হাসিবুলের মা পাগলের মতো ছুটছিলো। মাঠটা পাড়ি দিলেই চেয়ারম্যানের বাড়ি। এপাড়া ওপাড়া-মাঝখানে ছোট্ট মাঠ। পিছন দিক থেকে ছুটে আসছে প্রাইভেটকার। গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তা। শহরের মতো গাড়ি-ঘোড়া চলে না তবু এখন অনেকেই শহর থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি অসে। বার বার হর্ণ বাজছে। হাসিবুলের মা অন্য মনস্কের মতো হাঁটছে তো হাঁটছেই। প্রাইভেটকারটা হাসিবুলের মায়ের গা ঘেসে ব্রেক করলো। তখন পড়িমরি করে সরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো হাসিবুলের মা। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে মহিলাকে টেনে তুললো। তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো, ব্যথা পেয়েছো?
কেঁদে উঠলো হাসিবুলের মা। চোখ দুটো খড়খড়ে। অশ্রু নেই। এ শুধু তার বুক থেকে বেরিয়ে আসা কষ্টের আর্তনাদ।
ভদ্রলোক চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বললো, গাড়িতে উঠো। পাগলের মতো কোথায় যাচ্ছিলে রোদ মাথায়! এসব কথায় কান দিল না হাসিবের মা। বাবা তুমি যাও। আমার দুঃখের কথা শুনে তোমার কি হবে। ভদ্রলোকমহিলার হাত ধরে গাড়িতে তুললো। পাশে বসিয়ে বললো,
চাচী আমাকে চিনতে পারছো?
না। তুমি কি এই গাঁয়ের মানুষ!
হ্যাঁ, আমি শাকুর। শাকুর জোয়ারদার। বাড়ি সোনাতুন্দী।
তুমি কি ফায়েম মিয়া ভাই এর ছেলে?
এই তো চিনতে পেরেছো। এবার বলো তো, পাগলের মতো কোথায় ছুটছিলে।
আমার যাওয়ার কি আর ঠিকানা আছে রে বাবা। যাচ্ছিলাম কাননের কাছে।
কানন মানে এবার যে চেয়ারম্যান হলো? কাননের কাছে কেন?
বাবারে, আমার হাসিব মেট্টিক পরীক্ষা দেবে। কিন্তু কয়েক মাসের বেতন বাকী। পরীক্ষার ফী-সে অনেক টাকা। টাকা না দিলে ও আর পরীক্ষা দিবার পারবে না। কালই টাকা দেয়ার শেষ দিন। আমি এখন টাকা কোথায় পাবো। হাটবার ছাড়া গাভীটাও বিক্রি করা যাচ্ছে না।
তোমাকে কিছু করতে হবে না। কোথাও যেতেও হবে না। ওর পরীক্ষা দেয়ার জন্য যতো টাকা লাগে আমি দেবো। তুমি চিন্তা করো না।
তুই আমারে বাঁচালিরে বাবা।
হাসিবুল কি বাড়িতে আছে?
আছে।
শাকুর ড্রাইভারকে বললো, গাড়ি ঘোরাও। কালীবাড়ির সামনে যাও। এতক্ষণে হাসিবুলের মায়ের ধরে রাখা শক্তিটুকু শুকনা বালুর মতো ঝরে পড়লো। বুকের মধ্যে প্রশান্তির ঢেউ গড়লো। তার দেহটা এলিয়ে পড়লো শাকুরের কাঁধের উপর। বাড়ির সামনে এসে শাকুর তাকে আগলে ধরে বসলো গিয়ে তোরাব আলীর ঘরের বারান্দায়।
পায়ের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হাসিব।
তোমার কী হয়েছে মা?
আমার কিছু হয় নাই। একে চিনছিস, তোর ফায়েম চাচার ছেলে-শাকুর ভাই।
চিনছি। ভাই তো অনেক দিন পরপর বাড়ি আসে। মা, টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে?
মা কিছু বলার আগেই শাকুর বললো, তোর কতো টাকা লাগবে রে হাসিব?
