[মোশাররফ হোসেন খান (২৪ আগস্ট ১৯৫৭); আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি ও কথাশিল্পী। তাঁর জন্ম যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার অন্তর্গত কপোতাক্ষ তীরের বাঁকড়া গ্রামে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সম্পাদনাসহ এ পর্যন্ত তাঁর আশিটিরও অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘হৃদয় দিয়ে আগুন’, ‘নেচে ওঠা সমুদ্র’, ‘বিরল বাতাসের টানে’, ‘পাথরে পারদ জ¦লে’, ‘সবুজ পৃথিবীর কম্পন’, ‘দাহন বেলায়’, ‘স্বপ্নের সানুদেশ’, ‘পিতার পাঠশালা’, ‘বৃষ্টি ছুঁয়েছে মনের মৃত্তিকা’, ‘ক্রীতদাসের চোখ’, ‘কবিতাসমগ্র-১’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবিতায় অবদানের জন্য এ পর্যন্ত বেশ কিছু পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। চলতি মাসের (আগস্ট) চব্বিশ তারিখ কবির ৬২তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে ‘কিশোর পাতা’র পক্ষ থেকে তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন পত্রিকার সহকারি সম্পাদক কবি মোস্তফা মাহাথির।]

কিশোর পাতা : আস-সালামু আলাইকুম…। বেশ কিছুদিন যাবৎ আপনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। রাজধানীর বারডেম হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন। তো, এখন কেমন আছেন?
মোশাররফ হোসেন খান : ওয়া আলাইকুমুস সালাম। হ্যাঁ, আমি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ এবং এখনো অসুস্থতার মধ্যেই আছি। এজন্য দেশবাসী এবং দেশের বাইরে যারা দোয়া করেছেন এতোদিন, এখনো তাদের দোয়া আমি চাচ্ছি। যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারি। আমি সকলের কাছে দোয়া প্রার্থী।
কিশোর পাতা : আগামি চব্বিশ আগস্ট আপনার ৬২তম জন্মদিন। তো, এ মুহূর্তে কী ভাবছেন, কেমন লাগছে?
মোশাররফ হোসেন খান : হা হা হা। এ মুহূর্তে আমি আমার জন্মদিন নিয়ে খুব একটা ভাবি না। খুব একটা কেন, বলতে গেলে আমার জন্মদিন নিয়ে আমি কখনোই ভাবিনি। তবুও আমি লক্ষ করি যে, প্রতি বছরই আমার জন্মদিন আসলে দেশ এবং বিদেশে, বিভিন্ন দোয়া এবং অনুষ্ঠান হয়। আমার জন্য সেগুলো আল্লাহর রহমত বলে আমি মনে করি। আমি সবার জন্য দোয়া করি, যারা আমাকে ভালোবেসে এগুলো করে থাকেন।
কিশোর পাতা : আপনার কবি হয়ে ওঠার পেছনের গল্পটি বলবেন?
