এক
আমি তুরান আহমদ। আর সুমন আমার মামাতো ভাই। ও আমার থেকে এক বছরের ছোট। তবে দু’জনই একই ক্লাসে পড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে মামাবাড়ি পাঁচ কিলোমিটার পথ। সাইকেলে আমার যেতে সময় লাগে বারো থেকে পনেরো মিনিট। স্কুল যেদিন বন্ধ থাকে সেদিন আমি প্রায়ই ওদের বাড়িতে যাই। অথবা ও আমাদের বাড়িতে আসে। তারপর দু’জন মিলে বের হই বেড়াতে। তবে প্রত্যেক বারই নতুন কোন জায়গায়। এটা এখন আমাদের দু’জনের ছুটির দিনের রুটিন হয়ে গেছে।
গত শীতে বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়লে আজও শরীরের রোমরাজি দাঁড়িয়ে যায়। কি এক কারণে স্কুল তখন বন্ধ ছিল। বের হলাম আমরা দু’জন আমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখব বলে। একদিনে চক্কর দিয়ে নাকি শেষ করা যাবে না এতোবড় আমাদের এই গ্রামটা। যদিও আমি গ্রামের পুরোটা চিনি না। আর না চেনা অংশেই ছিল সেবারের ভ্রমণ।
সূর্য যখন ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম আমরা দু’জন। মেঠোপথ ধরে সাইকেলে করে ফিরছি।
হঠাৎ পেছন থেকে দুইটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে এলো কামড়াতে। প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়ে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দিলাম।
ও দুটোও যেন মরিয়া হয়ে ছুটে আসছে। সুমন পিছন থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে আরো জোরে চালাতে। ও পিছনে দুই পাশে পা দিয়ে বসেছে। পারলে ক্যারিয়ারের উপর উঠে দাঁড়ায় এমন অবস্থা ওর।
প্রাণপণে প্যাডেল ঘোরাচ্ছি। কিন্তু ধুলার কারণে মেঠোপথে জোরে চলছে না সাইকেল। ও দুটোও নাছোড় কুকুর। কিছুতেই পাছ ছাড়ছে না। আশপাশে কোন ঘরবাড়ি নেই।
দারুণ এক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কুকুর চায় কামড়াতে। আর আমরা চাই কামড়ের হাত থেকে বাঁচতে।
ওই দিকে সূর্য ডুবে গেছে।
রাস্তার পাশে ঘরবাড়ি দেখতেই সাইকেলের দুই ব্রেক একসাথে কষলাম। জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল সাইকেল। সুমন হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের ওপর পড়লো। কোন দেখাদেখি না করে পড়া থেকে উঠে ছুটলাম পাশের বাড়ির দিকে। সুমনও উঠে আমার সাথে দৌড় দিল। কোন বাছবিচার না করে ঠেলে উঠলাম ঐ বাড়ির বারান্দায়।
বাড়ির লোকজন কিছু বুঝতে না পেরে আমাদের দিকে ‘হাঁ’ তাকিয়ে থাকল।
কুকুর দুটোও আমাদের পাছ ছাড়েনি। ছুটে এসে বারান্দায় ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো। বারান্দা উঁচু হওয়ায় প্রথম যাত্রা রক্ষা পেলাম।
কোথ থেকে এগিয়ে এলেন বাড়ির কর্তা লাঠি হাতে। ভাগিয়ে দিলেন ও দুটোকে।
বারান্দায় বেদেপাটি (খেজুরের পাতার তৈরি পাটি) পাতা ছিল। দু’জনে তাতে বসে হাঁপাতে লাগলাম।
কর্তাব্যক্তি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়?’
বললাম, ‘এই গ্রামেই।’
‘তাতো বুঝলাম। কিন্তু কোন পাড়ায়?’
‘দক্ষিণ পাড়ায়।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার।
‘সেতো বেশ দূর। ’
‘হ্যাঁ, বাড়ি ফিরছিলাম। পথে ঐ কুকুর দুটো…।’
‘থাক থাক। আর বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি। তা তোমাদের বাপের নাম কী?’ জানতে চাইলেন তিনি।
আমি ছোট্ট করে বললাম, ‘তাজু মেম্বর আমার চাচা আর। সুমনকে দেখিয়ে ও আমার মামাতো ভাই।’ চাচা মেম্বর ছিলেন অনেক আগে। তবে তার সুনাম এখনো আছে।
কর্তাব্যক্তির এবার টনক নড়লো। শুরু করে দিলেন হাঁকডাক। বললেন, ‘আরে এরা আমাদের তাজু মেম্বরের ভাইপো। ওরে জলদি এদের জন্য নাস্তা-পানি নিয়ে আয়। তাজু মেম্বর আমার বন্ধু মানুষ।’
মধ্যবয়স্ক এক মহিলা এক গামলা মুড়ি আর খেজুরের পাটালি নিয়ে হাজির হলেন। বোঝা গেল ইনিই বাড়ির কর্ত্রী। বললেন, ‘খাও বাবারা। পেট পুরে খাও।’
লাজ-লজ্জা ঝেড়ে দু’জনে খেতে শুরু করলাম। এতক্ষণ যে পরিমাণ ক্যালোরি ক্ষয় হয়েছে তা পূরণ করতে শুরু করলাম।
গামলার অর্ধেক শেষ করে বললাম, ‘আর পারবো না। অনেক খেয়েছি। এবার যেতে হবে।’
‘আরে কিছুই তো খাওনি। মুড়ি তো সেই ভাবেই পড়ে রইল। আর একটু খাও। বাড়িতে ভাজা। কোনো ভেজাল নেই।’ বললেন কর্তাব্যক্তি।
‘না, আর পারবো না।’ বললাম আমি।
‘সময় পেলে আর একদিন এসে পেটপুরে খেয়ে যাব।’ এই প্রথম কথা বলল সুমন।
পেট যে পুরেনি তা কিন্তু নয়। আবার খেতেও ভালো লাগছে। কিন্তু সময় যে নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
‘ভাগ্যিস কুকুর দুটো তোমাদের তাড়া করেছিল। তা না হলে তোমাদের সাথে দেখাই হতো না। তা বাবারা সময় পেলে চলে আসবে। কোন লজ্জা নেই। মনে করবে নিজের বাড়ি।’ বললেন মহিলা। সরল গ্রাম্য মায়ের নির্ভেজাল আমন্ত্রণ।
আমার মুখে কোন কথা জোগালো না।
সুমন বলল, ‘নিশ্চয়। আবার যে কোনো একদিন চলে আসব।’
উঠানে নামতেই কর্তাব্যক্তি বললেন, ‘সন্ধ্যাতো হয়ে গেল। তা রাস্তা চিনে যেতে পারবে তো?’
