গ্রামের হাট থেকে দুই ক্রোশ হেঁটে এসে ক্লান্ত দেহ নিয়ে লেপ্টে বসে পড়েছি বাবার গড়ে দেয়া শান্তির নীড় খড়ের কুঠিরের দরজায় থাকা দু’টি ইটের উপর। আমি বাবার শহুরে সন্তান, থাকি ইট পাথরের শহরে কোলাহল যার অলঙ্কার, দানবীয় আকৃতির গাড়ির কর্কশ বাঁশি, হাজার হাজার মানুষ যেন সব অচেনা মূর্তি। ভালোবাসা এখানে ক্রয়-বিক্রয় হয়।

এখন বসে ভাবছি আহা কি নির্মল সুবজ গ্রামের দোল খাওয়া গাছের বাতাস হৃদয় জুড়িয়ে দিচ্ছে, শহরের বাতাস নাকে আসতেই রুমাল দিয়ে মুখ ডাকতে হয়। সামনে বরই গাছ, এখন ফাগুন, বাচ্চারা বরই গাছে পাথর ছুঁড়ছে, বরই কুড়িয়ে পেয়ে যেন তারা অনন্ত খুশির মালিক, উঠনে নববধূ কাঁথা সেলাই করছে। শাড়ি কোমরে গুঁজে দিয়ে ঢেঁকিতে চাল ভাঙছে নাতবউ, মুখে রাজ্যের খুশি নিয়ে দাদিমা পান জর্দার গুনগান করছেন আর মুখ লাল করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছেন। বিশাল পাতাহীন কড়ইগাছ, মুকুলে ভরা হলদে আমের মুকুল, মেহগনির নতুন কচি পাতা, শুকনো পাতায় দাঁড়িয়ে আছে উটের গ্রীবার ন্যায় বিশাল নারকেল গাছ। কবুতরের পেখম তুলা বাকুম বাকুম ধ্বনি, দোয়েলের লাফালাফি এক ডাল থেকে অন্য ডাল, মুরগির মাথার লাল তাজের বাহারি মেলা, চার পাশে খেলছে শিশুরা।

ঘরের ছালার লাল মরীচিকা পড়া টিনগুলো পূর্ব পুরুষের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে দাঁড়িয়ে আছে, মাটির তৈরি দেয়ালের ছোট্ট ঘরগুলো যেন টানছে আমায়। গায়ে কাদা মাখিয়ে হাতে বালি নিয়ে শিশুরা ছুড়ছে একে অন্যের দিকে, বেয়ারিং এর গাড়ি, সুপারি পাতার দোলনা, কোমর বাঁকিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে মহাখুশিতে। পাশের বাড়িতে ভয়াল চিৎকার, ঝগড়া হচ্ছে ছাগলে পাতা খেয়েছে বলে, মা হাতে তুলে দিলেন একগ্লাস লেবুর শরবত, নোলকে মাকে বড্ড মায়াবী লাগছে। সন্ধ্যা নেমে এলে ক্লান্ত আর ফ্যাকাসে চেহারায় বাড়ি ফিরে বাড়ির কর্তা। বিকেলে মটরশুঁটির ক্ষেতে ঘুঘুর পাল আর বাবুই পাখির শিল্প তৈরির খড় সংগ্রহের প্রতিযোগিতা হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। আমি আমার গ্রামের কথা বলছি…..!

