ইন্টারনেট আধুনিক যুগের এক বিস্ময়। ইন্টারনেটের সুবাদে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়ে গেছে। যে কেউ চাইলেই এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে বিশে^র এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে আলাপচারিতা করতে পারে অথবা মেইল আদান-প্রদান করতে পারে এবং কাক্সিক্ষত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তাই এবার আমরা এখানে ইন্টারনেট সম্পর্কে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করবো।
ইন্টারনেট হচ্ছে ইন্টারকানেক্টেড নেটওয়ার্কের সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা বিশেষ গেটওয়ে বা রাউটারের মাধ্যমে কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলো একে-অপরের সাথে সংযোগ করার মাধ্যমে গঠিত হয়। ইন্টারনেটকে প্রায়ই নেট বলা হয়ে থাকে।
তোমরা ইন্টারনেটে কারো সাথে চ্যাট করো কিংবা কাউকে মেইল সেন্ড করো তখন কখনো কি ভেবে দেখেছো যে এই কাজগুলো সম্পূর্ণ হতে কতগুলো আলাদা কম্পিউটার একসাথে কাজ করে যাচ্ছে? তুমি ডেস্ক বা ল্যাপটপ কম্পিউটার নিয়ে বসে আছো, আর আরেক প্রান্তে তোমার বন্ধু কম্পিউটার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে তোমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। কিন্তু ভেবে দেখেছো কি, তোমার আর তোমার বন্ধুর কম্পিউটারের ফাঁকের মধ্যে আরো কত ডজন কম্পিউটার রয়েছে যা তোমার আর তোমার বন্ধুর কম্পিউটারের মধ্যের ফাঁকা স্থান পূরণ করছে। আর এভাবেই একটি কম্পিউটারের সাথে আরেকটি কম্পিউটার সংযুক্ত রয়েছে গোটা পৃথিবীজুড়ে আর এটাই হলো দি ইন্টারনেট। কিন্তু এই আলাদা আলাদা কম্পিউটারগুলো নিজেদের ভেতর সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয় কিভাবে? বন্ধুরা, এসো এই সমস্ত বিষয় আরো ঘনিষ্ঠভাবে জানার চেষ্টা করি।
ইন্টারনেট কী? বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত হয়ে গেছে আর এই সবই কৃতিত্ব ইন্টারনেটের। গত ২০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মোটামুটি ২১০টি আলাদা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এর বিস্তার। এমনকি পৃথিবীর অনেক দরিদ্রতর দেশও সংযুক্ত হয়েছে এই জালে।
বেশির ভাগ মানুষই মনে করে যে, ইন্টারনেট শব্দটির মানে অনলাইনে চলে যাওয়া। কিন্তু সত্য কথা বলতে কী, এটি একটি সাধারণ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। মনে কর, একটি রাস্তার কথা যা পুরো পৃথিবী জুড়ে পেঁচিয়ে রয়েছে। যেমন করে রাস্তা দিয়ে ট্র্যাফিক বয়ে গিয়ে তার গন্তব্যে পৌঁছে ঠিক তেমনি বিভিন্ন কম্পিউটার দিয়ে ডাটা বয়ে গিয়ে তার গন্তব্যে পৌঁছে। আর এটাই হলো ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি। ইন্টারনেট আসলে একেকটি আলাদা কম্পিউটারের একসাথে সংযুক্ত হয়ে থাকার একটি সিস্টেম (তোমার ঘরের কম্পিউটার, অফিসের কম্পিউটার, স্কুল কলেজের কম্পিউটার ইত্যাদি)।
একটি কম্পিউটারের সাথে আরেকটি কম্পিউটারের সংযোগ করা থাকে বিভিন্ন উপায়ে। কোন কম্পিউটারগুলো সংযুক্ত থাকে পুরাতন কপার ক্যাবল দ্বারা আবার কোনগুলো ফাইবার-অপটিক ক্যাবল (যা আলোর স্পন্দনের মধ্যে ডাটা সেন্ড করে) দ্বারা, আবার কোন কম্পিউটারগুলো বেতার কানেকশনে যুক্ত থাকে (বেতার কানেকশন মানে আমরা যাকে ওয়্যারলেস বুঝি, এটি রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করে) এবং কোন কম্পিউটারগুলো স্যাটেলাইটের সাথে সংযুক্ত থাকে। আর এইভাবেই আমরা উপভোগ করতে পারি ইনস্ট্যান্ট মেসেজ সুবিধা, ইমেইল সেবা, অথবা ডাউনলোড করি এমপিথ্রি মিউজিক ফাইলস।
