এক.
করমচা গাছটাতে সকাল বেলায় একটা পাখি দেখতে পেয়ে মনটা ভরে যায় তাহমিনার। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ছোট্ট পাখিটার ছটফটানি দেখে চিনতে পারলো এটা একটা টুনটুনি। করমচা গাছ দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। ছোট ছোট পাতা। কোনটা গাঢ় সবুজ কোনটা হালকা সবুজ। মৌসুম এলে থোকায় থোকায় যখন করমচা ধরে থাকে তখন আরো সুন্দর লাগে। সুন্দর লাগে করমচার রঙ, কোন কোনটা সবুজ, কোন কোনটা হালকা গোলাপি বা লালচে আভাযুক্ত। সেই করমচা গাছে টুনটুনি টাখি আরো সুন্দর লাগছে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তাহমিনা। হঠাৎ ফুড়–ত করে পাখিটা উড়ে গেল। করমচা গাছ থেকে পুঁইয়ের মাচায়- তারপর আমগাছটায় আর এর পর উধাও।
ছোট ভাই তারেককে দেখাতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু ওটা ঘুম কাতুরে, এখনো নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। আম্মু বকা না দেয়া পর্যন্ত সে উঠবে না। উঠবেই বা কেন? গ-গোলে গ-গোলে বছর পার হতে চললো। স্কুল বলো সকালের আরবি ক্লাস বা মক্তব বলো সবই বন্ধ। রোহিঙ্গা মুসলমানদের কোন অধিকার থাকতে নেই। লেখাপড়া তো পরের কথা। অথচ আরাকানের কি সুন্দর পরিবেশই না ছিল। আর মংডু ছিল শান্তিপূর্ণ এলাকা। মংডুর ঠিক দক্ষিণে পাশে ফকির পাড়া গ্রাম। এই গ্রামে বা আশপাশের গ্রামে অশান্তির কোন কিছু ছিল না। রোহিঙ্গা মুসলিম বলো রাখাইন বলো সবাইতো মিলে মিশে ছিল। মংডুতে আগে থেকেই মুসলমানের সংখ্যা। কিন্তু তাতে তো কোন অশান্তি সৃষ্টি হয়নি কখনো। কিন্তু বর্মী সেনারা হানা দেয়ার পর সেই আনন্দ মাটি হয়ে গেছে- সব তছনছ হয়ে গেছে। তাহমিনা ভোরের আলোতে ফুল পাখি গাছপালা দেখছে বটে তার মনে আগের মতো আনন্দ নেই। একটা ভয় বাসা বেঁধেছে। মা নুরুন নাহারের মুখের দিকে তাকানো যায় না। সব সময় একটা অজানা আতঙ্কের ছাপ চোখে মুখে। নীরবে সংসারের কাজকর্ম করছে, শাক তুলছে, শুঁটকি রোদে দিচ্ছে, রাঁধছে বাড়ছে- কিন্তু আগের সেই আনন্দ আর নেই। তাহমিনার বাবা এমারত আলীর চোখে মুখেও আতঙ্ক। সেই আতঙ্কের সাথে ক্রোধ মিশে হয়েছে একটা নতুন চেহারা। এমারতের বাবা নেজারত আলীর বয়স হয়েছে। শরীরে আগের মতো জোর আর নেই। এখন ধর্মকর্ম নিয়েই বেশির ভাগ সময় কাটে তার। দক্ষিণের আকিয়াব আর অন্যান্য মুসলিম এলাকার দুঃসংবাদ শুনতে শুনতে মনটা পাথর হয়ে যাচ্ছে। তবে চোখ দুটো এখনো জ্বলে ইট ভাটার মতো। দাদা পরদাদার আমল থেকে তারা এই ভূখ-ের মানুষ। এখন বৌদ্ধ হার্মাদ আর বর্মী সেনা বলো শাসক বলো সবাই বলে তারা নাকি এখানকার কেউ নয়। এসব শুনতে শুনতে আর লড়াই করতে করতে তারা বড় হয়েছে। আগে রাখাইনদের সাথে তাদের যে সদ্ভাবটি ছিল তা এখন আর নেই। এই তো সে দিনও পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে উৎসব করেছে। রাখাইন পর্বই হোক আর মুসলিম পর্বই হোক আনন্দের কোন কমতি ছিল না। কি থেকে কি হয়ে গেল। বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে নেজারত আলীর।
