‘আমরা এত অবাক হয়েছিলাম তা বলার নয়। কারণ ঘরে ঢুকেই দেখি সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরা একজন মানুষ। মানুষ বললে ভুল হবে। কেননা ওটা ছিল কঙ্কাল। হাড়ের উপরে তার পাজামা-পাঞ্জাবি। দু’হাত ও দু’পায়ে শেকল দিয়ে দেয়ালের আংটার সাথে বাঁধা। পাঞ্জাবিতে হাত দেয়ার সাথে সাথে তা গুঁড়ো হয়ে যায়। পাঞ্জাবির পকেটে এক অদ্ভুত কাপড় ছিল।’ বলে তিনি পকেট থেকে একটা কাপড় বের করে আমাদের হাতে দিলেন। আগেকার আমলে রাজা-বাদশাহরা এমন কাপড়ে চিঠি লিখতো। কাপড়টা চার ভাঁজ করা। তাতে কালচে ধরনের কালি দিয়ে বড় বড় করে লেখা। মনে হয় রঙ তুলি দিয়ে লেখা হয়েছে।
তাতে লেখা:
‘হে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, সর্ব শেষ ঘরের ডান কোণে মাটির নিচে একটা লোহার সিন্দুক আছে। ঐ সিন্দুকে মুসলমানদের সম্পদ রয়েছে। রাজা এই সম্পদে হাত দিতে সাহস পায়নি তাই পুঁতে রেখেছে। বহু কষ্টে এই চিঠি লেখা। এই বদ্ধ ঘরে কালির অভাব বিধায় ওরা আমাকে মেরে যে রক্ত বের করেছে সেই রক্ত দিয়ে লিখলাম এই চিঠি। জানিনে মাটির নিচের এই ঘরে আমার চিঠি কেউ পাবে কিনা। যদি কেহ পায় তবে সে যেন আমার বংশধরের নিকট এই চিঠি অথবা সম্পদ পৌঁছে দেয়। এটা আল্লাহর এক হতভাগা বান্দার অনুরোধ।’
ইতি
আবুল হাসান।

আমি চিঠি পড়ে তা ভাঁজ করে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয় এই আবুল হাসানই আপনার দাদার নাম।’
‘হ্যাঁ, আমার দাদা। শুধু দাদা আর তার সহযোগীদের মেরেই তারা ক্ষান্ত হয়নি রাজা। ধুঁকে ধুঁকে মারতে চেষ্টা করেছে আমাদের পরিবারকে। আমার পিতার বয়স তখন সাত বছর। দাদাই একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দাদীকে সেই পথ দেখতে হয়। কিন্তু কেউ তাকে কাজ দেয়নি রাজার ভয়ে। তখন অর্ধাহারে-অনাহারে কেটেছে তাদের।’
‘কিন্তু আজ আপনার এই দশা কেন? বিশেষ করে মিরনের মত শয়তানের সাথে আপনার বন্ধুত্ব হলো কেন? আপনি না ফারায়যী আন্দোলনের কর্মীর বংশধর।’
‘হ্যাঁ, মিরন দাগি আসামি। আমি ওর সাথে মিশেছি এজন্য যে আমার দাদা মরেছে জমিদারের হাতে, পিতা মরেছে ধুঁকে ধুঁকে না খেয়ে না পরে বিনা চিকিৎসায়। তাই আমি চেয়েছিলাম বড়লোক হতে। দাদা ও পিতার মত ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সবার উপর কতৃত্ব করে বাঁচতে। কিন্তু আমার সেই সাধ এই মুহূর্ত আমার থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি আর অন্ধকারে নয় আমার দাদার পথে বাঁচতে চাই। তোমরাই আমার চোখ খুলে দিয়েছো। তোমরা আমাকে দেখিয়েছো কিভাবে বিপদে প্রভুকে ডাকতে হয়। কিভাবে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। এ কথা এত দিন আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তোমরাই তা স্মরণ করিয়ে দিলে।’
এ সময় সুমন একটু নড়েচড়ে বসতে গেল। কিন্তু পারলো না। ও ভুলে গেছে যে আমাদের হাত-পা দঁড়ি দিয়ে বাঁধা।
সুমনের নড়াচড়া তিনি লক্ষ্য করলেন।
বললেন, ‘এই দেখ, আমি ভুলেই গেছি যে তোমাদের হাত-পা বাঁধা। তোমাদের কষ্ট হচ্ছে।’
আমার কেমন যেন খটকা লাগলো। যদিও তিনি বাঁধন খুলে দিলেন এবং বললেন, ‘তোমরা এবার চলে যাও।’
‘সত্যি বলছেন?’ বলল সুমন।
‘কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?’
