এক.
নীলুদের খেলার জায়গাটা নির্দিষ্ট। বাড়ি থেকে দূরের যে জঙ্গল আছে তার মাঝখানে মাঠটা। পাশে একটা ভাঙাচোড়া পোড়া জমিদার বাড়ি। এই বাড়ি আর জঙ্গল নিয়ে এলাকায় নানা ভয়ানক গল্প প্রচলিত থাকলেও সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই নীলুদের। বলা যায় দঃসাহসী একদল বালক এরা। স্কুল ছুটি হলেই বিকালে এই মাঠে ক্রিকেট খেলা ওদের রীতিমত ডাল ভাতের মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীলু, ইকু, সাকিব, মুরাদ, মেহেদী ও মারুফ। ছয় বন্ধুর একটা দল। কিছুটা গোয়েন্দা টাইপের। বিকেলবেলা শুরু হল খেলা। নীলু ব্যাটিং করছিল। ইকুর বলিংয়ের হাত ভাল হলেও নীলুকে কাবু করা চাট্টিখানি কথা নয়। একে একে নীলু দুই-চার পিটিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে সে মারলো এক ছক্কা। কিন্তু বিপত্তি এখানেই ঘটে গেল। বলটা মাঠ ছেড়ে সোজা পোড়া বাড়িতে ঢুকে গেল। সবাই তো ভয়ে চুপ! কারণ, এই বল এখন কে আনবে? আর বল ছাড়া ওদের খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। মারুফ একটু ভিতু টাইপ ছেলে। ও বললো, ‘এখন কী হবে রে নীলু? তুই একি করলি!’
‘আরে চুপ, যেটা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। এখন কথা হল, বলটা কে আনতে যাবে?’ মারুফকে ধমক দিয়ে ইকু সবার দিকে তাকালো। সাকিব বললো, ‘কেন কেন? যে বল মেরেছে সেই গিয়ে আনবে।’ নীলু বললো, ‘ঠিক আছে আমি যাব বল আনতে। তোরা Happy তো?’ সবাই সবার দিকে তাকানো শুরু করলো। কিন্তু মেহেদী সবার থেকে একটু আলাদা। ও বললো, ‘না, এই ভুল করা যাবে না। নীলু হোক আর যেই হোক, একা একা ওখানে এই শেষবেলা যাওয়া ঠিক হবে না। চলো সবাই একসাথে যাই। আর দেখি আসলে কি রকম দেখতে পোড়া বাড়ির ভেতরটা।’ সবাই একসাথে হাঁটা শুরু করলো। দোতলা বাড়িটার ইট ও পলেস্তারা সব খসে খসে পড়ছে। বাড়ির সামনে একটা বড় জলাশয়, হাজার বছরের পরিত্যক্ত এই জলাশয়। প্রচুর লাল, নীল ও গোলাপী পদ্ম ফুলে জলাশয়টা পূর্ণ। শান বাঁধানো ঘাট। চারপাশে প্রচুর ঘাস ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ। দেয়ালের যেখানে সেখানে ফাটল ধরে গেছে। রুমগুলো ময়লা-আর্বজনায় পূর্ণ। কতকাল না জানি এখানে মানুষের পা পড়েনি। দরজা ও জানালাগুলো ভাঙ্গা ও মরিচা ধরা। গোটা পোড়া বাড়ির অন্ধকারের ভেতর কেমন যেন একটা ভয়ের হীম ¯্রােত বয়ে গেলো ছয় কিশোরের মনে। প্রতিটি দরজার সামনে একটি করে নারীমূর্তি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে ওরা রুমগুলো দেখতে লাগল। প্রায় দু’ঘন্টা খোঁজাখুজি করেও বলটা পেল না। হঠাৎ নীলু হকচকিয়ে গেল। কারণ, উপর তলায় একটা বুড়ো বয়সি মানুষ। লোকটা ভয়ানক দৃষ্টিতে নীলুর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ানক দু’টো লাল চোখ। মনে হয় কোনো অশরীরী। লোকটা রেগে বললো, ‘এই ছোকরার দল, এখানে কী চাই?’ সবাই ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা। মেহেদী সাহস করে বললো, ‘কাকু, আমরা মাঠে খেলছিলাম। হঠাৎ করেই আমাদের বলটা…।’
‘থাক থাক, আর বলতে হবে না। এই নাও বল। ভুল করেও আর এখানে এসো না। দূর হও।’ লোকটা অবাক করে দিয়ে ওদের বলটা ফেরত দিল। এদিকে চারপাশ অন্ধকার করে সন্ধ্যা নেমে পড়েছে। সবাই একসাথে হাঁটা শুরু করলো, ভয়ে একবারও পিছনে তাকালো না। লোকটা বিশ্রী করে কী যেন বলছিল। নীলুরা সেটা বুঝতে পারল না।

দুই.
