এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ফুটবল বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো একটি ঘটনা। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল-২০১৮ সবে শেষ হয়েছে, সবাই তখনই বিশ্বকাপের পর্যালোচনা আর ফলাফল বিশ্লেষণে ব্যস্ত। সে সময় হঠাৎ করেই বিশ্বে আলোড়ন তোলে একটি অবসরের ঘটনা। জার্মানির হয়ে আর আন্তর্জাতিক ফুটবলে না খেলার ঘোষণা দেন দেশটির ও সমগ্র বিশ্বের এই সময়ের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন মেসুত ওজিল।

ফুটবলে-বর্ণবাদের-কালো-ছায়া-6

মেসুত ওজিল

মুসলিম ও তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন তার সাথে বর্ণবাদী আচরণ করছে বলে জানান ওজিল। সেই আচরণ এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিলো যে- একজন ফুটবলারের জন্য সবচেয়ে গর্বের জাতীয় দলের জার্সিটা খুলে ফেলেন ওজিল। নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে ওজিল বলেন, ‘জার্মানির জার্সি পরতে আমার ঘৃণা হয়। জিতলে আমি জার্মান নাগরিক বলে সবাই গর্ব করে, আর হারলেই বলে বিদেশী।’
পেছনের কথাটা একটু বলে নিই। জার্মানির ২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক ওজিলের জন্ম তুরস্কে। শৈশবে বাবা মায়ের সাথে পাড়ি জমান জার্মানিতে। জার্মানির হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে শুরু করেন নিজের প্রতিভার গুণেই। টানা পাঁচ বছর জার্মান দর্শকদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন দেশটির সেরা ফুটবলার; কিন্তু অভিবাসী হওয়ার কারণে আরো অনেকের মতো তাকেও প্রায়ই শিকার হতে হতো বর্ণবাদী আচরণের। সেটা শুধু সাধারণ দর্শক-সমর্থক নয়, খোদ জার্মানির ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান এবং দেশটির অনেক জাতীয় রাজনীতিকও করতেন এমন আচরণ।
এবারের বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে লন্ডনে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে ওজিলের সাক্ষাৎ হয় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের সাথে। জন্মভূমির প্রতি যে কোন মানুষের টান থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। জন্মভূমির প্রেসিডেন্টকে জার্সি উপহার দেন ওজিল ও জার্মানি জাতীয় দলের আরেক ফুটবলার গুনদোয়ান (তিনিও তুর্কি বংশোদ্ভূত)। এই ঘটনার পর জার্মানিতে ব্যাপক সমালোচনা হয় তাদের দু’জনকে নিয়ে। এরপর বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে জার্মানি বাদ পড়ার পর সব দোষ গিয়ে পড়ে ওজিলের ঘাড়ে। নতুন করে তার ওপর শুরু হয় বর্ণবাদী অত্যাচার। যাতে বিরক্ত হয়েই অবসরে গিয়েছেন আর্সেনালের এই তারকা।