আমি একদৃষ্টিতে তার হাতে ধরা পিস্তলটার উপর তাকিয়ে থাকলাম। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘ও বুঝেছি। আমার হাতে পিস্তল দেখে ভয় পাচ্ছ তাই না?’ বলেই পিস্তলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এবার এটা নিয়েই তোমরা যাও।’
আমার সমস্ত সংশয় দূর হয়ে গেল। পিস্তলটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে খলিফা মামুনের প্রিয়পাত্র আলী ইবনে আব্বাসের ঘটনা। দামেস্ক নগরীর ব্যক্তির মত আমি আপনাকে বলছি, আপনি অন্ধকার থেকে আলোর পথে এসেছেন আমাদের জন্য। আর আমরা আপনাকে জ্বলন্ত অগ্নিকু- অর্থাৎ মিরনের হাতে ছেড়ে চলে যাবো তা হয় না। ঐ সিন্দুকে যে সম্পদ আছে তা মুসলমানদের সম্পদ। সুতরাং ঐ সম্পদ ঐ মিরনের হাতে যেতে পারে না।’
‘তার সাথে আমার চুক্তি হয়েছিল যে, যা পাবো দু’জনে ভাগ করে নেব। কিন্তু এখন দেখছি …।’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুমন বলল, ‘ও যে করেই হোক এই সম্পদ পুরো ভোগ করতে চাইবে। সেটা আমরা হতে দেব না।’
‘না! মিরন ভাই তা করতে পারে না।’
‘লোভ মানুষকে সব করাতে পারে।’
‘ঐ সব কথা এখন থাক। এসো আমরা এশার নামাজ পড়ি। নামাজের সময় হয়ে গেছে।’

পাঁচ
নামাজ শেষ হলে দূর থেকে পায়ের খট খট শব্দ শুনতে পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি জাবেদকে বললাম, ‘আমাদের বেঁধে ফেলুন।’
তিনি বললেন, ‘তা হয় না।’
‘দেখুন এখন সময় নেই। আপনি তাড়াতাড়ি করুন।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি আবার বাঁধলেন। তারপর পাহারা দেয়ার মত করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন।
মিরন এলেন। তার হতে পাউরুটির প্যাকেট। আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘খেয়ে নাও।’
প্যাকেটগুলো পড়লো আমাদের সামনে। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের শত্রু হতে পারি। তবে অত্যাচারী রাজার মত অতটা খারাপ নয়। না খাইয়ে মারবো না, খাইয়েই মারবো।’
‘আপনি অত্যাচারী রাজার থেকেও অধম।’ ফোস ফোস করে বলল সুমন।
‘এই ছেলে মুখ সামলে কথা বলবে। অত্যাচারী রাজার থেকে অধম হলে তোমাদের এতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতাম না।’
‘রাখা না রাখার মালিক আপনি নন। তারচেয়ে আগে বলুন খাবার সামনে রেখে খেতে দিচ্ছেন না কেন? এ কোন্ ধরনের রসিকতা। নাকি অত্যাচারীর অত্যাচার।’
সুমনের এই কথায় আমিও ক্ষুধা অনুভব করলাম। সুমনের সাথে গলা মিলিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, তাইতো। খেতে দিচ্ছেন না কেন?’