কেরাণী স্যার বলছে মোট তিন হাজার দুশো টাকা হলেই হবে।
মন দিয়ে পড়ালেখা কর। কাল সকালে আমাদের বাড়ি গিয়ে টাকাটা নিয়ে আসবি। আর প্রয়োজনে আমাকে জানাবি। টাকার জন্য ভাবতে হবে না। আমি এখন কমলাপুর যাবো। ফিরতে রাত হবে।
এই সেই শাকুর, যে একদিন টাকার অভাবে মেট্টিক পরীক্ষা দিতে পারেনি। আজ শাকুরের অনেক টাকা। চাকরী অবস্থায় পড়ালেখা করেছে। প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এম, এ করেছে। একদিন চাকরী ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা ধরেছে। গ্রামের বাড়িতে দালান তুলেছে, শহরেও বাড়ি করেছে। বাবা-মা পৃথিবী ছেড়ে গেছে অনেক আগেই। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে-দু চারদিন চেনা-জানা লোকদের সাথে সময় কাটায় আবার চলে যায় ঢাকা শহরে। ছোটবেলা নিজের গরজেই পড়ালেখায় ভালো হয়ে উঠেছিলো শাকুর। ক্লাস টেনে উঠার পর অর্থের টানাটানির কারণে স্কুলে বেতন দেয়া-অন্যদের মতো-প্রাইভেট পড়া তার পক্ষে সম্ভম হচ্ছিল না। তার উপর কাগজ, কলম কেনা, বিভিন্ন সময়ে এ চাদা সে চাদা। বেশ কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলো শাকুর। বাবার শরীরটাও ভালো যাচ্ছিলো না। মাঠে যে টুকু জমি আছে সেখানে ভালো ফসল না হলেও অদূর ভবিষ্যতে ইরির
ব্লকে পড়ে গেলে খেয়ে বাঁচা যাবে। কিছু মাটি কেটে সমতল করাও প্রয়োজন। এসব ভেবে বাবা-মা আর জমি বিক্রি করার কথা না ভেবে ছেলেকে একদিন বললো, শাকুর মনে হচ্ছে তোর আর পড়ালেখা হচ্ছে না। কোনো একটা কাজের সন্ধান কর।
ছেলে অবাক হয়ে বললো, কেন আব্বা-আমি তো খারাপ ছাত্র না। কলেজে গেলে টিউশনি করেই আমি পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারবো।
কিন্তু এখনই তো তোর পিছনে টাকা জোগান দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
শাকুর বাবার কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মনের যন্ত্রণা আর তেতে উঠা রাগ প্রশমিত করে মনে মনে ভাবলো, আব্বা তো সত্যি অপারগ। তবে বেঁচে থাকতে হলে আমাকে অন্যপথ ধরতে হবে। সময়ের সাথে তালমিলিয়েই আমাকে এগিয়ে যেতে হবে।
তারপর গ্রামের বাজারেই ঘোরাফেরা করে আর মনে মনে খুঁজে ফেরে আলোকিত কোনো পথ। বাজারের পাশে হাসপাতাল। “রোগ নিরাময়” ফার্মেসিতে বসে খবরের কাগজ পড়ে। দেশের হাল অবস্থা পড়ে মনেরশান্তি নষ্ট হয়। এখন জীবনের জন্য চাকরীর বিজ্ঞাপন খুঁজতে থাকে শাকুর। একদিন চোখে পড়লো বিদেশি এক কোম্পানীতে পিয়ন পোষ্টে কিছু লোক নিয়োগ দেয়া হবে। স্মার্ট স্বাস্থবান এবং বুদ্ধিমান ছেলেদের
অগ্রাধীকার। ইংরেজী পড়া বা লেখার চলনসই জ্ঞান থাকা আবশ্যক। শিক্ষাগত যোগ্যতার উল্লেখ নেই। শাকুরের মনে ধরলো। আবার চিন্তা করলো বিদেশী কোম্পানী ইংরেজী বলা সে তো আরেক ঝামেলা, আমার দ্বারা হবে না। মনের কথা মনে রেখেই ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে যায়-আসে।
