মা বাবার একমাত্র আদরের ছেলে সিফাত। বাড়ির পাশের প্রাইমারি স্কুল থেকে সমাপনী পরীক্ষায় ৪.৩৫ পেয়ে সে এখন বাজারের পাশে হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় ১ কিলোমিটার পথ। অনেকগুলো রাস্তার মোড় ও দোকানপাট অতিক্রম করার মাধ্যমে তাকে স্কুলে যেতে হয় প্রতিদিন। রমজান মাস শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই সে দেখছে বিভিন্ন রঙের পতাকা উড়ছে। রাস্তার দ্বারে, দোকানপাটে, বাসা-বিল্ডিংয়ের ছাদে পতপত করে উড়ছেই তো উড়ছেই। আশপাশ বিল্ডিং আর রাস্তাঘাটের দেয়ালগুলো সুসজ্জিত হচ্ছে নানান রঙের পতাকায়। যতদিন যাচ্ছে বাড়ছে শুধু পতাকা লাগানোর উন্মাদনা। সিফাত কয়দিন থেকে এগুলো দেখছে আর ভাবছে হয়তো এবারের ঈদ আনন্দ এভাবে শুরু হবে। তার মনেও কেমন আনন্দ ভর করছে। কিন্তু এখনো সে সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না এগুলো কী! সবকিছু বাদ দিয়ে কে কার থেকে বেশি টাকা দিয়ে বড় পতাকা লাগাবে সেই প্রতিযোগিতায় নামছে।
এই রমজান মাসেও ধর্মকর্ম পালনে মুসলমানদের নাজেহাল অবস্থা! যুবসমাজের প্রায় অধিকাংশ এসব পতাকা লাগানোর কাজে ব্যস্ত। বিষয়টা সিফাতকে খুব ভাবনায় ফেলে দিল। তার মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো! কাকে জিজ্ঞাসা করলে এর কারণ জানা যাবে? এমন ভাবনাচিন্তার মধ্যে কেটে গেল পঁচিশটি রমজান। ঈদও ঘনিয়ে আসছে, এরই মধ্যে সিফাতের ঈদের জন্য নতুন নতুন জামাকাপড় কেনা শেষ। জুতা কেনা হয়নি। কারণ কাকা বলেছিল ঈদের জুতা তিনিই কিনে দিবেন। তাই ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে সিফাতের কোন চিন্তা নেই। হঠাৎ সিফাতের মনে হল পতাকা উড়ানোর বিষয়টি কাকাকে জানালে এর যথাযথ কারণ জানা যাবে! ঈদের জুতা আর কাকার অপেক্ষার প্রহর গুনছে সিফাত। বাবা-মা আর ছোট কাকা মাহমুদ ছাড়া সিফাতের আপন আর কেউ নেই। মাহমুদ কাকা মাদরাসা থেকে ফাজিল শেষ করে এখন কামিল (এমএ) পড়ছেন। পাশাপাশি একটি প্রাইভেট মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। ঈদের আগের রাতে মাহমুদ কাকা বাড়ি আসবে এই অপেক্ষায় সিফাতের রাতদিন কাটছে। দেখতে দেখতে ঈদ একেবারে সামনে এসে উপস্থিত। সন্ধ্যায় আকাশে নতুন চাঁদ দেখে অনেক খুশি সিফাত। রাত পোহালে ঘরে ঘরে ঈদের আমেজ বইতে শুরু করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইশার নামাজের আজান হবে। কিন্তু… মাহমুদ কাকা এখনো বাড়ি এসে পৌঁছালো না! কাকার অপেক্ষায় সিফাতের বাবা-মাও। আজানের ধ্বনির সাথে সিফাদের অপেক্ষার অবসান হলো। কাকাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সিফাতের মন আনন্দে নেচে উঠলো। তাকে সালাম দিয়ে বরণ করে নিলো সিফাত। তার বাবাও সামনে এসে