: তারেকের মা, তারেকের মা তোমার শাশুড়িকে নাস্তা দিয়েছ? তাহমিনা কোথায় গেল? নেজারত আলীর কথা শেষ হতে না হতেই ঘরে ঢোকে তাহমিনা- এক হাতে তার কয়েকটি ফুল আর অন্য হাতে পুঁইয়ের ডগা আর ক্ষেত-বাগান থেকে তোলা আনাজপাতি।
: হ্যাঁ, আব্বা, আম্মাকে নাস্তা দিয়েছি। আপনাকে দেব এখন? না আগে চা খাবেন? রান্নাঘর থেকে জবাব দেয় তারেকের মা নুরুন নাহার।
: না না, চায়ের আর দরকার নেই। আগে নাস্তা দাও। তার পর ওষুধ খেয়ে চা খাবো।
বুড়ো নেজারত মাঝে মাঝে সকাল বেলাই চা চেয়ে বসেন। এটা তার বৌমা নাহারের ভাল করেই জানা। সে চা জ্বাল দিয়ে প্রস্তুতও থাকে। তবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত শাশুড়িকে আগে সামাল দিয়ে বাকি কাজ করতে হয়। তাহেরা বিবি দু’বছর হলো শয্যাশায়ী। ডাক্তার বলে দিয়েছেন এ রোগ আর সারবার নয়। তার সেবা যত্নের ভার পুরোটা নিয়ে নিয়েছে পুত্রবধূ নাহার। এ যুগে এমন বউ পাওয়া ভার। তাহমিনাও সাহায্য করে বটে। ছোট্ট একটা মেয়ে কতটুকুই আর করবে? তবু এটুকুতেই মায়ের বেশ সহযোগিতা হয়।
: তাহমনিাটা কোথায় গেল। মিনা, মিনা। খুঁজে খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত নাহার। ও দিকে তারেক এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। মেয়ের হাতে পুঁই শাক আর আনাজপাতি দেখে রাগ খানিকটা কমলো মায়ের।
: কোথায় তুই? বিহান বেলা থেকে খুঁজছি। যাক ভালোই করেছিস। পুঁই শাকের চচ্চড়ি করতে পারবো। এবার হাসি ফোটে মা মেয়ের মুখে। দশ বছর বয়স তাহমিনার। তারেকের সাত। নাহার ও এমারত আলীর এ দুটোই সন্তান। এমারতের বড় ভাই তেজারতের আলাদা সংসার। তবে সে এখানে থাকে না। ফকির পাড়ার পরের গ্রাম গাংপাড়াতে শ্বশুরবাড়িতে থাকে। ঠিক ঘর জামাই নয়। নিজের টাকাতেই একখানা ঘর তুলে নিয়েছে। আলাদা সংসার। গাংপাড়ায় তার ব্যবসাপাতি আর মাছ ধরার কারবার। ওখানেই থাকলে সুবিধা। তাই এই ব্যবস্থা।
তেজারতের একটাই মেয়ে- রেহানা। তাকে আরেক গ্রামে বিয়ে দিয়েছে। স্বামী সংসার নিয়ে সে ওখানে আছে। নেজারত আলীর মংডুতে রয়েছে একটি মাঝারি মুদি দোকান। নেজারত আর তার ছেলে এমারত দুজনে মিলে দেখাশোনা করে। নেজারত বেশি সময় বসতে পারে না, এমারতই বসে। সব তো ভালই চলছিল- দক্ষিণের দিক থেকে যত খারাপ খবর আসা শুরু হয়েছে। এখন বাপ বেটা কারো মনেই শান্তি নেই।

দুই.