একদিন করিম বক্স এর ছেলে মির্জা বললো তুই পরীক্ষা দিবি না তো চাকরীতে ঢুকে পর। এই এতটুকু কথায় মনের মধ্যে যেনো একটা দমকা বাতাস খেলে গেলো। মন থেকে উড়ে গেলো বিছিয়ে থাকা ঝরা পাতা।
শাকুর হাসলো। বললো, চাকরী কোথায় পাবো। একটা যেমন তেমন চাকরী আমার খুব দরকার। যদি তোমার জানা-শুনা কেউ থাকে তাহলে একটু চেষ্টা করে দেখ না।
ঢাকায় বিদেশী একটা কোম্পানীতে লোক নিচ্ছে।
বিজ্ঞাপনটা দেখেছি কিন্তু সাহস হয় না। অযথা…।
অযথা কিরে। অনলাইনে একটা এপ্লিকেশন করে দে-তারপর যা হয় হবে। একটা ফটো নিয়ে আয় আমি ঠিকানা বরাবর পাঠায়ে দেবো। কিন্তু বিশ টাকা তোকে দিতে হবে।
পরদিন মির্জাই কম্পিউটারে টাইপ করে ঠিকানা বরাবর পাঠিয়ে ছিলো শাকুরের এপ্লিকেশন। বললো, আল্লাহ আল্লাহ কর। যদি ইন্টারভিউতে ডাকে তাহলে চাকরীটা হয়েও যেতে পারে।
মনের মধ্যে স্বপ্ন নিয়ে প্রায় পনেরো দিনগত হওয়ার পরও কোনো সংবাদ না পেয়ে মনের স্বপ্ন ধুয়ে-মুছে আবার নতুন কাজের অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে লাগলো শাকুর। প্রায় একমাস পর মির্জা পথ থেকে চিৎকার করে শাকুর কে ডেকে বললো, তোর খবর আছে, অফিসে এসে দেখা কর।
আবার বুকের মধ্যে একটা আশার আলো জ্বলে উঠলো। ছুটে গেলো ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে। তার ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে। ঢাকা যেতে হবে। হাতে মাত্র সাতদিন সময়। ছুটে এলো বাড়িতে। বাবা-মা কে খবরটা দিলো। বাবা বললো, ঢাকা তো যাবি কিন্তু যাওয়া আসা খাওয়া-দাওয়া আর থাকা এসব মিলে কতো টাকা লাগবে একটা হিসাব করতো।
শাকুরের মুখটায় কে যেনো এক মুঠ ধূলা ছিটিয়ে দিলো। একটু থমকে গেলো সে। কিন্তু পরক্ষণেই প্রচণ্ড অভিমানের সুরে বললো, আমি কিচ্ছু জানি না। আব্বা তুমি কারো কাছ থেকে টাকা ধার করো। আমার চাকরীটা হয়ে গেলে তখন তো সবই হবে। মা তুমি মামাদের বাড়িতে একবার যাও। তারা কিছু টাকা দিলেও আমি যেতে পারবো। আমার চাকরীটা হলেই মামাদের টাকা আমি পরিশোধ করে দেবো। মা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ছেলের দিকে, তাদের টাকা থাকলেও দেবে না রে বাপ। আমি তোর মামাদের কাছে হাত পাততে পারবো না, পারলে তুই একবার যা।
মামাদের স্বচ্ছল সংসার। বোন পছন্দ করে বিয়ে করেছে বলে ভাইরা বোনের দিকে ফিরেও তাকায় না, ওদের বাবাই মেয়ের ইচ্ছায় বিয়ে দিয়েছিল। তখন শাকুরের বাবার ছিলো পাটের ব্যবসা। জমাজমি অল্প থাকলেও হাতে ছিলো নগদ টাকা। বড় বড় টাপুরে নৌকা ভরে পাট যেতো মুকামে। ভরা গড়াই নদীতে পাল তুলে বড় বড় গহনার নৌকা আসতো। ফিরতি বেলা হাল ধরে বসে থাকতো মাঝি, তরতর করে স্রোতের টানে নৌকা ছুটতো ভাটির পথে। একবার ডুবলো সেই পাট বোঝাই টাপুরে নৌকা। সম্বল হারিয়ে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি শাকুরের বাবা।
