বছর ঘুরে আবার এলো ঈদ। এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে মুসলিমদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর নিয়ে আসে আনন্দের বার্তা। বিশ্বের প্রায় ১৮০ কোটি মুসলিম এই উৎসবে মেতে ওঠেন। এ সময় মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে নামে আনন্দের ঢল। ঘরে ঘরে, পথে পথে ছড়িয়ে পড়ে এই আনন্দ। মুসলিম দেশ ছাড়াও অমুসলিম দেশগুলোতেও চলে খুশির রথযাত্রা। বাহারি রঙের পোশাকে আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আদর-আপ্যায়ন ও অনুষ্ঠান চলে। তবে ঈদ উদযাপনে বিভিন্ন দেশের রয়েছে নিজস্ব কিছু রীতি।

ইরাক
ঈদের দিন সুগন্ধি সাবান মেখে গোসল করার পর সবাই শির-খুরমা দিয়ে মিষ্টি মুখ করে। খাবারের তালিকায় বাদাম, খেজুর ও অন্যান্য খাবারও থাকে। এরপর নতুন পোশাক পরে ছোট-বড় সবাই ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে ছোটে। ছোটরা মেতে ওঠে নিত্যনতুন খেলায়। নামাজ শেষে সবাই যার যার বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়িতে একে একে আত্মীয় সমাগম বাড়তে থাকে। সবাই মিলে আনন্দ-আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া করে কাটিয়ে দেয় পুরো দিন। খাবার তালিকায় থাকে মজাদার সব মাংসের পদ আর ডেজার্ট।

মালয়েশিয়া
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ধনী দেশ মালয়েশিয়া। এখানে ঈদে উৎসব পালন হয় জমকালো সব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এ দিন পুরুষরা পরে কালো টুপি, শার্ট আর প্যান্ট। ছেলে-বুড়ো সবাই ঈদগাহে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে একজন আরেকজনের সঙ্গে কোলাকুলি করে, বুকের সঙ্গে বুক মেলায়। ঈদের দিন মালয় মুসলমানরা ঐতিহ্য অনুযায়ী ওপেন হাউস পালন করে। এ দিন যে কেউ যে কারও বাড়িতে অতিথি আসতে পারে এবং মুখরোচক খাবার রান্না হয় ঘরে ঘরে! একে অন্যের বাড়িতে যাওয়ার কারণে খোঁজ খবর আদান-প্রদান যেমন চলে তেমন আন্তরিকতাও বাড়ে।

ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনে ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ভেড়ার মাংস। সামর্থ্যবানরা আস্ত একটি ভেড়া দিয়ে রোস্ট করে। বাকিরা মানসাফ নামে ভেড়ার মাংসের একটা ডিশ রান্না করে। ঈদের নামাজের আগে ফিতরা করা হয়। নামাজ শেষে বাসায় গিয়ে সবাই নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরতে বের হয়। ঈদের দিন প্রত্যেক বাসাতে মিষ্টিসহ অন্যান্য খাবার বিতরণের রেওয়াজ আছে। তা ছাড়া পরিচিতদের বাড়িতে গিয়ে মিষ্টান্ন খাওয়াটা বাধ্যতামূলক। দুপুরে পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্যের বাসায় সবাই একত্রিত হয়ে দুপুরের খাবার খাওয়াটা যেন তাদের রেওয়াজ।

সৌদি আরব
মুসলিম জাহানের তীর্থস্থান সৌদি আরব। সেখানে ঈদ উদযাপিত হয় জৌলুস আর জাঁকজমক ভাব নিয়ে। সুন্দর করে ঘরবাড়ি সাজানো, রকমারি ভূরিভোজ, ঈদ সেলামি আদায়, অতিথি আপ্যায়ন, নতুন পোশাক পরা- সবই চলে সেখানে। তবে অঞ্চলভেদে ঈদের অনুষ্ঠান ভিন্ন হয়ে থাকে। ঈদ উদযাপনে তাদের উদারতা, আতিথেয়তা এবং উৎসবী আমেজ নজর কাড়ে সবার। এ দিন পুরুষরা ‘কান্দর’ নামে এক ধরনের সাদা পোশাক পরে। মাথায় দেয় গাহফিহ নামের এক ধরনের গোল টুপি। আর নারীরা ‘থাউব’ নামের বিশেষ ধরনের পোশাক পরে এই দিনে। ঈদের দিন সেখানকার দোকানিরা পর্যন্ত ক্রেতাদের বিভিন্ন জিনিস উপহার দিয়ে থাকেন। শিশুদেরও খেলনা ও বিভিন্ন ধরনের উপহার বিতরণ করেন তারা।