প্রিয় ভাইয়ের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। সাথে বললেন কী হল মাহমুদ এত দেরি করেছো কেন? উত্তরে মাহমুদ বললেন রাস্তাঘাটের যে অবস্থা! জ্যাম থাকায় এত দেরি। তাই নাকি তোমার দেরি দেখে আমাদের চিন্তা হচ্ছিলো! বললেন সিফাতের বাবা। যাহোক দেরি হলেও সুন্দরভাবে বাড়ি আসতে পেরেছি সেই জন্য মহান আল্লাহ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আলহামদুলিল্লাহ… এই বলে পাশে থাকা ব্যাগ থেকে সবার আগে সিফাতের জুতা বের করলেন। খুব দামি ও ভালো মানের জুতা দেখে সিফাত তো মহা খুশি। ঈদ আনন্দের ষোল আনা পূর্ণ তার। মাহমুদ কাকা ফ্রেশ হয়ে এসে সিফাতকে নামাজের অজু করতে বললেন। একসাথে ইশার জামাতে শামিল হবে সেই জন্য। নামাজ পড়ে এসে একসাথে বসে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলেন সবাই। খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই মিলে বসে গল্প করতে শুরু করলেন। কাল কোথায় কোথায় যাওয়া যায়! সিফাত তখন বলে উঠলো কাকা আপনি কাল ঈদের দিন যেখানে যাবেন আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে হবে। মাহমুদ কাকা বললেন তাহলে চল সময় নষ্ট না করে এখনি ঘুমিয়ে পড়ি অনেক রাত হয়েছে। লাইট অফ করে সবাই ঘুমিয়ে গেলেন।
আসসালাতু খাইরুম্মিনাননাউম… মুয়াজ্জিনের মধুর ডাকে ঘুম ভাঙলো মাহমুদ কাকার। ওঠার সময় প্রিয় সিফাতকে ডেকে ঘুম থেকে উঠালেন। বললেন- উঠে গিয়ে অজু করে নাও, আমরা একসাথে ফজরের সালাত (নামাজ) পড়তে যাবো। দেরি না করে সিফাত নামাজের অজু করে নিল। একসাথে সবাই মসজিদের দিকে রওনা করলেন। নামাজ শেষ সবার আগে বাড়ি এসেই সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করলেন। আর ঘরে এসে নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি, জুতা পরে সবার আগে সেজেগুজে প্রস্তুতি নিলেন বাবা-চাচাদের সাথে ঈদের নামাজে যাওয়ার জন্য। নাস্তা পানি শেষে নির্ধারিত সময়ের আগে সবার সাথে ঈদগাহ-এর দিকে রওনা হলো সিফাত। হাঁটতে হাঁটতে প্রিয় মাহমুদ কাকাকে-
-এটাকি! ওটাকি? এমন নানান প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে।
চাচাও অনায়াসে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় পতপত করে উড়তে থাকা পতাকাগুলো দেখে সিফাতের মনের মধ্যে জমে থাকা সেই প্রশ্নটা (!) করে ফেললো মাহমুদ কাকাকে।
সিফাত বললো…আচ্ছা কাকা রমজানের আগে থেকেই দেখছি।রাস্তাঘাট, দোকানপাট, পাকা বাড়ির দেয়াল ও ছাদে বিভিন্ন রকমের পতাকায় ছেয়ে গেছে। আমাদের স্কুলের ছাদেও বড় বড় পতাকা লাগাতে দেখেছি! কিন্তু কেন? এই পতাকা উড়ানোর সাথে কি ঈদের কোন সম্পর্ক আছে?
– আরে না। পতাকা উড়ানোর সাথে ঈদের কোন সম্পর্ক থাকবে কেন। বললেন মাহমুদ কাকা। সিফাত বললো তাহলে এগুলো কেন লাগানো হয়েছে?