ছোট চাচা রাশিয়া থেকে আসছেন। দু’মাস বাংলাদেশে থাকবেন। তিনি জঅঝঅ এর একজন কর্মকর্তা। মহাকাশ নিয়ে আর ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে রাশিয়া সরকার। আর চাচা এই প্রজেক্ট এর দ্বায়িত্বে আছেন। ছোট চাচা আসবে এই নিয়ে নীলুর আনন্দের শেষ নেই। অবশেষে চাচা ঢাকায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে ফোন দিলেন বাসায়। ফোনটা নীলু রিসিভ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা থেকে বাড়ি আসবেন চাচা। দাদু অনেক খুশি। ‘যাক বাবা, শাহরিয়ার তাহলে আসছে। কতদিন দেখিনি ছেলেটাকে।’ দাদুর চোখগুলো ভিজে উঠলো। খবরটা ছড়িয়ে পড়লো বাকি পাঁচজনের কানে। কারণ নীলুরা চাচাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর চাচাও দেশে আসলে ওদের নানা রকম বৈজ্ঞানিক কল্পকথা শোনাতেন। সেবার রাশিয়া চলে যাওয়ায় তারা এতদিন চাচাকে খুব মিস করেছে। যদিও চাচা অবশ্য ফোনে ওদের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতেন। চাচা বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। নীলুর মা রান্নাঘড়ে ভীষণ ব্যস্ত। কাজের বুয়া রহিমার মা নীলুর মাকে সাহায্য করছে। আজ বাসায় বিভিন্ন পদের রান্না হচ্ছে। সব বাঙালি খাবার। আসলে ছোট চাচা রাশিয়াতে সেভাবে দেশি খাবার খেতে পারেন না।
চাচা এসে গোসল করে ফ্রেশ হলেন। নীলু সরাক্ষণ চাচার সাথে সাথে। রাশিয়া থেকে চাচা অনেক কিছু এনেছেন। একে একে সবাই যার যার উপহার নিলো। এবার নীলুর পালা। কী আছে প্যাকেটগুলোর ভিতর। ছোট চাচা প্রথমেই নীল প্যাকেটটা খুললেন। কালো রঙের একটা যন্ত্র। চাচা বললেন, ‘শোন নীলু, এটা হলো ড্রোন-ক্যামেরা। এটা প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা উড়ে গিয়ে নিখুঁত ভিডিও এবং ছবি তুলতে পারে। আর এটা রিমোট-কন্ট্রোলার সিস্টেম। ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরপর চাচা বড় লাল প্যাকেট থেকে একটা ঐচ ব্রান্ডের ল্যাপটপ বের করলেন। সর্বশেষ প্যাকেটটা হলো, Virtual-Realityর যন্ত্র। হেড ডিসেপ্ল, গ্লাভস ও বডি সুট।

তিন.
আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। তাই নীলুরা সকাল থেকেই খেলা শুরু করলো। আজ তারা একা নয়। ছোট চাচাও ওদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ওরা চাচাকে সেদিনের সব কথা খুলে বললো। এমনকি ঐ রহস্য বুড়োর কথাও। ছোট চাচার মনে কথাটা শুনে যেন একটা খটকা লাগল। আসলেই কি পোড়া বাড়ির বুড়োটা মানুষ নাকি অশীরিরী কোন আতœা? যদিও চাচা এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করেন না। তারপরও প্যারানরমাল সাইকোলজি নিয়ে তিনি অনেক বই পড়েছেন দেশে ও বিদেশে। তাই এতটুকু আশঙ্কা করা অবান্তর নয়। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। নীলু ব্যাপারটা খেয়াল করলো। সে চাচাকে বললো, ‘কী ভাবছো ছোট চাচ্চু? কোন সমস্যা?’ চাচ্চু বললো, ‘নারে নীলু। আচ্ছা, তোরা কি আমাকে নিয়ে যাবি ঐ পোড়া বাড়িতে? আমি ওই বুড়ো লোকটার সাথে কথা বলতে চাই।’
‘ওরে বাবা, তুমি কি বলছো ছোট চাচ্চু! কে যাবে ওই ভয়ানক বাড়িতে! শেষমেষ প্রাণটাও চলে যাক!’ নীলু প্রায় আতঙ্কমাখা চোখে কথাগুলো বললো। চাচ্চু বললো, ‘শোন নীলু, পৃথিবীতে ভয় বলে কোন শব্দ নেই। আর অনেক দিনের একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে একটা বুড়ো লোকের উপস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাই ভয় পেলে আমরা সত্যটা উদঘাটন করতে পারবো না। যা হোক, আমি তাহলে একাই যাবো সেখানে। তোরা কেউ যাবি আমার সাথে?’ চাচ্চু সবাইকে ডাকলেন। সবাই রাজি হলো। অবশেষে ভরদুপুরেই তারা রওয়ানা দিল জঙ্গলের ভিতর। তারা হাঁটছে আর চারপাশে তাকাচ্ছে। একটা বুনো শেয়াল ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। শেয়ালটার লাল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। চাচা ড্্েরান-ক্যামেরাটা ছেড়ে দিলেন। রিমোট-কন্ট্রোলার দিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রন করে তিনি সামনে এগুতে লাগলেন। সবাই চাচার কাজ দেখে অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো। চাচা ওদের মুচকি হেসে আশ্বস্ত করলেন।
জমিদার বাড়ির দরজার সামনে এসে চাচা সবাইকে বললেন, ‘শোন, তোমরা কেউ কোন কথা বলবে না। আর হাসাহাসি তো একদম না। আমি যা বলার বলবো। দেখি ওই বুড়োর মতলবটা কী?’ সবাই জমিদার বাড়িতে ঢুকলো। চাচা তো অবাক। এতবড় বাড়ি। চারপাশের জঙ্গলের জন্য সেটা বাইর থেকে বোঝার উপায় নেই। চাচ্চু বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোরা বলতে পারবি এটা কোন জমিদার বানিয়েছে? জমিদারটার নাম কি?’ ইকু চট করে বলে ফেললো, ‘জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ। সম্ভবতঃ আজ থেকে আটশ বছর আগে।’ চাচা চোখ বড় বড় করে বলে ফেললেন, ‘কি, আটশ বছর! তাও বাড়িটা প্রায় অক্ষত?’ নীলু বললো, ‘হয়ত নির্মাণ কৌশল অনেক শক্তিশালী ছিল। তাছাড়া শুনেছি এই জমিদার নাকি অনেক প্রতাপশালী ছিলেন।’ হঠাৎ ‘ও মাগো…’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। কী হয়েছে বলতেই বললো, ‘দেখ আমি একটা ব্যাঙের উপর পা দিয়ে ফেলেছি!’ আসলে মুরাদ এমন একটা ছেলে যে কিনা তেলাপোকা দেখলেও ভয় পায়। সবাই একসাথে হাসা শুরু করলো। এতে মুরাদ খুব লজ্জা পেল। বারান্দায় আসতেই তারা দেখল বুড়োটা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছে। চাচ্চু বুড়োটার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। বুড়ো চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী চাই আবার। কোন সমস্যা?’ এই প্রথম বুড়ো হাসিমুখে কথা বললেন।
চাচ্চু বললেন, ‘কিছু নয় কাকু। আমরা শুধু জমিদার বাড়িটা দেখতে এসেছি।’
বুড়ো তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘তাই নাকি? তা কেমন দেখলে?’