এমারত আর তার এক সঙ্গী দ্রুত পা চালিয়ে চলেছে। কুতুবখালির দিক থেকে খারাপ খবর এসেছে। এমারতের ছোটবোন রেহানার স্বামীকে নাকি ধরে নিয়ে গেছে বৌদ্ধ নেতারা। রেহানা তার দুই সন্তান কোন মতে পালিয়ে এসেছে। নাফ নদীর তীরের এই গ্রামটা পুরো ছারখার হয়ে গেছে। এত দিন যারা পড়শি ছিল, আপনজনের ভান করতো সেই রাখাইন আর বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা চোখ উল্টে এখন সাক্ষাৎ হার্মাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আহা কত পরম আদরেই না মুসলমানরা তাদের বাড়িঘরে ডেকে দুই ঈদে খানাদানার আয়োজন করতো! যারা এক সময়ে ভ্রাতৃত্বের হাত বের করতো এখন বের করে ভোজালি আর তরবারি সমেত হাত। মানুষ মারতে তাদের হাত কাঁপে না। এক সময়ের পড়শিদের ঘরে আগুন দিতে লুটপাট করতে তাদের বাধে না। যাদের বোন ভাবী আর মা চাচি বলে ডাকতো তাদের ইজ্জত আব্রু ছিনিয়ে নিতে বুক কাঁপে না। ছি ছি ছি। এর নাম মানুষ! এরা তো জানোয়ারের অধম।

তিন.
গাংপাড়া আর যেতে হলো না। মধ্য পাড়াতেই এমারতের দেখা হয়ে গেল একটা রাখাইন গ্রুপের সাথে।
: আরে ইয়ার, খিন মিউ, কোথায় চলেছ? প্রথমে প্রশ্ন করে উ তিন।
: না তেমন কোথাও না, কাছাকাছিই। উত্তর দেয় খিন মিউ মানে এমারত। এমারতের বর্মী নাম খিন মিউ। বর্মী সমাজে তারা এই নামেই পরিচিত। আরাকানে প্রত্যেক মুসলমানের আছে বর্মী নাম। স্কুলেও এ নামই চলে।
উ তিন এমারতের স্কুলজীবনের বন্ধু। এমারতের বেশি পড়া হয় নি, আর মুসলমানদের সেই সুযোগও নেই। উ তিন পড়াশোনা করে স্থানীয় নেতা হয়েছে।
: একটা কথা বলবো? জানতে চায় এমারত।
: বলো ইয়ার।
: আমার বোন জামাই নাখুম মিনকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে কোথায়? জানো কিছু?
নাখুম মিন মানে রেহানার স্বামী আলী আকবর।
: আমি কি করে জানবো দোস্ত?
: কেউ সৈন্যদের হাতে তুলে দেয় নি তো !
: দেখো ইয়ার, তুমি আর আমি দোস্ত বটে, এখানে বহু বর্মী নেতা সক্রিয়। কে কোথায় কি করে আমি কি করে জানবো? তো কবে থেকে নিখোঁজ নাখুম? কপট অভিনয় করে উ তিন। এমারতের স্পষ্ট ধারণা উ তিন সব জানে কিন্তু ধরা দিতে চায় না। আসলে সে গভীর পানির মাছ।
: কয়েক দিন হলো। বলে থামে এমারত।
উ তিন আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের চাহনি আর কথাবার্তা এমনিতেই ভাল ঠেকেনি এমারতের। আর কথা না বাড়িয়ে সটকে পড়ে এমারত আর তার দুই সঙ্গী।

চার.
পরদিন গাংপাড়ে আলী আকবর মানে নাখুমসহ বার জনের লাশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে চারটি শিশু। কাদের মাসুম বাচ্চা কে জানে? নাফ নদীতে লাশগুলো ভাসছিল। খবর পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আসে আত্মীয় স্বজন। এমারতের চোখে পানি নেই। কি অপরাধ করেছিল ওরা? তার বোন জামাই?