আমি মনে মনে এ কথাটিই ভাবছিলাম। কুকুরের তাবড় খেয়ে দিক-বিদিক সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। বললাম, ‘একটু এগিয়ে দিলে ভালো হতো।’
অমনি কর্তা হাঁক ছাড়লেন, ‘এই ছরু হারিকেনটা ধরিয়ে নিয়ে আয়তো।’ অর্থাৎ এই পাড়ায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের থেকে বছর দুই বড় এক ছেলে হারিকেন ধরিয়ে নিয়ে এলো। কর্তা বললেন, ‘চল এদের একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। এরা তাজু মেম্বরের ভাইপো।’
ছেলেটা যেন নতুন উদ্যম পায়। আমাদের আগে আগে হারিকেন নিয়ে হাঁটতে থাকে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে যান তিনি। অবশেষে আমরা বাড়ি ফিরি।

এটাই ছিল গত শীতের কাহিনী। আজও স্কুল বন্ধ। আজ সুমন এসেছে আমাদের বাড়ি। আজ যাবো এক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে। সেটা হলো আমাদের শহরের একটু বাইরে অর্থাৎ যশোরের চাঁচড়ার রাজবাড়ী। শুনেছি একসময় নাকি অনেক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল এই রাজাদের। আমাদের বাড়ি থেকে চাঁচড়া রাজবাড়ী মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে। অথচ এখনও দেখা হয়নি।
এখন বাজে ৪টা। আজো দু’জন এক সাইকেলে চলেছি। সুমন চালাচ্ছে। আমি সামনে বসে আছি। সুমন পিছে নিয়ে ভালো চালাতে পারে না।
দু’জনে গল্প করতে করতে একসময় চাঁচড়া বাজারে চলে এলাম।
সুমন বাজারের কোলাহল পেরিয়ে একটু নির্জন মত জায়গায় সাইকেল থামিয়ে বলল, ‘এবার কোন দিকে যাবো।’
‘তাতো জানিনে। তবে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। ঐ লোকটার কাছে জিজ্ঞাসা করা যায়।’ একজন লোক আমাদের দিকে আসছে। পাশ দিয়ে যেতেই বললাম, ‘এই যে ভাইয়া শুনছেন?’ পরক্ষণে মনে হলো সম্মোধনটা ঠিক হয়নি।
লোকটা দাঁড়িয়ে চারিদিকে কান পেতে শুনলো। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কই কিছুই তো শুনতে পাচ্ছিনে।’
‘না… মানে, বলছিলাম কি রাজবাড়ীটা কোন দিকে।’ আমতা আমতা করে বললাম আমি।
‘তা দিয়ে তোমাদের কী?’ উল্টা জানতে চাইলো লোকটি।
পুরাতন রাজবাড়ীতো তাই একটু দেখতে এসেছিলাম।’ বলল সুমন।
‘বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরে যাও।’ অস্বাভাবিকভাবে বলল লোকটি।
‘কেন?’ বলে লোকটির মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম লোকটির চোখ জোড়া ভাটার আগুনের মত জ্বলছে। সেই অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে যেন আমাদের ভস্ম করতে চাইলেন। তারপর কি জানি কি মনে করে আর কোন কথা না বলে যেদিকে যাচ্ছিলেন সেদিকে চলে গেলেন।
‘আরে পাগল নাকি।’
‘একশত ভাগ পাগল। হ্যাঁ, সুমন আমিও তোর সাথে একমত।’ অবাক হয়ে বললাম আমি।
‘দুনিয়াশুদ্ধ সব পাগল। তুমি পাগল। আমি পাগল। জাবেদ পাগল মানে ঐ লোকটি পাগল। কে পাগল না বলতে পারবে? এক এক জন এক এক ধরনের পাগল।’
চকরির মত পাক খেয়ে পিছে এক লোককে দেখলাম। লোকটি মাঝ বয়সী। কথাগুলো তিনিই বললেন।
লোকটি আবার কথা বলে উঠলেন। বললেন, ‘কী ভয় পেলে নাকি?’
‘না… মানে।’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘আসলে কি জান?’ কোন উত্তরের সুযোগ না দিয়ে নিজেই উত্তর দিলেন, ‘জাবেদ পাগল না। ও খুব ভালো মানুষ।’
‘এই ধরনের ব্যক্তিরা যদি শিক্ষক হতেন তাহলে আমার মত ছাত্রদের খুব সুবিধা হতো। কেননা প্রশ্ন তিনিই করেছেন এবং উত্তরটা তিনিই দিয়েছেন। আমি যদি কোনো দিন শিক্ষামন্ত্রী হই তাহলে এ ধরনের মানুষকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবো যাতে ছাত্রদের কোন কষ্ট না হয়।’ এমন উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসতেই আমার খুব হাসি পেল। পাছে হেসে ফেললে লোকটা কি মনে করেন ভেবে জোর করে হাসি দমন করলাম। বললাম, ‘কিন্তু আমাদের সাথে পাগলের মত আচরণ করলেন কেন তিনি?’
‘কেন সেটা বলতে পারবো না। তবে ওকে সবাই একটু এড়িয়ে চলে।’ লোকটি একথা বলেই বুঝতে পারলেন এমন কথা বলা তার উচিত হয়নি।
সুমন তাড়াতাড়ি ওর কথার খেই ধরে বলল, ‘কেন? ও বাঘ-ভাল্লুক না চোর-ডাকাত।’
‘থাক ওসব কথা।’ ও প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলতে তিনি রাজি নন। অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘এখানে তোমরা মনে হয় নতুন? নিশ্চয় কারো বাড়ি খুঁজছো?’
‘ঠিক ধরেছেন।’ বলল সুমন।
‘তা কার বাড়ি।’
‘কারো বাড়ি বললে ভুল হবে। শুনেছি এখন সেখানে কোন মানুষ বাস করে না।’ বললাম আমি।
‘ও রাজবাড়ী।’
‘কি করে বুঝলেন?’ অবাক হয়ে জানতে চায় সুমন।
‘মামুলি ব্যাপার। এই অঞ্চলে রাজবাড়ী ছাড়া সব বাড়িতে মানুষ বাস করে। তা তোমরা সেখানে কি করবে?’ আগ্রহ ভরে জানতে চায় লোকটি।
‘পুরাতন বাড়িতো তাই দেখতে এসেছি। কেন কেউ কি আসে না?’ প্রশ্ন আমার।
‘নাহ! এখন আর তেমন কেউ আসে না। আগে অনেক লোকজন আসতো।’
‘এবার দয়া করে বলুন কোনদিকে সেই রাজবাড়ী।’ সুমনের যেন আর তর সইছে না।
‘এই রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে যাও। তারপর বামে একটা ইটের রাস্তা পাবে। ওটা ধরে গেলেই দেখতে পাবে। তবে হ্যাঁ।’ একটু দম নিলেন যেন লোকটা। তারপর বললেন, ‘বেলা থাকতে থাকতে বাড়ি চলে যেও। দিনকালতো ভালো না।’ বলে লোকটি জাবেদ যে পথে গেছেন সেই দিকে হাঁটা ধরলেন।
লোকটির শেষ কথায় স্পষ্ট হুমকি পেলাম। ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকলো। লোকটির দিকে দু’জন তাকিয়ে থাকলাম যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলেন।
চোখ ফিরিয়ে সুমন বলল, ‘একই পথে দুই স্বভাবের যাত্রী। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার। তা তুরান ভাই, চল এবার যাওয়া যাক।’
‘হ্যাঁ চল।’
সোজা রাস্তা ধরে কিছু দূর গেলাম। দেখতে পেলাম বামে ইটের রাস্তা। যার কথা লোকটি বলেছেন।
ইটের রাস্তা ধরে কিছু দূর গিয়ে রাস্তার বাম পাশে দেখতে পেলাম বিরাট দুর্গের মত চুন-সুড়কির গাঁথা এক ভাঙাচোরা বাড়ি। এটাই সেই রাজবাড়ী আমাদের বুঝতে আর অসুবিধা হলো না।
একটা ঝোপের মধ্যে সাইকেলটা লুকিয়ে রেখে চললাম বাড়ির ভেতরটা ভালোভাবে দেখতে।

দুই
প্রথমে আমরা বাড়িটার দক্ষিণ দিকে গেলাম। সেখানে তেমন কিছু নেই। ফাঁকা। পশ্চিম দিকে গেলাম। সেখানে ধ্বংসস্তূপ। ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে হাঁটছি। দু’জন এক জায়গায় এস থমকে দাঁড়ালাম। এখানে একটা কূপ। কূপের চারপাশের রেলিং এখনও অক্ষত আছে। রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে ঝুঁকে কূপের ভিতর তাকালাম। আনুমানিক পঁচিশ-ত্রিশ ফুট নিচে এখনও পানি আছে। পানি কাচের মত স্বচ্ছ। সুমনও আমার পাশে এসে পানি দেখছে। কূপটা কিন্তু অন্য কূপের মত নয়। কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক ঠেকছে। কিন্তু কি সেই অস্বাভাবিক সেটা ধরতে পারছিনে।
শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক জিনিসটা সুমনই ধরল।
ও বলল, ‘তুরান ভাই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস?’
‘কী?’ সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসা আমার।
‘কূপটা কিন্তু এখনও ব্যবহার করা হয়।’
‘কিন্তু এই বাড়িতে তো কোন জনমানবের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছিনে। তা ছাড়া আশপাশে কোন বসতিও নেই। আমার মনে হয় এই অঞ্চলে খাবার পানির সমস্যা আছে।’ বললাম আমি।
‘কোথায় যেন ঘাপলা আছে ঠিক ধরতে পারছিনে।’ বিজ্ঞের মতো বলল সুমন।
‘আর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিস?’ সুমনকে বললাম আমি।
ও উত্তর দিল, ‘কী ব্যাপার?’