চাচ্চু বললো, ‘খুব ভাল।’ কাকু যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা বলতে চাই। বলবো নাকি?’
বুড়ো হেসে বললো, ‘অবশ্যই। কী জানতে চাও?’
চাচ্চু বললেন, ‘আপনি কি এখানে একা থাকেন? মানে, এই পুরনো জমিদার বাড়িতে আপনার একা থাকতে ভয় কওে না বুঝি!’ বুড়ো হেসে উঠল। হাসিতে এতটাই রহস্য ছিল যেন তিনি অন্য জগতের কেউ।
বুড়ো বললো, ‘ভয়! কিসের ভয়, কার জন্যে ভয়? তাছাড়া এই বুড়ো বয়সে কে আর আসবে আমার ক্ষতি করতে। লোকের খেয়েদেয়ে বুঝি কাজ নেই! যাক সে কথা। তোমরা একটা কাজ কর। এসো, আমার গরিবের ঘরে। আর শোনো, আমার মতো এক অভাগার গল্প।’
আসলে তারা লোকটাকে যত খারাপ ভেবেছে আসলে লোকটা তত খারাপ নয়। হয়ত তাদের কোথাও একটা ভুল হয়েছে। সবাই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ছোট্ট একটা ঘর। সম্ভবত এই ঘরটা প্রাসাদের অন্য ঘরগুলো থেকে অক্ষত। একটা খাটে বিছানা পাতা, একটা টেবিল ও পুরনো দিনের কিছু ফার্নিচারে ঘরটা ভর্তি। কিছু নকশা করা টবে ফুল ও মোমবাতির আলোতে ঘরটা আরো ভৌতিক মনে হচ্ছে। সবাইকে বুড়ো বসতে বললেন। সবাই বসলো। এবার বুড়ো শুরু করলেন তার কাহিনী। সবাই মনেযোগ সহকারে শুনতে শুরু করলো। বুড়ো বলতে লাগলেন, ‘আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা। আমি তখন তাগড়া জোয়ান। সবেমাত্র বিয়ে করেছি। আর্মি তে থাকতাম। হঠাৎ ১৯৭১ সালে শুরু হল যুদ্ধ। গোটা দেশ কান্না-হাহাকারে ভরে গেল। চারদিকে লম্পট পাকসেনাদের ধ্বংসলীলা বিশ্ববিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। বাঙালি জাতির রক্তে লাল হয়ে গেল বাংলার মাটি। ২৫শে মার্চের কালো রাত। বাবা ও তিন ভাইকে পাকসেনারা গুলি করে মারলো। মা ও সালেহা, মানে তোমাদের চাচিমাকে ওরা ক্যাম্পে নিয়ে গেল। আমি তখন চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীতে ছিলাম। খবর পেলাম জয়নাল মারফত। কান্নায় পাগলের মতো হয়ে গেলাম। অবশেষে নয়টি মাস যুদ্ধ করার পর দেশ স্বাধীন হলো। আর আমি একা হয়ে গেলাম। স্বজন হারানোর কষ্ট আর সালেহার স্মৃতি নিয়ে এই রাজবাড়িতে আশ্রয় নিলাম। এখানেই কাটল দীর্ঘ চল্লিশটা বছর।’
চাচ্চু বললো, ‘আপনার একা থাকতে খারাপ লাগে না?’ বুড়ো বললো, ‘তা তো লাগে। কিন্তু কী করবো? সারাদিন ইবাদত-বন্দেগি আর রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকি। সপ্তাহে একদিন লোকালয়ে যাই। মানুষদের সাথে কথা বলি ও বাজার করে হালকা হই। যাক বাবারা, তোমরা কিন্তু দুপুরে খেয়ে যেও এই গরিবের বাড়িতে। না হলে আমি রাগ করবে।’
চাচ্চু বললেন, ‘কী রেঁধেছেন কাকু?’ বুড়ো বললো, ‘এই তো, বনমোরগের ভুনা আর কুঁচো চিংড়ি দিয়ে কলমি শাক।’ বন মোরগের ভুনার কথা শুনে নীলুর জিভে পানি এসে গেল।
বুড়ো বলতে লাগলেন, ‘সালেহা খুব সুন্দর করে কুঁচো চিংড়ি দিয়ে কলমি শাক রাঁধতো। আহা! কী স্বাদ ঐ রান্নার, না জানি ওরা কী বেঁচে আছে? মা ও সালেহা যদি বেঁচে থাকে তবে তারা কোথায়?’ বুড়ো দাদু চোখ মুছে আবার বললেন, ‘যাক সে কথা তোমরা খাওয়া শুরু কর তো বাবারা।’
নীলু বললো, ‘আপনি খাবেন না কাক?’