মোশাররফ হোসেন খান: খুবই মজার একটি প্রশ্ন। মজার এজন্য যে, এটি আমার জীবনের সাথে একান্তভাবে জড়িত। এর আগে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম, গত বছর। সুযোগ হলো সেই কথাগুলো আরেকবার বলার। আমি যখন খুব শৈশবে আব্বাজানের বুকের উপরে শুয়ে থাকতাম, তখন তিনি ছড়া কেটে কেটে কথা বলতেন। আব্বাজানের মুখের এই ছন্দ আর ছড়া শুনতে শুনতে আমার ভেতরও কেমন করে জানি একসময় সেটা জাগরিত হলো। পরমুহূর্তে আমিও চেষ্টা করতাম, আব্বাজানের কথার অপর পিঠে ছন্দ মেলাতে। এইভাবে ছোটো থেকে, অতি শৈশব থেকেই আমার সাহিত্য- বিশেষ করে ছড়া-কবিতা আমার ভেতরে জাগরিত হয়েছে। আর তখন থেকেই এবং ঐ আকর্ষণ থেকেই আমি কবিতার প্রতি ঝুঁকে পড়ি। একটি কাব্যগ্রন্থের নামই আমি দিয়েছি- ‘পিতার পাঠশালায়’। কারণ আমার কবি হয়ে ওঠার পেছনে আব্বাজানের ভূমিকা ছিলো বিশাল এবং ব্যাপক। তাঁর সেই ঋণের কথা আমি কখনো ভুলতে পারি না, ভুলতে পারবো না।
কবি হয়ে ওঠা খুব কষ্টকর একটা ব্যাপার। আমার স্বপ্ন ছিলো- শৈশবে এবং কৈশোরে আব্বাজানের কাছে আমি যখন বড়ো বড়ো কবিদের নাম শুনতাম এবং তাঁদের কবিতা শুনতাম, তখন আমি আমার ভেতরে একটা আন্দোলন এবং আলোড়ন অনুভব করতাম। আমার মনে হতো, কবিরা অন্য কোনো রকম মানুষ। এজন্য একদিন আব্বাজানকে জিজ্ঞেস করলাম- কবিরা কী খান? আব্বাজান হেসে উত্তর দিলেন- কেন, তুমি যা খাও কবিরাও তাই খান! আমি ভাবলাম- সত্যিই তাই? তখনই আমার মনে হয়েছিলো যে, আমি কবি হবো। আমি কবি হতে চাই। আর আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে আমি জাগতিক কোনো বিষয় না, অন্য কোনো বিষয় না, অর্থ-সম্পদ না- কবি হবার জন্য আমি হাত তুলে মুনাজাত করতাম। আল্লাহ হয়তো সেটা কবুল করেছেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। কবি হয়ে ওঠা- এটা যে কতো কষ্টকর ব্যাপার, তা আজ ৬২তম বছরে এসে আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। অন্তত আমার মতো কবিদের যারা শুধু সাহিত্যই করেন, কবিতাই লেখেন- তাদের জন্য যে কত কঠিন ব্যাপার। কত কষ্টকর ব্যাপার, সেটা এখন বুঝতে পারছি। এটা সহজ ব্যাপার নয়। একজন প্রকৃত কবি হতে হলে বৈরী বাতাস ভাঙতে হয়, উজান সমুদ্রে সাঁতার কাটতে হয় এবং আগুনের পর্বত মাড়াতে হয়। যার ভেতর এই দুঃসাহসী মানসিকতা ও শক্তি থাকে, তিনিই কেবল কবি হতে পারেন বলে আমি মনে করি। সকল জাগতিক হাতছানি থেকে নিজেকে আড়াল ও একা করার মতো দুঃসাহস একজন কবির থাকা প্রয়োজন। সৃষ্টিকর্তার অশেষ দয়া যে, তিনি আমার ইচ্ছাকে, আমার স্বপ্নকে কবুল করেছেন। এটুকুই শুধু বলবো।
কিশোর পাতা : আপনার প্রথম লেখাটি কোথায় প্রকাশিত হয়েছিলো এবং তখন আপনার অনুভূতি কেমন হয়েছিলো?
মোশাররফ হোসেন খান : আমার প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিলো ‘মিতালী’ নামক একটি পত্রিকায়। আবদুল্লাহিল বাকী নামে একজন সম্পাদনা করতেন। বছরে একবার বা দু’বার সেটি বেরুতো। তো, সেই পত্রিকায় আমার প্রথম একটি কবিতা ছাপা হয়েছিলো- আমি ছাপার অক্ষরে দেখেছি। সেটির নাম ছিলো- ‘গোধূলি সময়’। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদয় দিয়ে আগুন’-এ কবিতাটি আছে। আমি এখনো সেটা মাঝে মাঝে পাঠ করি, ভালো লাগে।
কিশোর পাতা : তখন আপনার বয়স কেমন ছিলো?
