মা : সাজিদ, এই সাজিদ! ওঠো বাবা তোমার বাবা ডাকছে নামাজে
যাবে না?
সাজিদ : জি আম্মু এই তো উঠেছি।
সাজিদ নিয়মিত নামাজ পড়ে। জায়নামাজটা হাতে নিয়ে আব্বুর সাথে
মসজিদে যায় সাজিদ।
সকাল থেকে সাজিদের শরীরটা চনমনে ছিলো। নামাজ পড়ে ছোট
গাছগুলিতে পানি দিয়ে পায়রাগুলোকে খাবার দিয়েছে। ছাদের বাগানে
ফুলগাছগুলো সুন্দর বেড়ে উঠছে। কখনও কখনও দোয়েল ও টুনটুনি
পাখি বসে থাকে ঐ ফুলগাছে। সাজিদের দিকে তাকিয়ে টুইট টুইট শব্দ
করে পাখিগুলো। সাজিদ দৌড়ে ঘর থেকে কবুতরের খাবার মুঠি ভরে
নিয়ে পাখিদের দিকে ছিটিয়ে দেয়। পাখিগুলো দানা মুখে নিয়ে উড়ে
চলে যায়।

মা : সাজিদ, তোমার বাবার সাথে গোসল সেরে নাও বাবা। আমি নাস্তা রেডি করে দিচ্ছি স্কুলের সময় হয়ে
এলো।
সাজিদ : জি আম্মু।
সাজিদের বাবা প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে স্কুলে সাজিদকে নামিয়ে দেন। স্কুল শেষে ও সোজা বাড়ি চলে
আসে। সন্ধ্যায় টিচারের নিকট এসে পড়াগুলো গুছিয়ে নেয় সাজিদ।
সাজিদের বাবা মায়ের ইচ্ছা ছেলে বড় ডাক্তার হবে। ৭ম শ্রেণির ছাত্র সাজিদ স্যারকে জিজ্ঞাসা করে, “স্যার
আমি কিভাবে ডাক্তার হবো?” স্যার জবাব দিলেন,“বাবা, তুমি ভালোভাবে লেখাপড়া করলে যা হতে চাও
তাই হতে পারবে।”
সাজিদের বন্ধু রাকিব। স্কুলে তারা দু’জনে একই বেঞ্চে বসে। রাকিবের বাবা ইজিবাইক চালায় এবং বাড়িতে
দুটি গাভী আছে। ওরা মাঝে মাঝে গরুর দুধ বিক্রি করে কিছু আয় করে। দুধ বিক্রির কিছু টাকা জমিয়ে
ছেলেকে একটা শার্ট কিনে দিয়েছে ওর বাবা। শার্ট পেয়ে রাকিব খুব খুশি হয়, “মা আমি অহন থাইকা ইশকুল
কামাই দিমু না। আমার বর্শিটা ভালা কইরা রাইখো কেলাস শ্যাষে মাছ কই মাছ ধরতে যামু। তুমি আমারে
কই মাছ ভাজা দিয়া ভাত দিবা।”
স্কুলে সাজিদ ও রাকিব একসাথে টিফিন ভাগাভাগি করে খায়। বিষয়টি সাজিদের আম্মু জানেন তাই তিনিও
ছেলেকে টিফিন ক্যারিয়ারে একটু বেশি করে খাবার দিয়ে দেন। রাকিবের রোল-২ এবং সাজিদের-৪।
প্রতিদিনের মত স্কুলের ক্লাস চলছিলো। সাজিদ-রাকিব একই বেঞ্চে বসে ছিলো। আজকে স্যার একটু কড়া
করে পড়া আদায় করছেন। সামনে ঈদ তাই কয়েকদিন পর ঈদের ছুটি হবে।
স্কুলের পিয়ন মকবুল হঠাৎ এসে স্যারের কানে কি যেনো বলে চলে গেলো। স্যার চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে
রাকিবকে ডাকলো, “রাকিব, তোমার বাবা কি ইজিবাইক চালায়?” রাকিব কৌতূহলী হয়ে জবাব দেয়, “জি
স্যার, আমার বাজানে খুব ভালো ইজিবাইক চালাইতে পারে স্যার, আপনি কোথাও যাইবেন স্যার? বাজানরে
বলব? আপনার কাছে কোন ট্যাহা পয়সা লাগবো না স্যার!” স্যার বললেন, “না বাবা, আমি কোথাও যাবো
না।” “তাইলে স্যার?”- জিজ্ঞাসা করে রাকিব। স্যার বলেন, “তোমার বাবা ঐ নিউমার্কেটের সামনে