‘হ্যাঁ খাচ্ছি। আচ্ছা, তরকারি বুঝি স্বাদ হয়নি?’
চাচ্চু হেসে বললেন, ‘কি বলেন কাকু! অসাধারণ স্বাদ। খাঁটি বাঙালি রান্না।’
একজন আর্মি অফিসারকে অশরীরী ভেবে সবাই খুব লজ্জা পেল। আসলে একটা মানুষকে কাছ থেকে না দেখলে মনে হয় না সে আসলে কী। চাচ্চু নিজের পরিচয় দিলেন। বুড়ো দাদু পরিচয় শুনে অবাক। কারণ তিনিও ভিনগ্রহ নিয়ে অনেক কিছু জানেন। শুধু তাই নয়, এই রাজবাড়িতে তিনি ফ্লাইং সসারের মতো কিছু উড়তে দেখেন প্রায় মধ্যরাতে। চাচ্চুকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন দাদু। আর মধ্যরাতে ফ্লাইং সসারের মতো কিছু জমিদার বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যায়। এটা সবার জন্য একটা মোক্ষম সুযোগ। বিশেষ করে চাচ্চুর। চাচ্চু ড্রোন-ক্যামেরাটা নিয়ন্ত্রণে এনে সেটাকে তার ব্যাগে পুরলেন। সবাই দাদুর কাছ থেকে বিদায় নিল। একজন আর্মি অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধার এই অবস্থা দেখে সবাই খুব কষ্ট পেল। মুরাদ চাচ্চুকে বললো, ‘আচ্ছা চাচ্চু, ড্রোন-ক্যামেরা থেকে আমরা কী তথ্য পাবো?’
চাচ্চু বললেন, ‘রাতে সবাই এসো আমার রুমে। ভিডিও ফুটেজ চেক করবো। আর তবেই বুঝা যাবে আসলে কী নতুন তথ্য আছে আমাদের জন্য।’
ইকু, মুরাদ, মারুফ, সাকিব সবাই ঘাটে এসে বিদায় নিলো। আর নীলু, মেহেদী ও চাচ্চু সোজা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলো।

চার.
রাত আটটা। সবাই চাচ্চুর ঘরে জমায়েত হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, পোড়া বাড়িতে মধ্যরাতে কী ঘটে? চাচ্চু ল্যাপটপ অন করলেন। ক্যামেরার Data Cable কম্পিউটারে লাগালেন। Data Input হলে ডেস্কটপে সেটা কপি করলেন। সবাই আগ্রহ সহকারে দেখেছে আর পরস্পর একে অন্যকে দেখছে কী ঘটতে যাচ্ছে? চাচ্চুর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভিডিও প্লে করা হলো। ভিডিওতে দেখা গেল রাজবাড়ির তোরণ, জলাশয় আর ছাদের উপর কিছু কবুতর ও একটা বিড়াল। রাজবাড়ির ঠিক পেছনে একটা পুকুর আর পাশে খোলা মাঠ। মাঠের ঠিক মাঝখানে গভীর একটা গর্ত। মনে হচ্ছে ভারি কোন বড় জিনিসের চাপে গর্তটা সৃষ্টি হয়েছে।
চাচ্চু বললো, ‘মনে হচ্ছে কিছু একটা পাওয়া যাচ্ছে। তোমরা কি বলো?’
সবাই বলে উঠল, ‘এটা কোন ভিন্নগ্রহের প্রাণীদের দ্বারা সৃষ্টি নয়তো? চাচ্চু তুমি কী বলো?’ সবাই গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। কাজের মেয়ে রহিমা সবার জন্য পিঠা আর চা নিয়ে আসলো। খেতে খেতে চাচ্চু বললেন, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমাদের উচিত জায়গাটা পরিদর্শন করা। তাই নয় কি?’
‘হ্যাঁ তাই।’ সবাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
চাচ্চু বললেন, ‘আর শোন, ঐ বুড়ো আর্মি অফিসারকে আমাদের প্রয়োজন হতে পারে। আর আমি RASA এর ওয়েবসাইটে ভিডিওটি আপলোড করে দিচ্ছি।’
চাচ্চু গুগলে গিয়ে সার্চ দিচ্ছেন আর একটা করে তথ্য খাতায় লিখছেন। আসলে গত আঠারো শতক প্রর্যন্ত এলিয়েনদের নিয়ে নানা গুজব থাকলেও উনিশ শতকে বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে শুরু করছেন। বিশেষ করে মঙ্গল গ্রহের মাটিতে পানির অস্তিত্ব এটাকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। NASA, RASA সহ বিভিন্ন মহাকাশ গবেষনা সংস্থা বিভিন্ন সময় মহাকাশে রকেট পাঠাচ্ছে। বেড়িয়ে আসছে সব নতুন নতুন তথ্য। চাচ্চু ঝশুঢ়বব-তে রাশিয়ায় ড. রুস্তম ভাগিরভ এর সাথে কথা বললেন। রাশিয়ার বিখ্যাত বিজ্ঞানী, যিনি পৃথিবী থেকে ২০,০০০০০ আলোকবর্ষ দূরে কোয়াসার গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। টেলিস্কপে কিছু উড়ন্ত পিরিচের মত কিছু পৃথিবীর দিকে আসতে দেখেছেন। ড. ভাগিরভ ভিডিওটি দেখে ধরে নিলেন এই গর্ত আসলে কোয়াসার গ্রহেরই কোন যানের দ্বারা সৃষ্টি। তার মানে, জমিদারবাড়িতে ভিনগ্রহের প্রাণীরা আসে। হয়তবা তারা মানুষের থেকে অনেক বুদ্ধিমান আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছে বহুদূর। নীলুরা খুশিতে উত্তেজিত। আবিস্কারের নেশা তাদের মনে দোলা দিচ্ছে। নীলু এতদিন শুধু বইয়ে এসব কল্প-বিজ্ঞানের কাহিনী পড়েছে কিংবা চাচ্চুর কাছে শুনেছো সবাই বিদায় নিয়ে যে যার মত বাড়ি চলে গেল।

পাঁচ.