মোশাররফ হোসেন খান : বয়স তখন খুব বেশি ছিলো না। আমি তখন সিক্স কি সেভেনে পড়ি। ঠিক এরকম একটা বয়সে লেখা কবিতা। কিন্তু আমি যে সেটা আমার কাব্যগ্রন্থে দিতে পেরেছি, সেই বয়সের একটি কবিতা এবং ১৯৮৬ সালে যখন বইটি বের হয় তখন অনেকেরই এই কবিতাটি প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। অনেকেই কবিতাটি পছন্দ করেছিলেন এবং আমাকে বলতেন। তো, এটা ভাবতেও এখন ভালো লাগে যে, সে সময়কার একটি কবিতা- কৈশোরের একটি কবিতা আমার যৌবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলো। আমার খুব ভালো লেগেছিলো সেটা।
কিশোর পাতা : আপনার কিশোর উপন্যাস পড়লে আমরা দুর্দান্ত সব অ্যাডভেঞ্চারের মুখোমুখি হই। আপনার কৈশোরেও অ্যাডভেঞ্চারের কোনো বাস্তব গল্প আছে কি, যা আপনাকে আজও আলোড়িত করে?
মোশাররফ হোসেন খান : থাকবে না কেন! নিশ্চয় আছে। প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে, গ্রামে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে আমি। ধুলো, কাদা, মাটি- তারপর মাটির গন্ধ, ফসলের গন্ধ, কখন কোন ঋতু আসছে- সেই ঋতুর আবহাওয়া, এই সবকিছুই তো আমার জানা। আমার অতি চেনা এইসব। কোন পাখির কোন স্বর, কোন পাখি কেমন বাসা বাঁধে, কোন পাখি কী খায়, কোন পশু কী করতে ভালোবাসে, কী খেতে ভালোবাসে, নদীতে কখন জোয়ার-ভাটা লাগে- এসবই তো আমার জানা। সুতরাং মানুষ এবং মৃত্তিকার যে প্রকৃত অর্থবহতা, সেটি আমার ভেতরে আছে।
কিশোর পাতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘সহজ করে লিখতে আমায় কহ যে, সহজ করে যায় কি লিখা সহজে!’ এক্ষেত্রে আপনার লেখা ‘সাহসী মানুষের গল্প’ সিরিজের কথাই যদি বলি- কিংবা অন্যান্য কিশোর উপন্যাস; যেগুলো একইসাথে সহজ, প্রাঞ্জল ও শিল্পোত্তীর্ণ। প্রশ্ন হলো, শিশু-কিশোরদের জন্য সাহিত্যের ভাষা ও শিল্পমান কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন?
মোশাররফ হোসেন খান : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন। সহজ কথা সহজ করে বলাটা কিন্তু অতো সহজ নয়। সহজ করে বলারও একটা টেকনিক আছে। এবং সেই টেকনিকটাই শিখতে হয়। আমি যখন সাহসী মানুষের গল্প লিখি- এ কথাটুকু না বললে অনেকেই আবার বুঝতে পারবে না; অনেক আগে থেকেই আমাকে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিলো। আমি ভেবেছিলাম- জীবনে কবিতা ছাড়া অন্য কিছুই লিখবো না- না গল্প, না গদ্য। কিন্তু যা ভাবি, জীবন তো আর সেভাবে চলে না। একসময় সাহসী মানুষের গল্প যখন আমি লিখতে শুরু করলাম তার আগেই আমি কিন্তু প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে কিভাবে লিখবো। লেখাটা কেমন হবে, লেখার বৈশিষ্ট্য কেমন হবে এবং লেখাটা কারা পড়বে- তাদের উপযোগী করে কোন ভাষায় আমাকে লিখতে হবে- এইসব। সুতরাং পাঠকের দিকে তাকিয়ে আমি ঠিক সেই ভাষাটি- উত্তম একটি ভাষায় আমি লিখতে চেষ্টা করেছি। এখনো অনেকে আছেন, যাদের চুল-দাঁড়ি পেকে গেছে- আমাকে যখন বলে- স্যার, আপনার লেখা পড়েই আমি সাহিত্যে বা জীবনে একটা গতি পেয়েছিলাম। তো, শুনতে বেশ ভালো লাগে। আপনারা জানেন যে, আমি একজন বিচরণশীল কবি। আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যাই। সুতরাং সেখানে অভিভাবক শ্রেণীর যে সকল ব্যক্তিকে পাই, তারাও অনেক সময় বলে ওঠেন-আপনি সাহসী