পাশের পুকুরে সাঁতার কাটছে চঞ্চল ছেলেগুলি, গাছের ওপর থেকে উল্টোমুখী লাফে প্যারাসুটের নিষ্প্রয়োজন বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমি ঘাম মুছছি। পাহারাদার বিশ্বস্ত কুকুরটি পাশে এসে বসেছে, আমি ভাবছি শহুরেদের চোখে অশিক্ষিত, অসামাজিক, অরুচিকর মানুষগুলোর অন্তহীন সুখের কথা। মায়ের হাসি, ভাইয়ের ভালোবাসা, বাবার শাসন, বোনের ঝগড়া, পরিবারের রাত জেগে গল্প করা পূর্ণিমার রাতে, দাদা দাদীর মুখে পুঁথি শুনা। মাঝরাতে বাঁশির হৃদয় ছোঁয়া সুর, বন্ধুরা মিলে বসন্তের আগমনে ফুলচুরি, পহেলা বৈশাখের মেলায় গিয়ে হরেকমাল কেনা, তীর ছুঁড়ে পাখি শিকার করা। বিশেষ দিনে মহিষের দুধের দই আর রসগোল্লা নিয়ে আসা কুটমদের মুখে এক চিলতে হাসি, পালকি করে নতুন বউয়ের শশুরবাড়ি যাত্রা, পুকুরে সদা হাঁসের মিলনমেলা। সকালবেলা দুষ্ট বালকের দল শাপলা তুলে এনে চড়ুইভাতি রান্না করে চার খুঁটির ছোট্ট দোকান দিয়ে ফুল বিক্রেতা সেজে মুচকি হেসে গুন গুন গান ধরে হাওয়ায়। তালের পাতার পাখায় বাতাস করছে খেটে আসা স্বামীর মাথায় লাজুক বউ, ভালোবাসার চাহনি, লাল মরিচের ভর্তা কর্মে শক্তি দেয় রাখাল চাষির দেহ মনে।

মনে রেখাপাত করছে সুন্দর সেসব ভালোবাসার অন্তহীন সুমিষ্ট রঙিন অনুভূতি। মুয়াজ্জিন আজান দিবে, মসজিদে গিয়ে নামায পড়ে এসে মুড়ি চিনির সুখ নিয়ে মক্তবে গিয়ে নূরানি পড়ে ফিরে আসে হাসিমুখে মায়ের কোলে। কপালে চুমো খেয়ে বাবজান ডেকে মুখভর্তি হাসি দেয় মা। মা যেন গ্রাম্যজীবন পরিবারের স্বর্গ। অথচ আমি বিদ্যাশ্রম বলে একটি শব্দ চিনি, যেটি গ্রামে অপরিচিত নয় কেবল বিস্ময়করও বটে। ভালোবাসা যেন এখানে প্রকৃতির দান। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে রোদ পোহাতাম পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের সাথে, ফুল কুড়াতে যেতাম বকুল তলায়। বর্ষায় কদম ফুল রাতের হাসনাহেনার ঘ্রাণ, সকালে গোলাপ সূর্যমুখী ফুলের কাননে গিয়ে সৌন্দর্য অবলোকন করা যেন নিয়মিত অভ্যাস আমাদের। রাস্তায় বালি কাদায় ভরা, হেঁটে চলি সবুজের পথ ধরে, ক্লান্তিহীন অনন্তে গিয়ে মিলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বিশাল আকাশের পানে ঘুড়ি ছেড়ে দিয়ে তার পিছু ধাওয়া করা আর নারকেল পাতার চশমা ঘড়ি বানিয়ে হ্যারিপটার সাজার মাঝেই যেন চিরন্তন সুখ।

বাবার সাথে কনিষ্ঠা আঙুলি ধরে আলো-আঁধারির সকালের শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে জিয়ারত আর তেলাওয়াত ছিলো ভালোবাসার নিয়মিত বহিঃপ্রকাশ। মায়ের আঁচল ধরে পিছু পিছু হেঁটে নানা বাহানা ধরে কত কিছু খেতে কাঁদতাম। আবার কখনো খুব ভোরে শীতের সকালে খেজুরের রস কলসি বা চুঙ্গির মুখ থেকে চুরি করে খেতে বন্ধুদের সাথে বাগান বাড়িতে যেতাম। এটি আমার গ্রামের অলঙ্কার, আমার গ্রাম মাতার ঐশ্বর্য, আমার সোনালি গ্রামের হাজার বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি।

নাম না জানা কত ফুল, সোনালি ধানের বিশাল সমারোহ, কোকিলের কুহুতান, ভাত ফুটানো ফেনার সুঘ্রাণ, বালকের চোখে বিশ্বজয়ের স্বন্ন, পল্লীবালার মুখে স্বর্গীয় হাসি। কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ, বাঁকা রাস্তার মুগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার প্রলেপ, প্রজাপতিদের স্বপ্ন কানন, গভীর রাতে হুতুম পেঁচার ভীতি-উদ্রেককারী ডাক যেন কেবল গ্রামেই শোভা পায়। গ্রাম গ্রামীণ গ্রাম্য সুখ এসব কিছুই।