কোয়াসার গ্রহের নীল মাটিতে সবুজ গাছ পালা, ফলমূল আর ঔষধের বাগান। বড় বড় কাঁচের বিল্ডিং। সব ঘরই Virtual ও কম্পিউটারাইজড। এখানে কৃষিকাজ, কলকারখানা ও অন্যান্য কাজে রোবট ব্যবহার করা হয়। এসব রোবট Biologically Inspired! তাই এরা মানুষের কথা বুঝতে পারে। নীনা’র মন খারাপ। কারণ তার মানুষ মা ও বাবা সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকে। ফলে, সে একদম একা।
কয়েক বছর আগের কথা। কোয়াসার গ্রহ ছিল শিশুশূন্য। কারণ এ গ্রহের কারও সন্তান হয় না। দিন দিন জনসংখ্যা কমে যাচ্ছিল। এ গ্রহের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. আসিক ইবরার ব্লেকো-৩ নামক একটি শিশু রোবট তৈরী করেন। যা কিনা মানব শিশুর ৯৫% বৈশিষ্ট্য ধারন করতে পারে। এটি পানি দ্বারা শক্তি অর্জন করে একটানা ৪ মাস র্চাজ থাকে। কোয়াসার গ্রহের হাজার হাজার দম্পতিকে সন্তান দেওয়ার জন্য এটা বাজারজাত করা হয়েছে। আর ব্লেকো-৩ মডেলের রোবট নীনাকে ব্যবহার করছেন মিসেস খান ও তার স্বামী ড. খান। যারা পেশায় চিকিৎসা বিজ্ঞানী। কাজের রোবট ফ্রগ সকাল থেকেই ব্যস্ত নীনা কে নিয়ে। সে খাবার খাচ্ছে না। শুধু কান্নাকটি করছে। ফ্রগ হাতের ইশারায় LED দেয়ালের নির্দিষ্ট স্থানে নাম্বার ডায়াল করলো। মিসেস খান কলটা রিসিভ করে বললেন, ‘কী ব্যাপার ফ্রগ। কোন সমস্যা? নীনা ঘুমিয়েছে?’
ফ্রগ বললো, ‘না ম্যাডাম। ও শুধু কান্নাকাটি করছে। আপনাকে আর স্যারকে চাচ্ছে।’
মিসেস খান বললেন, ‘ঠিক আছে ওকে বলো আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি।’
ফ্রগ খুশিতে বললো, ‘ঠিক আছে।’
ড.খান ফ্লিট শহরের ‘জাতীয় ভ্রুণ গবেষনা ও মানব শিশুর জন্মদান ইন্সটিটিউট’- এর একজন গবেষক। এই প্রতিষ্ঠান চাচ্ছে পৃথিবী থেকে DNA সংগ্রহ কওে, সেটা মা-বাবার শরীরে উঘঅ রিকম্বিনেট করে মানব শিশু জন্ম দেয়ার। ফলে হয়ত কোয়াসার গ্রহের নিঃসন্তান দম্পতিরা তাদের দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে। এজন্য তারা পৃথিবীতে সসটেক-৭ নামক যান পাঠিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু সেগুলো বার বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। গত শুক্রবার সসটেক-৮ নামক নতুন একটি মহাকাশ যান পৃথিবীতে বাংলাদেশের কোন এক জঙ্গলের মাঝের পোড়াবাড়িতে ল্যান্ড করেছিল। কিন্তু ল্যান্ড করার পর যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তারা আবার সেখান থেকে ফেরত আসে। এইবার নতুন অভিযানে ড. খান নিজেই যাবেন পৃথিবীতে। হয়ত তিনি পৃথিবীর সভ্য মানুষদের সাহায্য পেতে পারেন। অভিযান পরিচালনা করছে কোয়াসার গ্রহের আর্ন্তজাতিক মহাকাশ গবেষনা সংস্থা QUASA. কোয়াসার গ্রহ পৃথিবীর থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে। কারণ এখানকার মানুষ অনেক পরিশ্রমী ও নির্লোভ প্রকৃতির। বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞান গবেষনার নামে যে মানব হত্যা করা হচ্ছে সেটা নিয়ে তারা অবগত ও পৃথিবীর ভবিষৎ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এ প্রসঙ্গে QUASA এর একটি অনুষ্ঠানে ড. খান ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা কেন ওদের ধ্বংস করবো? ওরা তো নিজেরাই ধ্বংস হচ্ছে।’

ছয়.