‘কূপে নামার জন্য কিন্তু কোন রিং বা অন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। অথচ প্রত্যেকটা কূপ পরিষ্কার বা অন্য কাজের জন্য নামার ব্যবস্থা থাকে। তার মানে এরও ব্যবস্থা আছে তবে অন্য ভাবে। কিন্তু কী সেটা।’ ভালো করে খুঁজছিলাম কূপের ভিতর। হঠাৎ চোখ গেল কূপের মাঝামাঝি এক জায়গায়। আর একটু ভালো করে ঝুঁকে সুমনকে বললাম, ‘দেখ… দেখ। ওখানে একটা ভেন্টিলেটার বসানো দেখা যাচ্ছে।’
সুমন ভাল করে দেখে বলল, ‘হুম। তাই দেখছি। নিশ্চয় এটা একটা রহস্যময় কূপ।’
‘রহস্য! তুই কি বোঝাতে চাচ্ছিস? তুই কি গুপ্তধনের কথা ভাবছিস?’ জিজ্ঞাসা আমার।
‘থাকতেও তো পারে। রাজাদের ব্যাপার-স্যাপার। দেখতে পারলে ভাল হতো।’ বলল সুমন।
‘কিন্তু দেখবি কী করে। রিং বা অন্য কিছু তো নেই। তবে দড়ি হলে অবশ্য হতো। কিন্তু সেটাতো আর হচ্ছে না। চল অন্য দিকে যায়।’ বললাম আমি।
কি আর করা। কূপের পাশ থেকে সরে উত্তর দিকে গেলাম। সেখানে ঘাট বাঁধানো পুকুর।
পুকুরে পানি কানায় কানায় পূর্ণ। চারিদিকে লতাপাতা আর আগাছা বোঝাই। শুধু সিঁড়ির সামনে পরিষ্কার। ঘাটের সিঁড়িতে যেমন ছেদলা থাকার কথা ছিল তেমন নেই। মনে হয় এখানেও কে বা কারা নিয়মিত গোসল করাসহ যাতায়াত করে।
সিঁড়ির সর্বশেষ ধাপে যেয়ে বসে পানির দিকে তাকালাম। সুমন আমার বাম পাশে এসে বসল।
মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সাত-আট যুগ আগের স্মৃতি। এই পুকুরে নামাতো দূরে থাক এই সিঁড়িতে কোনো মুসলমান পা দিতে সাহস পায়নি। এই সিঁড়িতে বসে গল্প করতো রাজকুমারী আর তার সখীরা। সখীরা হয়তো গাইতো কোন বিরহ বা সুখকর গান। হয়তো রাজকুমারী ভাবতো কোন এক অচিন রাজকুমারের কথা। হয়তো বা এক সময় চোখে আনন্দ বা বেদনার অশ্রু দেখা দিত। আর আজ! হয়তো চোর ছেচড়া মনের সুখে এই ঘাটে বসে গোসল করে। অথবা সাপ, বেজি, শিয়াল, পানি খেতে আসে এই ঘাটে।
‘কিরে কল্পনায় কোন রাজকুমারীকে পাশে বসিয়ে গল্প শুরু করলি নাকি।’ পাশ থেকে বলে ওঠে সুমন।
আমার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায়। হেসে বলি, ‘নারে!’

আমরা প্রথম ঘরটায় ঢুকলাম। মেঝেয় অনেকগুলো গর্ত। চুন-সুড়কি খসে পড়েছে। এখনও মিহি কুয়াশার মত চুন-সুড়কি উড়ছে। ঘরে ঢুকতেই কতগুলো ইঁদুর হুটো-পাটা করে গর্তে ঢুকে পড়ল।
ঘরের দু’পাশে দু’টি জানালা। আর আমরা যে পাশ দিয়ে ঢুকেছি তার বিপরীত পাশে আর একটা দরজা। বিপরীত পাশের দরজা দিয়ে আর একটা ঘরে ঢুকলাম। এই ঘরের অবস্থা আগেরটার মত। দুটো জানালা আর দু’টা দরজা। দরজা-জানালায় কোনো পাল্লা নেই। হয়তো উই পোকায় খেয়েছে। না হয় কেউ খুলে নিয়ে গেছে।
কওয়া নেই বলা নেই হঠাৎ ঘরের মাঝে এসে হাত-পা নেড়ে হো.. হো করে হাসতে লাগলাম।
সুমন ভয় পেয়ে গেল। ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘কিরে রাজবাড়ীতে এসে তোকে রাজভূতে ধরল নাকি?’
হাসির মাঝে বললাম, ‘নারে নাহ! রাজভূতে ধরেনি।’
‘তাহলে হাসছিস কেন?’
‘রাজইতিহাস স্মরণ করে।’ বিজ্ঞের মতো বললাম আমি।
‘কি সেই ইতিহাস?’ আগ্রহ ভরে জানতে চাই সুমন।
‘এদের অত্যাচারের ইতিহাস।’
‘রাজা-বাদশারা অমন একটু আধটু অত্যাচারী হয়েই থাকে।’
‘এই রাজারা সরার ওপর অত্যাচার করেনি।,
‘তাহলে?,
‘তারা এক বিশেষ শ্রেণীর ওপর অত্যাচার-অবিচার করতো।’
তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, তাই। শুনবি নাকি?’
‘সংক্ষেপে বল।’ বলল সুমন।
‘তাহলে শোন।’ শুরু করলাম এই রাজাদের ইতিহাস। ‘১৯৪৭ সালের পরেও এই রাজবংশ এখানে রাজত্ব করেছে।’
‘এতে হাসার কী হলো?’ অবাক হয়ে বললও।
‘মূল কথাতো এখনও বলতে দিলিনে।’
‘হ্যাঁ বল।’
‘এরা ছিল হিন্দু রাজবংশ। এদের ছিল বহু শান-শওকত। প্রভাব-প্রতিপত্তি।’
‘তখনকার অধিকাংশ রাজবংশই হিন্দু ছিল। এতেও কিন্তু হাসার কিছু নেই।’ আমার কথাকে কেড়ে নিয়ে বলল ও।
‘কথাতো এখানেই শেষ নয়। শুরু তো করতে দিলিনে। আরে আরও আছে। শোন, এরা ছিল ভীষণ অত্যাচারী রাজা। বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি এদের অত্যাচার ছিল কল্পনাতীত।’
‘যেমন?’
‘যেমন ধর, এই রাজবাড়ীর সামনে দিয়ে কোন মুসলমান ছাতা মাথায় দিয়ে কিংবা জুতা পরে যেতে পারত না। ছাতা বন্ধ করতে হত, জুতা খুলে হাতে নিতে হতো। যে এগুলো মানতো না তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো। কোনো মুসলমান যদি তৃষ্ণার্ত হয়ে কোন হিন্দু বাড়িতে পানি খেতে চাইতো তাহলে তারা বারান্দায় বসে মুসলমানের হাতে পানি ঢেলে দিত। হিন্দুদের কোন কলস যদি কোন মুসলমান স্পর্শ করতো তাহলে ঐ কলস ভেঙে ফেলা হতো। তাছাড়া হিন্দুদের কোন কিছু স্পর্শ করাই ছিল মুসলমানদের জন্য হারাম।’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে সুমন বলল, ‘এটা তাদের ধর্মীয় ব্যাপার।’
‘যে ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়। আর যা-ই হোক সেটা ধর্ম হতে পারে না।’
‘সত্যিই, বিষয়টা জটিল।’ গম্ভীর স্বরে বলল সুমন।
‘এর মধ্যে কোন জটিলতা নেই। মানব কল্যাণেই ধর্ম। মানুষ যখন নিজেকে অনেক বড়, শক্তিশালী মনে করে তখন সে অপরের ওপর অত্যাচার করে। যুগে যুগে এটাই হয়ে এসেছে। আর এসব অত্যাচারী রাজা কখনও চিরস্থায়ী হয়নি। ভবিষ্যতে হবেও না। থাক ওসব কথা। যা বলছিলাম, এই রাজদরবারে মুসলমানরা পেত না ন্যায়বিচার। সর্বত্রই মুসলমানরা ছিল তখন অত্যাচারে জর্জরিত। কিন্তু আজ কোথায় সেই অত্যাচার। কোথায় সেই রাজত্ব, ধন-দৌলত। কোথায় গেল আজ সেই সব। এই বাড়ির সামনে দিয়ে মুসলমানরা যেতে ভয় পেত। আর আজ এখানে বাস করছে শিয়াল, বেজি, ইঁদুর, তেলাপোকা, সাপ, বাদুড় আরো কত কী? হায়রে ক্ষণিকের রাজত্ব।’
আমার কথা গোগ্রাসে গিলছিল এতক্ষণ সুমন। এবার বলল, ‘সামনের ঘরে চল।’
ঢুকলাম সামনের ঘরে। সে এক অবাক কা-। ছাদের সর্বত্রই ঝুলছে বাদুড়। আমাদের আগমন যেন ওরা টেরই পায়নি। একটা বাদুড়ও তার জায়গা থেকে উড়া তো দূরের কথা নড়লো না পর্যন্ত। এই ঘরটাও আগের মত। বিপরীত দরজা দিয়ে বের হয়ে এক করিডোর পেলাম। এটা পূর্ব-পশ্চিম বরাবর। আমরা পশ্চিমে এগোলাম।
দু’পাশে ঘর। প্রত্যেকটি ঘরে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। সুমন ডানে আমি বামে। এসব ঘরগুলোর দুইটা করে ফাঁকা জানালা ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি সুমনের থেকে দুই ঘর এগিয়ে গেছি। পেছনে তাকিয়ে দেখি ও একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, ‘কিরে সুমন, রাজাদের গুপ্তধন পেয়ে গেলি নাকি?’