মানুষের গল্পের সেই কায়েস মাহমুদ না? আমি তখন চমকে উঠি। আমি জিজ্ঞেস করি যে, আপনি এটা কিভাবে জানেন? তখন বলেন- আমি তো তার একজন পাঠক ছিলাম। তার মানে তিনি পাঠক, তার সন্তান পাঠক এবং সন্তানের সন্তানও এখন পাঠক সাহসী মানুষের গল্পের। আর আমার মনে হয় না যে, বাংলাদেশের আর কোনো লেখক এই ভাষায়- মানে সাহসী মানুষের গল্পের ভাষায় আর কোনো সাহিত্য- বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের উপযোগী কোনো সাহিত্য করতে পেরেছেন- আমার মনে হয় না। এটা আমি দেখিনি। অবশ্য এটা আমি বলছি না যে, আমি খুব বড়ো কিছু একটা করে ফেলেছি। সবই আল্লাহর শুকরিয়া। তবে আমি চেয়েছিলাম- আমি যা লিখবো, তা যেন তাদের জীবনের জন্য এবং তাদের আদর্শের জন্যও কাজে লাগে। তাদের চলার পথে যেন কাজে লাগে, আমি সেটাই চেয়েছিলাম।
কিশোর পাতা : আজকাল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের একাডেমিক পড়াশোনায় যতোটা গুরুত্ব দেন, ঠিক ততোটা গল্প-উপন্যাস ও অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রে দেন না; বিশেষত সেসব বই, যা তাদের নৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এটা কেন?
মোশাররফ হোসেন খান : এটা খুব দুঃখজনক একটি বিষয়, আমি ইদানীং লক্ষ করছি। প্রশ্নটি আমাকে না বললেও আমি এ বিষয়টি নিয়ে বলতাম। ইদানীং শুধু নয়, আমি লক্ষ করছি কয়েক দশক ধরে- ঠিক এই প্রবণতা আমাদের দেশে চলে আসছে। এটি খুবই মারাত্মক। প্রথমত জানা দরকার যে, একাডেমিক শিক্ষা যেটা, সেটা কেবল অর্থ ও বৈষয়িক সম্পর্কিত। এর বাইরে যে পঠন-পাঠন রয়েছে, এর বাইরে যে সাহিত্য রয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি বিশাল জগৎ রয়েছে- সেটা কিন্তু প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মোক্ষম ভূমিকাটি রাখে। আমাদের সন্তানদেরকে প্রকৃত মানুষ বানাতে না গিয়ে শুধুমাত্র টাকা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এটা আদৌ ঠিক নয়। এটা অমানবিক। ছোটো থেকেই উচিৎ এ ব্যাপারে তাদেরকে জানানো, বোঝানো। দেশ সম্পর্কে, বিশ^ সম্পর্কে তাদেরকে জানাতে হবে। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে, ফেসবুক, টুইটার, গুগল ইত্যাদি মাধ্যম দিয়ে অনেক কিছুই হয়তো তারা জানে। কিন্তু এই জানা কোনো জানাই না। এই জানাটা একটা ফান ছাড়া আর কিছুই না। এতে করে অনেক জীবনও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখি। এটাকে একটা অপসংস্কৃতিও বলা যেতে পারে। আমি যেটা মনে করি-জীবন গড়ার ক্ষেত্রে তাদের ভালো বই পঠন-পাঠনের কোনো বিকল্প নেই। পড়তেই হবে। পাঠ্য বইয়ের বাইরে যতো ভালো ভালো বই আছে, তা আমাদের সন্তানদের পড়তে দিতে হবে। প্রয়োজনে অভিভাবকরা নিজেরা কিনে এনে হলেও তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। এটাই উচিৎ, এটাই কাম্য। আমি আশা করি, অভিভাবকরা এ ব্যাপারে অনেক সতর্ক হবেন।
কিশোর পাতা : আপনি লিখেছেন- ‘পাথরে পারদ জ¦লে, জলে ভাঙে ঢেউ। ভাঙতে ভাঙতে জানি, গড়ে যাবে কেউ।’ তরুণ সমাজের নৈতিক অবক্ষয় এবং ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্দ এই সময়ে আপনি এমন আশার কথা উচ্চারণ করলেন। আপনার কি মনে হয়, এ অবস্থার দ্রুত কোনো পরিবর্তন ঘটবে এবং পৃথিবীটা শিশু-কিশোরদের বাসযোগ্য হয়ে উঠবে?
