১.
এখন খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি আমাদের তিনতলা বাসাটির সামনের দিকের বারান্দাটায় বসে আছি। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা বারান্দার খাঁচার ওপর পড়ে ছিটে পড়ছে আমার মুখে। আমাদের বাড়ির সামনে বড় বড় গাছ লাগানো আছে, এমন একটা বাগান আছে। কাঁঠাল, আতা, মেহগনি গাছ লাগানো। আগে বেল গাছও ছিল। প্রায়ই পাড়ার কিছু প্রাপ্তবয়স্ক ধর্মভীরু হিন্দু মহিলা পূজো দেয়ার জন্য সেই বেল গাছের বেল পাতা নিতে আসত। এখন নেই। তাই এখন তেমন কেউ আসে না, এ খোলা বাগানে। তবে প্রায়ই পথে তাদের দেখা মেলে। ছোট্ট জায়গা তো! বাগানটায় এখন প্রায় অনেকটুকু জায়গাই ফাঁকা। তাই আমরা এখানে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টিপু, আর যা যা ইচ্ছা হয় তাই খেলি। বাড়ির পেছন দিকেও আগে খেলা হতো। সেখানেও একটা ছোট করে ফাঁকা জায়গা আছে। এখন তাও হয় না। ছোট্ট শহরটা অনেক বাসাবাড়িতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তাই এমন দু-চারটে খেলার জায়গা খুবই কম। তবু আমাদের খেলার জায়গাটুকু এখনো আছে। তাই এই-ই আমাদের শৈশবের স্বর্গ!

রৌদ্রমাখা দুপুরে যখন কাজ থাকে না, বারান্দাটার কোণে রাখা উঁচু চেয়ারটায় বসে থাকি। বাগানের পরে রাস্তা, তাতে একটু পর পর মানুষ-গাড়ি যাচ্ছে। তার সামনে কিছু ছোট-ছোট বাড়ি। তারপরেই সেই ছোট্ট নদীটা। যেখানে কত পালিয়ে পালিয়ে গোসল করতে গেছি। লাফ মেরেছি দুঃসাহসী হয়ে ব্রিজ থেকে। কিন্তু আজ বুক কেঁপে ওঠে সেই কথা চিন্তা করলে। আজ হয়তো আর পারব না। সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি, তখন সবার আগে গিয়ে দাঁড়াই বারান্দাটিতে। সেই একই চিত্র। তবু যেন আমার কাছে জাহাজ থেকে সমুদ্র দেখার মতো কোনো স্থান, সেই বারান্দাটি। আর নিচের ছোট্ট খেলার বাগান হলো আমার পৃথ্বীস্বর্গ। আমার অনেক প্রিয় জায়গা।

২.
বসে আছি। বৃষ্টি এখনো হচ্ছেই। রান্নাঘর থেকে ফুফু কিছু জিজ্ঞেস করলেন। আমি বুঝলাম না। তিনি কয়েক টুকরো কাটা তরমুজ বাটিতে করে নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। ফুফু বললেন, ‘কাল তোর বাপ কিনে লিয়ে আসিছে। ধর খা। আমি দুডা খানু।’ ফুফু গ্রামে থাকতেন। এখন আমাদের সাথেই থাকেন। তাই গ্রামের ভাষা ছাড়তে পারেননি। আমি আচ্ছা বলে বাটিটা নিয়ে ধীরে ধীরে খেতে শুরু করলাম।

হঠাৎ একটা সাইকেল শাঁ করে চলে গেল রাস্তা দিয়ে। আর রাস্তার পানিগুলো ছিটকে পড়লো রাস্তার দু-দিকে। কিছুক্ষণ পর আবার উল্টো দিক থেকে এলো সাইকেলটি। কিছুক্ষণ পর আবার। বৃষ্টি অনবরত দেড় ঘণ্টা যাবৎ মুষলধারায় হয়েই চলেছে। এর মধ্যে সেই সাইকেলটি আমি অন্তত পাঁচবার দেখলাম যেতে-আসতে। রাস্তায় আর কেউ নেই। খুব বৃষ্টি হচ্ছে তো। একটু পর রিদমি এসে বলল, ‘তানভীর ভাইয়া, ছাদে গোসল করতে যাবা?’ রিদমিরা আমাদের বাসায় ভাড়া থাকে। প্রায় আমারই বয়সের। তবে আমার থেকে ছোট। তিন ক্লাস নিচে পড়ে।
আমি একগাল হেসে বললাম, ‘চলো! আগে সাজিদকে ডেকে নিয়ে আসো।’ সাজিদ আমার খালাতো ভাই। পাশেই থাকে। সেও আমার থেকে ছোট ক্লাসে পড়ে, তবে প্রায় সমবয়সী। ও কথা বলতে পারে না। তবে পড়াশোনায় খুব ভালো। আমাদের ইস্কুল জেলার শ্রেষ্ঠ স্কুল। অনেক পুরনো। সে আমাদের ইস্কুলেই পড়ে। আমরা তিনজন ছোট বড় হলেও এক সাথেই ঘুরি-ফিরি-চলি।