আফগানিস্তান
যুদ্ধে বিধ্বস্ত হওয়ার স্মৃতি আফগানিস্তানের জন্য খুবই সাম্প্রতিক। তবু এখানে ঈদের আনন্দের কমতি নেই এতটুকু। বরং ঈদের খুশিতে মুসলিমরা প্লাবিত হয় রোজার প্রথম দিন থেকে। মহল্লার সবাই দল বেঁধে মসজিদে নামাজ পড়ে, ইফতার করে। নিতান্ত শারীরিকভাবে অক্ষমরা রোজা রাখে না। তবে সবার মাঝে রোজা রাখার প্রবণতা তীব্র থাকে। এখানে ঈদের আনন্দ সমান গুরুত্বের সঙ্গে চলে একটানা তিন দিন। আফগানদের ঈদের নামাজ পড়ার রীতি মসজিদে গিয়ে। নামাজ শেষে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি ও কুশল বিনিময় চলে। ঈদে সবার চাই নতুন পোশাক। তবে ছোটদের জন্য একটু বেশিই স্পেশাল ঈদ আনন্দ। তাদের পোশাক আর খাবার-দাবারের বায়না মেটানো হয় সবার আগে।

মিসর
দেশটির ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদের দিন সকালে তাদের প্রথম খাবার হলো খেজুর আর এক গ্লাস দুধ। এ ছাড়া মধু দিয়ে এক ধরনের বিশেষ কুকিজ তৈরি করা হয় এ দিনের খাবার হিসেবে। ঈদ উপলক্ষে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই একে অন্যকে ঈদকার্ড দেওয়া-নেওয়ার রেওয়াজ আছে। শিশু ও নারীদের জন্য উপহার কেনার ধুম পড়ে যায়। বড়দের সঙ্গে ছোটরা ঈদের মাঠে যায়, ঈদ সেলামি নেয় এবং ইচ্ছামতো খেলনা ও মুখরোচক খাবার কেনে। নামাজ শেষে শহরের শিশুরা বিনোদন পার্কে যায় আর গ্রামের শিশুরা ছুটে যায় গল্পদাদু ও ম্যাজিশিয়ানদের কাছে। শিশুদের আনন্দ দিতে তারাও গল্প আর ম্যাজিকের ডালা বিছিয়ে বসে থাকে। এ সময় ঘোরাঘুরি আর মজার মজার খাবার খাওয়াতে কারও আগ্রহের কমতি থাকে না।

ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ ইন্দোনেশিয়া। আর তাই সেখানে ঈদ উৎসবের ঘটা হয় ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এখানকার মুসলমানরা ঈদের দিন শার্ট-প্যান্ট ও কালো টুপি পরে থাকেন। নারীরা বাজু কুরুং ও বাজু কেবায়া নামের গলা থেকে পা পর্যন্ত এক ধরনের স্কার্ট পরেন। ঈদের দিনের বিশেষ খাবার হিসেবে তারা রান্না করেন কেতুপাত, দোদোল, লেমাং নামের ঐতিহ্যবাহী খাবার। ঈদের নামাজ শেষে স্বজনদের কবর জিয়ারত করার রীতি আছে তাদের মধ্যে। দিনের বাকি সময় পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাটান। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে ঈদের সেলামি ও নানা রকম উপহার পেয়ে থাকে। এ দিন শিশুরা নানা রকম খেলা ও ঘোরাঘুরিতে মেতে থাকে।