মোশাররফ হোসেন খান : কবিতাটি আছে আমার ‘পাথরে পারদ জ¦লে’ কাব্যগ্রন্থে। বুক সাইজের একটি সাহিত্য পত্রিকায় সাত পৃষ্ঠা হয়েছিলো কবিতাটি। একটা দীর্ঘ কবিতা। তো, কবিতাটি পরে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। প্রথমত আমার একটু বলে নেয়া উচিৎ যে, ‘পাথরে পারদ জ¦লে’ এবং ‘বিরল বাতাসের টানে’ এই দু’টি কাব্যগ্রন্থ যখন বের হলো- ১৯৯১ সালে ‘বিরল বাতাসের টানে’ যখন বের হয়েছিলো, তখন একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিলো। কবি সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আল মাহমুদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আবদুস সাত্তার, শাহাবুদ্দীন আহমদসহ বড়ো বড়ো যে সকল কবি-সাহিত্যিক ছিলেন, প্রত্যেকেই কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেছিলেন। এমনকি এতোটাই আলোড়িত হয়েছিলেন কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ যে, তিনি আমার উপর একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন- ‘আশির দশকের কবি মোশাররফ হোসেন খান’ শিরোনামে। ১৯৯১ সালেই বেরিয়েছিলো বইটি। ‘দরোজার পর দরজা’ নামক সেই বইটিতে এই লেখাটিও আছে। তো, এটাও আমার সৌভাগ্য।
আমি সবুজ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। ‘পাথরে পারদ জ¦লে’ পঙক্তিটি যখন আমি যুক্ত করি- শুধু ওই একটি কবিতা লিখতে কিন্তু আমার তিন-চারমাস সময় লেগেছিলো। আমি মনে করি, এটি যে শুধু লেখার জন্য যে লিখেছিলাম- তা নয়। যখন এটা লিখেছিলাম, তখনও একটা অস্থির সময় বিরাজ করছিলো। একজন কবি তো আর দেশের বাইরের কেউ নন, সমাজের বাইরের কেউ নন। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ তাকেও আলোড়িত করে। এখনো আমি আলোড়িত হই। আমার পরিবেশ ও চারপাশের জগৎ সম্পর্কে আমি ওয়াকিফহাল। আর কবি তো অন্য কোনো প্রাণী বা জীব না। তিনিও মানুষ বটে। সেটা মনে রাখতে হবে। তারও ক্ষুধা আছে, তিনিও বোঝেন এবং সবকিছুর সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি হয়তো লেখার মাধ্যমে থাকেন, সরাসরি রাজপথে না। তো, লেখার মাধ্যমেই আমি আমার সমাজ বিনির্মাণের কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমার স্বপ্ন ছিলো¬- এই যে এখন যেসব মানুষ আছে, হয়তো এদের দিয়ে হবে না। কিন্তু এমন কোনো মানুষ আসবে, যাকে দিয়ে সেটা সম্ভব হবে- একটা স্বপ্নিল জগৎ তৈরি হবে। বিনির্মাণের যে প্রক্রিয়া- সেটা কিন্তু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। দেশে-বিদেশে সেটা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। আমি আশাবাদি। আর আমি কবি বলেই যে শুধু আশাবাদি তা নয়, বরং আমি দেখছি, একটা সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ইনশাআল্লাহ, আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু সেটা হবে। কারণ ¯্রােত কখনো আটকে রাখা যায় না। ¯্রােত স্বভাবতই গতিময়, সেটা চলবেই। ইনশাআল্লাহ, বিশ^ আবারও ছোটোদের জন্য, বড়োদের জন্য এবং সকল মানুষের জন্যই বাসযোগ্য হয়ে উঠবে বলে আমি আশাবাদী।