২০১৭ সাল। আগস্টের শেষে দক্ষিণাঞ্চলে কি যেন ঘটনা ঘটেছে। কেউ ভাল করে জানেও না বলতেও পারে না। মংডু টাউনশিপের লোকেরা এর জন্য দায়ীও নয়। তার জন্য এই সাধারণ লোকগুলো প্রাণ দিলো? ওরা তো কোন দোষ করে নি। এইভাবে নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হলো তারা? ফুটফুটে শিশুগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না। আহা ওদের বাবা মায়েরা হয়তো জানেও না।
কান্নার বদলে এমারতের চোখে ক্রোধের আগুন। তার ছেলে তারেক মেয়ে তাহমিনা বোন রেহানা ও তার বাচ্চারা কেঁদেই চলেছে। কেঁদে কী হবে?

পাঁচ.
সেই উসিলায় পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আরাকানে এসে সব তছনছ করে চলেছে বর্মী সেনা বাহিনী। সঙ্গে আছে বর্ডার গার্ড বিজিপি লুন্টেনসহ সকল নিরাপত্তা বাহিনী। না, আরো একদল আছে রাম দা আগ্নেয়াস্ত্র মশাল কিরিচ ইত্যাদি নিয়ে, মহান গৌতম বুদ্ধের অহিংসা পরম ধর্ম বাণী বহনকারী বৌদ্ধ নেতারা। তাদের এখন একটাই কাজ। রোহিঙ্গা ছেলেদের হত্যা, মেয়েদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা আর ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভয়ানক রক্ত খেলায় মেতে থাকা। এদেরও পরিণতি করুণ মৃত্যু।
আকিয়াব বুচিডং ছারখার করে দিয়ে বর্মী বাহিনী বীর দর্পে এগিয়ে চলেছে মংডুর দিকে। যারা মরেছে তো মরেছেই- আর যারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে যেতে পেরেছে তারা কোন মতে বেঁচে বর্তে আছে। ওপারের দেশ মানে বাংলাদেশ। কেউ কেউ ভেলায় বা নৌযানে করে থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার দিকে পাড়ি জমায় বটে, তবে অধিকাংশেরই করুণ মৃত্যু ঘটে পথিমধ্যে। নাফ নদীর ওপারে যেখানে আশ্রয় মিলে তার নাম টেকনাফ, কুতুপালং, শাহপরীর দ্বীপ।

ছয়.
বৌদ্ধ নেতাদের মধ্যে ইয়াং খিউ বেশ নাম করেছে। রোহিঙ্গা মারতে তার হাত কাঁপে না। কোন অনুশোচনা হয় না। তলোয়ার হোক কিংবা কিরিচ ভোজালি- এক কোপেই গর্দান নামিয়ে দেয়ার কৌশল সে রপ্ত করেছে। সকল বর্মী বাহিনীর সাথে তার খাতির। বর্মী মেজর উ মিন বান্ট তাকে খুবই তোয়াজ করেন। কারণ ইয়াং খিউ থাকাতে বর্মী সেনাদের বেশি মানুষ মারতে হচ্ছে না। তাদের হাতে তেমন রক্তের দাগ নেই। জাতিসংঘ যতই চেঁচাক তারা তো বলতে পারছে তাদের হাতে কোন রক্তের দাগ নেই। তারা তোন কোন রোহিঙ্গা মারছে না। তারা ধোয়া তুলসি পাতা। তাদের সর্বময় কর্তা জেনারেল সাহেব সাক্ষাৎ একজন দেবদূত। দেশের নেত্রী শান্তির বার্তাবাহক অং সান সু চি গৌতম বুদ্ধের আশীর্বাদ ধন্য একজন কীর্তিময়ী নারী, যিনি নোবেল জয় করেছেন।
: দেখেছ কর্নেল ঝাউ জিউ, আজকের আকাশটা কত উদার কত পবিত্র। কত সুন্দর। বললেন মেজর উ মিন বান্ট।