এতো কষ্টের মধ্যেও ছেলের মুখ চেয়ে বাবা বুকে সাহস টেনে বললো, আচ্ছা! তুই চিন্তা করিসনে, টাকার ব্যবস্থা আমি করে দেবো। শাকুর কখনো ঢাকা যায়নি। চরপাড়ার কেয়ামত মাষ্টারের ছেলে কবির যাবে ঢাকা। ও ঢাকায় চাকরী করে। বাজারের উপর মির্জা কবিরের সাথে কথা বলে ঠিক করল যে ৭ তারিখে সে শাকুরকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। রাতটুকু ওর বাসাতেই থেকে পরদিন সকালে মতিঝিল যাবে ইন্টারভিউ দিতে।
বরইচারা বাসষ্ট্যান্ড থেকে ওরা বাসে উঠলো। শাকুরের মনের মধ্যে হাজারো জল্পনাকল্পনা। অযথাই স্বপ্ন দেখে আর স্বপ্ন ভাঙে। চুপচাপ বসে থাকলেও শাকুর প্রতিটি নিশ্বাসে পড়ে চলেছে ছোটবড় নানান কিসিমের দোয়া। ইন্টারভিউটা যেনো ভালো হয় আর চাকরীটাও যেনো পেয়ে যায় সে।
ডাইরেক্ট বাস। ফেরীতে কবির ওকে নিয়ে গেলো উপরে কেন্টিনে। শাকুরকে বললো, কিছু খেতে চাও?
না। পেট ভরা আছে।
তাহলে চা বিস্কুট খাও। ঢাকায় কি প্রথম যাচ্ছো?
জি।
ভয়ের কোনো কারণ নেই। শুনতে শুনতে মানুষ মক্কা চলে যায়। মনে সাহস রাখাটাই হলো বড় কথা। ভাবটা এমন রাখতে হবে যে, তুমি সব চেনো জানো। প্রতিটি বাসে লিখা থাকে গন্তব্যস্থান কোথায়। প্রয়োজনে বাসের হেলপারের সাহায্য নেয়া যায়। মতিঝিল এই কোম্পানীর অফিসে আরো অনেকেই আসবে তোমার মতো পরীক্ষার্থী। তাদের সাথে কথা বলবে। আবার গাবতলী এসে ডাইরেক্ট মাগুরা যশোরের গাড়িতে চড়লেই পৌঁছে যেতে পারবে।
ওরা গাবতলী নামলো। চারদিকে তাকালো শাকুর। একটার পর একটা বাস আসছে যাত্রী নামছে, আবার অন্য বাসে বা সি এন জিতে চলে যাচ্ছে শহরের কেন্দ্রের দিকে-যার যার ঠিকানায়। কবির দৌড়ে গেলো নিউমার্কেটের বাসের দিকে। শাকুরকে বললো, এখান থেকে বাসে যেতে হবে এসো। মানুষের ভীড়ে শাকুরের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেলো কবির। বাসের মধ্যেও ভীড়। বাস ছেড়ে দিয়েছে তখন। একটা সিট জোগার করে কবির বসলো ঠিকই তবে শাকুরকে খুঁজে আনার ব্যবস্থা আর করতে পারলো না ও। ভাবলো সবই তো বলেছি, ঢাকাও পৌঁছে গেছে। একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে নিতেপারবে।
শাকুর ছুটোছুটি করলো কিছুক্ষণ। কোথাও কবিরকে দেখতে পেলো না। সে দৌড়ে কোন্ বাসে উঠলো সেটাও বুঝলো না। তখনই অচেনা একটা হাওয়া যেনো ওর শরীর ছুয়ে হাসতে হাসতে হারিয়ে গেলো দূরে। মনের মধ্যে নানান রকম ভয় এসে জড়ো হতে লাগলো। গুন্ডা, ছিনতাই, গুম, খুন, পুলিশের হয়রানি-আরো অনেক কিছু। তবে কবিরের গল্পের ছলে উপদেশমূলক কথাগুলো ভেসে উঠলো মনের মধ্যে। আর মনে পড়লো দেশে প্রচলিত জহুর পাগলের সেই কথা-ভয় করলে ভয়, ভয় না করলে কিসের ভয়। শাকুর নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। ভাবলো ঢাকা শহরে যখন এসে গেছি এখন আর ভয় কি। এক কাপ চা খেয়ে নিই। চা খেলে মনের শক্তি বেড়ে যায়।
এক কাপ চা দেন তো।
লাল চা না দুধ চা?