কিশোর পাতা : বিশ^জুড়ে চলমান অচলাবস্থা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কবিতায় আপনাকে সোচ্চার হতে দেখেছি, মানবিকতার পক্ষে কলম ধরতে দেখেছি- এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
মোশাররফ হোসেন খান : হ্যাঁ, আমি একজন সচেতন কবি হিসেবে যখনই বিশে^র কোনো প্রান্তে কোনোরকম মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, কিংবা মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে- আমি তখনই কিন্তু সোচ্চার হয়েছি। আমার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে এ নিয়ে কবিতা আছে। বসনিয়া আছে, চেচনিয়া আছে, কসোভা আছে, বাগদাদ আছে- আরো বহু আছে। সম্প্রতি যে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে ঘটনাগুলো ঘটলো, তা নিয়েও আমি লিখেছি। তো, এক সময়কার গুজরাটের যে হত্যাকা– তা নিয়েও আমি লিখেছিলাম। সব মিলে, পৃথিবীর যেখানেই কোনো জুলুমের ঘটনা ঘটেছে- আমি তা নিয়ে লিখেছি। কারণ আমি তো একজন কলম সৈনিক। যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করেন, রাজনীতি করেন- তাদের ক্ষেত্র ভিন্ন। কিন্তু আমি একজন সচেতন কবি হিসেবে আমার উচিৎ মানবাধিকারের পক্ষে কলম ধরা। এটা আমি সবসময়ই করেছি এবং ভবিষ্যতেও করবো, ইনশাআল্লাহ।
কিশোর পাতা : আপনি তো জীবনের দীর্ঘ একটি সময় ধরেই সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং এখনো আছেন। তো, এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
মোশাররফ হোসেন খান : হা হা হা। হ্যাঁ, এই এক ভাগ্য বটে আমার। আমি আল্লাহর কাছে প্রকৃত অর্থে চেয়েছিলাম কবি হবার জন্য। কিন্তু তিনি আমাকে আরেকটি যোগ্যতাও দিয়েছেন, সেটা হলো সম্পাদনা। আমার কিন্তু কবিতার পাশাপাশি কৈশোরকাল থেকেই সম্পাদনা চলে আসছে। প্রথম শুরু হয়েছিলো আমার স্কুলের দেয়ালিকা সম্পাদনা দিয়ে। এরপর যখন যশোর এলাম, তখন সাপ্তাহিক মুজাহিদ এর সাহিত্য পাতা ‘নবীনের মাহফিল’ আমি সম্পাদনা করতাম। তাছাড়াও আমি ‘দাবানল’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা এবং প্রস্তুতি নামে আরেকটি সাহিত্য পত্রিকা বের করতাম। ঢাকা, কোলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গার বড়ো বড়ো লেখকরা সেখানে লিখতেন। আমি যখন ঢাকায় আসলাম, কোনো চাকরি নিয়ে আসিনি। আমি সাহিত্য করার জন্যই কিন্তু ঢাকায় আসি। কবিতার জন্যই কিন্তু আমি ঢাকায় এসেছিলাম। আমার যদি কবিতা লিখতেই হয়, আমাকে ঢাকায় যেতে হবেÑ এই চিন্তা থেকে ঢাকায় আসি। কারণ ঢাকাই হলো আমার মূল জায়গা।
আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে এলাম ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে। কোনো চাকরি নিয়ে আসিনি, অথচ ঢাকায় আসার পরপরই আমার সম্পাদনার চাকরি হয়ে গেলো মাসিক আল ইত্তেহাদে। এরপরে উম্মাহ ডাইজেস্ট এর সম্পাদক হলাম। তারপর সৃজন প্রকাশন হলো, যেটা পিসিপি লিমিটেডের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ছিলো। খুবই উন্নত মানের একটি প্রকাশনা ছিলো সেটি, তার সম্পাদক হিসেবে সেখানে যুক্ত হলাম। তারপরে আরো কয়েকটি মাসিক পত্রিকা এসে গেলো, যেগুলোর সম্পাদক ছিলাম আমি। এখনো প্রতি বছরই একটি বড়ো পত্রিকা বের হয়, যেটা সীরাত স্মারক। সেটিও প্রায় সতেরো-আঠারো বছর ধরে আমি সম্পাদনা করে আসছি। আর প্রতি বছরই অগণিত বই এবং সংকলন আমার হাত দিয়ে আমি সম্পাদনা করে যাচ্ছি। তো, বেশ কয়েকটি নামিদামি প্রতিষ্ঠানের রিভিউয়ার হিসেবেও আমি আছি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আমার সমকালীন যেসব কবি বন্ধুরা আছেন, নাম না বলাই ভালো- তাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থগুলোও কিন্তু আমাকে সম্পাদনা করে দিতে হয়েছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা ফেলে দিয়ে, পঙক্তির পর পঙক্তি ফেলে দিয়ে আমি সম্পাদনা করে দিয়েছি। পরে শুনেছি তাদের সেই বইগুলো নাকি খুব নাম করেছে। এরপর নব্বই দশকেরও অনেকেরই কাব্যগ্রন্থের সম্পাদনা আমি করে দিয়েছি। তো, এখনো করে যাচ্ছি- মাসিক পত্রিকা এবং অন্যান্য সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করে যাচ্ছি। মোটকথা হলো, এই যে লেখালেখি এবং সম্পাদনা- এই দু’টোর সাথেই আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছি।

কিশোর পাতা : বলা হয়- স্বদেশের পাশাপাশি কবি একজন বিশ^ নাগরিকও। এ বিষয়ে কী বলবেন?
মোশাররফ হোসেন খান : হা হা হা। আমার একটি কবিতার শেষ লাইনই হলো- ‘আমি তো মানুষ বটে বিশনাগরিক।’ তার মানে? তার মানেটা হলো, একজন কবি প্রথমত মানুষ। কবি কোনো চতুষ্পদ জন্তু নন, তিনিও মানুষই। সুতরাং আমিও মানুষ; গোটা বিশই আমার। আর আমিও গোটা বিশের। এটা তো আমাদের প্রত্যেকের চেতনায়ই থাকা উচিৎ যে, গোটা বিশ আমার। আর আমিও গোটা বিশের। সুতরাং এখানে কোনো বাধা থাকা উচিৎ নয়- এটাই আমার কথা।
কিশোর পাতা : এই বয়সে এসে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
মোশাররফ হোসেন খান : শুধু এই বয়সে কেন, আমার সামান্যতম যখন বুদ্ধি-জ্ঞান হয়েছে, তখন থেকেই আমি কামনা করে এসেছি যে, এমন একটা…। আমার বহু কবিতায় এ নিয়ে কথা আছে যে, আমি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই। এ নিয়ে আমার মনে হয় যে, নতুন করে কিছু বলার নেই। যদি কেউ আমার কবিতাগুলো মন দিয়ে একটু পড়েন-তাহলে বুঝতে পারবেন যে, আমি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই। তো, আমি এখন হরিণের ডাক শুনতে চাই, আমি কোকিলের ডাক শুনতে চাই। বন্য বরাহের ডাক আমি শুনতে চাই না, কাকের কর্কশ ধ্বনি আমি শুনতে চাই