এক্সিডেন্ট করেছে, আমি পিয়নকে বলেছি একজন স্যার তোমাকে নিয়ে যাবে। তুমি যাও বাবা আজ তোমার
ছুটি।”
ঠোঁট উল্টিয়ে রাকিব কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কেঁদে ওঠে।
দুঃসংবাদটি শুনে ক্লাসের সবাই নীরব হয়ে যায় । সবাই রাকিবকে সান্ত¡না দিতে এগিয়ে আসে। রাকিব তার
বন্ধু সাজিদকে সাথে নিয়ে যেতে চায়। স্যার সাজিদকেও ছুটি দিলেন। চলে যাওয়ার সময় বুকে জড়িয়ে রাখা
বইগুলো কান্নার পানিতে ভিজতে থাকে রাকিবের।
প্রায় ঘন্টা সময় পর ওরা চলে আসে নিউমার্কেট হাসপাতালে। সেখানে পৌঁছে দেখে রাকিবের মা কান্নাকাটি
করছেন। দুর্ঘটনায় বাবা মাথায় প্রচ- আঘাত পেয়েছেন, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে মুমূর্ষু অবস্থায় তখনও
অচেতন হয়ে জরুরি বিভাগে পড়ে আছেন। ট্্রাকটা ইজি বাইককে ধাক্কা দিয়ে ওর বাবার বুকের এক পাশ
দিয়ে চলে গেছে। ডাক্তার বলেছে অপারেশনের জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। বড় ডাক্তার অপারেশন করবেন
তাই খরচ বেশি।
এতোগুলো টাকার কথা শুনে রাকিবের মায়ের কান্না আরও বেড়ে গেলো। মাথায় হাত দিয়ে ‘থ’ মেরে বসে
পড়ল হাসপাতালের কোণে। মুখে কথা নেই। রাকিব শুধু মৃতের মতো পড়ে থাকা বাবার দিকে তাকিয়ে
কাঁদতে লাগলো। কিছুদিন আগেই ইজিবাইকটি ক্রয়ের সময় দেড় লক্ষ টাকা ঋণ করতে হয়েছে রাকিবের
বাবাকে। আজও সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন নি তিনি। সাজিদের বাবা গাড়ি নিয়ে সরাসরি হাসপাতালে
আসে রাকিবের বাবাকে দেখার জন্য। ডাক্তারের কথা শুনে দ্রুত অপারেশনের তাগিদ দেন এবং টাকা
জোগাড়ের বিষয় আশ^স্ত করেন।
খবর পেয়ে সাজিদের মাও হাসপাতালে চলে আসেন। দুর্ঘটনার দু’ঘণ্টা পর অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু হয়।
কিন্তু রাকিবের বাবাকে বাঁচানো সম্ভব হলো না। ডাক্তার সাহেব দুঃখ প্রকাশ করলেন। মৃত্যুর কথা শুনে
অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে রাকিবের মা। রাকিব তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা, বাজানে কইছিলো তরে
ডাক্তার বানামু ভালা কইরা পড়াশুনা করবি, বাজান ভালা না হইলে আমি কি ডাক্তার হইতে পারমু মা?” মা
সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বলে, “হবি বাজান, আমিই তরে ডাক্তার বানামু।”
সাজিদের বাবা-মার চোখেও পানি চলে আসে। সাজিদ বলে, “বাবা, আমি ডাক্তার হয়ে গরীব মানুষের সেবা
করতে চাই।” মা সাজিদকে জড়িয়ে ধরে বললেন,“তোমরা কিন্তু আগের মতই স্কুলে বেঞ্চে একসাথে বসে
টিফিন খাবে আর তোমাদের দুজনকেই একসাথে ঈদের জামা কিনে দিবো আমরা।”

Share.

মন্তব্য করুন