প্রকৃতিতে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। আপন নিড়ে ফিরে আসছে গৃহত্যাগী পাখিগুলো। সূর্য তার আলো গুটিয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। সিমেন্ট বাঁধানো বিরাট আম গাছটার নিচে একাকী বসে আছে নাফি। আম গাছটায় এবার মুকুল এসেছে খুব। চারদিকে আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ। একটা কাব্যিক আবহ তৈরি হয়েছে যেন। কিন্তু নাফির হৃদয়ের গহিনে বইছে উথালপাতাল কালবৈশাখী ঝড়! অন্য সময় আম গাছটার নিচে এসে অনেককক্ষণ ধরে শ্বাস টেনে টেনে মুকুলের প্রাণ নিতো নাফি। বেশ লাগে মুকুলের ঘ্রাণটা তার । কোন কোন দিন মনে মনে আওড়াত প্রিয় কবিতার কয়েকটি চরণ-
হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি
দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি
বাতাবি লেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
কিন্তু আজ তার মনের অবস্থা খুবই খারাপ। বুকের ভিতরে জমানো অভিমানটা চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে । বিরহের ঘোর লাগা এমন ঝিম সন্ধ্যায় নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনা নাফি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নীরবে কেঁদেই চলছে অবিরামভাবে। আবীর ভাই তার সাথে এমন আচরণ করতে পারে! সকালের ঘটনাটা মন থেকে কিছুতেই দূর করতে পারছে না নাফি। ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার।
অথচ তার হৃদয়রাজ্যের অনেকাংশ জুড়ে একটিই তো নাম- আবীর ভাই! চারদিকে গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। স্কুল মসজিদ থেকে ভেসে আসছে এশার আজান। নিঝুম নিস্তব্ধতা বুক ছিঁড়ে শুধু নাফির গোঙানির অস্পষ্ট শব্দ। আজ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পাছে কেউ বুঝে ফেলে। তাই নীরবে অশ্রুপাত করাই শ্রেয় ভাবে সে।
নাফি রাজধানী ঢাকার স্বনামধন্য একটি বয়েজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস এইটের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে। আগে সে মফস্বলের স্কুলে পড়ত। বেশ নাদুসনুদুস গড়ন খোলতাই চেহারা। হাসিখুশি, মিশুক, প্রাণখোলা আর ভাবুক প্রকৃতির ছেলে। দেখলেই মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে মন চাইবে। পাঁচতলা স্কুল হোস্টেলের তৃতীয় তলায় থাকে নাফি। একই ফ্লোরে আবীরও। প্রথম যেদিন বাড়ি থেকে রাজধানীর আত্মীয়-স্বজনহীন হোস্টেলে এসেছিল কতই না মন খারাপ হয়েছিল তার। আব্বু-আম্মু আর ছোট্ট বোনটির মুখটা বার বার ভেসে আসছিল স্মৃতিপটে। রোজ স্কুল থেকে ফেরার পর বোনটি আহ্লাদী গলায় ভাইয়া এসেছে, ভাইয়া এসেছে বলে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এখন কেমন আছে আদরের ছোট্ট বোনটি আমার!