গ্রামের-স্বরূপ

গ্রামের এসব সোনার ছেলেগুলো গড়ে তুলেছে যান্ত্রিক শহর। এমনি এক শান্ত পরিবারে সবুজে ঘেরা গ্রামেই জন্মেছেন নজরুল আর আল মাহমুদ। কবি বা কাব্য, লেখক বা লেখনী, শাসক বা শাসন, জীবন বা জীবনের গল্প সব কিছুরই সৃষ্টি গ্রামের অবলা মায়ের সন্তানদের দিয়ে।

গ্রাম আমাকে নয় সব মানুষকেই টানে। এই অনিন্দ্য সৌন্দর্যরূপ, বিমুগ্ধ সজীবতা, সোনালি রূপালি সূর্যের কিরণ চাঁদের হাসি দিয়েছে পৃথিবীকে পূর্ণতা। গ্রামের ভূষণ আর অলঙ্কার হলো ভালোবাসা, সহযোগিতা, মমতা, উদারতা, সহমর্মিতা, সাহায্য, সহৃদয়তা, দাক্ষিণ্য, কৃপা, সৌজন্য, পরোপকারিতা, সদিচ্ছা। রূপালি দাঁতের হাসি বড্ড নাড়া দেয় হৃদয়ে সরল মানুষগুলোর।

জীবন মানে এখানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, দুমুঠো ভাত, একটু ডাল সাথে পুঁটিমাছ। স্বার্থের বাজারে এখানে কেউ পণ্য নয়, বিপদে একে অন্যের চিরচেনা সহযোগী মুখ। জন্মে যেমন খুশি হয়, মৃত্যুতেও চার খুঁটির খাটিয়া কাঁধে নিয়ে দুচোখ ভরে কেঁদে চোখে অশ্রু বন্যা বইয়ে বিদায় দেয় প্রিয় মুখদের। ভুলে যায় না হারিয়ে যাওয়া মানুষদের, তাদের স্মৃতিচিহ্ন বুকে নিয়ে মহাপুরুষের গল্প বানায় একে অন্যকে নিয়ে। সকাল কি বিকালে, সন্ধ্যে কি মাঝরাতে হাটবাজারে সবাই সবার প্রিয়মুখ, বসে মিলনমেলা। ভাগাভাগি করে নেয় একে অন্যের সুখ। সান্ত¡না হয়ে কাছে আসে একে অন্যের।

এখানে মানুষগুলো বড্ড সামাজিক। দু’জন মিলে একটা সংসার পাতানো, আর এক টুকরো স্বর্গ বানানো এটিই গ্রামের অনন্য অনুভূতি। ওই যে ছোট্টবেলায় হাঁড়ি পাতিল নিয়ে খেলতাম আজও সে স্মৃতিকে নিয়েই বেঁচে আছি। আজও মনে পড়ে কুড়িয়ে আনা কচুরি ফুল কানে কিংবা চুলে লাগিয়ে কিনা খুশি হতাম! মেঘনার কোলে জাগা চরের পাড়ে আমাদের ঘর, এখানেই ভাঙা-গড়ার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার লড়াই শিখি। কৃষক আর কৃষাণী রোদে পুড়ে কালো চামড়ার অফুরন্ত ভালোবাসায় হিংসে হয় সাদা চামড়ার দর্শনার্থীদের।

কুপি বা হারিকেনের আলোয় উঠানে মাদুর পেতে ঝাল মুড়ির আড্ডা প্রায়ই হয়। গ্রীষ্মের রাতে উঠোনে জোনাকি দেখে বিশ্ববিধাতার সৃষ্টিনৈপুণ্যে ভাবনার জগতে হারিয়ে যাই। নতুন শাড়ি পরে বাপের দেশে নাইওর যায় বধূ পালকিতে চড়ে ঘোমটা দিয়ে মুখ মুড়িয়ে, নতুন সংসার পাতিয়ে চাবি কাপড়ের আঁচলে বেঁধে কোমর বাঁকিয়ে রাজ সংসারের রানী হবে বলে স্বপ্ন দেখে। এটিই আমার গ্রামের চিরচেনা রূপ।

Share.

মন্তব্য করুন