ফজরের আজান শুনে আশরাফুলের ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে উঠে
কলপাড়ে গেলেন ওযু করার জন্য সাথে রহিমাকেও ডাক দিলেন।
আশরাফুলের স্ত্রী রহিমা। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিনজন। একটাই
সন্তান নাম আকাশ। রহিমা ঘুম থেকে উঠে আকাশকে ডাক দিলেন নামাজ
পড়ার জন্য। বাপ ছেলে মসজিদে চলে গেলেন আর রহিমা ঘরেই নামাজ
আদায় করলেন। নামাজ শেষ করে আশরাফুল আর তার ছেলে বাড়ি এলেন।
আশরাফুল দিনমজুরের কাজ করেন। বলতে গেলে দিন আনে দিন খায়।
রহিমা নামাজ শেষ করে আশরাফুলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলেন। পান্তা
আর কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে চলে গেলেন কাজের উদ্দেশে। আর আকাশ
চলে গেল স্কুলে।আকাশ পড়ালেখায় খুব ভালো। এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাবা
খুব কষ্ট করেই ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। বাবা মায়ের স্বপ্ন
ছেলে অনেক বড় ডাক্তার হবে। আমাদের মত গরিব মানুষকে
বিনা টাকায় চিকিৎসা করাবে। বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে
আকাশ খুব ভালো করেই পড়াশোনা করছে। স্কুলে যায়, স্কুল
থেকে এসে মাঠে চলে যায়। অন্যের জমিতে চাষ করতে।
সারাদিন কাজ করে ঘরে ফিরে। আবার কিছু খেয়ে পড়তে বসে।
এভাবেই দিন চলে যায়। আশরাফুল সারাদিন কাজ করে রাতে
ঘরে ফিরে। রহিমা খাবার দিলেন। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে
পড়লেন। আর আকাশ তখনও পড়ছে। বাবা মায়ের স্বপ্ন
যেভাবেই হোক আমি পূরণ করবো। পড়তে পড়তে কখন যে
ঘুমিয়ে গেছে আকাশ টেরই পায়নি।
পরের দিন আকাশ স্কুলে গেলে তার বন্ধুরা বলছে কিরে আকাশ
প্রত্যেকদিন ময়লা কাপড় পরে আসিস নতুন জামা পরে আসতে
পারিস না। আকাশ কিছু না বলে ক্লাসে চলে গেল। মনে মনে
ভাবছে আমিওতো কিছু টাকা ইনকাম করছি কিন্তু যা পাই মায়ের
কাছে তো দিয়ে দেই। অভাবের সংসার। তাই মায়ের কাছে টাকা
চাইতেও পারি না। এভাবে চলতে লাগলো দিন। একদিন সকাল
বেলা আশরাফুল নামাজ পড়তে উঠলো। নামাজ শেষ করে বাড়ি
ফিরলো। কাজে যাবে এমন সময় মাথা চক্কর দিলো। পড়ে গেল
মাটিতে। রহিমা দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসলো। আকাশও সাথে
সাথে বাবাকে ধরলো। আকাশ তার বাবার শরীরে হাত দিতেই
দেখে জ¦রে গা পুড়ে যাচ্ছে। ঘরে এনে শুতে বললো রহিমা।
আকাশের ভীষণ মন খারাপ হলো। আজকে বাবা কাজে না গেলে
আমরা দিনটা পার করবো কিভাবে। কিভাবে চলবে। বাজার তো
করা হবে না। আর টাকা না পেলে চিকিৎসা করাবো কিভাবে!
নানান চিন্তা আকাশের। সে নিজেই চলে গেল বাবার কাজ করতে।
আশরাফুল এবং রহিমা দুজনই ছেলেকে বাধা দিলো, কিন্তু আকাশ
কোনো কথা না শুনেই চলে গেল। সারাদিন কাজকর্ম করে সন্ধ্যায়
বাড়ি ফিরলো আকাশ। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। ঘরে ঢুকেই
আগে বাবার কাছে গেল। দেখলো জ¦র মোটেই কমেনি। আকাশ
বাবার জন্য ওষুধ নিয়ে এলো। রোজা এসে গেছে। রোজা রেখেই
আকাশ কাজে চলে যেত। সংসারের হাল এখনই ধরা শুরু
করলো। লেখাপড়া আর হলো না। বাবা মায়ের স্বপ্নও পূরণ হলো
না। নানান চিন্তায় ঘুম হয় না আকাশের। রোজা চলে এলো।
আকাশ রোজা রেখে কাজ করে। খুব কষ্ট হয়ে যায়! তারপরও কী
করবে। বাবা তো অসুস্থ। এই শরীর নিয়ে কিভাবে কাজ করবে!