এমন আটপাঁচ ভেবে যখন সে মন খারাপ করে বসে ছিল তখন তার রুমে আসে আবীর। একই প্রতিষ্ঠানের কলেজ সেকশনের মেধাবী ছাত্র আবীর। আবীরকে হোস্টেলের সবাই তোয়াজ করে চলে। হোস্টেল সুপারের পরেই স্কুল সেকশনের ছেলেরা আবীরকে খুব মান্য করে। যদিও আবীর ভাইয়ের মধ্যে ডমিনেটর ভাবটা কখনো দেখতে পায়নি নাফি। তবুও কেন যেন স্কুলের জনপ্রিয় মুখ আবীর। লিকলিকে শরীর আর বুদ্ধিদীপ্ত চশমা পরা দুটি চোখ।
মুখে এক চিলতে হাসি সর্বদা লেগেই থাকে। নাফির দুইটা রুমের পরেই আবীর ভাইয়ের রুমটা। পরিপাটি টেবিল বিছানা। পড়ার টেবিল জুড়ে সাজানো হরেক রকম বই। নাফি হোস্টেলে আসার প্রথম দিন থেকেই আবীরের সাথে তার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।
তার পর থেকেই নাফির জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আগের মত নামাজ পড়ায় গা-ছাড়া ভাবটি এখন আর নেই। এখন আযান হলেই আবীর এসে তাকে মসজিদে নিয়ে যায়। নামাজের গুরুত্ব বুঝায়। পড়ালেখায় কিভাবে ভালো করা যায়, কিভাবে আদর্শবান মানুষ হওয়া যায় সে সম্বন্ধে নানান উপদেশ দেয় নাফিকে। আবীর একদিন একটা বই পড়তে দিল তাকে। ডক্টর আহসান হাবীব ইমরোজের ‘মোরা বড় হতে চাই’। বইটা পড়ার পর আবীরের প্রতি তার শ্রদ্ধাটা যেন আরো বেড়ে গেল। এমন বই আগে কখনো পড়েনি নাফি। এর কিছুদিন পর ‘মুক্তির পয়গাম’ নামে আরেকটা বই দিল। ঐ বইটাও অসম্ভব ভালো লেগেছিল নাফির। এভাবে নাফিকে ধর্ম, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই পড়তে উৎসাহিত করে আবীর। অতঃপর দু’জনের সম্পর্কটা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায় দিনে দিনে। স্কুলের কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিজগুলোতে দু’জনেই সানন্দে অংশগ্রহণ করে।
একসাথে খেলাধুলা করা, ঘুরতে যাওয়া, স্কুলের অভ্যন্তরীণ ক্লাবগুলো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা। আর আবীরও নাফির মধ্যে গ্রামে থাকা ছোট ভাইটির প্রতিচ্ছবি দেখে। তাই পরম মমতাময় আগলে রাখে নাফিকে। স্বপ্ন দেখে নাফিকে আলোর ভুবন গড়ার কারিগর বানানোর।
দেখতে দেখতে একটি বসন্ত কেটে গেল। স্মৃতির ডায়েরিতে অসংখ্য খুনসুটিময় সুখস্মৃতি জমা হয়, আবীর আর নাফির জীবনপ্রবাহের। ঋতুর স্বাভাবিক আবর্তনেই আরেকটি বসন্ত এলো প্রকৃতিতে। প্রকৃতিতে বাসন্তীর আমেজ।
মার্চ মাসে তাদের স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলতে থাকে পুরো মাসজুড়েই। স্কুল ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছে লাল-সবুজের সাজে। ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজে এবারও অংশগ্রহণ করবে আবীরদের প্রতিষ্ঠান। বরাবরের মতো এবারও প্যারেডের দলনেতা হয় আবীর। নাফিও আছে আবীরের দলে । এবার সালাম গ্রহণ করতে অতিথি হিসেবে আসবেন স্থানীয় সাংসদ এবং ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়। তাই মার্চপাস্ট হতে হবে নিখুঁত ও আকর্ষণীয়।
মার্চপাস্টের প্রস্তুতিমূলক মহড়ার জন্য আবীর তার দলের সদস্যদের ঠিক সকাল ৭টায় মাঠে আসার নির্দেশ দেয়। গত রাতে রুমমেটদের সাথে অনেকরাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে শেষরাতে ঘুমাতে যায় নাফি। ফজরের নামাজের পর একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। যখন ঘুম ভাঙে তখন ঘন্টার কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে কোনরকম ইউনিফর্ম পরে মাঠের দিকে ছুটতে লাগল। তখন স্টেজের মাইকে হাই ভলিউমে দেশের গান বাজছিল। মার্চপাস্টের পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দেখে; তাদের দলের সবাই চলে এসেছে। শুধু সে-ই লেট। আবীরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয় নাফি, কিন্তু আবীর কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সবাই প্রস্তুতিমূলক মহড়ায় ব্যস্ত কিন্তু নাফিকে এখনো ডাকা হয়নি। অদূরে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে লজ্জায় এতটুকু হয়ে যেতে লাগল নাফি।
না-জানি কি আছে আজ কপালে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার প্রায় ১৫ মিনিট পর নাফির ডাক পড়ল। এতক্ষণ যে সে দাঁড়িয়েছিল তা যেন দেখেইনি কেউ। আবীর বলল-
ফিজিক্যাল স্যার তোমার জন্য যে শাস্তি ঘোষণা দিয়েছেন তা কি তুমি জান?