ও কোন কথা না বলে ইশারায় কাছে ডাকলো। গুরুতর কিছু দেখেছে ভেবে দ্রুত এগিয়ে গেলাম। গুরুতরই বটে। তবে জনগুরুত্বপূর্ণ নয়। ঘরের মেঝেয় দশ-বারোটা শেয়াল শুয়ে রয়েছে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে।
সুমন ঐদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুরান ভাই একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিস?’
‘কি ব্যাপার।’
‘আমাদের দেখে কিন্তু একটা শেয়ালও নড়েনি। কারণটা কী?’
‘শুধু শেয়াল কেন বাদুড়ের কথাও ভাব।’
ঠিক তখন একটা শেয়াল আড় মোড়া ভেঙে আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। ভাবখানা যেন-বেটা যাতো যা। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাস না। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বড় কষ্টে আছি।
ওর কথার যেন সমর্থন করলো পাশের বাচ্চা তিনটে ‘কেউ কেউ’ করে ডেকে ওঠে।
‘মনে হচ্ছে এখানে কেউ নিয়মিত যাতায়াত করে।’ বলল সুমন।
‘হয়তো বা। চল সামনে চল।’
সামনে চলতে উদ্যত হয়েছি অমনি পেছন থেকে পদশব্দ শুনতে পেলাম। দুই জোড়া পদশব্দ। যেন নিজের বাড়িতে আসছে। ভাবখানা এমন।
মনে খটকা লাগলো। সুমনকে নিয়ে শেয়ালের পাশের ঘরে ঢুকে পড়লাম। দাঁড়ালাম এক কোণে। লোক দু’জন চলে গেল পশ্চিম দিকে। চেহারা দেখতে পেলাম না। পাছে আমাদের দেখে ফেলে এই ভয়ে। আরও পাঁচ মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম ঐভাবে। কিন্তু খোঁজ নেই লোক দু’জনের।
আমরা বের হলাম ঘর থেকে। চললাম পশ্চিমে। বাকি ঘরগুলো একনজরে দেখে এগুলাম। করিডোরের শেষ ঘরে পৌঁছালাম। কোথাও কিছু নেই।
আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তবে ঐ লোক দু’জন এই ঘরে এস থেমেছে। কিন্তু গেল কোথায়?

তিন

এই ঘরটা আগের ঘরগুলোর চাইতে বড়। একটি মাত্র দরজা। আর কোন কিছু নেই। কিন্তু লোক দু’জন গেল কোথায়?
পুরো বাড়িটা আর একবার তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না।
আবার ঐ ঘরে এসে দাঁড়ালাম দু’জন।
সুমন বলল, ‘হয়তো অন্য ঘরের জানালা দিয়ে বের হয়ে গেছে।’
‘যারা নিজেদের বাড়ির মত এখানে ঢুকেছে তারা চোরের মত জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে না? উুঁ…হু তা নয়। আর আমি নিশ্চিত ওরা দু’জন এ ঘর থেকেই উধাও হয়েছে।’
‘তাহলে কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?’ বলল সুমন।
‘সেটা অসম্ভব।’ আমার জবাব।
‘তাহলে?’ জানতে চায় সুমন।
‘কোনো গোপন পথে…।’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুমন বলল, ‘তুই ঠিক বলেছিস। রাজাদের ব্যাপার। কোনো গোপন পথ থাকতেই পারে।’
দু’জন ঘরের প্রত্যেক ইঞ্চি মেঝে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।
ঘরে দুই ধরনের পায়ের ছাপ। স্পষ্ট হলো ওরা দু’জনই।
সুমন এক কোণে বসে আমাকে ডাকলো। আমি ওর কাছে গেলাম।
ও মেঝেয় তিন বাই তিন ফুট বর্গাকৃতির জায়গা দেখিয়ে বলল, ‘ঘরের সব জায়গায় সুড়কি পড়ে আছে। কিন্তু এখানে নেই। মনে হচ্ছে এখানে নিয়মিত ঝাড়– দেয়া হয়। অর্থাৎ এটাই সেই গুপ্ত পথ।’
দু’জন অনেক ঠেলাঠেলি করলাম। মেঝে নড়লো না।
এটা খোলার জন্য নিশ্চয় কোন সুইচ আছে। তাই দেয়ালে খুঁজতে লাগলাম এবং পেয়েও গেলাম।
দেয়ালে একটা মুকুটের ছবি। ভালভাবে লক্ষ না করলে দেখা যায় না। মুকুটের মাথায় পালকের গোড়াই ছোট্ট একটা পাথর বসানো। এটা মুকুটের নক্সা। আর এই পাথরটাই একটু উঁচু। আমি পাথরটিকে আস্তে আস্তে চাপ দিলাম।
মেঝের ঐ জায়গা থেকে দু’টি পাল্লা আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেল। আমরা কিন্তু মোটেও অবাক হলাম না। কারণ জানি রাজবাড়ীতে এরকম একটা জিনিস পাব। কপাল ভালো থাকলে গুপ্তধনও পেতে পারি।
গুপ্ত দরজা থেকে উনিশ ধাপ সিঁড়ি নিচে নেমে আর একটা ঘরে যেয়ে থেমেছে।
দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। ঘরটা অন্ধকার। গুপ্ত দরজা অটোম্যাটিক বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার আরো জেঁকে বসলেও যতটা হওয়ার কথা ছিল ততটা না। চোখে অন্ধকার সয়ে যেতেই দেখলাম ঘরটা পুরো ফাঁকা। অপর পাশে আর একটা দরজা আছে।
দু’জন সেই দরজার দিকে এগুলাম। দরজা খুলতে যাবো এমন সময় ঘরের ডান পাশ থেকে মৃদু আওয়াজে আজানের শব্দ ভেসে এলো। শব্দ লক্ষ করে তাকালাম। দেখি বড়সড় একটা ভেন্টিলেটার। ওখান থেকে আলোর একটা আভা ঘরে ঢুকছে। এবার বুঝতে পারলাম কূপের মধ্যে ভেন্টিলেটার বসানোর কারণ। এই গুপ্তঘরে বাতাস চলাচলের জন্যই ঐ ভেন্টিলেটার বসানো।
সুমন আমাকে বলল, ‘তুরান ভাই বুঝতে পেরেছিস কূপের মধ্যে ভেন্টিলেটার কেন বসানো?’
বললাম, ‘নিশ্চয়।’
‘এবার চল বাইরের মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজ পড়ে আসি।’ বলল সুমন।
‘তাই চল।’ উত্তর আমার।
কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। গুপ্ত দরজা আর খোলা যাচ্ছে না।
এ দিকে সুমনের মুখ পাংশু হয়ে গেছে। হতাশ গলায় ও বলল, ‘তাহলে কী হবে?’