রাশিয়া
রাশিয়ায় রয়েছে ১৬ মিলিয়ন মুসলিমের বসবাস। তাদের ঈদ উৎসব অনেক বেশি জাঁকজমক। খাবার-দাবারের ঘটা থাকে উল্লেখ করার মতো। ঈদের বিশেষ খাবার হিসেবে গরুর মাংসের পদ থাকা চাই-ই। ঈদের নামাজ আদায়ের পর তারা আনন্দ উদযাপন করে পরবর্তী তিন দিন ধরে। এ ছাড়া নানা রকম খাবার ও ডেজার্ট থাকে তাদের তালিকায়। এই সময় একে অন্যকে উপহার দেওয়া, কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে সময় কাটানো ও ঘুরতে যাওয়া ঈদ উৎসবের অন্যতম অংশ। ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে দেশবাসী ও মুসলিম জাহানে শান্তির জন্য দোয়া করা হয়।

তুরস্ক
ঈদুল ফিতরের ছুটিকে তুরস্কে বলা হয় ‘শেখার বায়রামা’ বা ‘রমজান বায়রামা’। নগরীর ব্লু মসজিদের মিনার থেকে শুরু করে পুরো মসজিদ আলোকসজ্জায় সাজানো হয়। ঈদের দিন সকালে গোসল করে, নতুন পোশাক পরে মসজিদে নামাজ আদায় করতে যান। একে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যান। কবরস্থানে গিয়ে পূর্বসূরিদের জন্য দোয়া কামনা করেন। ঈদের প্রথা হিসেবে বিশেষ কায়দায় প্রবীণদের শ্রদ্ধা জানানো। শিশুদের ক্যান্ডি, চকলেট, ঐতিহ্যবাহী খাবার সঙ্গে সেলামিও দেওয়া হয়। ঈদ আয়োজনে থাকে কনসার্ট, ছায়া নাটকের মতো ঐতিহ্যবাহী বিনোদন।

ভারত
চাঁদরাতে মেয়েরা হাতে মেহেদি লাগায়। এই রাতে অনেকেই কেনাকাটা করতে যান। মুসলিম বাড়িতে এই সময় রান্নাবান্নারও ধুম চলে। ঈদের দিন নতুন পোশাক পরে ‘ঈদ মোবারক’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। চলে কোলাকুলি করে হৃদ্যতা-বিনিময়। ঈদের খাবারের আয়োজনে থাকে পোলাও-মাংসের মজাদার পদ। এ ছাড়া নানা রকম মিষ্টান্ন না থাকলেই নয়। ভারতে ঈদ উপলক্ষে এক দিনের সরকারি ছুটি থাকে। নয়াদিল্লিতে জামে মসজিদ, হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদে, লক্ষৌতে আয়েশবাগ ঈদগাহে, কলকাতায় রেড রোডে ঈদের বড় জামাতের আয়োজন করা হয়।

চীন
চায়নিজ মুসলিমদের কাছে ঈদের গুরুত্ব অন্যতম। তারা ঈদের দিন জিয়াং নামের একটি বিশেষ খাবার খেতে খুবই পছন্দ করে। এই খাবারটি তৈরি করা হয় মূলত ভাজা আটা-ময়দা দিয়ে। এই খাবারটি স্যুপ অথবা ভাত দিয়ে খাওয়া হয়। তাদের ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় মূলত মসজিদে। সরকারিভাবে এই উৎসবে কোনো ভূমিকা না থাকলেও মুসলিমরা ধর্মীয় আলোকে নিজেদের মধ্যে শান্তির বার্তা পৌঁছায়। ঈদের দিন সরকারি ছুটি থাকায় দিনটি আনন্দের সঙ্গে উদযাপন হয়। এমনকি রাস্তায় টোল পর্যন্ত আদায় হয় না।

পাকিস্তান
ঈদ উপলক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে রমজান মাসজুড়ে থাকে ঈদের আমেজ। প্রিয়জনদের ঈদকার্ড পাঠানো এখানকার ঐতিহ্য। খেলার মাঠে, পার্কে ঈদের জামাত হয়। নামাজের পর গরিবদের মধ্যে দান-খয়রাত চলে। বাড়ি ফেরার পথে পুরুষরা পরিবারের সদস্যদের জন্য মিষ্টিসহ বিভিন্ন উপহার কেনেন। ঈদের দিন সকালে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, ঐতিহ্যবাহী শির-কোরমা দিয়ে নাস্তা করেন। গণমাধ্যমগুলো ঈদের খবর ছাড়াও বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। শিশুদের জন্য দিনভর খোলা থাকে বিভিন্ন খাবার ও খেলনার দোকান।

Share.

মন্তব্য করুন