: না-তো। মিনমিনে গলায় জবাব দেয় নাফি।
: তোমাকে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মাঠের কাজে অবহেলা করার জন্য কর্ডের আঘাতের শাস্তিভোগ করতে হবে তোমাকে। নিঃস্পৃহ গলায় বলল আবীর।
‘ভাইয়া আমি ভুলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম’-নাফিকে এতটুকু বলার সুযোগ না দিয়ে গলায় ঝুলানো কর্ড দিয়ে সজোরে পরপর তিনটা আঘাত করে আবীর!
ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে নাফি। কিছুক্ষণ যেন অন্য ভুবনে হারিয়ে গেল সে।
বাম ডান বাম,
বাম ডান বাম…।
বুকে হাসি মুখে বল…
ধ্বনিগুলো যেন অস্পষ্ট শুনলো কানে। যেন মাথায় ঝিম লেগেছে।
: তুমি এখন সারাদিন ঘুমাতে পারো, যাও।
আবীরের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে মাঠ থেকে রুমে ফিরে আসে সে। দরজা বন্ধ করে অনেক কেঁদেছে সারাদিন। দিনটা কেটেছে অভিমানে গোস্বায়। দুপুরের মিলে ভালো রেসিপি থাকলেও গলা দিয়ে নামলো না কিছুই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই চলে এসেছে আম তলায়। কথায় আছে মানুষ প্রিয়জনের দেয়া বিষ অনায়াসে হজম করা যায় কিন্তু প্রিয়জনের অবহেলা সহ্য করা যায় না। প্রিয়জনের অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ্ মানুষকে দেননি। তাই তাদের দেয়া একটু আঘাতও কখনো কখনো হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে যায়। আম গাছের শাখায় বসবাসকারী পাখিগুলো যেন বিরহের বিউগল বাজিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। হাঁটুতে মাথা গুঁজে নীরবে অশ্রপাত করছে নাফি। হঠাৎ মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলল নাফি। আর কেউ নয় স্বয়ং আবীর ভাই স্বভাবসুলভভাবে তার মাথার চুলগুলো আলতো টেনে দিচ্ছে!
হকচকিয়ে যায় নাফি। নিজেকে সামলে নেয় মুহূর্তেই।
: কিরে নাফি, তোর রুমে গিয়ে খোঁজ নিলাম তুই নাই, তোর রুমমেটরা তুই কোথায় গিয়েছিস কেউ বলতে পারছিল না। আর তুই এখানে বসে আছিস। চল নামাজ পড়তে যাবি না। দুপুরে নাকি কিছুই খাসনি!
: তুমি যাও, আমি পরে যাচ্ছি।
: এই নাফি তুই কি আমার ওপর রাগ করেছিস? সকালের ব্যাপারটায়।
: না, রাগ করিনি তো বলেই গলাটা ধরে এলো নাফির।
আবীরের আর বুঝতে বাকি রইল না। নাফিকে টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে বলল, তুই আমাকে মাফ করে দে ভাই। তখন ফিজিক্যাল স্যারের নির্দেশে বাধ্য হয়েই আমাকে তেমনটি করতে হয়েছেরে! তাছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। এবার নাফি সশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আবীরও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। দুজন দুজনকে বুকে টেনে মিলনের কান্নায় মেতে উঠল। নাফির অভিমানের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেঙে যেতে লাগল। আর এ কান্না যেন অপার্থিব স্নেহ আর ভালোবাসার নিঃস্বার্থ অভিব্যক্তি…।

Share.

মন্তব্য করুন