রাত আটটা। সবাই আর্মি দাদুর পোড়া বাড়ির ঘরে সমবেত হয়েছে। চাচ্চু টেলিস্কোপসহ প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছেন। সবাই গল্প-গুজব করছে। দাদু ও চাচ্চু চা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। এ বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। থাকার কথাও না। কারণ পুরনো দিনের জমিদার বাড়িতে বিদ্যুৎÑ এটা অসম্ভব ব্যাপার। কাচের মোমদানিতে বড় বড় মোমবাতি জ্বলছে। নীলুরা কিছুক্ষণ পর পর হেসে উঠছে। দাদু ও চাচ্চু চা-নাস্তা নিয়ে এলো। সবাই খেতে খেতে পরামর্শ করছে কে কী করবে। হঠাৎ বিকট শব্দে কিছু পড়ার আওয়াজ হলো ছাদে। সবাই দৌড়ে ছাদে গেল। অন্ধকারে কিছু দেখার কথা না। তবুও মোমবাতির আবছা আলোয় ওরা দেখতে পেল, কিছু একটা গোলাকার টাইপের ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল। সবাই দৌড়ে বাড়ির পেছনে গেল। বাইরে তীব্র আলোর ঝলকানি। সম্ভবত ওটা পুকুর থেকে আসছে। চাচ্চু টেলিস্কাপ অন করলেন। টেলিস্কোপের পর্দায় দেখা গেল, উজ্জ্বল গোলাকার কিছু মাটিতে পুকুরের পাড়ে নামছে। হঠাৎ সিগনাল বন্ধ হয়ে গেল। আর কিছু দেখা যাচ্ছে না টেলিস্কোপের পর্দায়। চাচ্চু ধ্যাঁৎ বলে টেলিস্কোপ অফ করলেন। সবাই রুমে ফিরে আসলো। প্রত্যেকে বাসায় বলে এসেছে যে তারা আজকে রাতটা নীলুদের বাসায় থাকবে। কিন্তু বিপাকে পড়লো নীলু আর চাচ্চু। ওরা কী বলবে বাসায়। চাচ্চু একটা বুদ্ধি বের করলেন। ফোন করে বললেন যে, তারা রাতটা চাচ্চুর বন্ধুর বাসায় কাটাবেন। ব্যাস, সমাধান হয়ে গেল।
দাদু রাতের খাবারের আয়োজন করলেন। বোয়াল মাছের ঝোল, বেগুনভর্তা ও ডিমভাজা। সবাই খুশিতে খেতে লাগল। খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম। তারপর রাত বারোটা বাজলেই কাজ শুরু হবে। রাত তিনটায় মধ্যরাত হয়। তাই এই সময়টাই উপযুক্ত সময়। রাত বারোটা বেজে গেলে সবাই ছাদে গেল। চাচ্চু ছাদের কর্ণারে টেলিস্কোপ বসিয়ে সেটা আকাশের দিকে তাক করলেন। ড্রোন-ক্যামেরাটা ছেড়ে দেয়া হলো। ছাদের উপর সিঁড়িঘরে সবাই বসলো। চাচ্চু ল্যাপটপ থেকে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন। নীলুরা চাচ্চুকে সাহায্য করছে। আর্মি দাদু চাচ্চুকে তথ্য দিচ্ছেন। আর চাচ্চু সে মোতাবেক কাজ করে যাচ্ছেন।

সাত.
১৩ তারিখ শুক্রবার। QUASA এর সদর দপ্তর এ প্রচুর লোকের সমাগম। কারণ তাদের দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. আসিফ ইবরার আজ নতুন কিছু বলবেন দেশবাসীর প্রতি। হঠাৎ করে পুলিশের করা নিরাপত্তার মধ্যে লাল রঙের কারটা দরজার সামনে থামল। সামনে সাংবাদিকদের ক্যামেরা আর মাইক্রফোনের ভিড়। ড. আসিফ ইবরার কার থেকে নামলেন। তিনি সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে QUASA এর সদর দপ্তরে ঢুকলেন। ভিতরে আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. খান এগিয়ে এসে ড. আসিফ ইবারারকে কক্ষে স্বাগত জানালেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হল। ড. আসিফ ইবরার দেশবাসীর প্রতি তার বৃক্ততা শুরু করলেন, ‘হে আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আজকের দিনটা কোয়াসার গ্রহের জন্য একটা স্মরণীয় দিন। কারণ এই দিন আমরা আমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. খান ও তার টিমকে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছি। আমি আশাবাদি, তিনি সফল হয়ে এ গ্রহে ফিরবেন। আপনারা জানেন, এর আগে আমরা দু’টো অভিযান করেছিলাম। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেগুলো সফল হয়নি। এবার আমরা ছটঅঝঅ এর বিজ্ঞানীরা বহু সাধনার পর সসটেক-৯ তৈরী করেছি। যা কিনা সসটেক-৭ ও সসটেক-৮ এ থেকে চারগুণ দ্রুতগতি সম্পন্ন। আর ড. খান পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের সাথে বন্ধুত্ব করে হয়ত আমাদের কাক্সিক্ষত উঘঅ সংগ্রহ করতে সক্ষম হবেন। আমি অভিযানে যাচ্ছি না। কারণ, কোয়াসার গ্রহ থেকে এটি নিয়ন্ত্রনের ভার আমার উপর ন্যাস্ত। আমি ড. খানকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।’ সবাই জোরে করতালি দিতে লাগল।