‘নামাজ এখানেই পড়তে হবে।’ আমার উত্তর।
‘কিন্তু ওজু তো নেই।’
‘ কি আর করা তায়াম্মুম করবো।’ সমাধান বাতলে দিলাম।
ঘরটা অন্ধকার। তবে বোঝা যাচ্ছে পাশের ঘরে বাতি জ্বলছে। দরজার ফাঁক দিয়ে চিকন রেখার মত আলো এসে পড়ছে এ ঘরে।
আমরা দু’জন এককোণে দেয়ালের ধুলো নিয়ে তায়াম্মুম করলাম। তারপর শুরু করলাম নামাজ।
‘ফরজ নামাজ শেষে যেই সালাম ফিরিয়েছি অমনি পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘সিংহের গুহায় এসে প্রভুকে স্মরণ। বা বেশ বেশ।’
আমরা দু’জন দু’জনের দিকে তাকালাম। দু’জনের চোখে তখন ভয় ও জিজ্ঞাসার চিহ্ন। দু’জন একই সাথে পেছনে ফিরলাম। দেখলাম রাস্তার সেই লোক। যাকে আমরা পাগল বলেছিলাম অর্থাৎ জাবেদ।
বাতিওয়ালা ঘরের দরজা খোলা। সেই ঘর থেকে মৃদু আলো এসে পড়েছে এখানে। তাতে দেখলাম জাবেদের হাতে পিস্তল। ও পিস্তল নেড়ে বলে উঠলেন, ‘সুন্নাত নিশ্চয় পড়বে। তবে হ্যাঁ। চালাকির চেষ্টা করবে না।’ বলে তিনি একটা গুলি ছুড়লেন দেয়ালে।
আমরা আর কোন কথা না বলে সুন্নাতের নিয়ত করলাম। নামাজ শেষে দেখলাম পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। লোকটি তার পিস্তল সামনে রেখে নামাজ পড়ছেন।
আমরা তার দিকে সূর্যমুখীর মত তাকিয়ে রইলাম। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নামাজ পড়ছেন।
তার নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে পেছন থেকে কে যেন বললেন, ‘জাবেদ এসব কী হচ্ছে?’
তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘না মানে.. এই একটু নামাজ পড়লাম।’
ওসব পরে পড়ার সময় পাবে। এখন…।’ আমাদের দিকে চোখ পড়তেই যেন তিনি কথা হারিয়ে ফেললেন। সাথে সাথে পকেটে হাত দিয়ে বের করলেন পিস্তল। তাক করলেন আমাদের দিকে। জাবেদকে লক্ষ করে বললেন, ‘জাবেদ এরা এখানে কেন?’
‘মিরন ভাই আমারও একই প্রশ্ন। আমি বাইরে যাচ্ছিলাম। এ ঘরে এসে দেখি এরা দু’জন।’
এই মিরন আর কেউ নয়। যে আমাদের রাজবাড়ীর পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, তারা কোন গোপন কাজ করছে এখানে।
‘জাবেদ ওদের নিয়ে এসো।’ বলে তিনি বাতিওয়ালা ঘরে গেলেন।
এই মিরন আর রাস্তার সেই মিরনের মধ্যে এখন উত্তর-দক্ষিণ মেরু পার্থক্য।
আমরা দু’জন জাবেদের দিকে আবেদনের দৃষ্টিতে তাকালাম।
কিন্তু তিনি পিস্তল নাচিয়ে বললেন, ‘লাভ নেই। চল।’
আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে কোন কথা বের হলো না আমাদের মুখ থেকে। শান্ত-শিষ্ট ছেলের মত গেলাম পাশের ঘরে। অন্য ঘরের তুলনায় এ ঘরটা ছোট। এঘরে মাত্র একটা দরজা। যেটা দিয়ে আমরা এখানে এসেছি। ঘরের এককোণে একটা লোহার সিন্দুক পড়ে রয়েছে। পাশে মাটি খোঁড়া। বোঝাই যাচ্ছে সিন্দুকটা ওখান থেকে তোলা হয়েছে। মিরন সিন্দুকের গা থেকে মাটি ছাড়াচ্ছে। আর জাবেদ আমাদের দিকে পিস্তল এখনও তাক করে রেখেছে।
সুমন ভয়ে ভয়ে বলল, ‘দয়া করে এবার আপনার পিস্তলটা নামান।’
‘কেন ভয় করছে?’
‘তা একটু একটু। আর আমাদের কাছে তো কিছুই নেই। আমরা… আমরা আপনাদের কথা মত চলবো।’ এক দমে বলল সুমন।
‘কে বলেছে তোমাদের কাছে অস্ত্র নেই। আল্লাহর প্রতি যারা ভরসা করে তাদের অস্ত্র লাগে না।’ জাবেদের জবাব।
‘কিন্তু আপনি…।’ জাবেদ আমার কথা কেড়ে নিয়ে যেই বলল ‘আমার…।’ অমনি জাবেদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিরন বললেন, ‘ও সব কথা বাদ দাও। এখন ওদেরকে বাঁধ।’
‘আ.. আ..আমরা তো আপনাদের কিছু করিনি। আমাদের ছেড়ে দিন।’ তোতলাতে তোতলাতে বলল সুমন।
‘তা হয় না মানিক জোড়।’
আমার রাগ হলো। একটু ঝাঁঝের সাথে বললাম, ‘দেখুন আমরা মানিক জোড় নই। আমরা দু’জন ভাই।’
‘তাহলে দু’জনের চেহারা দু’রকম কেন?’
‘আপনার হাতের পাঁচ আঙুল কি এক সমান?’ উত্তর দিলাম আমি।
‘বাহ্ বাহ্। এই বয়সে দেখি অনেক কথা শিখে গেছ। যাই হোক। তোমাদের দু’বার সাবধান করেছি। এবার আর নয়।’ নিজের কাজে মন দিয়ে বললেন মিরন।
‘কোথায় দুইবার সাবধান করলেন?’ প্রশ্ন সুমনের।
‘কেন একবার জাবেদ আর একবার আমি।’ মাটি সরাতে সরাতে বললেন তিনি।
‘আপনারা যেভাবে বলেছেন তাতে এখানে আসতে আমাদের আগ্রহ আরো বেড়েছে।’ বললাম আমি।
‘এই ডিটেকটিভ বইগুলো তোমাদের মাথা খেয়েছে। কেন যে লেখকরা এগুলো লেখেন। বুঝি না।’ রাগ ঝাড়লেন লেখকদের ওপর মিরন।
‘লেখেন আপনাদের মত ক্রিমিন্যালদের ধরতে।’ পাল্টা উত্তর দিল সুমন।
‘এ্যাই ছেলে মুখ সামলে কথা বলবে।’ ধমকের সুরে বললেন মিরন।
‘মুখটা কি আপনার।’ সুমনও রেগে গেছে।
‘আর একটা কথা বলেছো তো এই পিস্তল দিয়ে তোমাদের মাথা গুঁড়ো করে দেব।’ উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে আমাদের দিকে তাক করে শাসিয়ে বললেন মিরন।
ঘরের এক কোণ থেকে দুইটা দড়ি নিয়ে দু’জনে মিলে আমাদের বাঁধলেন। বাঁধা শেষ হলে মিরন জাবেদকে বললেন, ‘এখন কটা বাজে?’
‘ পৌনে সাতটা।’
‘রাত দশটা পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকতে হবে। তুমি বসে এদের পাহারা দাও। আর আমি এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।’ বলে চলে গেলেন মিরন।

চার
আমরা মিরনের গমনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যতক্ষণ না পায়ের ঠক ঠক শব্দ বাতাসে মিলিয়ে গেল ততক্ষণ।
আমি জাবেদকে বললাম, ‘আপনাকে এখন রাস্তার সেই লোক বলে মনে হচ্ছে না কেন? আপনার সেই কঠোর ভাষা গেল কোথায়?’
‘জানিনে! তোমাদের দেখ আমার সব পাল্টে গেছে।’ সোজাসাপ্টা উত্তর তার।
‘কেন পাল্টালো?’ প্রশ্ন সুমনের।
‘সে অনেক কথা।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তিনি।
‘শুনতে চাই সেই কথা।’ নাছোড়বান্দার মতো বললাম আমি। ‘প্লিজ। বলুন না।’
‘শুনবে?’