দুধ চা।
ছোট্ট দোকান। ব্যাগটা কোলের উপর রেখে ধীরে ধীরে চা-টা শেষ করে পাঁচ টাকা দিলো দোকানদার ছেলেটাকে। সে দুই টাকা ফেরত দিলো। আবার পথে দাঁড়িয়ে বাসের সামনের লেখা পড়তে লাগলো। হঠাৎ মতিঝিল লেখা দেখে উঠে পড়লো বাসে। পথে পথে বাসা ভাঙা পিঁপড়ার মতো এলোমেলো ছুটছে মানুষ আর মানুষ। রাস্তায় থেমে থেমে বাস পৌঁছালো মতিঝিল।
তখন সূর্য ডুবে গেছে কিন্তু তার আগেই টুপটাপ জ্বলে উঠলো শহর জুড়ে ইলেক্ট্রিসিটি। কেমন যেনো ধোঁয়া ধোঁয়া পরিবেশ। আবার বাস বোঝাই দিয়ে অফিস পাড়ার লোকজন ছুটছে যার যার ঘরে। দেখতে দেখতে অনেকটা ফাঁকা হয়ে এলো শহর। একসময় দোকানপাটও প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করতে করতে চোখে পড়লো মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের সামনে ফুটপাতে ছিন্নমূল মানুষরা কেউ শুয়ে আছে কেউ ঘুমোবার জন্য জায়গা করছে।
শাকুর পাশের দোকান থেকে দ্রুত একটা পেপার কিনে সেও শোয়ার আয়োজন করলো। ঠিক তখনই দুজন গুন্ডা ধরণের লোক কেমন টলতে টলতে এসে বললো, এই তুই কেরে; আমাদের ঘর দখল করছিস। যা ভাগ এখান থেকে। জড়ানো কণ্ঠ, কথা স্পষ্ট নয়। এরা যে নেশা করে এসেছে তা বেশ বুঝতে পারলো শাকুর।
শাকুর ভড়কে গেলো। অজানা সব ভয়ে মাথা থেকে সাপের শীতল স্পর্শের মতো একটা স্রোত গড়ালো তার পা পর্যন্ত। কি করবে, কোথায় যাবে! খুব বেশি বেশি করে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলো। চোখ ফেটে অশ্রু গড়ালো। আর একটু এগিয়ে একটা শপিংমলের সামনে সিঁড়ির উপর কাগজ বিছালো। পকেটে দু’টা টাকা রেখে খরচের বাকী টাকা পায়ের মোজার মধ্যে রেখে ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লো।
একটু পরই টহল পুলিশের গাড়ি এসে থামলো রাস্তায়।
এই ছেলে এদিকে আয়।
স্যার আমি খুব ক্লান্ত, ঘুমোবো।
রাখ তো ঘুম, এদিকে আয়।
শাকুর ব্যাগটা রেখেই এগিয়ে গেলো পুলিশ ভ্যানের পাশে।
কি নাম?
মোঃ শাকুর জোয়ারদার।
কি করা হয়?
একটা ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। শহরে থাকার মতো আমার কোনো জায়গা নেই।
বাড়ি কোথায়?
মাগুরা।
ব্যাগের মধ্যে কী আছে?
