান্য সভ্যতা আরেক সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নতুন কিছু শিখেছিলো। কিন্তু এই সভ্যতা যা করেছিলো তা নিজেই নিজেই করেছিলো। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় ইনকারা কতটা মেধাবী এবং সৃজনশীল ছিল। তাই আজ এতটা বছর পরেও তাদের নিদর্শন আমাদের কাছে শিক্ষণের নতুন মাত্রা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।