কিছুদিন পর আকাশের বাবা সুস্থ হয়ে গেলেন। ছেলেকে আর
কাজে পাঠান না। নিজেই কাজ করেন। সংসারের হাল আবার
ধরলেন। এবার ঈদে ছেলেকে একটা জামা কিনে দেয়ার চিন্তা
করছে। যদিও কোনো সময় আকাশকে কিছুই দেয়া হয়নি। এবার
অন্তত দিতেই হবে। আর ছেলে চিন্তা করছে বাবা মাকে কিছু কিনে
দিবে। অভাবের সংসার। ইচ্ছা থাকলেও উপায় থাকে না।
ঈদের আর কয়দিন বাকি। কাজের খুব চাপ আশরাফুলের। কিছুই
কেনা হলো না আশরাফুলের। এমনকি সেমাই, চিনি, দুধ কিছুই
না। কী করবে ভেবে কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। এক বুক হতাশা
নিয়ে বাড়ি ফিরলো। রহিমা দেখে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে
তোমার। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আশরাফুল কিছু না বলে হাত মুখ ধুয়ে নিলো।
ভাত খেতে বসেও কি যেন চিন্তা করছে। রহিমা
আবার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তোমার।
কোনো বিপদ হলো নাতো। আশরাফুল বললেন
না মানে ছেলেকে জামা কিনে দিতে চেয়েছিলাম
কিনতে পারলাম না। বাজার সদাই করতে
পারলাম না। কিভাবে কি করবো বুঝে উঠতে
পারছি না।
রহিমা একটু ভেবে বললেন এ আর নতুন কী।
প্রতিবারই তো এমনটি হয়ে থাকে। দু’জনই
দুশ্চিন্তার সাগরে ভাসছে। আর দুদিন পরেই ঈদ।
আশরাফুল সকালে বের হয়ে মাঠের দিকে গেল।
গাছতলায় বসে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না।
তারপর নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে দেখে বাড়ির
দিকে গেল। আশরাফুল আকাশকে ডাকাডাকি
করছে। আকাশ দৌড়ে বাবার কাছে এলো।
বললো কী হয়েছে বাবা ডাকছো কেন? গোসলটা
করে নাও চলো দুই বাপু একসাথে জোহরের
নামাজটা পড়ে আসি। আকাশ বললো ঠিক আছে
বাবা যাচ্ছি। আকাশ কলপাড়ে যেতেই দেখলো
একদল কিশোর-কিশোরী। আকাশ আবার বাবার
কাছে গেল, বাবা ও বাবা দেখ না একদল
ছেলে-মেয়ে আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে।
আশরাফুল বাইরে তাকিয়ে দেখে তাইতো ওরা
তো আমার বাড়ির দিকেই আসছে। আকাশ
সামনে যেতেই দেখে ওর স্কুলের বন্ধুরা এবং
স্কুলের স্যার ম্যাডামরাও আসছে।
আকাশকে দেখে ওর স্যার বললো, ঈদের ছুটি
শেষ হলেই তুমি স্কুলে যাবে। ফ্রিতে পড়াশোনা
করবে। কোনো টাকা লাগবে না। আকাশ এই
কথা শুনেই আনন্দে লাফালাফি করতে লাগলো।
স্যার আশরাফুলকে ডেকে বাজার সদাই, সেমাই,
চিনি, দুধ, চাল ইত্যাদি হাতে তুলে দিলো। আর
স্কুলের বন্ধুরা মিলে আকাশের জন্য একটা
পাঞ্জাবি, রহিমার জন্য শাড়ি, আশরাফুলের জন্য
একটা শার্ট নিয়ে এলো। আশরাফুল দেখেই হাউ
মাউ করে কেঁদে ফেললো। বললো স্যার
আকাশের জন্য আপনারা এতো কিছু করেছেন।
আপনাদের তো আমি কিছুই দিতে পারবো না।
এই কথা বলেই আশরাফুল স্যারকে জড়িয়ে ধরে
কাঁদলেন। স্যার তখন বললেন প্রতিবেশী বলেই
দিয়েছি। আর আমাদের সবার উচিত যারা
নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া দিনমজুর তাদের সবাইকে
সহযোগিতা করা। তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো।
আল্লাহপাক আমাদের সকলকে যেন তৌফিক
দান করেন। আমিন।

Share.

মন্তব্য করুন