ড. খান শুরু করলেন, ‘হে আমার প্রিয় দেশবাসী, আপনারা বুঝতে পারছেন আমাদের বর্তমান সমস্যাটা। যদিও আমরা ড. আসিফ ইবারর এর প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ, তিনি ব্লোকো-৩ নামক রোবটটি তৈরী করে আমাদের মা-বাবাদের দুঃখ কিছুটা হলেও লাঘব করেছেন। তারপরও আমি বলবো, আজকের এই অভিযান হয়ত, আমাদের চিরদিনের জন্য মাতৃত্ব বা পিতৃত্বর দুঃখ মিটেয়ে দেবে। আমি মহান ষ্টার কাছে সেই প্রার্থনাই করছি। বিকাল চারটা অর্থ্যাৎ আর আধা ঘন্টার মধ্যে সসটেক-৯ মহাকাশে উৎক্ষেপন করা হবে। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘সসটেক-৯ এর যাত্রা শুভ হোক। আমিন।’ QUASA এর সদর দপ্তর এর বিশাল রানওয়েতে সসটেক-৯ রাখা আছে। সুইচ দেয়া মাত্র সেটা মহাশূন্যে উৎক্ষেপিত হবে। চারপাশে প্রচুর লোকের সমাগম। ড. খান ও তার টিম রকেটের ভিতর ঢুকলেন। শেষবারের মত সব ঠিক আছে কিনা তা চেক করা হল। অবশেষে বিকট শব্দে সসটেক-৯ মহাশূন্যের দিকে যেতে শুরু করল। কন্টোল রুমে বিজ্ঞানীরা সেটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। সসটেক-৯ চলছে তার গন্তবে। ড. খান স্ক্রীনে দেখতে লাগলেন হাজার হাজার আলোকবর্ষ তারা পাড় হচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ধুমকেতু, উল্কা বা মহাজাগতিক বিভিন্ন বস্তু উড়ে চলছে। ড. খান এর মাথায় এখন বিভিন্ন চিন্তা ভিড় করছে। তিনি কি পারবেন, নাকি আগের যাত্রাগুলোর মতো এটাও ব্যর্থ হবে! তার চোখে ভেসে উঠছে হাজার হাজার নিঃসন্তান দম্পতি তার দিকে চেয়ে আছে। পৃথিবীর সভ্য মানুষেরা কি DNA দেবে নাকি ফিরিয়ে দেবে?

আট.
চাচ্চু হকচকিয়ে গেলেন। কম্পিউটারের স্ক্রীনে একটা লাল বিন্দু এগিয়ে আসছে। সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ পৃথিবী। যাতে শুধু জীবের অস্তিত্ব আছে। অন্য গ্রহে জীব আছে কী নেই এ নিয়ে বির্তক চলছে বিজ্ঞান জগতে। আর জঅঝঅ এর বিজ্ঞানী ও চাচ্চুর সহকর্থী ড. রুস্তম ভাগিরভ এর আবিষ্কৃত কোয়াসার গ্রহে প্রাণী থাকাটা অবান্তর কিছু নয়। কারণ, ওখানে এর সন্ধান পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় জীব বেঁচে থাকার সব আলামতই মিলে গেছে ঐ গ্রহে। চাচ্চু ঘেমে যাচ্ছেন, আর হাত দিয়ে কপাল মুছছেন। সবাই আবার ছাদে গেল।
রাত তিনটা বাজে। টেলিস্কপের পর্দায় দেখা গেল পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। সবাই আকাশের দিকে তাকাতে লাগল। একটা উড়ন্ত যান ধীরে ধীরে পুকুরের পাড়ে ল্যান্ড করলো। সবাই হুড়মুড় করে নিচে গেল। যান থেকে ড. খান নামলেন সাথে তার টিম। চাচ্চু ও আর্মি দাদু এগিয়ে গেলেন। ড. খান মুচকি হেসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। আমরা মানুষ, আপনাদের পৃথিবীর ২০,০০০০ আলোকর্বষ দূরে কোয়াসার নামক গ্রহ থেকে এসেছি। আর আমি বিজ্ঞানী ড. খান। আমার পুরো টিম আমার সাথে।’
ডা. খানের ৬ সদস্যের টিম একে একে চাচ্চুর সাথে হ্যান্ডশেক করল। চাচ্চু নিজের ও আর্মি দাদুর পরিচয় দিলেন। অবশেষে সবাই রুমে প্রবেশ করল। দাদু সবার জন্য চা ও শুকনো খাবার এর ব্যবস্থা করলেন। খেতে খেতে ড. খান সব খুলে বললেন। চাচ্চু তাদের আশস্ত করলেন। এদিকে চাচ্চু রাশিয়ায় ড. রুস্তম ভাগিরভ এর সাথে যোগাযোগ করলেন। ড. ভাগিরভ বাংলাদেশ আসতে চাইলেন। আগামিকাল বিকাল পাঁচটায় তিনি ঢাকায় জিয়া আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে আসছেন। চাচ্চু ড. খানকে বললেন, ‘আপনারা পৃথিবীতে এসেছেন এটা ঘুর্ণাক্ষরেও কেউ যেন না জানে। তাই ফ্লাইং সসার সসটেক-৯ থেকে সরিয়ে রাজবাড়ির পেছনে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা উচিত। তাই নয় কী ড. খান?’
ড. খান বললেন, Ofcourse. . আমারও তাই মনে হয়। চলুন সবাই যানটা একবার দেখে নেই। সবাই যানের ভিতরে প্রবেশ করলো। নীলুরা হতবাক। তারা খুব মনোযোগ সহকারে ভিতরটা দেখতে লাগল। ড. খান কন্ট্রোল সিটে বসে যানটা Start. দিয়ে সেটাকে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গেলেন। সবাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। যা করার কালকেই করা যাবে। সবারই বিশ্রাম দরকার।

নয়.