কাগজপত্র-ইন্টারভিউ কার্ড।
কাগজপত্র না কি অস্ত্র।
এসব আপনি কি বলছেন। আমাদের পাশের গ্রামের একটা লোকের সাথে আমি এসেছি। গাবতলী নামার পর ভীড়ের মধ্যে তাকে আমি হারায়ে ফেলেছি। শেষে নিরুপায় হয়ে এখানে এসেছি। কোনো রকমভাবে রাতটা শেষ হলেই সকালে ইন্টারভিউটা দিয়ে আবার মাগুরার বাস ধরে চলে যাবো।
সে দেখা যাবে। আগে ব্যাগটা নিয়ে আয়।
শাকুর যেনো মহা বিপদে পড়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো কথায় বলে ঘোড়ার পিছনে যেয়ো না আর পুলিশের সামনে পড়ো না। এরা টাকা খাওয়ার জন্য সব করতে পারে। সরকারি লোক-হাতে অস্ত্র তাই মানুষ কিছু বলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ব্যাগটা নিয়ে গেলো পুলিশের কাছে। পুলিশ বললো গাড়িতে ওঠো। তোমাকে থানায় যেতে হবে। পুলিশের কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো শাকুর।
স্যার আমি খুব গরীব। আব্বা অনেক চেষ্টা করে শুধু আসা যাওয়ার খরচটা জোগাড় করে দিয়েছে। আমি অনেক আশা নিয়ে ইন্টারভিউটা দিতে এসেছি। আমাকে ছেড়ে দেন স্যার। রাতে আমার খাওয়াও হয় নাই।
পুলিশ বললো, মাগুরার লোকের বিশ্বাস করি না।
ঠিক তখনই এক রিক্সাওয়ালা খালি রিক্সা নিয়ে যাচ্ছিলো। তার কানে মাগুরা কথাটা যাওয়া মাত্রই রিক্সাটা একটু স্লো করলো সে। শাকুর তখন
পুলিশের হাত পা ধরে কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করছে তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য।
বয়সী রিক্সাওয়ালার বাড়ি মাগুরা। সে রিক্সা থেকে নেমে পুলিশটাকে সালাম দিয়ে বললো, স্যার আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে ছেলেটাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে পারি। রিক্সাওয়ালার কথা শুনে শাকুর যেনো হাতে চাঁদ পেলো, বললো, চাচা অনেক কষ্টে আসা যাওয়ার পয়সা জোগাড় করে একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। শহরে আমার কোনো জানাশুনা লোক নেই। তাই ঐ ফুটপাতে অন্যদের দেখাদেখি আমিও একটু ঘুমোতে চেয়েছিলাম।
রিক্সাওয়ালা বললো, স্যার ছেলেটা মনে হয় সারাদিন খায় নাই। একটু দয়া করেন স্যার।
পুলিশ বিরক্ত হয়ে বললো, তোমার তো সাহস কম না। তুমি আমাকে বুদ্ধি দিতে এসেছো। তোমার বাড়ি কোথায়।
আমার বাড়ি মাগুরা।
তুমি ওকে চেনো না কি?
চিনি না তবে; মাগুরার কথা শুনেই মনটা যেনো কেমন করে উঠলো। একই মাটিতে জন্ম তো, এ বড় মায়ার টান।
পুলিশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে রিক্সাওয়ালাকে বললো, মাটির টান ভালই বলেছো। যাও, তুমি ছেলেটাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। আমি
ভেবেছিলাম থানাতে থাকলে ও নিরাপদ থাকবে।
শাকুর সালাম দিয়ে বললো, আসি স্যার। পুলিশ আর কোনো কথা না বলে তখনই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো ইনকিলাবের দিকে। রাতে একজনের খাবার দুজন খেয়ে শাকুর শুয়ে থাকলো রিক্সাওয়ালার মেসে। একরুমে তারা তিনজন থাকে। একজন দেশে গেছে। শাকুর সেই বিছানায় ঘুমালো। সকালে রিক্সাওয়ালাই নিয়ে এলো বিদেশী কোম্পানীর সেই অফিসে। তখন শাকুর কী বলে যে, তাকে ধন্যবাদ জানাবে সে কথা ভাবতে গিয়ে কোনো কথাই সে খুঁজে পেলো না। শেষে চাচা বলতেই চোখ দুটো ভরে উঠলো জলে। রিক্সাওয়ালা বললো, বাবা চোখের পানি মুছে ফেলো। দুনিয়াটা বড় কঠিন জায়গা। চোখের জলের কেউ দাম দেয় না। দোয়া করি তোমার চাকরীটা যেনো হয়ে যায়। চাচা চাকরী হলে তো আবার আসবো। আপনার কথা আমার মনে থাকবে।
দুটো পোষ্টের জন্য শত শত ক্যান্ডিডেট। ইন্টারভিউ নেয়ার পর শাকুরের মনে হলো চাকরীটা হয়তো হয়ে যেতেও পারে। ইন্টারভিউ বোর্ডের লোকেরা প্রশ্ন করেছিলো-চাকরীটা কি তোমার খুব প্রয়োজন?