রিদমি সাজিদকে ডাকতে চলে গেল। আমি সেই ভাবেই বসে আছি। তরমুজটুকু খাওয়া কিছুক্ষণ আগেই শেষ। বাটিটা রেখে দিয়েছি বারান্দার দরজার পাশের পড়ার টেবিলটার ওপরে। বৃষ্টিও অনবরত গর্জন-তর্জন করে চলেছে।
তিনতলার সদর দরজা খোলার আওয়াজ এলো। সেই থেকে শুনতে পেলাম সাজিদ আর রিদমির আনন্দে ভরা কণ্ঠস্বর। দেখলাম ওরা গামছা হাতে নিয়ে, সাদা গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে চলে এসেছে বৃষ্টিতে ভিজতে। আমিও হাফপ্যান্ট পরেই ছিলাম। গায়ের জামাটা খুলে সাধারণ একটা সাদা জামা পরে ওদের সাথে চললাম। আর ওদের জানালাম, বৃষ্টিতে ভিজে নদীর পাড়ে গিয়ে গোসল করে একবারে আসব।

৩.
যেই না কোণের ঘরটা থেকে বেরোবো, এমন সময় রাস্তা দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে পাড়ার চার-পাঁচ জন খেলার সঙ্গী-সাথী এলো আমাদের সেই ছোট্ট বাগানটিতে। এসেই হাঁক দিতে লাগল। আমিও ততক্ষণে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়েছি। ওরা এসে কিছু বলার আগেই আমি উত্তেজনায় বলে দিলাম, ‘থাম! থাম! আমরাও আসছি।’ জবাবে ওরা বলল, ‘আয়! আয়! তাড়াতাড়ি আয়!’ ওদের হাতে ফুটবল দেখলাম।

নিচে যেতেই ওরা বলল, ‘মসজিদের মাঠে ফুটবল খেলব চল। আরো অনেকে আছে। ওরা চলে গেছে। তোক ডাকতে এলাম।’
‘ভালো করেছিস। আমরা ভাবছিলাম ছাদে গিয়ে ভিজব।’
কথা বলতে বলতে দৌড় দিয়ে সবাই মাঠে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সত্যি অনেকে এসেছে আজ। যারা কোনো দিন এমনি খেলতেও আসে না, তারাও এমন দু-এক জন এসেছে। আসার সময় পাশের বাসার পলককে ডাকলাম। কিন্তু ও এলো না। বলল যে বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি ওর জ্বর হয়। আমার তা মনে হয় না। একবার এক গুণীসভায় শুনেছিলাম যে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এই ধারণা নেহাতই মানুষের মাঝে ছড়িতে পড়েছে। পলক আসলে একটু ঘরকুনো। তাই এলো না। হয়তো বাবা-মার বকা খেত দেখে এলো না। তবে আমরা তার ভ্রুক্ষেপ করি না। বকা খেলে খাব, তবু যাব!

৪.
আমরা মাঠে যেতে যেতে টিম-মাঠ সব রেডি। মাঠ রেডি মানে কে কোন সাইড নিবে, কারা শুরু করবে এগুলো। তা ছাড়া ইট দিয়ে গোল পোস্ট বানানো হয়! সেসব কিছুই প্রস্তুত। এখন খেলা শুরু হওয়ার পালা। আমরা গিয়ে অর্ধেক ভাগ হয়ে ঢুকে পড়লাম দু-টিমে। খেলা শুরু হলো। বৃষ্টিতে তো মাঠ প্রায় ভিজে গেছে। পা মনে হচ্ছে ডুবেই যাবে। ফুটবলে শর্ট দিলে, পুকুরের ওপর লাঠি মারা হচ্ছে, এমন ভাবে পানি ছিটে পড়ছে। তার মধ্যে কাদা! সে এক অন্যরকম অবস্থা। ফুটবল তো নয়, যেন পানির মধ্যে কুস্তি খেলা হচ্ছে!