মস্কো বিমান বন্দরে প্রচুর ভিড়। ড. রুস্তম ভাগিরভ এর গাড়ির সামনে সাংবাদিকদের জটলা। রাশিয়ান এয়ার ওয়েজের একটি বিশেষ বিমানে তাকে বাংলাদেশে পৌঁছানো হবে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট পরে বিমান ছেড়ে দেয়া হবে। অল্প সময়ের মধ্যে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিমানে উঠলেন ড. ভাগিরভ। বিমান ছেড়ে দিলো। প্রায় আট ঘন্টা পর বিমান জিয়া আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। চাচ্চু ও নীলুরা বিমানবন্দরে ড. ভাগিরভকে রিসিভ করলো। তারা সবাই চাচ্চুর লাল রঙের কারটাতে উঠল। কার ঢাকা থেকে ছুটে চললো গ্রামের বাড়ির দিকে। চাচ্চু গাড়ি ড্রাইভ করছেন। পাশে ড. ভাগিরভ, পেছনের সিটে নীলুরা বসেছে। নীলু খেয়াল করলো ড. ভাগিরভকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে। আর দেখাবেই না কেন? কারণ কোয়াসার গ্রহের সন্ধান তিনিই তো দিয়েছেন। ড. ভাগিরভ খুব ভালো বাংলা না জানলেও চাচ্চুর সুবাদে তিনি বাংলায় কথা বলতে পারেন। তাই নীলু ড. ভাগিরভকে চাচ্চু বলে সম্বোধন করে বললো, ‘আপনি মনে হয় সবচেয়ে খুশি আজকে?’
ড. ভাগিরভ হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ রে নীলু, এটা পৃথিবীর জন্য একটা বিশাল পাওয়া। আজকের দিনটার জন্যই হয়ত আমরা এত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’ ঢাকা থেকে হিজলতলী গ্রাম খুব বেশি দূরে না হওয়ায় তারা এক ঘন্টার মধ্যে গ্রামে প্রবেশ করলো।

দশ.
সবাই ড্রয়িং রুমে বসেছে। চাচ্চু ড. ভাগিরভকে ড. খান ও তার টিমের পরিচয় দিলেন। নীলুর মা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। কাজের মেয়ে রহিমার মাও তাকে সাহায্য করছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ। সবাই চাচ্চুর রুমে বসে পড়লো। ড. খান প্রথমে তার গ্রহের সমস্যার কথা তুলে ধরলেন। ড. ভাগিরভ সেগুলো লিখে RASA এর সদর দপ্তরে মেইল করে দিলেন। RASA এর প্রধান ড. ফার্ন্দানেন্স ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় প্রেরণ করার ঘোষণা দেয়ায় সবাই ‘বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষনা প্রতিষ্ঠান’ এ যোগ দিতে ঢাকায় উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। ঢাকায় ৩ দিন মিটিং শেষে সবাই এ সিন্ধান্তে উপনীত হল যে কোয়াসার গ্রহে মানুষের DNA প্রদান ও তাদের সমস্যা সমাধান শুধু মানবিক দিক থেকেই নয় বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় পৃথিবী একধাপ এগিয়ে যাবে। আর পৃথিবীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন ড. খান। তিনি কোয়াসার গ্রহে ড. আসিফ ইবরার ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে বিশেষ ধরনের কম্পিউটারের মাধ্যমে মতবিনিময় করলেন। অবশেষে DNA সংগ্রহের পালা। আগামি এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার ঘোষণা দিলেন ড. ভাগিরভ। তারপর সবাই নীলুদের বাসায় ফিরে আসলেন।

এগার.
মধ্যরাত। তিনটা বাজে। আকাশে আজ প্রচুর জ্যোৎ। রাজবাড়ির পরিবেশ থমথমে। কারণ, ড. খান ও তার টিম বিদায় নিবেন। তাদের DNA সংগ্রহ শেষ। সবাই আর্মি দাদুর রুমে। ড. খানেরা গোছগাছ করে তৈরী হলেন। সবাই বাইরে বেরিয়ে এসে মহাকাশ যানটার দিকে গেলেন। যানটার দরজা খুলে কন্ট্রোল রুমে ড. খান বসলেন। আর বাকিরা সবাই যার যার সিটে বসলেন। বিকট শব্দ করে যানটা কেঁপে উঠল। লাল ও নীল আলোতে ভরে গেল চারপাশ। শেষবারের মত সবাই হাত নাড়লো। ফ্লাইং সসারটি ধীরে ধীরে উড়তে লাগল। নীলুরা তাকিয়ে থাকলো। দেখতে দেখতে মহাকাশ যানটা মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল। অতিথির বিদায় বেদনায় সবাই স্তব্ধ। যদিও এর মধ্যে আনন্দও আছে। আজকের এই মধ্যরাত নীলুদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
চারপাশ পূর্ণিমার আলোতে ঝলমল করছে। হঠাৎ নীলু আকাশের দিকে তাকালো। হাজার হাজার তারকা মিটমিট করে জ্বলছে। অযথাই নীলুর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। কেউ সেটা বুঝতে পারলো না। এসময় এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিল। নীলুর লজ্জা ঢাকবার জন্য হয়তো!

Share.

মন্তব্য করুন