এবার তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। আমাদের হাতের বাঁধন খুলে দিলেন।
দু’জন গোগ্রাসে রুটিগুলো গিললাম। মনে পড়লো সেই কোন দুপুরে খেয়েছি।
খাওয়া শেষ হলে আবার বাঁধলেন। পিস্তল নাচিয়ে বললেন, ‘চল এখন তোমাদেরকে আজরাইলের কাছে পাঠিয়ে দিযে আসি।’
‘আজরাইলের কাছে পৌঁছানো লাগবে না। সময় হলেই সে হাজির হয়।’ বলল সুমন।
‘মনে কর তোমাদের সময় হয়ে গেছে।’ যেন তিনি আজরাইলে বড়ভাই। ভাবখানা এমন।
‘এই কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন যে, জীবন-মৃত্যু মানুষের হাতে নয়।’ বললাম আমি।
‘থাক থাক আর জ্ঞান দিতে হবে না। জাবেদ চলোতো বেরিয়ে পড়ি। বাইরে সব রেডি।’
‘কিন্তু…।’
জাবেদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিরন বললেন, ‘এরা দুইজন আর সিন্দুক নিয়ে অসুবিধাতো? এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি, আমি সব ব্যবস্থা করে তবে এসেছি। একটা পিকআপ ভাড়া করে নিয়ে এসেছি। ড্রাইভারকে বলেছি, আমরা বড় দুইজন, দুইজন ছোট ছেলে, একটা কাঠের বাক্স আর একটা সাইকেল যাবে। সাইকেলটাও ওদের।’ আমাদের দিকে আঙুল নির্দেশ করে, ‘পেয়েছি এই বাড়ির পাশের ঝোপে।’
‘কিন্তু কাঠের বাক্স কই?’ জানতে চায় জাবেদ।
‘ওপরের ঘরে আছে। ওর মধ্যে সিন্দুক ভরে নেবো।’ বিজ্ঞের মত বলে মিরন।
জাবেদ জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা যাবো কোথায়?’
‘গেলেই দেখতে পাবে।’ বলে তিনি একটা বিদ্রƒপের হাসি হাসলেন। এই হাসিতেই প্রকাশ পায় তার মধ্যে কোনো কুমতলব আছে।
দু’জন মিলে ধরে সিন্দুকটা বাইরে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ঠক ঠক শব্দ আসতে লাগলো। সিন্দুক বাক্সে ভরে হয়তো পেরেক এঁটে দিচ্ছে ওরা।
মিরন আমাদের নিতে এলেন। পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। পিস্তল উঁচিয়ে আমাদেরকে বের করে নিয়ে গেলেন। বের হওয়ার সময় দেখলাম ভেতর থেকে গুপ্ত দরজা খোলার জন্য বাইরের মতো আর একটা সুইচ আছে দরজার পাশে। উত্তেজনায় ওটা তখন আমাদের নজরে পড়েনি।
বাইরে যেয়ে দেখি সাদা রঙের একপিকআপ স্টার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পিছনে সিন্দুকের বাক্সটা আর আমাদের সাইকেল। ড্রাইভারের পাশে জাবেদ বসে আছেন। মিরন আমাদের পিকআপের ডালায় উঠতে নির্দেশ দিলেন। আমরা একান্ত বাধ্য ছেলের মত তার নির্দেশ পালন করলাম। তিনিও আমাদের সাথে উঠলেন।
ড্রাইভার টিকআপ ছাড়লো। মিরন পিস্তলটা পকেটে পুরতে পুরতে বললেন, ‘কোনরূপ চালাকির চেষ্টা করবে না কিন্তু?’