– শুন তাহলে.. এই মাস থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু। মানে ফুটবল খেলা। পৃথিবীত সবচেয়ে বড় ফুটবল টুর্নামেন্ট (আসর)। যা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাশিয়ায়। এই খেলা প্রতি ৪ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর সেরা ৩২টি দল অংশগ্রহণ করে একটি মাত্র ট্রফি (শিরোপার) জন্য। এক মাস ধরে চলতে থাকা এই খেলায় সর্বশেষ ম্যাচ যে দল জিতবে তারাই এই ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরবে। আর সেই দেশের নামের পাশে ৪ বছরের জন্য থাকবে শিরোপা জয়ের তকমা।
– সিফাত বললো তারপর…
আর এই বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করা প্রিয় দলকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য এই পতাকা উড়ানো হয়েছে। কেউ আর্জেন্টিনা, কেউ ব্রাজিল, কেউ আবার জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স ইত্যাদি দল সাপোর্ট করছে। তা প্রকাশ করছে পতাকা উড়ানোর মাধ্যমে। আবার নিজের প্রিয় ফুটবল প্লেয়ারদের অনুসরণ করছে তাদের দেশ ও নাম সংবলিত জার্সি গায়ে দিয়ে। তাদের মত হেয়ার কাটিং দিয়ে। যে যার অবস্থান থেকে তাদের প্রিয় দেশ ও খেলোয়াড়দের অনুসরণ করে যাচ্ছে। এটা ঈদ আমেজ নয়! বিশ্বকাপ ফুটবল উন্মাদনা।
– সিফাত বললো। এতে আমাদের লাভ কী?
– এতে আমাদের কোন লাভ নেই! আমরা যে তাদের সাপোর্ট করার জন্য এতকিছু করছি, বড়বড় পতাকা উড়াচ্ছি, জার্সি গায়ে দিচ্ছি, হেয়ার কাট করছি, তাদের অনুসরণ করছি এই খবর ওরা রাখেও না। আর বেশির ভাগ দল বা খেলোয়াড় বিধর্মী! মাহমুদ কাকার থেকে এসব শুনে নিস্তব্ধতার ঘোর কাটলো সিফাতের। বিস্ময়ের চাপ চোখেমুখে ফুটে উঠলো তার।
– মাহমুদ কাকা বললেন, আমাদের এসব খেলাধুলা থেকে শুধুমাত্র বিনোদন নেয়া উচিত। আর নিজেদের অবসর সময়ে ক্রিকেট, ফুটবল, দাবা, লুডু ইত্যাদি এই সমস্ত খেলাধুলা দেখা দরকার। তাহলে আমাদের মন মানসিকতার ভালো থাকবে। পড়ালেখায় মন বসবে। বাজে আড্ডা, খারাপ কাজ, বখাটে বন্ধু ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকতে পারবো।
– সিফাত মাহমুদ কাকার কথাগুলো খুব মনোযোগী হয়ে শুনছে।
– এসময় মাহমুদ কাকা বললেন, আচ্ছা তুমি কি জানো আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে অনুসরণ করার জন্য একজন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন?
– না তো! এমন কারো কথা আমার জানা নাই। কে তিনি? গভীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো সিফাত।
– মাহমুদ কাকা বলেন তিনি হলেন, মানবতার মুক্তির মহান দূত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহতায়ালা বলেন- “তোমাদের জন্য রাসূল (সা) এর অনুসরণে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আহজাব : ২১)
আর রাসূল (সা)-এর আদর্শ অনুসরণ করেই সাহাবীগণ হয়েছিলেন সোনার মানুষ। অর্জন করেছিলেন পৃথিবীতে থেকেই জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়ার মত বিরল সম্মান। অথচ আমরা অনুসরণ করছি তথাকথিত খেলোয়াড়দের। রাসূল (সা)-এরও ‘হেয়ার কাট’ ছিল। কিন্তু আমাদের তা জানা নেই হয়তো! আমরা যদি দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ে সফল হতে চাই! তাহলে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করার মাধ্যমে তার আদর্শে ফিরে যেতে হবে। তাই আমাদের উচিত রাসূল (সা)-এর জীবনকে গভীরভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমে তার নৈকট্য অর্জন করা। তাহলে আমরা উভয় জাহানে সফলকাম হব। বলতে বললে ঈদগাহ চলে আসলো। সিফাতের ঈদের খুশি আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল। কারণ আজ সে শ্রেষ্ঠ অনুসরণকারী ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছে। সাথে সাথে তার মনে জেগে উঠলো রাসূল (সা)-এর অনুসরণ করার শ্রেষ্ঠ অনুভূতি।

Share.

মন্তব্য করুন