শাকুর তখন ওর সব কথা খুলে বললো। সে আরো বললো, চাকরী হলে আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাবো। আমি ছাত্র হিসেবে একেবারে খারাপ না স্যার। কিন্তু গ্রামের কেউ আমাকে সাহায্য করলো না।
এর মধ্যেই শাকুরের মনটা ভরে উঠেছে সাহসে।
দৈনিক বাংলার মোড়ে এসে গাবতলীর বাস ধরলো শাকুর। তারপর বেশ খুশি খুশি মনে গাবতলী থেকে যশোরের বাসে উঠলো। বাসে বসে চাকরী না হওয়ার কথা নিয়ে নানান রকম দুঃখের ছবি আঁকলো মনে মনে। পরীক্ষা দেয়াও হলো না আবার আব্বার ধার করা এতোগুলো টাকাও নষ্ট হবে। আবার সুখের স্বপ্নেও সে ভাসলো। শেষে আর কিছুই ভাবতে ভালো লাগলো না তার। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে এলো।
ফেরী ঘাটে এসে কবির ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। তাকে আর দোষ দিয়ে লাভ কি। আমার কপালে যা ছিলো তাই হলো। পয়সা হিসাব করে ঝালমুড়ি আর কচি শশা খেয়ে পেটটা ভরলো শাকুর। মধুখালি আসতে আসতে বেলা ফুরালো। রাত দশটার দিকে বাড়ি পৌঁছালো শাকুর। মা বলে ডাকতেই দরজা খুলে এগিয়ে এলো শাকুরের মা। পরীক্ষা দিতে পারছিস বাবা!
হ্যাঁ।
সবকথা পরে শুনবো। আগে মুখ হাত ধুয়ে খেয়ে নে। সারাদিন যে কিছুই খাওয়া হয় নাই সে আমি তোর মুখ দেখেই বেশ বুঝতে পারছি।
শাকুর জামা কাপড় খুলে মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসলো। বাবা বললো, অচেনা জায়গা তোর খুব কষ্ট হয়েছে। না, বাবা, আল্লাহ যা করে তা মানুষের ভালোর জন্যই। জীবনে শিখতে হলে ঠকতে হয়। কিন্তু আমি ঠকেও শিখতে পারলাম না। আল্লাহ যেনো তোকে তেমনটি না করে।
সারাদিন পর খাওয়ার সময় কথা না বলে শাকুর ধীরে ধীরে পেটটা ভরে খেয়ে নিলো। তারপর বাবার দিকে চেয়ে বললো, আব্বা মাটির টান কি খুব বড় টান?
একথা বলছিস যে!
ঢাকা গিয়ে সত্যি বড় বিপদে পড়েছিলাম। মাগুরার এক রিক্সাওয়ালা চাচা আমার জন্য অনেক করেছে। তা না হলে আমার পরীক্ষা দেয়া তো হতোই না তার উপর কতোবড় বিপদ যে ঘাড়ে চাপতো সে এক আল্লাহই জানে।
মা বাবা দুজনই চমকে উঠে বললো-বলিস কী?