ইন্টারনেটের আসল কাজ কী? ইন্টারনেটের কাজটা আসলে খুবই সহজ, সে শুধু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ডাটার আদান-প্রদান করে, ব্যাস এইটুকুই। যে মেশিনগুলো একত্রিত হয়ে ইন্টারনেট তৈরি করেছে তাদের প্রধান কাজই হলো ডাটা আদান আর প্রদান। বাস্তবিকভাবে তুলনা করতে গেলে ইন্টারনেটকে পোস্টাল সার্ভিসের সাথে তুলনা করা যায়। পোস্টাল সার্ভিসে চিঠি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আদান-প্রদান করা হয়। কিন্তু এটা কোন ব্যাপার না যে চিঠি কার কাছ থেকে এলো বা চিঠির ভেতর কি লেখা আছে। আবার চিঠি একদম ফাঁকা থাকলেও পোস্টাল সার্ভিসের কোন যায় আসে না। তার কাজ চিঠি পৌঁছানো, ব্যাস তা পৌঁছে দেবে। ইন্টারনেটও একইভাবে কাজ করে।
পোস্টাল সার্ভিসের মতো ইন্টারনেটও অনেক তথ্য ধারণ করে তা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেয়। এর মানে হলো যদি কোন ডাটা আদান প্রদান করানো হয় তবে ইন্টারনেট সেটি সম্পূর্ণ করে দেবে। এখন আপনি ইমেইল পাঠালেন না কাউকে মেসেজ করলেন এর সাথে ইন্টারনেটের কোনো লেনদেন নেই। তবে যে কাজেই ডাটা আদান প্রদান করার বিষয় আছে সেটিই ইন্টারনেট সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করবে। এখন এই ডাটা আদান প্রদানের সূত্রের ওপর ভিত্তি করে আমরা নতুন নতুন ব্যবহার খুঁজে বের করছি। যেমন যখন দুই ইউরোপিয়ান বিনিয়োগকারী স্কাইপ তৈরি করলেন তখন তারা টেলিফোনের কথা বলাকে নেটে নিয়ে এলেন। তারা একটি প্রোগ্রাম তৈরি করলেন যেখানে আমাদের কথা ডাটায় পরিণত হতে পারে এবং তা আদান প্রদানের মাধ্যমে কথাবার্তা চলতে থাকে। কিন্তু কখনোয় সরাসরি আমাদের কথা আদান প্রদান করিয়ে স্কাইপের জন্য আলাদা ইন্টারনেট তৈরি করা সম্ভব ছিল না।
ইন্টারনেটের ডাটাগুলো কিভাবে আদান প্রদান করা হয়? ইন্টারনেট মূলত টেলিফোন নেটওয়ার্কের মতো কাজ করে থাকে। কিন্তু ইন্টারনেটের ডাটা বহন করা আর টেলিফোন লাইনে কল করা আলাদা ব্যাপার। তুমি যখন তোমার কোনো বন্ধুকে রিং করো তখন তোমার টেলিফোনে তুমি ও তোমার বন্ধুর মধ্যে একটি সরাসরি কানেকশন (বা সার্কিট) ওপেন হয়ে যায়। তুমি যতক্ষণ টেলিফোনে কানেক্ট হয়ে থাকো, সার্কিটটি ততক্ষণ ওপেন হয়ে থাকে। একটি টেলিফোনের সাথে আরেকটি টেলিফোনকে কানেক্ট থাকার পদ্ধতিকে সার্কিট সুইচিং বলা হয়। কখন কার কথা শোনা যাবে আর কার কথা পাঠানো হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে ইলেকট্রনিক টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সিস্টেম।
কিন্তু বন্ধুরা, তোমরা একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে যে, সার্কিট সুইচিং কোন নেটওয়ার্ক স্থাপন করার জন্য সত্যিই অদক্ষ একটি পদ্ধতি। তুমি যখনই ফোনে তোমার বন্ধুর সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকবে তখন সেই লাইনে তোমার সাথে অন্য কেউ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। (মনে কর, তুমি কাউকে একটি ইমেইল টাইপ করছো, টাইপ করতে ঘণ্টা লেগে যেতে পারে, আর এই সময়ে যদি তোমাকে আর কেউ কোন মেইল সেন্ড করতে না পারে তবে?) মনে কর, তুমি টেলিফোনে অনেক ধীরে ধীরে কথা বলছো বা কথা বলতে বলতে লম্বা ফাঁকা নিচ্ছো বা কথা বলতে গিয়ে ফোন রেখে কফির মগ আনতে গেলে। তো তুমি তো তখন কোনো তথ্য প্রেরণ করছো না, কিন্তু তারপরও তোমার ফোন তোমার বন্ধুর ফোনের সাথে কানেক্টেড হয়ে রয়েছে। তোমাকে প্রত্যেকটা সেকেন্ডের জন্য বিল চার্জ করা হচ্ছে এবং তুমি কথা বলো আর নাই বলো ফোন কানেক্টেড থাকা মানে আর অন্য কেউ সেই লাইনে ফোন করতে পারবে না। তাই সার্কিট সুইচিং কখনোই আদর্শ নেটওয়ার্ক হতে পারে না। তাহলে ইন্টারনেট কি ধরনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ডাটা বহন করে?
