প্রতিটি বিশ্বকাপ শেষের সাথে সাথেই শেষ হয় অনেক ফুটবলারের ক্যারিয়ার। বিশ্ব ফুটবলের এই বড় মঞ্চেই অনেকে খেলেন দেশের হয়ে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটা। পরের বিশ্বকাপ ৪ বছর পরে, তাই বয়সী খেলোয়াড়রা আগেই সরে যেতে শুরু করেন নতুনদের জায়গা করে দেয়ার জন্য। কেউ হাসি মুখে, কেউবা অশ্রুসিক্ত নয়নে তুলে রাখেন বুট জোড়া। এবারের বিশ্বকাপের মাঝ পথেই এমন দু’টি অবসরের ঘোষণা ফুটবল মাঠে সৃষ্টি করেছে শূন্যতা। স্পেনের আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ও আর্জেন্টিনার হাভিয়ের ম্যাচেরানো ঘোষণা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার সমাপ্তির। দুঃখজনকভাবে দু’জনের দেশই দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে, তাই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষটা মধুর হয়নি দীর্ঘদিন দেশের হয়ে খেলা এই দুই তারকার। বয়সের কারণে বিশ্বকাপের পর তাদের অবসরটা অনুমেয়ই ছিলো; কিন্তু তাই বলে এভাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে বিদায় নেয়াটা কারো ভাবনায় ছিলো না।

শেষটা রঙিন হলো না ইনিয়েস্তার
স্পেন আর বার্সেলোনা ক্লাবের কিংবদন্তি মিডফিল্ডার ছিলেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। তার সম্পর্কে বলা হয়, স্পেন ও বার্সেলোনার মাঝমাঠের সেনাপতি। ফুটবলের সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারের খেতাবটি অনায়াসেই জুড়ে দেয়া হয় তার নামের সাথে। ফুটবলে একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে জেতা সম্ভব এমন সব শিরোপাই জিতেছেন ইনিয়েস্তা। স্পেনের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক তিনি। ২০১০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে তার দেয়া গোলেই নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে স্পেন। ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও উঠেছিলো তার হাতে। তার আগে ও পরে দেশের হয়ে জিতেছেন ইউরোপ মহাদেশের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক শিরোপা ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ (২০০৮ ও ২০১২)। ২০১২ ইউরোতে তার নেতৃত্বেই স্পেন জিতেছে টানা দ্বিতীয় ইউরো শিরোপা। সে আসরের ম্যান অব দ্য ফাইনাল ও ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টও হয়েছিলেন ইনিয়েস্তা। ২০১০ সালে ফিফা ব্যালন ডি অর পুরস্কারে দ্বিতীয় ও ২০১২ সালে তৃতীয় হয়েছিলেন তিনি। লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর অতিমানবীয় খেলার কারণেই হয়তো তার হাতে ওঠেনি পুরস্কারটি।
১২ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে স্পেনের হয়ে খেলেছেন ১৩১ ম্যাচ। গোল করেছেন ১৩। গোলসংখ্যা দিয়ে কোন মিডফিল্ডারকে পরিমাপ করার সুযোগ নেই। তার বাড়ানো বলে স্ট্রাইকাররা শতাধিক গোল করে দলকে আনন্দে ভাসিয়েছেন। ক্লাবের হয়েও ইনিয়েস্তার সাফল্যের ঝুড়ি ভর্তি একের পর এক ট্রফিতে। বার্সেলোনার স্বর্ণযুগ বলা হয় ২০০৮ থেকে ২০১৬ সময়টিকে। এই সময়েই বার্সেলোনা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্লাব হয়ে উঠেছে। আর এই সাফল্যের নেপথ্যে বড় অবদান ইনিয়েস্তা, জাভি হার্নান্দেজ আর লিওনেল মেসির। সর্বমোট ৩৩টি ট্রফি জিতেছেন বার্সেলোনার হয়ে। ক্লাব বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা সব শিরোপা স্বাদই পূর্ণ হয়েছে বার্সেলোনার জার্সিতে। বার্সেলোনার ঐতিহাসিক দু’টি ট্রেবল জয়েরও (২০০৯ ও ২০১৫) সাক্ষী ইনিয়েস্তা।
ফুটবলে যে কোন দলের শক্তির জায়গা হচ্ছে মাঝমাঠ। এখান থেকেই ফরোয়ার্ডদের বলের যোগান দেয়া হয় গোলের জন্য। ইনিয়েস্তা তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সেই কাজটিই করেছেন দক্ষতার সাথে। ফুটবলে সাধারণত বড় তারকা হয়ে ওঠেন ফরোয়ার্ড বা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা। তারা গোলের পর গোল করে দলকে জয় উপহার দেন; কিন্তু মাঝমাঠের খেলোয়াড়রা হচ্ছেন ফরোয়ার্ডদের সাফল্যের নেপথ্যের কারিগর। তারাই বল জোগান দেন প্রতিটি আক্রমণের জন্য। আবার প্রয়োজনে উপরে উঠে গোল করেন। ইনিয়েস্তা আর বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব যেন ছিলো মানিকজোড়। ক্লাবের যুব অ্যাকাডেমি লা মাসিয়া থেকেই ফুটবলার হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। ২০০২ সালে ক্লাবটির হয়ে অভিষেক হলেও নিয়মিত খেলার সুযোগ পেয়েছেন ২০০৪-০৫ মৌসুম থেকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জাতীয় দল ছাড়াও স্পেনের অনুর্ধ্ব-১৫, ১৬, ১৭, ১৯, ২০ ও ২১ দলে খেলেছেন।
খেলার মাঠে সাফল্যের পাশাপাশি কিছু ব্যর্থতাও দেখতে হয়েছে এই কিংবদন্তি মিডফিল্ডারকে। ২০১০ সালে বিশ্বকাপ জেতা স্পেন ২০১৪ আসরে বিদায় নিয়েছে প্রথম রাউন্ড থেকে। এবারের বিশ্বকাপেও তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে টাইব্রেকারে রাশিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে। ফলে বিদায়টা সুখকর হলো না এই তারকার।
বিশ্বকাপের আগেই আভাস দিয়ছিলেন জাতীয় দল থেকে অবসরের। এ বছরের মে মাসে বার্সেলোনা ক্লাব ছেড়ে জাপানের ভিসেল কোবে ক্লাবে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেন। বয়স ৩৪ বছর হয়ে গেছে, আর দু’ এক বছর গেলে হয়তো গতি আর ক্ষিপ্রতা কমে আসবে। তাই আগে ভাগেই মাঠে নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। গত মৌসুমে স্প্যানিশ লা লিগার শিরোপা জেতার ম্যাচ দিয়েই বিদায় নিয়েছেন প্রিয় ক্লাব থেকে। ইচ্ছে করলে ইউরোপ-আমেরিকার কোন নামি ক্লাবে নাম লেখাতে পারতেন; কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যে ক্লাবের সাথে আত্মার সম্পর্ক- সেই বার্সেলোনার বিপক্ষে কখনো খেলতে যাতে না হয় তাই চলে গেছেন জাপানের ক্লাবে। ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যা ও এক পুত্রের জনক ইনিয়েস্তা।

কান্নায় বিদায় ম্যাচেরানোর
ইনিয়েস্তার সাথেই ক্লাব ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা বার্সেলোনায় কাটিয়েছেন আর্জেন্টাইন তারকা হাভিয়ের ম্যাচেরানো। তাকে বলা হতো আর্জেন্টিনা দলের লিটল চিফ। সাবেক এই অধিনায়ক আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছেন ১৫টি বছর। অবশ্য ইনিয়েস্তার সাথে তার বড় একটা অমিল আছে। ইনিয়েস্তা যেখানে সব কিছু জিতেছেন, সেখানে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনার হয়ে পাঁচটি ফাইনাল খেলেও কোন শিরোপা জেতা হয়নি ম্যাচেরানোর। লিওনেল মেসির মতোই এই অপূর্ণতার তার।
অসম্ভব পরিশ্রমী আর নিবেদিতপ্রাণ এই ফুটবলার মাঠে নামলে যেন প্রয়োজনে দলের জন্য প্রাণটাকেও দিয়ে দিতে পারতেন। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ছিলেন। এর পর মেসির হাতে নেতৃত্ব তুলে দিলেও সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে দলটাকে একসূত্রে গেঁথে রাখতে তারই ছিলো প্রধান ভূমিকা। চারটি কোপা আমেরিকা কাপ আর ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেও একবারও শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে না পারাটাই এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আফসোস। অবশ্য অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে ২০০৪ এথেন্স ও ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতেছেন।
২০১৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ফাইনালে যাওয়ার পেছনে লিওনেল মেসির পরই তার ভূমিকা ছিলো বলে মনে করা হয়। সেবার খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছেন বিশ্বকাপ শিরোপার। ফাইনালে গঞ্জালো হিগুইন ওই সহজ গোল মিস না করলে হয়তো এবারের বিশ্বকাপটা তিনি বাড়িতে বসে টিভিতেই দেখতেন; কিন্তু ওই যে কিছুই না জেতার অভাব ঘোচাতেই হয়তো আরো একটি আসর খেলেছেন জাতীয় দলে। কিন্তু নিয়তি কখনো বড়ই নির্মম। এবার দ্বিতীয় রাউন্ডেই আর্জেন্টিনার বিদায়, তাকে রাঙাতে দিল না ক্যারিয়ারের শেষটা। ২০০৩ সালে অভিষেকের পর আর্জেন্টিনার হয়ে ১৪৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। যা দেশটির হয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড। আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল আছে তিনটি। বার্সেলোনার হয়ে ম্যাচ খেলেছেন ২০৩টি।
বয়স হয়ে গেছে ৩৫। আগের সেই গতি আর ক্ষিপ্রতা নেই। গত মৌসুমে লা লিগা জিতেই তাই বার্সেলোনাকেও বিদায় বলেছেন। যোগ দিয়েছেন চীনের হেবেই চায়না ফরচুন ক্লাবে। বার্সেলোর হয়ে পাঁচটি লা লিগা, দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, দুইটি ক্লাব বিশ্বকাপসহ জিতেছেন অনেকগুলো শিরোপা। ক্লাবটিতে যোগ দিয়েছিলেন ২০১০ সালে। আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেটে ক্যারিয়ার শুরু। এরপর ব্রাজিলের করিন্থিয়ান্স, ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট হ্যাম ও লিভারপুল ক্লাব হয়ে যোগ দিয়েছেন বার্সায়। একের পর এক সাফল্যই তাকে টেনে নিয়ে গেছে এতদূর। কাজানে ফ্রান্সের কাছে হারার পর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘোষণা দিয়েই কেঁদে ফেলেন মাচেরানো। বলেন, ‘খুবই দুঃখজনক বিদায় হলো। দলের হয়ে সব মিলিয়ে পাঁচটি ফাইনাল খেলেছি। কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপ না জেতার কষ্ট আমি ভুলতে পারবোনা।’
সেই ২০০৩ সাল থেকে জাতীয় দলে খেলছেন। এবার নিয়ে চার বিশ্বকাপে তার উপস্থিতি। তার অবসরে আর্জেন্টিনা একজন নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার হারালো, যিনি কখনোই নিজের সুনামের জন্য নয় দলের প্রয়োজনে যেখানে যেভাবে দরকার খেলেছেন। যেমন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই খেলেছেন মিডফিল্ডার হিসেবে; কিন্তু বার্সেলোনায় যাওয়ার পর তাকে যখন বলা হলো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে, না করেননি ম্যাচেরানো। এরপর এক পর্যায়ে তো দলের প্রয়োজনে পুরোপুরি ডিফেন্ডার হিসেবেই সামলেছেন বার্সেলোনার রক্ষণভাগ।

Share.

মন্তব্য করুন