ফুটবলে-বর্ণবাদের-কালো-ছায়া-8বর্ণবাদ বলতে বোঝায়- গায়ের ভিন্ন রঙ, ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্ন গোষ্ঠীর লোককে নিজের চেয়ে ছোট করে দেখাকে। সাধারণত শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের অন্য সবার চেয়ে উচ্চবর্ণের ও সম্মানী মনে করে। ইউরোপে বর্ণবাদী আচরণ নতুন কিছু নয়। শ্বেতাঙ্গ নয় এমন (কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি রঙের এশীয় কিংবা আরব) মানুষদের সেখানে দেখা হয় ছোট চোখে। ইউরোপের ফুটবলও এই ধারা থেকে বের হতে পারেনি। মেসুত ওজিল একটি উদাহরণ মাত্র, কিন্তু যুগে যুগে এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন আরো অনেকে। অথচ খেলাধুলাকে বলা হয় সম্প্রীতি স্থাপনের মাধ্যম। সেই খেলার মাঠেও ঘৃণা ও জাতিবিদ্বেষের নজির স্থাপন করে চলছে ইউরোপ। বেলজিয়ামের তারকা স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু গত বিশ্বকাপের সময় প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে লেখা এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘যখন সবকিছু ভালোভাবে হয়, পত্রিকার পাতায় আমার সম্পর্কে লেখা হয় বেলজিয়ান স্ট্রাইকার লুকাকু। আর যখন দল খারাপ করে আমি হয়ে যাই কঙ্গোর বংশোদ্ভূত লুকাকু।’ ফ্রান্স ও রিয়াল মাদ্রিদের স্ট্রাইকার করিম বেনজেমাও শিকার হয়েছেন এ ধরনের আচরণের। ২০১১ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘জাতীয় দলের হয়ে গোল করলে বলা হয় আমি একজন ফরাসি, আর না পারলে তাদের কাছে আমি হয়ে যাই একজন আরব।’
২০০৬ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে জিনেদিনে জিদান যে ইতালীয় ফুটবলার মাতেরাজ্জিকে মাথা দিয়ে আঘাত করেছিলেন, তার কারণও ছিলো মাতেরাজ্জির ঘৃণাত্মক মন্তব্য। গত বিশ্বকাপের পরপরই রাশিয়ার ঘরোয়া ফুটবলে ঘটেছে ন্যক্কারজনক একটি ঘটনা। তৃতীয় স্তরের ক্লাব টর্পেডো মস্কো কঙ্গোলিজ বংশোদ্ভূত ডিফেন্ডার ইয়োবামাকে দলে নেয়ার পর সমর্থকরা বিরোধিতা করে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে দলে নেয়ার। ফলে ওই খেলোয়াড়ের সাথে চুক্তি বাতিল করে ক্লাবটি। যদিও ইয়োবামা রাশিয়ারই নাগরিক।
২০১৬ সালে স্পেনের বার্সেলোনা ক্লাবের হয়ে খেলার সময় ব্রাজিলীয় তারকা নেইমারকে তার গায়ের রঙ নিয়ে গালি দেয় এস্পানিওল ক্লাবের সমর্থকরা। এ ঘটনা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। ২০১১ সালে সার্বিয়ার মাঠে সার্বিয়া বনাম ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলের একটি ম্যাচে ইংল্যান্ড দলের কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের সাথে ব্যাপক বর্ণবাদী আচরণ করেন সার্ব দর্শকরা। ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার ড্যানি রোজ ম্যাচের পর বলেন, গ্যালারি থেকে পুরো ম্যাচজুড়ে তাকে উদ্দেশ করে বানরের ডাকের মতো শব্দ করা হয়। যে কারণে তিনি খেলায় মন বসাতে পারেননি। গ্যালারি থেকে ছোড়া দুটি ইটের টুকরো এসে লাগে তার গায়ে। এক পর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে দর্শকদের উদ্দেশে বলে কিক করেন ড্যানি। ওই ঘটনার পর তৎকালীন ফিফা সভাপতি সেফ ব্লাটারও স্বীকার করেন যে, ইউরোপের ফুটবলে বর্ণবাদ ও বৈষম্য রয়েই গেছে।

ফুটবলে-বর্ণবাদের-কালো-ছায়া-3২০১৪ সালের মে মাসে স্প্যানিশ লা লিগার ম্যাচে লেভান্তের সেনেগালি মিডফিল্ডার পেপে দিওপেকে লক্ষ্য করেও বানরের ডাকের মতো শব্দ করে অ্যাথলেটিকোর সমর্থকরা। এর মাসখানেক আগে বার্সেলোনায় খেলা ব্রাজিলীয় অধিনায়ক দানি আলভেজের গায়ে কলা ছুড়ে মারে ভিলারিয়ালের সমর্থকরা। সেই ঘটনায়ও ব্যাপক ঝড় উঠেছিলো ফুটবল বিশ্বে।
এগুলো উদাহরণ মাত্র। ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবে ‘রেসিজম ইন ফুটবল’ লিখে সার্চ দিলে পাওয়া যাবে ফুটবলে বর্ণবাদী আচরণের অনেক ভিডিও। অনেক জায়গায়ই দেখা যায় কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের সাথে হ্যান্ডশেক করতে চায় না শ্বেতাঙ্গরা। এর হার ক্রমশই বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৭-১৮ ইংলিশ ফুটবলে মৌসুমে বর্ণবাদী আচরণের ঘটনা ঘটেছে ২৮২টি, ২০১২-১৩ মৌসুমে যা ছিলো ৫৩টি। কাজেই ইউরোপীয় ফুটবলের এই বর্ণবাদী চরিত্র কবে পাল্টাবে, আদৌ পাল্টাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
অথচ ইউরোপের ফুটবলে অনেক বড় অবদান রেখেছেন অভিবাসীরা। এবারের বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলের আটজন ফুটবলার ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ (যাদের মধ্যে কয়েকজন মুসলিম)। ২০০২ সালে ফ্রান্সকে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দেয়া জিনেদিনে জিদানও একজন আলজেরীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম।

Share.

মন্তব্য করুন