: ইয়েস স্যার। হবে না, আজ আমরা একটা অধ্যায়ের ইতি টানতে যাচ্ছি। মংডু রি-ক্যাপচারের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের আরাধ্য কাজ শেষ করতে যাচ্ছি। এখন সমগ্র মিয়ানমার দ্যাট ব্লাডি রোহিঙ্গা মিনস বাঙালি মুক্ত। মিয়ানমার আমাদের, সমগ্র রাখাইন আমাদের, কোন বাঙালি বসতি আর এখানে নেই। থাকবে না।
: গুড, ভেরি গুড। এই তো একজন বাঘা আর্মি অফিসারের মতো কথা। আমরা তো এমনটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা কথা। ওপার থেকে কোন রাখাইন এক্সোডাস হবে না এটা ভাবা কি ঠিক হবে? জানতে চাইলেন কর্নেল।
: ওপার থেকে আর্মি এটাক বা কাউন্টার এক্সোডাস হবে না ধরে নিতে পারেন স্যার। আমরা চীন আর ভারতকে পাশে পেয়েছি। অতোটা সাহস ওরা দেখাবে না, দেখালে এত দিনে আমরা টের পেতাম।
: তুমি ঠিক বলছো কর্নেল? সন্দেহ ঝরে পড়ে মেজর উ বান্টের কথায়।
: আর্মি এটাক হবে না ধরে নিন। আমরা ডার্টি পিপলকে তাড়াতে পেরেছি এটাই আমাদের সাফল্য।
: ওকে অফিসার, উই ক্যান নাও ডু মোর দ্যান উ্ই থিংক এবাউট।

সাত.
আর্মি বিজিপি লুন্টেন বাহিনী আর বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা রাতের আঁধারে একযোগে হানা দিয়েছে মংডুর জনপদে। মুসলমানদের বাড়িঘর, দোকানপাট সব জ্বলছে। আশপাশের গ্রামগুলোও রক্ষা পায়নি। জ্বলছে ফকিরা বাজার, মাস্টার পাড়া, গাংপাড়া, ফকির পাড়া। ধরমড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠেন বৃদ্ধ নেজারত আলী। বলতে গেলে ঘুমাননি, চোখটা একটু ধরে এসেছিল। তাদের উত্তরের ঘরে কারা যেন আগুন দিয়েছে। সন্ধ্যা রাতেই খবর পেয়ে এসেছেন আজ রাতে মংডুর সব শেষ করে দেবে ওরা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীকে ফেলে, দাদার আমলের ভিটে ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি নেজারত আলীর। মওত যদি লেখা থাকে এখানেই স্বামী স্ত্রী এক সঙ্গে মরবেন।
ছেলে ছেলের বউ দুই নাতি ও নাতনি, মেয়ে রেহানা ও তার ছেলে মেয়েরা এতক্ষণে নৌকাঘাটে পৌঁছে নাফ নদীতে নৌকা ভাসিয়েছে।
: কে ওখানে? ফিসফিস শব্দ শুনে প্রশ্ন করেন নেজারত। পাশে শয্যায় শুয়ে তার স্ত্রী। নড়াচড়ার শক্তিহীন। তবে প্রাণটুকু এখনো আছে।
: শালা পালাস নি? তবে মর। আগুনে পুড়ে মর।
: কে কে? গলাটা চেনা মনে হচ্ছে!
: হ্যাঁ আমি। তোদের চেনাই বটে। তোর ছেলে কই? বউ কই?
: উ তিন! তুমি? তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারলে? আমার ঘরে আগুন দিলে? তোমাকে আমার ছেলের মতো আদর করতাম। সব ভুলে গেলে?
: ও সব বলে এখন আর লাভ নেই বুড়ো। আমরা এখন এ ঘরেও আগুন দেবো। হা হা হা।
এর পর কে যেন কেরোসিন দিয়ে সারা ঘর ভিজিয়ে একটা দেশলাইয়ে ঘষা দেয়। আর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। ভেতরে দুটি মানুষ পুড়ছে, পুড়ে ছাই হচ্ছে।

Share.

মন্তব্য করুন