প্যাকেট সুইচিং : ইন্টারনেট তার ডাটা বহন করতে এখনো কখনো কখনো সার্কিট সুইচিং পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। যেমন তুমি যদি ডায়াল-আপ কানেকশন (যেখানে তোমার কম্পিউটার তোমার ইন্টারনেট প্রদানকারীর কাছে পৌঁছাতে একটি টেলিফোন নাম্বার ডায়াল করে, আর এটি কোন সাধারণ ফোন কলের মতোই কাজ করে) ব্যবহার করেন ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হতে। এখানে তুমি অনলাইনে আসার জন্য সার্কিট সুইচিং পদ্ধতি ব্যবহার করলে। তাই আমি কানেক্টেড থাকা পর্যন্ত কেউ তোমাকে ফোন করতে পারবে না এবং তোমাকে কানেক্ট থাকার প্রত্যেক সেকেন্ডের জন্য টাকা দিতে হবে। এবং বদলে তোমার নেট কানেকশন কাজ করবে একদম কচ্ছপ গতিতে।
কিন্তু বেশির ভাগ ইন্টারনেট ডাটা বহন করা হয়ে থাকে সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতিতে যার নাম হলো প্যাকেট সুইচিং। মনে কর তুমি তোমার কোনো ভারতীয় বন্ধুকে ইমেইল পাঠাতে চাচ্ছো। তো এখানে তোমার ভারতীয় বন্ধু এবং তোমাকে সরাসরি কানেক্টেড থাকার কোনো প্রয়োজন নেই এই সম্পূর্ণ মেইলটি একবারে পাবার জন্য। প্যাকেট সুইচিংয়ে তোমার মেইলটি পাঠানোর পরে তা অনেকগুলো খ-ে বিভক্ত হয়ে যায়। আর এই প্রত্যেকটি খ-কে বলা হয়ে থাকে প্যাকেট। প্রত্যেকটি প্যাকেটের গায়ে ট্যাগ করা থাকে যে তাদের কথায় যেতে হবে এবং তারা আলাদা আলাদা পথে ভ্রমণ করতে পারে। খ-গুলো যখন তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যায় তখন সেগুলো আবার একত্রিত হয়ে যায়, যাতে তা মেইল রূপে প্রদর্শিত হতে পারে।
প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতি সার্কিট সুইচিং পদ্ধতি হতে অনেক বেশি দক্ষ হয়ে থাকে। তোমার কখনোই প্রয়োজন পড়বে না কারো সাথে একেবারে কানেক্টেড হয়ে থাকার। তাই তুমি কারো লাইন একদমই বন্ধ করে রাখছো না। অন্য কেউ একই সময়েই একই লাইন ব্যবহার করতে পারে এবং নির্দিষ্ট প্যাকেটগুলো ঠিক মতোই তোমার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। যেহেতু প্যাকেটগুলো আলাদা আলাদা পথে ভ্রমণ করে পৌঁছায় তাই কোন বাধা বিঘœ ঘটে না। ফলে অনেক ফাস্ট স্পিড দেখতে পাওয়া যায়।
ইন্টারনেটের ইতিহাস শুরু হয়, ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের অগ্রগতির সাথে সাথে ১৯৫০ সালে। ইন্টারনেট সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে প্রথম ধারণা প্রবর্তিত হয়েছিল, যখন কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক লিওনার্ড ক্রাইনরক তার গবেষণাগার মাধ্যমে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) থেকে অর্পানেটের মাধ্যমে একটি বার্তা স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এসআরআই) পাঠান।
১৯৬০-এর দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণা সংস্থা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট্স এজেন্সি বা আরপা পরীক্ষামূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে তৈরি করা এই নেটওয়ার্ক আরপানেট নামে পরিচিত ছিল। ইন্টারনেট ১৯৮৯ সালে আইএসপি দ্বারা সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯০ এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৯০ এর পরবর্তী সময়ের দিকে পশ্চিমা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন