থাইল্যান্ডের থাম লুয়াং গুহায় আটকে পড়া ১২ কিশোর আর তাদের কোচকে উদ্ধারের শ^াসরুদ্ধকর দুঃসাহসিক অভিযান এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানটি খুবই সূক্ষ্মতা ও সাবধানতার সঙ্গে পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু এই উদ্ধার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন একদিকে যেমন ছিল সাহসী, বিপজ্জনক তেমনি ভীষণ জটিলও। তবে সব সংকটের মধ্যেও প্রতিটি পর্যায়ে সাফল্য এসেছে।

থাম লুয়াং গুহাঃ
থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় পর্বত এই গুহার দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার। দেশটির উত্তরাঞ্চলে চিয়াংরা প্রদেশের পংফা গ্রামের কাছে থাম লুয়াং বনে এর অবস্থান। গুহার ভেতরে নানা প্রকোষ্ঠ আর সংকীর্ণ-প্রশস্ত পথ একে দুর্গ করে তুলেছে। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম এক কিলোমিটার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেলেই এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। গুহাটির পুরো নাম থাম লুয়াং নাং নন। এর অর্থ ‘ঘুমন্ত নারীর বিশাল গুহা’। জানা যায়, এক রাজকুমারী সাধারণ এক মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু রাজ পরিবার তাদের বিয়েতে রাজী হননি। ক্ষোভে-অভিমানে রাজকুমারী আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পর তার দেহটা নাকি পর্বতে পরিণত হয়। সেই পর্বতের নাম থাম লুয়াং গুহা।

কেন গুহার ভেতরে গিয়েছিল ক্ষুদে ফুটবলাররা?
২৩ জুন, কিশোর ফুটবলাররা প্র্যাকটিস করতে সকাল দশটার দিকে ন্যাশনাল পার্কে গিয়েছিল। ঐদিন ছিল তাদের শিডিউল ম্যাচ। কিন্তু প্রধান কোচ সেটা বাতিল করে অনুশীলনের কথা বলেন। তারা পিতামাতা ও কোচের সঙ্গে পরামর্শ করে সাইকেল চালিয়ে মাঠে যায়। দিনটি ছিল দলের সদস্য পীরাপাত সম্পিয়াংজাইয়ে ১৬তম জন্মদিন। আর সেটা উদযাপন করার জন্য স্থানীয় বাজার থেকে ৭০০ বাথেরও (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮০০ টাকা) বেশি টাকা দিয়ে খাবার কেনে। এরপর তারা সহকারী কোচ একাপল চান তাওংকে অনুরোধ করে। তবে গুহার ভেতরে ঢুকার ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি।

তারপর কী হয়েছিল তারা এখনো কেউ জানে না। গুহার প্রবেশ-মুখের সামনে ১১টি সাইকেল রাখা দেখতে পান নাঙ্গনন ন্যাশনাল পার্কেও একজনকর্মী। ২৪ জুন শনিবার পার হয়ে রবিবার সকাল একটা থেকে তাদের খোঁজার কাজ শুরু হয়। বলা হচ্ছে, প্র্যাকটিস শেষ হয়ে যাওয়ার পর ফুটবলের দলের একজন সদস্যের জন্যে সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করতে তারা গুহার ভেতরে ঢুকেছিল। প্রবল বৃষ্টির কারণে গুহার ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করলে তারা পালাতে পালাতে গুহার গভীরে চলে যায়। এরপর তাদের খোঁজে নেমে পড়ে পুলিশ প্রশাসন।

যেভাবে গুহার ভেতরে বেঁচেছিল কিশোর ফুটবলাররা
খেলোয়াড়রা ছিল খুবই উৎসাহী। শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং নিজেদের মধ্যে ছিল খুবই ভালো সম্পর্ক। ধারণা করা হচ্ছে, গুহার ভেতরে আটকা পড়ার পর তাদের সাথে আনা খাবার খেয়েই কিশোররা বেঁচেছিল। গুহার ভেতর যখন খাবার কমার শঙ্কা খুব কম খাবারই খেয়েছেন কোচ। গুহার পানি ছিল নোংরা ও ঘোলা। এজন্য ফুটবলাররা গুহার দেয়াল থেকে যেসব পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে সেসব পানি পান করতো। আর নিজেদের উষ্ণ রাখার জন্যে গুহার ভেতরে পাথর দিয়ে পাঁচ মিটার গভীর গর্ত খুঁড়েছিল। নিজেদের উষ্ণ রাখতে তারা সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল।
২ জুলাই ডুবুরিরা যখন ফুটবল দলটিকে গুহার ভেতরে খুঁজে পান, তখন শারীরিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল ছিলেন কোচ একাপল। তাদের সন্ধান পাওয়ার পর তাদেরকে বাইরে থেকে অক্সিজেন সরবরাহ ও খাবার দেওয়া শুরু হয়। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে সহজে হজম হয় এরকম খাবার, শক্তিদায়ক খাদ্য যেগুলোতে মিনারেল ও ভিটামিন মেশানো হয়েছে। কিশোর ফুটবলার এবং তাদের কোচের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গুহার ভেতরে ডাক্তার ও নার্সও পাঠানো হয়।
পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলে তাদের মানসিক অবস্থা ভালো হতে পাওে, এ কথা ভেবেই গুহাটিতে টেলিফোন সংযোগ দেয়ার ব্যবস্থা করছে থাই কর্তৃপক্ষ।

যেভাবে পরিচালনা করা হয় উদ্ধার অভিযান
১৮ দিন ধরে আটকা থাকার পর টানা ৩ দিন উদ্ধার অভিযান চালিয়ে ১২ জন কিশোর ফুটবলার এবং তাদের কোচকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ডুবুরিরা। ২৩ জুন আটকা পড়ার পর থেকে প্রবল বৃষ্টির পানিতে গুহার মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। প্রবল বৃষ্টিপাতে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হলে তখন পানি তোলার পাম্প বসানো হয়, রোবট ব্যবহার করা হয়। উদ্ধারকারীরা রীতিমতো যুদ্ধ করেছে, যাতে করে ভেতরে পানির উচ্চতা না বাড়ে। কিন্তু গুহায় ঢোকার প্রধান প্রবেশ পথটি বৃষ্টির কারণে একেবারে প্রবেশের অযোগ্য হয়ে পড়ে। গুহার ভেতরে বন্যার পানি ২৯ জুন কমতে শুরু করলে উদ্ধার কর্মীরা ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়। ২ জুলাই রাতে ব্রিটিশ উদ্ধারকারী ডুবুরি গুহার প্রবেশ মুখ থেকে চার কিলোমিটার ভেতরে ওই স্থানটিতে দলটির সন্ধান পায়। তাদের সবাইকে জীবিত ও নিরাপদ অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে জানান উদ্ধারকর্মীরা।

গুহায় আটকে পড়াদের উদ্ধার কাজে প্রায় ১১০ নেভিসিল সদস্য যোগ দিয়েছেন। থাইল্যান্ড ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীনা, অস্ট্রেলিয়া ও বিভিন্ন দেশের ডুবুরিরা এ উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। তাদের উদ্দেশ্যে ১৮ জন অভিজ্ঞ ডুবুরি গুহার ভেতরে কাজ করছে। একেক জন কিশোরকে দুইজন করে ডুবুরি তাদের তত্বাবধানে বের করে আনছেন। পুরো পথ পার হতে তাদেও অন্তত ছয়ঘন্টা করে সময় লাগেছে।

৮ জুলাই প্রথম দফায় চারজন ও ৯ জুলাই দ্বিতীয় দফায় চারজনকে উদ্ধার করা হয়। ১০ জুলাই শেষ দিনের অভিযানে বাকি চার সদস্য ও তাদের কোচকে উদ্ধারের মাধ্যমে কঠিন আর দুঃসাহসিক ওই অভিযান শেষ হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৮ জুলাই ১৯ জন ডুবুরিকে গুহার ভেতরে উদ্ধার অভিযানে পাঠানো হয়। এক একজন কিশোরকে দু’জন করে ডুবুরি বাইরে আনার জন্য গুহার ভেতরে কাজ করেছেন।

শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের গল্প
শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযানের অংশ নেয়া ডুবুরিই ভানারাদজিক বলেন, আটকে পড়া ওই কিশোরদের এমন একটি কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, যা তারা কখনও করেনি। বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তাদের ডুব সাঁতার দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। গুহার ভেতরে পানির নিচের কোনো কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। আমাদের সঙ্গে থাকা টর্চ লাইটই ছিল একমাত্র ভরসা। এতে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন আতঙ্কে ছিলাম আমরা। উদ্ধার সরঞ্জামগুলোতেও যেকোনো সময় ত্রুটি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল।

তিনি আরো বলেন, আমি যখন ডুবুরির সঙ্গে একটি শিশুকে বেরিয়ে আসতে দেখছিলাম তখন সত্যিই ভয় পাচ্ছিলাম। আমরা হয়তো ৫০ মিটার পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। তাই আমরা বুঝতে পারছিলাম যে কিশোরটিকে নিয়ে আসা হচ্ছে সে জীবিত না মৃত।

উদ্ধার অভিযানে এক ডুবুরির মৃত্যু
৫ জুলাই পর্যন্ত সেচের পর পানির উচ্চতা দেড় সেন্টিমিটার কমে আসে। কিন্তু পরদিন ৬ জুলাই দেখা গেল, গুহায় অক্সিজেনের পরিমান কমে আসছে। ঐ দিন কিশোরদের অক্সিজেনের বোতল দিয়ে ফেরার পথে নিজের অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে নেভিসিলের সাবেক ডুবুরি সামান গুনান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার সহকর্মী তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও তিনি মারা যান।

থাইল্যান্ডের স্মরণকালের ইতিহাসের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ও সফল এ উদ্ধার অভিযানের পর থাম লুয়াং গুহাটিকে আগামীদিনের পর্যটকদের জন্য একটি জাদুঘরে রূপদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে থাই কর্তৃপক্ষ। এটি থাই পর্যটনের একটি ‘বড় আকর্ষণে’ পরিণত হবে। দুটি কোম্পানি ইতোমধ্যে ঘোষণাও দিয়েছে, উদ্ধার অভিযানের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে তারা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Share.

মন্তব্য করুন