‘অবশ্যই।’ সমস্বরে বললাম আমি ও সুমন।
‘তাহলে শোন।’ বলে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
বলা শুরু করলেন, ‘আমার বাড়ি এই গ্রামে। এই রাজার অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়েছে আমার দাদা, আমার পিতা। আমার দাদা ছিলেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। ফরায়যী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন তিনি। তখন ফরায়যী আন্দোলনের নেতা ছিলেন বাদশাহ মিয়া। তখন মুসলমানদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দীর্ঘকাল হিন্দুদের সাথে বসবাস করার ফলে হিন্দুদের রীতিনীতি তাদের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। আমার দাদাও সেই কুসংস্কার দূর করার জন্য কাজ করেছিলেন। ফলে প্রায় একশত জন মানুষ দাদা এই গ্রামে তৈরি করেন। তারাও ইসলামের খেদমতে নিজেদের উৎসর্গ করেন। এই সময়ই এই রাজার সাথে দাদাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একদিন রাজা আমার দাদাসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আসে এই রাজবাড়ীতে। আর কখনও আমার দাদা বাড়িতে ফিরে যায়নি।’ এ পর্যন্ত বলে তিনি মাথা নিচু করলেন। দু’গ- বেয়ে তার দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মাথা তুলে জামার ডান হাতায় চোখ মুছে আবার বলা আরম্ভ করলেন, ‘দাদার সাথে যাদের ধরে নিয়ে যায় তাদের ডেডবডি তাদের বাড়িতে ফেরত দেয় ওরা। কিন্তু আমার দাদার ডেডবডি ফেরত যায়নি। ওই শয়তান রাজা আমার দাদাকে এইগুপ্ত ঘরে আটকে রাখে। না খেতে দিয়ে নিঃশেষ করে আমার দাদাকে। দুই মাস আগে আমার এইগুপ্ত দরজা আবিষ্কার করি। এই দরজা দিয়ে যেদিন প্রথমে আমরা নিচে নেমেছিলাম।’ একটু দম নিলেন যেন তিনি।
‘আমরা এত অবাক হয়েছিলাম তা বলার নয়। কারণ ঘরে ঢুকেই দেখি সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরা একজন মানুষ। মানুষ বললে ভুল হবে। কেননা ওটা ছিল কঙ্কাল। হাড়ের উপরে তার পাজামা-পাঞ্জাবি। দু’হাত ও দু’পায়ে শেকল দিয়ে দেয়ালের আংটার সাথে বাঁধা। পাঞ্জাবিতে হাত দেয়ার সাথে সাথে তা গুঁড়ো হয়ে যায়। পাঞ্জাবির পকেটে এক অদ্ভুত কাপড় ছিল।’ বলে তিনি পকেট থেকে একটা কাপড় বের করে আমাদের হাতে দিলেন। আগেকার আমলে রাজা-বাদশাহরা এমন কাপড়ে চিঠি লিখতো। কাপড়টা চার ভাঁজ করা। তাতে কালচে ধরনের কালি দিয়ে বড় বড় করে লেখা। মনে হয় রঙ তুলি দিয়ে লেখা হয়েছে।
তাতে লেখা:
‘হে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, সর্ব শেষ ঘরের ডান কোণে মাটির নিচে একটা লোহার সিন্দুক আছে। ঐ সিন্দুকে মুসলমানদের সম্পদ রয়েছে। রাজা এই সম্পদে হাত দিতে সাহস পায়নি তাই পুঁতে রেখেছে। বহু কষ্টে এই চিঠি লেখা। এই বদ্ধ ঘরে কালির অভাব বিধায় ওরা আমাকে মেরে যে রক্ত বের করেছে সেই রক্ত দিয়ে লিখলাম এই চিঠি। জানিনে মাটির নিচের এই ঘরে আমার চিঠি কেউ পাবে কিনা। যদি কেহ পায় তবে সে যেন আমার বংশধরের নিকট এই চিঠি অথবা সম্পদ পৌঁছে দেয়। এটা আল্লাহর এক হতভাগা বান্দার অনুরোধ।’
ইতি
আবুল হাসান।

আমি চিঠি পড়ে তা ভাঁজ করে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয় এই আবুল হাসানই আপনার দাদার নাম।’
‘হ্যাঁ, আমার দাদা। শুধু দাদা আর তার সহযোগীদের মেরেই তারা ক্ষান্ত হয়নি রাজা। ধুঁকে ধুঁকে মারতে চেষ্টা করেছে আমাদের পরিবারকে। আমার পিতার বয়স তখন সাত বছর। দাদাই একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দাদীকে সেই পথ দেখতে হয়। কিন্তু কেউ তাকে কাজ দেয়নি রাজার ভয়ে। তখন অর্ধাহারে-অনাহারে কেটেছে তাদের।’
‘কিন্তু আজ আপনার এই দশা কেন? বিশেষ করে মিরনের মত শয়তানের সাথে আপনার বন্ধুত্ব হলো কেন? আপনি না ফারায়যী আন্দোলনের কর্মীর বংশধর।’
‘হ্যাঁ, মিরন দাগি আসামি। আমি ওর সাথে মিশেছি এজন্য যে আমার দাদা মরেছে জমিদারের হাতে, পিতা মরেছে ধুঁকে ধুঁকে না খেয়ে না পরে বিনা চিকিৎসায়। তাই আমি চেয়েছিলাম বড়লোক হতে। দাদা ও পিতার মত ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সবার উপর কতৃত্ব করে বাঁচতে। কিন্তু আমার সেই সাধ এই মুহূর্ত আমার থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি আর অন্ধকারে নয় আমার দাদার পথে বাঁচতে চাই। তোমরাই আমার চোখ খুলে দিয়েছো। তোমরা আমাকে দেখিয়েছো কিভাবে বিপদে প্রভুকে ডাকতে হয়। কিভাবে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। এ কথা এত দিন আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তোমরাই তা স্মরণ করিয়ে দিলে।’
এ সময় সুমন একটু নড়েচড়ে বসতে গেল। কিন্তু পারলো না। ও ভুলে গেছে যে আমাদের হাত-পা দঁড়ি দিয়ে বাঁধা।
সুমনের নড়াচড়া তিনি লক্ষ্য করলেন।
বললেন, ‘এই দেখ, আমি ভুলেই গেছি যে তোমাদের হাত-পা বাঁধা। তোমাদের কষ্ট হচ্ছে।’
আমার কেমন যেন খটকা লাগলো। যদিও তিনি বাঁধন খুলে দিলেন এবং বললেন, ‘তোমরা এবার চলে যাও।’
‘সত্যি বলছেন?’ বলল সুমন।
‘কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?’
আমি একদৃষ্টিতে তার হাতে ধরা পিস্তলটার উপর তাকিয়ে থাকলাম। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘ও বুঝেছি। আমার হাতে পিস্তল দেখে ভয় পাচ্ছ তাই না?’ বলেই পিস্তলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এবার এটা নিয়েই তোমরা যাও।’
আমার সমস্ত সংশয় দূর হয়ে গেল। পিস্তলটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে খলিফা মামুনের প্রিয়পাত্র আলী ইবনে আব্বাসের ঘটনা। দামেস্ক নগরীর ব্যক্তির মত আমি আপনাকে বলছি, আপনি অন্ধকার থেকে আলোর পথে এসেছেন আমাদের জন্য। আর আমরা আপনাকে জ্বলন্ত অগ্নিকু- অর্থাৎ মিরনের হাতে ছেড়ে চলে যাবো তা হয় না। ঐ সিন্দুকে যে সম্পদ আছে তা মুসলমানদের সম্পদ। সুতরাং ঐ সম্পদ ঐ মিরনের হাতে যেতে পারে না।’
‘তার সাথে আমার চুক্তি হয়েছিল যে, যা পাবো দু’জনে ভাগ করে নেব। কিন্তু এখন দেখছি …।’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুমন বলল, ‘ও যে করেই হোক এই সম্পদ পুরো ভোগ করতে চাইবে। সেটা আমরা হতে দেব না।’
‘না! মিরন ভাই তা করতে পারে না।’
‘লোভ মানুষকে সব করাতে পারে।’
‘ঐ সব কথা এখন থাক। এসো আমরা এশার নামাজ পড়ি। নামাজের সময় হয়ে গেছে।’

পাঁচ
নামাজ শেষ হলে দূর থেকে পায়ের খট খট শব্দ শুনতে পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি জাবেদকে বললাম, ‘আমাদের বেঁধে ফেলুন।’
তিনি বললেন, ‘তা হয় না।’
‘দেখুন এখন সময় নেই। আপনি তাড়াতাড়ি করুন।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি আবার বাঁধলেন। তারপর পাহারা দেয়ার মত করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন।
মিরন এলেন। তার হতে পাউরুটির প্যাকেট। আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘খেয়ে নাও।’
প্যাকেটগুলো পড়লো আমাদের সামনে। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের শত্রু হতে পারি। তবে অত্যাচারী রাজার মত অতটা খারাপ নয়। না খাইয়ে মারবো না, খাইয়েই মারবো।’
‘আপনি অত্যাচারী রাজার থেকেও অধম।’ ফোস ফোস করে বলল সুমন।
‘এই ছেলে মুখ সামলে কথা বলবে। অত্যাচারী রাজার থেকে অধম হলে তোমাদের এতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতাম না।’
‘রাখা না রাখার মালিক আপনি নন। তারচেয়ে আগে বলুন খাবার সামনে রেখে খেতে দিচ্ছেন না কেন? এ কোন্ ধরনের রসিকতা। নাকি অত্যাচারীর অত্যাচার।’
সুমনের এই কথায় আমিও ক্ষুধা অনুভব করলাম। সুমনের সাথে গলা মিলিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, তাইতো। খেতে দিচ্ছেন না কেন?’