না। মানে, এটা আমি প্রতীকী হিসেবে বলছি। তো, এখন কথা হচ্ছে- আমার এ ভূ-খ- হবে সবুজে, সুন্দরে, শ্যামলিমায়- সকল দিক দিয়ে বাসযোগ্য। এমন একটি সুন্দর বাংলাদেশ- যেখানে ভয় থাকবে না রাস্তায় হাঁটতে, যেখানে সঙ্কোচ থাকবে না। আমার কথা আমি বলতে পারবো। যেখানে আমার জীবন নিয়ে সংকট থাকবে না, আমার সন্তানদের জীবন নিয়ে সংকট থাকবে না, তারপরে আমার পরিবার নিয়ে সংকট থাকবে না, এইরকম। মানে, গোটা বাংলাদেশের মানুষই যেন নিঃশংসয়ভাবে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে এবং মানবাধিকার নিয়ে থাকতে পারে। এরকম একটা সুন্দর, সুশৃঙ্খল, সুগঠিত এবং উন্নয়নশীল বাংলাদেশ আমি দেখতে চাই। যেখানে কেউ ক্ষুধায় কাতরাবে না। একটা সমতা যেন থাকে। একটা মানবিকতা যেন সব জায়গায় থাকে। এটা আমি কামনা করি।
কিশোর পাতা : বাংলাদেশের অগণন শিশু-কিশোর- যারা আপনাকে ভালোবাসে, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
মোশাররফ হোসেন খান : শুধু বাংলাদেশ বললে তো সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ আমার লেখা অনুদিত হয় পৃথিবীর আরো বেশকিছু ভাষায়। সুতরাং বলতে হবে বাংলাদেশের বাইরেও…। তো, যারা আমাকে ভালোবাসে আমি তাদের না চিনলেও, তাদের জন্য আমার ভালোবাসা এবং দোয়া সর্বক্ষণ রয়েছে। আমি তাদের জন্য শুভ কামনা করি এবং আমার শুভেচ্ছা তাদের জন্য রইলো। আল্লাহ যেন তাদের হৃদয়কে অনেক বড়ো এবং প্রশস্ত করে দেন। মানুষের হৃদয় যদি প্রশস্ত না থাকে, সে মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে পারে না। সে মানুষ অমানুষ হয়ে যায়। তো, আল্লাহপাক আমাকে যারা ভালোবাসেন, তাদের হৃদয়কে অনেক বড়ো করে দিন। যেন আরো অনেক মানুষকে তারা ভালোবাসতে পারেন।
কিশোর পাতা : আমাদেরকে সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ এবং চব্বিশ আগস্ট আপনার ৬২তম জন্মদিন উপলক্ষে আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো।
মোশাররফ হোসেন খান : হ্যাঁ, কিশোর পাতা যারা পড়েন তারা তো আমার আত্মার আত্মীয়। মোটকথা, যারা সাহিত্যকে ভালোবাসেন, সাহিত্য জগৎতে ভালোবাসেন এবং সাহিত্যিকদের ভালোবাসেন- তারা অত্যন্ত বড়ো মানুষ। বড়ো হৃদয়ের মানুষ। আমি তাদেরকে ভালোবাসি এবং আমি সকলের জন্য দোয়া করি। তারা এখন অনেক ছোটো হলেও একদিন অনেক বড়ো হবে। তাদের সন্তানরাও যেন তাদের মতো গড়ে ওঠে এবং তাদের মতো হয়। যেন সাহিত্যকে ভালোবাসে, সাহিত্যিকদের ভালোবাসে এবং এই দেশ ও পৃথিবীকে ভালোবাসে- এটা আমি চাই। তাহলে তারা আলোকিত পথের দিশা পেযে যাবে, ইনশাআল্লাহ। কিশোর পাতার জন্যও অনেক শুভ কামনা। এছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে যারা প্রতি বছর আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান এবং আমার জন্য দোয়া করেন, তাদের সবার জন্য শুভ কামনা এবং অনেক অনেক ভালোবাসা।

Share.

মন্তব্য করুন