এইভাবেই খেলা হচ্ছে তো হচ্ছেই। যেন এ খেলার কোনো শেষ নেই। একদিক থেকে না হওয়াই ভালো। ইস্কুলে যেতে হবে না। পড়তে হবে না। সারাদিন খেলা আর বৃষ্টিতে ভেজা। খেলতে খেলতে দু-একটা করে গোল হওয়া শুরু হলো। প্রায় সমান সমান করেই খেলা এগোচ্ছে। মাঝে মাঝে নতুন নতুন করে দু-একজনের আবির্ভাব হচ্ছে। তারাও ঢুকে পড়ছে যে যার মতো। একসময় তো বৃষ্টির পানিতে মাঠে আধ-হাঁটু পানি হয়ে গেল। যেন আর দৌড়ানোই যাচ্ছে না। শুধু পড়ে যাচ্ছে সবাই। কেউ রেগে গেলে মারছে কাদা ছুঁড়ে।
এমনই একটা গুরুতর কান্ড ঘটালো ইমন। দেখতে অনেকটা দানবের মতো কিন্তু বোকা। ও একবার ধাক্কা মারল জয়কে। আগেও একবার মুগ্ধকে মেরেছিল কিন্তু তেমন জোরে নয়। এবার জয়কে এমনভাবে ধাক্কা মেরেছে যে, উল্টে পড়ে গিয়ে ও দু-একবার পানিই খেয়ে নিলো। আমরা আছি ইমনের বিপরীত দলে। আমরা তো রেগে গেলাম। সবাই মিলে করলাম কি, দানবটাকে কাদা ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। ওর তো যাচ্ছে তাই অবস্থা হলো। আমাদের সাথে সাথে ওর দলের ছেলেরাও ওকে কাদা ছুঁড়ে মারতে লাগল। যাকে বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ!

৫.
এইভাবে হাসি ঠাট্টা করতে করতে খেলা শেষ হলো। খেলা শেষ হলো আরেক বিবাদ দিয়ে। ইমনেরা করেছে সাত গোল আর আমরা ছয় গোল। কিন্তু আমরা আর কিছুতেই হার মানি না। সে নিয়ে আরেক দফা কাদা-যুদ্ধ হয়ে গেল। শেষে একেক জনের চেহারা এমন দাঁড়াল যে, কেউ দেখলে আমাদের আর চিনতেই পারত না। শেষে সবাই গলা ধরে যাওয়া হলো নদীর পাড়ে। আমাদের বড় মাঠটা আসলে নদীর পাশেই। সবাই গিয়ে ঢুমঢাম করে লাফ মারলাম নদীতে। তবে বেশি উঁচু থেকে নয়। বেশি উঁচু এখন ভয় লাগে। এখানে আরেক মজার ঘটনা। একেক করে সবাই যে যার ওপর লাফ মারছে। দানব ইমন লাফ মারল আমার ওপর। ওকে বেশি কাদা মেরেছি কিনা! সবাই তারপর ইমনের ওপর ঢুম ঢাম করে লাফ মারল। বেচারার দিনটাই বুঝি খারাপ গেল। তবে ওর তাতে মন খারাপ হয় না। আসলে আমরা যে এমনি!

এদিকে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। মাঝে মাঝে একটু জোরে করে হচ্ছে। তা ছাড়া এমনি সময় গুড়গুড় করেই পড়ছে। নদীতেও নানারকম খেলা হয়। যেমন পানিতে গাবল ফল ফেলে দিয়ে লাফালাফি করে যে পায় সে জিতে যায়। অনেক সময় পকেটে কেউ দু-একটা লুকিয়ে রাখে, আর নকল গাবল বের করে নিজেকে জয়ী বলে দাবি করে। আমিও করি না, তা কিন্তু না! তবে এ খেলা কেউ আজ খেলবে না। বল আছে তো! তাই সবাই ঠিক করল, ফুটবল দিয়ে লুফা-লুফি খেলা হবে। মাঝে একজনকে রাখা হলো। আর বাকি সবাই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এখন ঐ একজনকে আর বল দেয়া হবে না। আমরা তা ফিকে-ফিকি করব। আর ও চেষ্টা করবে বলটা নেয়ার। যার হাত থেকে নিতে পারবে, সে আবার বল অন্যদের কাছ থেকে নেয়ার চেষ্টা করবে। এভাবেই মজা করতে করতে আমরা গোসল শেষ করে, বাড়ির উদ্দেশে ফিরলাম। বাড়িতে এসেই তাড়াতাড়ি গোসলঘরে ঢুকে ঢুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।

৬.
আগে থেকেই জামা-কাপড় রেডি করা ছিল। যাতে এসেই তাড়াতাড়ি জামা পরে নেয়া যায়। এতে বাড়ির কেউ সন্দেহ করবে না তেমন। যদিও প্রায় বেশির ভাগ সময়ই ধরা পড়ে যাই। তবু ব্যর্থ চেষ্টা!

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরুলাম। বেরিয়ে ঘরে ঢুকেছি, এমন সময় ফুফু বলে উঠল, ‘কুন্টি গেছলু?’
: এই তো একটু ছাদে গেছিলাম।
: ছাদে তো আমিও গেছলাম। কুন্টি তুই তো ছিলু না।
: তাহলে হয় তো দেখতে পাওনি।
: আচ্ছা! তালে ছাদেত কাদা কোত থেকে অ্যালো?
: মানে?
: মানে গোসলখানাত যি জামাকাপড় পড়ে আছে, তাত্ কাদা লাগল কোত থেকে? ছাদেত তো কোনো কাদা নাই? হাসতে হাসতে বললেন তিনি। এখন আমিও হাসি, আর কী!

Share.

মন্তব্য করুন