এবার তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। আমাদের হাতের বাঁধন খুলে দিলেন।
দু’জন গোগ্রাসে রুটিগুলো গিললাম। মনে পড়লো সেই কোন দুপুরে খেয়েছি।
খাওয়া শেষ হলে আবার বাঁধলেন। পিস্তল নাচিয়ে বললেন, ‘চল এখন তোমাদেরকে আজরাইলের কাছে পাঠিয়ে দিযে আসি।’
‘আজরাইলের কাছে পৌঁছানো লাগবে না। সময় হলেই সে হাজির হয়।’ বলল সুমন।
‘মনে কর তোমাদের সময় হয়ে গেছে।’ যেন তিনি আজরাইলে বড়ভাই। ভাবখানা এমন।
‘এই কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন যে, জীবন-মৃত্যু মানুষের হাতে নয়।’ বললাম আমি।
‘থাক থাক আর জ্ঞান দিতে হবে না। জাবেদ চলোতো বেরিয়ে পড়ি। বাইরে সব রেডি।’
‘কিন্তু…।’
জাবেদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিরন বললেন, ‘এরা দুইজন আর সিন্দুক নিয়ে অসুবিধাতো? এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি, আমি সব ব্যবস্থা করে তবে এসেছি। একটা পিকআপ ভাড়া করে নিয়ে এসেছি। ড্রাইভারকে বলেছি, আমরা বড় দুইজন, দুইজন ছোট ছেলে, একটা কাঠের বাক্স আর একটা সাইকেল যাবে। সাইকেলটাও ওদের।’ আমাদের দিকে আঙুল নির্দেশ করে, ‘পেয়েছি এই বাড়ির পাশের ঝোপে।’
‘কিন্তু কাঠের বাক্স কই?’ জানতে চায় জাবেদ।
‘ওপরের ঘরে আছে। ওর মধ্যে সিন্দুক ভরে নেবো।’ বিজ্ঞের মত বলে মিরন।
জাবেদ জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা যাবো কোথায়?’
‘গেলেই দেখতে পাবে।’ বলে তিনি একটা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন। এই হাসিতেই প্রকাশ পায় তার মধ্যে কোনো কুমতলব আছে।
দু’জন মিলে ধরে সিন্দুকটা বাইরে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ঠক ঠক শব্দ আসতে লাগলো। সিন্দুক বাক্সে ভরে হয়তো পেরেক এঁটে দিচ্ছে ওরা।
মিরন আমাদের নিতে এলেন। পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। পিস্তল উঁচিয়ে আমাদেরকে বের করে নিয়ে গেলেন। বের হওয়ার সময় দেখলাম ভেতর থেকে গুপ্ত দরজা খোলার জন্য বাইরের মতো আর একটা সুইচ আছে দরজার পাশে। উত্তেজনায় ওটা তখন আমাদের নজরে পড়েনি।
বাইরে যেয়ে দেখি সাদা রঙের একপিকআপ স্টার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পিছনে সিন্দুকের বাক্সটা আর আমাদের সাইকেল। ড্রাইভারের পাশে জাবেদ বসে আছেন। মিরন আমাদের পিকআপের ডালায় উঠতে নির্দেশ দিলেন। আমরা একান্ত বাধ্য ছেলের মত তার নির্দেশ পালন করলাম। তিনিও আমাদের সাথে উঠলেন।
ড্রাইভার টিকআপ ছাড়লো। মিরন পিস্তলটা পকেটে পুরতে পুরতে বললেন, ‘কোনরূপ চালাকির চেষ্টা করবে না কিন্তু?’
ড্রাইভার কিন্তু এসব কিছুই লক্ষ করলো না।
পিকআপ বড় রাস্তায় উঠে পশ্চিম দিকে চলল। রাতের রাস্তাটা বড় নির্জন।
ছয়
পিকআপ চলছেতো চলছেই। এর যেন শেষ নেই। হঠাৎ পাকা রাস্তা থেকে বামে মাটির রাস্তায় মোড় নিলো। মাটির রাস্তায় চলল কিছুক্ষণ। এই রাস্তায় এই নির্জন পরিবেশে পিকআপ যেন আর্তনাদ করে ছুটে চলছে।
এক সময় পিকআপ একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে থেমে গেল।
মিরন লাফ মেরে পিকআপ থেকে নামলেন। পকেটে হাতপুরে বললেন, ‘তোমরা নেমে এসো।’
আমরা নেমে এলাম। ইতোমধ্যে ড্রাইভার আর জাবেদ এসে মিরনের পাশে দাঁড়িয়েছে।
মিরন জাবেদকে একটা চাবি দিয়ে বললেন, ‘দরজা খোল।’
জাবেদ দরজা খুললেন। মিরন আবারও নির্দেশ দিলেন, ‘জাবেদ তুমি ও ড্রাইভার দু’জন মিলে বাক্সটা ঘরে তোল। আর তোমরা।’ আমাদেরকে নির্দেশ করে বললেন, ‘চল ঘরে।’
আমরা বাধ্য ছেলের মত তার আদেশ পালন করলাম।
ঘরটা বেশ বড়। ঘরে অন্ধকার বিরাজ করছে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। মিরন একটা মোমবাতি জ্বালালেন। একটি মাত্র ঘর। ঘরে তিনটি জানালা। ওগুলো বন্ধ। একটা খাট ও দুইটা চেয়ার।
আমাদের দু’জনকে চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধলেন। ইতোমধ্যে জাবেদ আর ড্রাইভার মিলে সিন্দুক ও সাইকেল নিয়ে এসেছে ঘরে।
মিরন ড্রাইভারকে নিয়ে বাইরে গেলেন। দু’জনে কি কথা বললেন শোনা গেল না।
মিরন ঘরে ফিরে এলেন। পিকআপ স্টার্ট নেয়ার শব্দ পাওয়া গেল এবং শব্দ স্থির হয়ে থাকলো।
আমি মিরনকে বললাম, ‘আমাদের কি এভাবে শাস্তি দেয়া উচিত হচ্ছে?’
‘এটা আমাদের কাজে নাক গলানোর ফসল।’
‘আমরাতো ইচ্ছে করে নাক গলায়নি। আপনারাইতো নাক গলাতে বাধ্য করেছেন।’
‘চো..ও..প। আর একটা কথাও শুনতে চাইনে।’ জাবেদের দিকে ঘুরে বললেন, ‘জাবেদ তুমি এদের দেখ। আমি একটু ঘুরে আসি।’ বলেই মিরন বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে পিকআপও ছাড়লো।
পল পল করে বয়ে চলল সময়। চলল নীরবতা পালন। নীরবতা ভাঙলেন জাবেদ।
বললেন, ‘তোমাদেরকে আমি আগেই চলে যেতে বলেছিলাম।’
‘বাদ দিন তো ওসব কথা। এখন কাজের কথায় আসুন।’
‘কি কাজ?’ বললেন জাবেদ।
‘আগে আমাদের বাঁধন খুলুন।’ বলল সুমন।
তিনি বাঁধন খুলে দিলেন। হাত-পা ডলে আমি রক্ত চলাচল ঠিক করে নিলাম। কিন্তু সুমন দড়ি হাতে চেয়ারে বসে আছে। আমি ওর দিকে তাকালাম। ও কি করতে চাই আমাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিল। এসময় কোথায় যেন পেটা ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার ঘণ্টা দিল।
আমি পুরো প্ল্যানটা নিয়ে একমুহূর্ত ভাবলাম। তারপর দু’জন দড়ি হাতে নিঃশব্দে জাবেদের দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি খাটে পা ঝুলিয়ে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে কি জানি ভাবছেন।
যখন তাকে বাঁধবো তখন তিনি বুঝতে পারলেন। কিন্তু কোন প্রতিবাদ করলেন না। আমরা তার হাত-পা বেঁধে ফেললাম।
তিনি শুধু বললেন, ‘কি হচ্ছে এ সব?’