ড্রাইভার কিন্তু এসব কিছুই লক্ষ করলো না।
পিকআপ বড় রাস্তায় উঠে পশ্চিম দিকে চলল। রাতের রাস্তাটা বড় নির্জন।
ছয়
পিকআপ চলছেতো চলছেই। এর যেন শেষ নেই। হঠাৎ পাকা রাস্তা থেকে বামে মাটির রাস্তায় মোড় নিলো। মাটির রাস্তায় চলল কিছুক্ষণ। এই রাস্তায় এই নির্জন পরিবেশে পিকআপ যেন আর্তনাদ করে ছুটে চলছে।
এক সময় পিকআপ একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে থেমে গেল।
মিরন লাফ মেরে পিকআপ থেকে নামলেন। পকেটে হাতপুরে বললেন, ‘তোমরা নেমে এসো।’
আমরা নেমে এলাম। ইতোমধ্যে ড্রাইভার আর জাবেদ এসে মিরনের পাশে দাঁড়িয়েছে।
মিরন জাবেদকে একটা চাবি দিয়ে বললেন, ‘দরজা খোল।’
জাবেদ দরজা খুললেন। মিরন আবারও নির্দেশ দিলেন, ‘জাবেদ তুমি ও ড্রাইভার দু’জন মিলে বাক্সটা ঘরে তোল। আর তোমরা।’ আমাদেরকে নির্দেশ করে বললেন, ‘চল ঘরে।’
আমরা বাধ্য ছেলের মত তার আদেশ পালন করলাম।
ঘরটা বেশ বড়। ঘরে অন্ধকার বিরাজ করছে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। মিরন একটা মোমবাতি জ্বালালেন। একটি মাত্র ঘর। ঘরে তিনটি জানালা। ওগুলো বন্ধ। একটা খাট ও দুইটা চেয়ার।
আমাদের দু’জনকে চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধলেন। ইতোমধ্যে জাবেদ আর ড্রাইভার মিলে সিন্দুক ও সাইকেল নিয়ে এসেছে ঘরে।
মিরন ড্রাইভারকে নিয়ে বাইরে গেলেন। দু’জনে কি কথা বললেন শোনা গেল না।
মিরন ঘরে ফিরে এলেন। পিকআপ স্টার্ট নেয়ার শব্দ পাওয়া গেল এবং শব্দ স্থির হয়ে থাকলো।
আমি মিরনকে বললাম, ‘আমাদের কি এভাবে শাস্তি দেয়া উচিত হচ্ছে?’
‘এটা আমাদের কাজে নাক গলানোর ফসল।’
‘আমরাতো ইচ্ছে করে নাক গলায়নি। আপনারাইতো নাক গলাতে বাধ্য করেছেন।’
‘চো..ও..প। আর একটা কথাও শুনতে চাইনে।’ জাবেদের দিকে ঘুরে বললেন, ‘জাবেদ তুমি এদের দেখ। আমি একটু ঘুরে আসি।’ বলেই মিরন বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে পিকআপও ছাড়লো।
পল পল করে বয়ে চলল সময়। চলল নীরবতা পালন। নীরবতা ভাঙলেন জাবেদ।
বললেন, ‘তোমাদেরকে আমি আগেই চলে যেতে বলেছিলাম।’
‘বাদ দিন তো ওসব কথা। এখন কাজের কথায় আসুন।’
‘কি কাজ?’ বললেন জাবেদ।
‘আগে আমাদের বাঁধন খুলুন।’ বলল সুমন।
তিনি বাঁধন খুলে দিলেন। হাত-পা ডলে আমি রক্ত চলাচল ঠিক করে নিলাম। কিন্তু সুমন দড়ি হাতে চেয়ারে বসে আছে। আমি ওর দিকে তাকালাম। ও কি করতে চাই আমাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিল। এসময় কোথায় যেন পেটা ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার ঘণ্টা দিল।
আমি পুরো প্ল্যানটা নিয়ে একমুহূর্ত ভাবলাম। তারপর দু’জন দড়ি হাতে নিঃশব্দে জাবেদের দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি খাটে পা ঝুলিয়ে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে কি জানি ভাবছেন।
যখন তাকে বাঁধবো তখন তিনি বুঝতে পারলেন। কিন্তু কোন প্রতিবাদ করলেন না। আমরা তার হাত-পা বেঁধে ফেললাম।
তিনি শুধু বললেন, ‘কি হচ্ছে এ সব?’
