বর্ষাকাল আমাদের দেশের জন্য আনন্দ-বেদনার এক
ঋতু। গ্রীষ্মের প্রচ- তাপদাহ শেষে বর্ষা আসে প্রকৃতির
অনাবিল এক আনন্দ হয়ে। একটানা বর্ষণের পর
পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন জেগে ওঠে। বর্ষা এলে তাই
বাংলার প্রকৃতির রূপও বদলে যায়। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে
গ্রীষ্মের প্রচ- তাবদাহে তেতে ওঠা প্রকৃতি হয়ে ওঠে
কোমল আর সজীব। এ সময় আকাশে সারাক্ষণ চলে
ঘন কালো মেঘের আনাগোনা। ঋতুর গণনা হিসেবে
আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু বর্ষার বৃষ্টি শুরু
হয়ে যায় বৈশাখ থেকেই। চলে ভাদ্র-আশ্বিন মাস
পর্যন্ত। সেই হিসাবে বর্ষা বাংলাদেশের দীর্ঘতম ঋতবললেও অত্যুক্তি হয় না। অনেক সময় দেখা যায়
শরৎকালকে স্পর্শ করেও বৃষ্টির কোনো বিরাম নেই।
বর্ষার আগমনে পৃথিবী সিক্ত-শীতল হয়ে যায়। মানুষ,
জীবজন্তু, গাছপালা, পশুপাখি সব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
নতুন করে প্রাণ পায়। নদীনালা, খালবিল, মাঠঘাট
পানিতে ভরপুর হয়ে যায়। ফোটে কেয়া, কদম ফুল। বর্ষা
বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সুখ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে
আসে। গাছপালা নতুন পত্রপল্লবে ভরে যায়, উর্বর হয়ে
ওঠে ফসলের খেত। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে
বর্ষার এই ভরভরান্ত দৃশ্য খুবই আনন্দের। ছোট
ছেলেমেয়েরা কলার ভেলা বা কেয়াপাতার নৌকা ভাসিয়ে
আনন্দে মেতে ওঠে। অনেকে কেউবা খোশগল্পে মেতে
ওঠে। বই পড়ে। অলস সময় কাটায় কেউ কেউ।
বর্ষাঋতু সাধারণ দরিদ্র খেটেখাওয়া মানুষের জন্য
কখনো-কখনো খুবই কষ্টের। কারণ, অনেক সময়
টানাবর্ষণে খেটেখাওয়া মানুষ কাজে যেতে পারে না।
তাদের আয়-রোজগার বন্ধ থাকে, ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে
ভেসে যায়। ফলে তাদের দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না।
অতিবৃষ্টির ফলে নদীভাঙনে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন
হয়ে পড়ে। কৃষকের ফসলের জমি ভেসে যায়, খেতের
ফসল নষ্ট হয়। বানবাসী মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখলে
মনে হয়, বর্ষা এসব মানুষের জীবনে দুর্যোগ ও দুর্ভোগ
নিয়ে এসেছে। বর্ষায় বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপ
অন্যরকম হয়ে যায়। আকাশে ঘন কালো মেঘের
আনাগোনা চলতে থাকে সারাক্ষণ। কখনো-বা আকাশ
অন্ধকার করে বৃষ্টি নামে। দু’তিন দিন হয়তো সূর্যের
দেখাই মেলে না। কখনো কখনো শোনা যায় মেঘের
তুমুল গর্জন। একটানা বৃষ্টিতে কোথাও হঠাৎ বাজ পড়ার
শব্দে কেঁপে ওঠে ছেলে-বুড়ো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লিখেছেন-
‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’
ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বছর ঘুরে ঘুরে ঋতু
পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নানা বৈচিত্র্য ধরা দেয় এখানে।
গ্রামের গাছে গাছে কদমের ডালে চমৎকার কদম ফুল
ফুটে সবাইকে আকর্ষণ করে। শহরেও কোথাও কোথাও
কদমের গাছ চোখে পড়ে। দূর থেকে বেশ সুন্দর লাগে
পাতাসহ কদম ফুল। দেখতে অনেকটা টেনিস বলের
মতো হয়। আর এই কদম ফুলে রয়েছে তিনটি স্তর।
ছোট ছোট দলগুলো থাকে দু’টি স্তরে। এগুলো উপড়ে
ফেললে শেষ স্তরে মেলে একটি টেবিল টেনিস বা পিংপং
বলের চেয়ে সামান্য ছোট আকৃতির একটি বল। বাহারি