তারপর সব ঘটনা খুলে বললো শাকুর। শেষে বললো, সেই রিক্সাওয়ালা চাচাই বলছিলো, “মাটির টান বড় টান”।
বাবা বললো, সবই তার ইচ্ছা। তো পরীক্ষা তো ভালই দিয়েছিস।
পরীক্ষা ভালো হয়েছে। বোর্ডের লোকজনও ভালই বলেছে।
এখন আল্লাহ ভরসা। দিন যায় রাত পোহায়। দেখতে দেখতে কেটে যায় দু’সপ্তাহ। একদিন মির্জাকে বললো, মির্জা ভাই কোনো খবরই তো আসে না। আরো এক সপ্তাহ অপেক্ষায় থাক। একটু চিন্তার বিষয় যে মাত্র দুটো পোষ্ট। আজকাল পিয়নের চাকরীর জন্যও মন্ত্রীরা ঘুষ খেয়ে সুপারিশ করে। তুই আল্লাহ আল্লাহ করতে থাক। আর যদি নাই হয় আমি অন্য কোনো চাকরীর বিজ্ঞাপন খুঁজবো। একদিন না একদিন চাকরী হবেই।
তারপর আর এক সপ্তাহ কেটে গেলো। কোনো খবর নেই। শাকুর ধরে নিলো-চাকরীটা হবে না। কেউ হয়তো মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে…। শুধু শুধু টাকাগুলো খরচ হলো। আবার একথাও ভাবলো যে, যা জানলাম শিখলাম তা কি আর ঘরে বসে শিখতে পারতাম!
একদিন বাজারের উপর শাকুরের ছোট মামা বললো, কিরে শাকুর চাকরী হলো?
সে খবর নিয়ে আপনার কাজ কি।
আমার কিছু না তবু জানতে চাইলাম আর কি। কতো আই, এ-বি, এ পাশ ছেলেরাও পিয়নের চাকরীর জন্য, ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে খাবিখায়ে বেড়াচ্ছে। তুই তো মেট্টিক দিতেও পারলি না।
শাকুর অপমানে, রাগে তখন পাগল হওয়ার জোগাড়। বাড়ি এসে মা কে বললো, মা, মামাদের আমি কী ক্ষতি করেছি যে তারা এভাবে আমাকে কষ্ট দেয় অপমান করে।
মা ছেলের চোখের পানি সইতে না পেরে নিজেও চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বললো,
আমি দোয়া করছি। তোর চাকরী হবেই হবে। আর এর প্রতিশোধ একদিন আল্লাহই নেবে। তুই আর মন খারাপ করিস নে বাপ।
পরদিন সকাল গেলো বিকাল গেলো শাকুর আর বাজার মুখো হলো না। বাবাও জমিতে ধানের চারা লাগাবে বলে ভালো জাতের চারা আনতে গেছে দুর্গাপুর। সন্ধ্যার পর নতুন একটা বই নিয়ে মন দিয়ে পড়ছিলো শাকুর।
হঠাৎ মির্জার ডাক কানে এলো।
শাকুর তোর সুখবর আছে রে। তোর চাকরী হয়ে গেছে। কাল সুন্দরবন কুরিয়ারে গিয়ে দেখা করবি। কার্ড নিয়ে আমার অফিসে আসিস।
শাকুর ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে এলো।
মির্জা ভাই তুমি কোথায় খবর পেলে?
কুরিয়ারে এপোয়েন্টমেন্ট কার্ড এসেছে তোর নামে।
হারুন বিশ্বাস খবরটা দিল। নেটেও আসতে পারে। কাল দেখবো। তুই সকাল আট-টার মধ্যে বাজারে সুন্দরবন কুরিয়ার অফিসে যাবি। কার্ডটা নিয়ে আমার কাছে আসবি। কবে কোন তারিখে জয়েন করতে হবে দেখবো।
মা খবরটা শুনে আনন্দে হাসতে হাসতে কেঁদে ফেললো, তার দু’চোখ ভরে যাচ্ছে অশ্রুতে বার বার। বাবাও তখন ফিরলো বাইরে থেকে।
কী হয়েছে?
আব্বা আমার চাকরী হয়েছে।
মা-বাবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললো, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।