‘মুক্তির একটা উপায়।’
‘তাহলে তাই হোক। কিন্তু তাড়াতাড়ি।’ হয়তো তিনি আমাদের প্ল্যান বুঝতে পেরেছেন।
আমি বললাম, ‘জানি আপনার একটু কষ্ট হচ্ছে। তবুও মুক্তির জন্য এই কষ্টটুকু স্বীকার করে নিতে হবে। যদি আপনিও আমাদের সাথে যেতেন তাহলে এই সম্পদগুলো মিরন এসে আমাদের না পেয়ে সরিয়ে ফেলবে। আর কখনও হয়তো তা পাব না। আর….।’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তিনি বললেন, ‘আর বেঁধে তোমরা ভালো করেছো। এতে মিরন সম্পদগুলো নিজের করতে পারবে না। তবে তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।’
সুমন আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুরান ভাই তাড়াতাড়ি চল পুলিশ ডেকে আনি।’
‘হ্যাঁ চল।’ বললাম আমি।
দু’জনে ঘর থেকে বের হয়ে আন্দাজের ওপর নির্ভর করে উত্তর দিকে ছ্টুলাম। উত্তেজনায় সাইকেলর কথা ভুলেই গেছি।
যখন চারিদিকে শুধু আখ ক্ষেত দেখতে পেলাম তখন সাইকেলের কথা মনে পড়লো।
আখ ক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে দু’জন দু’জনের দিকে তাকালাম। দু’জনের চোখে তখন একই প্রশ্ন, কোন্ দিকে যাব?
ঠিক তখন পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘আর কোনো দিকে যেতে হবে না। ওখানেই দাঁড়াও ’
চকরির মত পাক খেয়ে দু’জন পিছনে তাকালাম। বিশ-পঁচিশ ফুট দূরে একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা কালো বস্তু নড়াচড়া করতে দেখে আমাদের আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, ও মিরন। আর ওর হাতে পিস্তল।
তিনি কাছে এগিয়ে এলেন। পিস্তল উঁচিয়ে বললেন, ‘আর এক পা নড়েছো তো মাথা গুঁড়ো করে দেব। বাধ্য ছেলের মতো যেখান থেকে এসেছো সেখানে চলো।’
পিস্তলের মুখে কোন কিছু বলার বা করার সাহস হলো না। ওর আদেশ পালন করলাম। আমরা আগে তিনি পিছে পিছে এলেন।
ঘরের এক কোণ্ থেকে দঁড়ি এনে আবার ও আমাদের চেয়ারের সাথে বাঁধলেন। কিন্তু জাবেদকে খুললেন না।
বাঁধা শেষ করে একটা হাসি দিলেন। কিন্তু একে হাসি বলে মনে হলো না আমার কাছ। মনে হলো যেন হায়েনা হাসছে।
হাসি থামিয়ে বললেন, ‘পিচ্চির দল বেশতো একহাত দেখালে। আমি গিয়েছিলাম একজন স্বর্ণকারের কাছে। এসে দেখি দুইটি ছায়া মূর্তি বেরিয়ে যাচ্ছে আখ ক্ষেতের দিকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম তোমরা ছাড়া আর কেউ না। কিন্তু….।’ মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললেন, ‘আমার দুঃখ হচ্ছে বেচারা জাবেদের জন্য। আমিতো ওকে গুপ্তধনের একপাইও দেবো না।’
এ কথা শোনার সাথে সাথে জাবেদ উঠে দাঁড়াতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। কেননা তার হাত-পা বাঁধা।
মিরন জাবেদের কাছে এগিয়ে গিয়ে পিস্তলের বাঁট দিয়ে জাবেদের কানের পাশে একটা আঘাত করলেন। অমনি তিনি মেঝেয় পড়ে গেলেন। নিথর হয়ে পড়ে রইলেন মেঝেয়।
মিরন এবার পিস্তল নাচাতে নাচাতে সিন্দুকের কাছে গেলেন। বাক্স ভেঙে সিন্দুক বের করে আনলেন। দক্ষ চোরের মতো খুলে ফেললেন সিন্দুকের তালা চাবি ছাড়াই। পাল্লা খুলেই তার মধ্যে হাত প্রবেশ করালেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল।
আমি ভাবলাম হয়তো গুপ্তধন রক্ষাকারী কোনো সাপ তাকে দংশন করেছে। রূপকথার গল্পে যেমন থাকে।