‘মুক্তির একটা উপায়।’
‘তাহলে তাই হোক। কিন্তু তাড়াতাড়ি।’ হয়তো তিনি আমাদের প্ল্যান বুঝতে পেরেছেন।
আমি বললাম, ‘জানি আপনার একটু কষ্ট হচ্ছে। তবুও মুক্তির জন্য এই কষ্টটুকু স্বীকার করে নিতে হবে। যদি আপনিও আমাদের সাথে যেতেন তাহলে এই সম্পদগুলো মিরন এসে আমাদের না পেয়ে সরিয়ে ফেলবে। আর কখনও হয়তো তা পাব না। আর….।’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তিনি বললেন, ‘আর বেঁধে তোমরা ভালো করেছো। এতে মিরন সম্পদগুলো নিজের করতে পারবে না। তবে তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।’
সুমন আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুরান ভাই তাড়াতাড়ি চল পুলিশ ডেকে আনি।’
‘হ্যাঁ চল।’ বললাম আমি।
দু’জনে ঘর থেকে বের হয়ে আন্দাজের ওপর নির্ভর করে উত্তর দিকে ছ্টুলাম। উত্তেজনায় সাইকেলর কথা ভুলেই গেছি।
যখন চারিদিকে শুধু আখ ক্ষেত দেখতে পেলাম তখন সাইকেলের কথা মনে পড়লো।
আখ ক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে দু’জন দু’জনের দিকে তাকালাম। দু’জনের চোখে তখন একই প্রশ্ন, কোন্ দিকে যাব?
ঠিক তখন পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘আর কোনো দিকে যেতে হবে না। ওখানেই দাঁড়াও ’
চকরির মত পাক খেয়ে দু’জন পিছনে তাকালাম। বিশ-পঁচিশ ফুট দূরে একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা কালো বস্তু নড়াচড়া করতে দেখে আমাদের আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, ও মিরন। আর ওর হাতে পিস্তল।
তিনি কাছে এগিয়ে এলেন। পিস্তল উঁচিয়ে বললেন, ‘আর এক পা নড়েছো তো মাথা গুঁড়ো করে দেব। বাধ্য ছেলের মতো যেখান থেকে এসেছো সেখানে চলো।’
পিস্তলের মুখে কোন কিছু বলার বা করার সাহস হলো না। ওর আদেশ পালন করলাম। আমরা আগে তিনি পিছে পিছে এলেন।
ঘরের এক কোণ্ থেকে দঁড়ি এনে আবার ও আমাদের চেয়ারের সাথে বাঁধলেন। কিন্তু জাবেদকে খুললেন না।
বাঁধা শেষ করে একটা হাসি দিলেন। কিন্তু একে হাসি বলে মনে হলো না আমার কাছ। মনে হলো যেন হায়েনা হাসছে।
হাসি থামিয়ে বললেন, ‘পিচ্চির দল বেশতো একহাত দেখালে। আমি গিয়েছিলাম একজন স্বর্ণকারের কাছে। এসে দেখি দুইটি ছায়া মূর্তি বেরিয়ে যাচ্ছে আখ ক্ষেতের দিকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম তোমরা ছাড়া আর কেউ না। কিন্তু….।’ মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললেন, ‘আমার দুঃখ হচ্ছে বেচারা জাবেদের জন্য। আমিতো ওকে গুপ্তধনের একপাইও দেবো না।’
এ কথা শোনার সাথে সাথে জাবেদ উঠে দাঁড়াতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। কেননা তার হাত-পা বাঁধা।
মিরন জাবেদের কাছে এগিয়ে গিয়ে পিস্তলের বাঁট দিয়ে জাবেদের কানের পাশে একটা আঘাত করলেন। অমনি তিনি মেঝেয় পড়ে গেলেন। নিথর হয়ে পড়ে রইলেন মেঝেয়।
মিরন এবার পিস্তল নাচাতে নাচাতে সিন্দুকের কাছে গেলেন। বাক্স ভেঙে সিন্দুক বের করে আনলেন। দক্ষ চোরের মতো খুলে ফেললেন সিন্দুকের তালা চাবি ছাড়াই। পাল্লা খুলেই তার মধ্যে হাত প্রবেশ করালেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল।
আমি ভাবলাম হয়তো গুপ্তধন রক্ষাকারী কোনো সাপ তাকে দংশন করেছে। রূপকথার গল্পে যেমন থাকে।
কিন্তু না! তিনি তা থেকে সেই আমলের একটা চিঠি বের করলেন। চিঠিটা রাজ চিঠির মত ছোট্ট দু’টি লাঠির সাথে প্যাঁচানো। তিনি তা খুলে পড়তে লাগলেন। পড়া শেষ হলে আমাদের দিকে তাকালেন। তার চোখ-মুখে এক আনন্দাভাব দেখা দিলো। মনে হলো এখন তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা।
সুমন মিরনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘যখন আমরা রাজবাড়ী খুঁজছিলাম তখন কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিলেন আমাদের সাথে। তারপর দেখলাম আপনি ভালো লোক নন। আপনি একজন বাজে মানুষ। সত্যি প্রবাদ বাক্যটা মিছে নয় ‘দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা।’
‘এক্কেবারে মিথ্যা কথা।’ স্বগোক্তি ভাবে বললেন তিনি।
‘কেমন করে?’ বলল সুমন।
‘ইসলামের ইতিহাস স্মরণ কর। দেখবে মুসলমানরা ব্যবহারে বিশ্ববরেণ্য হয়ে আছে।’ যেন তিনি অন্তর থেকে বলেলন কথাটি।
‘আপনার মুখে এসব কথা মানায় না। কেননা আপনি তো ভালো মানুষ নন। আপনি দুষ্টু। পাজির পা ঝাড়া।’ ঝাঁঝের সাথে বললাম আমি।
‘হয়তো ছিলাম। কিন্তু এখন এই মুহূর্ত থেকে আর নেই। এই চিঠি শুধু আমার চোখ নয় অন্তরের দুয়ারও খুলে দিয়েছে। জীবনে অনেক, অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু আর নয়। বাকি জীবন মানুষের তরে, দেশের তরে, ধর্ম-কর্ম পালন করে কাটিয়ে দেবো। এটা আমার ওয়াদা।’ অন্য এক ভালো মানুষের মতো বললেন তিনি।
‘দেখি চিঠিটা। কি লেখা আছে ওতে।’ বললাম আমি।
‘তার আগে তোমাদের বাঁধন খুলে দিই।’
আমাদের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে জাবেদের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার বাঁধনও খুলে দিলেন। ইতোমধ্যে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। মিরনের সমস্ত কথাগুলো তিনি শুনেছেন। উঠে চুপ করে খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলেন।
আমি চিঠির প্যাঁচানো খুললাম। তাতে লেখা:
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ,
এই সিন্দুকের সম্পদ কারো ব্যক্তিগত নয়। এতে যে সোনা-দানা, গহনা-গাঁটি স্বর্ণ ও রোপ্য মুদ্রা আছে তা মুসলমানদের দান। তাদের দানের কারণ তারা একটা মসজিদ ও মাদ্রাসা তৈরি করবে। জানি নাহ! তাদের আশা মহান আল্লাহ পূরণ করবেন কিনা? রাজা ক্ষেপেছে। যে কোনো সময় আমাদের আটক করতে পারে।
আমাকে ধরার কয়েক দিন পরে এক রাতে রাজার লোকেরা সিন্দুকটিও এখানে আনে। এ রাজা আমাকে মসজিদ নির্মাণ করতে দেয়নি। দেয়নি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে।
যখন আমরা চাইলাম সত্যিকার মুসলমান হয়ে বাঁচবো। তখনি রাজার সাথে আমাদের টক্কর লাগলো। আর এটাই নিয়ম। যুগে যুগে নবী-রাসূল ও তাদের অনুসারীদের সাথে বাতিল শক্তির টক্কর লেগেছে। ভবিষ্যতেও ইসলামপন্থী ও বাতিলপন্থীদের মধ্যে বিরোধ লাগবেই।
একদিন শেষ হবে এই রাজার অত্যাচার। আসবে সেনালি দিন। আমার বড় আশা এই বাংলার আকাশে শান্তি-সুখের সুবাতাস বয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা। তাইতো আমি গ্রামের মানুষগুলোকে একত্র করতে শুরু করেছি। জানি না আমার সেই আশা পূরণ হবে কি না?’
ইতি
আবুল হাসান

মুহাম্মাদ দারিন
জান অপটিকস
জনতা সুপার মার্কেট
এইচ এম এম রোড, যশোর

Share.

মন্তব্য করুন