কদম ফুল শিশুদের খুবই আকর্ষণ করে। কদম গাছ বেশ
উঁচু ও আকারে বড়সড় হয়। কদম ফুলের হাওয়া খুবই
স্বাস্থ্যকর। আর তাই গ্রামে বসতবাড়ির আঙিনায় চোখে
পড়ে অজস্র কদম গাছ। এই কদম ফুলের হালকা মিষ্টি
ঘ্রাণ আছে। বর্ষার দূত কদম ফুল নিয়ে আমাদের
সাহিত্যে এর বন্দনা নানাভাবে চোখে পড়ে। কেবলশুধকদম ফুলই নয়, কেয়াও বর্ষার আগমনে প্রাণ ফিরে পায়।
কেয়া ঝোপ বৃষ্টির পানি পেয়ে বেড়ে ওঠে। আর এক
সময় ফুলে সুশোভিত হয়।
বর্ষা ঋতু আসার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে বৃক্ষরোপণের ধুম
পড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় বৃক্ষমেলা।
এই সময় বৃক্ষরোপণের অবশ্য কারণ আছে। গাছের চারা
সব সময়েই রোপণ করা যায়। তবে বর্ষাকালে আবহাওয়া
বৃষ্টিস্নাত থাকে বলে চারা লাগালে সহজে মরে না। অন্য
সময় চারা লাগালে নিয়মমতো পানি দিতে হয়- বর্ষায়
এর তেমন প্রয়োজন হয় না। বৃষ্টি সেই অভাব পূরণ করে
দেয়। আর প্রাকৃতিক নিয়মে এ সময় গাছগুলো
লকলকিয়ে বেড়েও ওঠে তাড়াতাড়ি। আমাদের সবারই
উচিত এই বর্ষা মৌসুমে গাছ লাগানো। এতে করে গাছে
গাছে সবুজ হয়ে উঠবে আমাদের প্রিয় প্রকৃতি। আমরা
পাব আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন।
এই গাছ যে অক্সিজেনের বার্তাবাহক তা আমরা সকলেই
জানি। বর্ষায় পল্লীর মাঠ-ঘাট বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ হয়ে
যায়। নদীর দুকূল ছাপিয়ে বর্ষার পানি গ্রামে ঢুকে পড়ে।
রাস্তাঘাট কাদায় ভরে যায়। নৌকা ছাড়া অনেক জায়গায়
চলাফেরা করা যায় না। তখন গ্রামগুলোকে মনে হয় নদীর
বুকে জেগেওঠা এক একটা দ্বীপ। তাই বর্ষায়
গ্রাম-বাংলার দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব।
এই ঋতুতে আমাদের দেশে কেয়া, কামিনী, কদম, জুঁই,
টগর, বেলি, চাঁপা প্রভৃতি ফুলের সুগন্ধে চারপাশ সুরভিত
হয়ে ওঠে। বর্ষায় আমনসহ বিভিন্ন ধরনের ধানের আবাদ
হয়। এ সময় মাঠে সবুজ পাট গাছগুলো বড় হয়ে ওঠে।
বর্ষার পানিতে পাট চাষ ভালো হয়। আমাদের দেশের
বিভিন্ন এলাকায় ভালো পাট জন্মে। সেগুলো বর্ষা শেষে
কেটে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে নিয়ে শুকাতে হয়।
ধান-পাট ছাড়া বর্ষা ঋতুতে নিচু জমিতে তেমন অন্য
কোনো ফসলের আবাদ করা যায় না। ফলে অনেক জমি
খালিই পড়ে থাকে। সে সকল জমিতে এ সময়
সকাল-সন্ধ্যায় মাঠ আলো করে শাপলা ফোটে। এছাড়া
বিল, দিঘি, পুকুরেও শাপলার বাহারি পরশ পাই আমরা।
শেষবর্ষায় আমরা এই চিত্রগুলো দেখতে পাই। তখন
শরৎকাল আসি আসি করছে।
পেয়ারা, কলা, চালকুমড়া, ঝিঙা, করলা, ঢেঁড়শ, বরবটি
ইত্যাদি ফল ও তরকারি বর্ষারই অবদান। বর্ষাকালে প্রচুর
মাছ পাওয়া যায়। খালে-বিলে-ডোবায় নানা জাতের মাছে
খলবল করে ওঠে। বৃষ্টি এবং বর্ষা আমাদের প্রকৃতিকে
ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে যায়। জমিতে পলি জমে।
এতে করে জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়। নতুন করে
আবাদ করা ফসল খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। বর্ষাকালে বৃষ্টি
হবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতির নিয়ম। মৌসুমি বায়ুর
প্রভাবে জ্যৈষ্ঠের গুমোট গরমের ভাবটা কেটে গিয়ে
প্রশান্তির একটা হাওয়া বয়ে যায়। এরপর শুরু হয় বৃষ্টি।
আষাঢ় আর শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ বাংলার পরিবেশকে
করে তোলে আরো প্রাণবন্ত, আরো মোহনীয়।

Share.

মন্তব্য করুন