কিন্তু না! তিনি তা থেকে সেই আমলের একটা চিঠি বের করলেন। চিঠিটা রাজ চিঠির মত ছোট্ট দু’টি লাঠির সাথে প্যাঁচানো। তিনি তা খুলে পড়তে লাগলেন। পড়া শেষ হলে আমাদের দিকে তাকালেন। তার চোখ-মুখে এক আনন্দাভাব দেখা দিলো। মনে হলো এখন তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা।
সুমন মিরনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘যখন আমরা রাজবাড়ী খুঁজছিলাম তখন কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিলেন আমাদের সাথে। তারপর দেখলাম আপনি ভালো লোক নন। আপনি একজন বাজে মানুষ। সত্যি প্রবাদ বাক্যটা মিছে নয় ‘দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা।’
‘এক্কেবারে মিথ্যা কথা।’ স্বগোক্তি ভাবে বললেন তিনি।
‘কেমন করে?’ বলল সুমন।
‘ইসলামের ইতিহাস স্মরণ কর। দেখবে মুসলমানরা ব্যবহারে বিশ্ববরেণ্য হয়ে আছে।’ যেন তিনি অন্তর থেকে বলেলন কথাটি।
‘আপনার মুখে এসব কথা মানায় না। কেননা আপনি তো ভালো মানুষ নন। আপনি দুষ্টু। পাজির পা ঝাড়া।’ ঝাঁঝের সাথে বললাম আমি।
‘হয়তো ছিলাম। কিন্তু এখন এই মুহূর্ত থেকে আর নেই। এই চিঠি শুধু আমার চোখ নয় অন্তরের দুয়ারও খুলে দিয়েছে। জীবনে অনেক, অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু আর নয়। বাকি জীবন মানুষের তরে, দেশের তরে, ধর্ম-কর্ম পালন করে কাটিয়ে দেবো। এটা আমার ওয়াদা।’ অন্য এক ভালো মানুষের মতো বললেন তিনি।
‘দেখি চিঠিটা। কি লেখা আছে ওতে।’ বললাম আমি।
‘তার আগে তোমাদের বাঁধন খুলে দিই।’
আমাদের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে জাবেদের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার বাঁধনও খুলে দিলেন। ইতোমধ্যে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। মিরনের সমস্ত কথাগুলো তিনি শুনেছেন। উঠে চুপ করে খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলেন।
আমি চিঠির প্যাঁচানো খুললাম। তাতে লেখা:
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ,
এই সিন্দুকের সম্পদ কারো ব্যক্তিগত নয়। এতে যে সোনা-দানা, গহনা-গাঁটি স্বর্ণ ও রোপ্য মুদ্রা আছে তা মুসলমানদের দান। তাদের দানের কারণ তারা একটা মসজিদ ও মাদ্রাসা তৈরি করবে। জানি নাহ! তাদের আশা মহান আল্লাহ পূরণ করবেন কিনা? রাজা ক্ষেপেছে। যে কোনো সময় আমাদের আটক করতে পারে।
আমাকে ধরার কয়েক দিন পরে এক রাতে রাজার লোকেরা সিন্দুকটিও এখানে আনে। এ রাজা আমাকে মসজিদ নির্মাণ করতে দেয়নি। দেয়নি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে।
যখন আমরা চাইলাম সত্যিকার মুসলমান হয়ে বাঁচবো। তখনি রাজার সাথে আমাদের টক্কর লাগলো। আর এটাই নিয়ম। যুগে যুগে নবী-রাসূল ও তাদের অনুসারীদের সাথে বাতিল শক্তির টক্কর লেগেছে। ভবিষ্যতেও ইসলামপন্থী ও বাতিলপন্থীদের মধ্যে বিরোধ লাগবেই।
একদিন শেষ হবে এই রাজার অত্যাচার। আসবে সেনালি দিন। আমার বড় আশা এই বাংলার আকাশে শান্তি-সুখের সুবাতাস বয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা। তাইতো আমি গ্রামের মানুষগুলোকে একত্র করতে শুরু করেছি। জানি না আমার সেই আশা পূরণ হবে কি না?’
ইতি
আবুল হাসান

Share.

মন্তব্য করুন